এই সংশোধনী কেবল আইনি কাঠামোই শক্তিশালী করবে না, বরং ওয়াকফের মাধ্যমে সমাজের দুর্বল অংশের কল্যাণও নিশ্চিত করবে।
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪ : দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতার সম্মান সংস্কার ও ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের ভারসাম্য
এই সংশোধনী কেবল আইনি কাঠামোই শক্তিশালী করবে না, বরং ওয়াকফের মাধ্যমে সমাজের দুর্বল অংশের কল্যাণও নিশ্চিত করবে।
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪ : দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতার সম্মান সংস্কার ও ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের ভারসাম্য
রঙিন হালদার
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪, ভারতের ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রভাব নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ এটিকে ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখলেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বিলটির মূল উদ্দেশ্য হলো স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, স্বেচ্ছাচারী দাবি প্রতিরোেধ এবং ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। ওয়াকফ সম্পত্তি ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয়, দাতব্য ও শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে দান, যা সম্প্রদায়ের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে, অনিয়ন্ত্রিত কর্তৃত্ব, আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা এবং ওয়াকফ জমির অপব্যবহারের মতো সমস্যাগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
২০২৪ সালের সংশোধনী এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতেই আনা হয় যাতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে কোনো প্রভাব না ফেলে।
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইন প্রণয়নের পরও অসংখ্য ঘটনায় সম্পত্তির অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, অবৈধ জমি দখল এবং আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ওয়াকফ বোর্ড কখনো কখনো ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণ করে দেয়, যার ফলে মালিকদের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, ওয়াকফ বোর্ড সারা ভারতে ৮.৭ লক্ষ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে, যা ৯.৪ লক্ষ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এবং এর মোট মূল্য ১.২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া ট্রাইব্যুনালে ওয়াকফ সংক্রান্ত ৪০ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যার অনেকগুলোতে ব্যক্তিগত নাগরিকরা তাদের জমির মালিকানা নিয়ে ওয়াকফ বোর্ডের দাবির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। সংশোধনীটি ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক ডকুমেন্টেশন, আর্থিক লেন-দেনে স্বচ্ছতা এবং জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধের ন্যায্য নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে চায়।
ন্যায্য মালিকানা নিশ্চিতকরণ; স্বেচ্ছচারী জমি দাবি রোধ
বিলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শুধুমাত্র আইনসম্মত মালিকরাই ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করতে পারবেন। আগে ওয়াকফ বোর্ড যে কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে দাবি করার ক্ষমতা রাখত এবং প্রমাণের ভার বাস্তব মালিকের উপর বর্তাত। সংশোধনীতে এই অসাম্য দূর করে বিরোধপূর্ণ মালিকানা নির্ধারণের দায়িত্ব ওয়াকফ বোর্ডের বদলে কালেক্টরের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়া বিলটিতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, সরকারি
জমিকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না, যা সরকারি সম্পত্তিকে আইনি যাচাই ছাড়া ওয়াকফ হিসেবে নথিভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। এই পরিবর্তনটি উচ্চমূল্যের সরকারি সম্পত্তি, যেমন কোর্ট কমপ্লেক্স বা গোটা গ্রামের উপর ওয়াকফ সম্পত্তি দাবির মতো ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করবে, যা বিভিন্ন রাজ্যে আইনি বিবাদের সৃষ্টি করেছে।
ডিজিটালাইজেশন: ওয়াকফ ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ সংশোধনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হলো ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ডাটাবেস তৈরি। সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে এই সংশোধনী দুর্নীতি হ্রাস, অননুমোদিত বিক্রি রোধ এবং আর্থিক তদারকি উন্নত করা। পুরাতন অসম্পূর্ণ ওয়াকফ সম্পত্তির রেকর্ড ছিল, যার মালিকানা, আর্থিক লেন-দেন এবং জমি দখলের তথ্য উদ্ধার কঠিন হয়ে পড়েছিল।
নতুন ব্যবস্থায় সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির ইলেকট্রনিক নথিভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে এবং কার্যকর অডিটের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ওয়াকফ বোর্ড : প্রতিনিধিত্ব সম্প্রসারণ
ওয়াকফ বোর্ডের গঠন কাঠামো প্রায়শই অন্তর্ভুক্তির অভাবের জন্য সমালোচিত হয়েছে। নতুন বিলটি এই সমস্যা সমাধানে মুসলমান নারী এবং অমুসলমান
প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করেছে। এটি বিস্তৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এবং পক্ষপাত ও অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির ঝুঁকি কমাবে। ওয়াকফ প্রশাসনে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে, সংশোধনীটি দায়বদ্ধতা শক্তিশালী করতে এবং সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করতে চায়, যাতে সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়।
আর্থিক তদারকি শক্তিশালীকরণ : দুর্নীতি প্রতিরোধ
ওয়কফ বোর্ডসমূহে আর্থিক অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে একটি সমস্যা হিসেবে রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় ও দাতব্য উদ্দেশ্যে নির্ধারিত তহবিল সঠিক অডিটিং ব্যবস্থার অভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। সংশোধনীতে নিয়মিত অডিট বাধ্যতামূলক করা, আর্থিক ব্যবস্থার কারণে অন্যত্র চলে যায়। সংশোধনীতে নিয়মিত অডিট আর্থিক রেকর্ড জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা এবং আর্থিক অনিয়মের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। স্বচ্ছতা প্রয়োগের মাধ্যমে, বিলটি নিশ্চিত করতে চায় যে ওয়াকফ তহবিল তার নির্ধারিত উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবে, যা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষামূলক প্রকল্প ও সমাজকল্যাণমূলক উদ্যোগের জন্য সহযোগী হবে।
আইনি ব্যবস্থা বৃদ্ধি: হাইকোর্টে আবেদনের সুযোগ
পূর্ববর্তী আইনে, ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হতো, যা আক্রান্ত পক্ষগুলোর আইনি ক্ষমতা হ্রাস করে। নতুন বিলে ব্যক্তিদের ট্রাইব্যুনালের রায় হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধের ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করবে। এই বিধানটি ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সম্ভাব্য পক্ষপাত দূর করবে এবং একটি ন্যায্য আপিল প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে।
অবৈধ দখল থেকে ওয়াকফ সম্পত্তি সুরক্ষা
ওয়াকফ জমিতে অবৈধ দখল একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যেখানে অসংখ্য সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলীকৃত বা অননুমোদিতভাবে বিক্রি হয়েছে। সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডকে অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদের আদেশ দানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তিগুলোকে সুরক্ষিত করা হবে, যাতে সেগুলো তাদের মূল ধর্মীয় ও সমাজকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হতে পারে।
উপসংহার: স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার দিকে অগ্রসর
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪, ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও দক্ষতা আনতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি ধর্মীয় স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ না করে সম্পত্তির সুরক্ষা, আর্থিক দায়বদ্ধতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করে। ডিজিটালাইজেশন, নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব এবং হাইকোর্টে আপিলের
সুযোগের মতো সংস্কারগুলো ওয়াকফ ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও ন্যায়সংগত করে তুলবে। এই সংশোধনী কেবল আইনি কাঠামোই শক্তিশালী করবে না, বরং
ওয়াকফের মাধ্যমে সমাজের দুর্বল অংশের কল্যাণও নিশ্চিত করবে।