অন্যান্য জাতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিনষ্ট ও বিলুপ্ত করিয়া নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করিবার মানসিকতা আব্রাহামিক ও সেমেটিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য। ইহা করিবার জন্য তাহারা হেন কুকর্ম নাই যাহা করিয়াছে। বিশ্বের বহু উন্নত সভ্যতাকে তাহারা চিরতরে বিলীন করিয়া দিয়াছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও তাহারা ইহা প্রয়োগ করিবার চেষ্টা করিয়াছে। বহু শতাব্দীব্যাপী অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্মান্তরণ, মঠ-মন্দির চূর্ণ করিয়া ভারতবর্ষের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করিয়াছে। তাহার পরেও তাহারা ভারতবর্ষকে বিলুপ্ত করিতে পারে নাই। ভারতবর্ষের প্রাণশক্তির নাগাল তাহারা পায় নাই। মাত্র কয়েক শতাব্দী পূর্বে টমাস ব্যবিংটন মেকলে ভারতবর্ষের প্রাণশক্তিকে অনুধাবন করিয়া তাহা বিনষ্ট করিবার চেষ্টা করিয়াছে। তাহার সুপারিশে ইংরাজ শাসক এমন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করিবার পরিকল্পনা করিয়াছে যাহাতে ভারতীয়রা শুধুমাত্র গাত্রবর্ণে ভারতীয় থাকিবে; আচারে-বিচারে, চিন্তায়-মননে তাহারা সাহেব হইয়া যাইবে। তাহারা তাহাদিগের উন্নত ঐতিহ্য ও পরম্পরার সমস্ত কিছুই বিস্মৃত হইয়া যাইবে শুধু নহে, ভারতবর্ষের যাহা কিছু উন্নত ও গরিমাময়, তাহাকে ঘৃণা করিতে শিখিবে। ইহার জন্য ইংরাজ শাসক সর্বপ্রথম শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতবর্ষের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাইয়াছে। ব্রিটিশ-ভারতে ইতিহাস পুস্তকের পাঠ্যবিষয় অবলোকন করিয়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যথিত হইয়াছেন। তিনি তাঁহার বিভিন্ন নিবন্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। তাহা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতে প্রকৃত ইতিহাসের পুনর্লিখন হয় নাই। বরং ইতিহাস লিখনের ন্যায় গুরুদায়িত্বটি মার্কস ও মেকলেপুত্রদের হস্তেই সমর্পিত হইয়াছে। তাহার ফলে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকসমূহে দেশের কথা নহে, বিদেশের গৌরবগাথায় পরিপূর্ণ রহিয়াছে। কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকবাহিনী এই কার্যটি আরও সুচারুরূপে করিয়াছে। তাহারা আক্রমণকারী ইসলামি অত্যাচারের নৃশংস ঘটনাগুলি আড়াল করিয়া তাহাদের কীর্তিকলাপকে মহান করিয়া দেখাইয়াছে। কয়েক প্রজন্ম ধরিয়া এই মিথ্যা ইতিহাস অধ্যয়নের ফলে দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও স্বাভিমানী ভারতীয় জাতি নির্মাণ হইতে পারে নাই। মেকলে সাহেব তো ইহাই চাহিয়াছিলেন! রাষ্ট্রভক্ত ঐতিহাসিকগণ মাঝে মধ্যে সত্য তথা প্রকৃত ইতিহাস তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিলেই মেকলেপুত্ররা ইতিহাসের গৈরিকীকরণ হইতেছে বলিয়া চিলচিৎকার শুরু করিয়াছে। তাহাদের চিৎকারে যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ প্রকৃত ঐতিহাসিকগণ চাপা পড়িয়া গিয়াছেন। সেই সুযোগে ভারত-ইতিহাসে নায়কের স্থানে প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছে বৈদেশিক আক্রমণকারীদের। কিন্তু ইতিহাস হইল অতীতের অধ্যয়ন। ইতিহাস তো ‘জীবনের পাতায় পাতায় অদৃশ্য লিপি দিয়া, পিতামহদের কাহিনি লিখিছ মজ্জায় মিশাইয়া’- তাহাকে চাপা রাখিবে সাধ্য কাহার? ইতিহাস নানাভাবে ফিরিয়া আসে। কাব্যে-কবিতায়-লোকসাহিত্যে-নাটকে-চলচ্চিত্রে। সম্প্রতি একের-পর-এক যখন প্রকৃত ইতিহাস চলচ্চিত্রের পর্দায় ফুটিয়া উঠিতেছে, মার্কস-মেকলেপুত্র সেকু-মাকুর দল তাহাদের স্বভাবসিদ্ধ চিৎকার শুরু করিয়াছে। তাহাদের বহু বৎসরের লালিত বিকৃত ও ভ্রান্ত ন্যারেটিভের কবর রচিত হইতে শুরু করিয়াছে। এই চিৎকার শুধুমাত্র ভারতের সেকু-মাকুরাই করিতেছে তাহা নহে, ভারত বিদ্বেষী পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমেও এই চিৎকার শোনা যাইতেছে। তাহাদের এই চিৎকার ক্রমশ আর্তচিৎকারে পরিণত হইবে। কারণ বর্তমানে ভারত শাসনের দায়িত্ব রহিয়াছে রাষ্ট্রভক্তদিগের হস্তে। তাহাদিগের কারণেই ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন ঘটিতেছে। তাহা প্রকৃত ও সত্য ইতিহাসের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করিতেছেন, বর্তমান ভারত দুইটি শিবিরে বিভক্ত হইয়াছে। একটি রাষ্ট্রভক্ত, অন্যটি রাষ্ট্রবিরোধী। সুখের বিষয় যে গরিষ্ঠাংশ ভারতবাসী রাষ্ট্রীয়তার পক্ষে রহিয়াছেন। রাষ্ট্রবিরোধীরা নগণ্য। তাহাদের সঙ্গে রহিয়াছে দেশি বিদেশি দেশবিরোধী, মানবতা বিরোধী, সর্বোপরি জেহাদিশক্তি। সমগ্র বিশ্ব অবলোকন করিতেছে, ভারতে কাহাদের আইকন তৈমুর লং, ঘোরি, আকবর, ঔরঙ্গজেব? আর কাহাদের আইকন শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ মহামানব এবং গুরুগোবিন্দ, রাণাপ্রতাপ, ছত্রপতি শিবাজী, ছত্রপতি শম্ভাজী প্রমুখ বীর যোদ্ধা? ভারতের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস মৃত্যুঞ্জয়ী। তাহাকে বিকৃত অথবা চাপিয়া রাখিবার সাধ্য মার্কস-মেকলেপুত্রদের নাই। তাহার উন্মোচনের কাল শুরু হইয়াছে।