ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজের নির্মম হত্যার বদলা মরাঠারা কীভাবে নিয়েছিলেন ?
কানু রঞ্জন দেবনাথ
আজকাল ভারত তথা সারা বিশ্বের সিনেমাহলে বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে হিন্দি চলচ্চিত্র অভিনেতা ভিকি কৌশল অভিনীত, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুপারহিট হিন্দি ফিল্ম ‘ছাওয়া’র জয়জয়কার চলছে। এই নিবন্ধটি লেখা চলাকালীন পর্যন্ত এই সিনেমাটির আয় প্রায় ৫০০ কোটির ক্লাবে পৌঁছে যাচ্ছে। যারা এই সিনেমাটি দেখেছেন তারা হয়তো ভালো করেই জানেন এই সিনেমায় বর্ণিত মরাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের জ্যেষ্ঠপুত্র শম্ভাজী মহারাজ ওরফে ‘ছাওয়া’র সাহসিকতা এবং মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর মৃত্যুকাহিনি। এই কাহিনি দেখে অনেকেই ভাবুক হয়েছেন, অনেকেই দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা, পীড়া সহ্য করতে না পেরে সিনেমা হলেই কেঁদে ফেলেছেন। এখন এই নিষ্ঠুর মৃত্যুকাহিনি যারা দেখেছেন, তারা অবশ্যই এই নিষ্ঠুর মৃত্যুর পরবর্তী বদলা
মরাঠারা নিয়েছিলেন কিনা বা বদলা নিলে কীভাবে নিয়েছেন, তা জানতে আগ্রহী।
ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজ ছিলেন মরাঠা সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ছত্রপতি, লেখক, চিন্তাবিদ এবং ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের উত্তরসূরি। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ১২০টি যুদ্ধ করেছেন এবং সবকটিতেই তিনি জয়লাভ করেছেন। দাক্ষিণাত্যে মুঘল আক্রমণ বন্ধে শম্ভাজী মহারাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি তাঁর সাহসিকতা এবং পাণ্ডিত্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
শম্ভাজী মহারাজের জন্ম ১৬৫৭ সালের ১৪ মে মহারাষ্ট্রের পুণের পুরন্দরের দুর্গে হয়েছিল। রাজ্যাভিষেক হয়েছিল ১৬৮১ সালের ১৬ জানুয়ারি। তাঁর মৃত্যু ১৬৮৯ সালের ১১ মার্চ। তিনি মাত্র ৯ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি ছিলেন মহান ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এবং তাঁর প্রথমা স্ত্রী সাইবাঈয়ের পুত্র। তিনি যখন মাত্র আড়াই বছরের, তখন তাঁর মা পরলোকগমন করেন। মায়ের মৃত্যুর পর শম্ভুরাজেকে তাঁর ঠাকুমা জীজাবাঈ লালন-পালন করেন। শম্ভাজী রাজে কেবল তাঁর পিতামহীর প্রিয়ই ছিলেন না এমনকী তাঁর পিতামহ শাহজীরও ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয় ছিলেন। পুত্র শিবাজীর মতো জীজাবাঈ তাঁর প্রিয় নাতি শম্ভাজীর মধ্যেও দেশপ্রেম, স্বধর্ম প্রেম, হিন্দু স্বরাজ এবং আদর্শ জীবনের মূল্যবোধ স্থাপন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি কাশীরাম শাস্ত্রীর কাছ থেকে গণিত, যুক্তি, ভূগোল, ইতিহাস, পুরাণ, রামায়ণ, ব্যাকরণ ইত্যাদি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁর পিতা শিবাজী মহারাজ জীবিতকালে শম্ভাজীকে শারীরিকপ্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি তিনটি সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন- যা তাঁর গভীর পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক। শিবাজী মহারাজ্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র হবার কারণে শম্ভাজী ‘হিন্দবী স্বরাজ’ সৃষ্টির প্রতি তাঁর বাবার প্রচেষ্টা পর্যবেক্ষণ করে বড়ো হয়েছিলেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে রামনগরে প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং ১৬৭৫-৭৬ সালে গোয়া, কর্ণাটকে সফল অভিযান পরিচালনা করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৬৮০ সালের ২০ জুলাই হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে তাঁর রাজ্যাভিষেক হয় এবং তিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ছত্রপতি হন।
শিবাজী মহারাজের মৃত্যুর তিন মাস পরে শম্ভাজী মহারাজের রাজ্যাভিষেক হয়। ছত্রপতি হওয়ার পর পরই তিনি অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। জনসাধারণের জন্য রাস্তাঘাট ও নিকাশি ব্যবস্থা সংস্কার করেন, কৃষকদের উপর কর কমিয়ে দেন এবং জনগণকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করেন। শম্ভাজী মহারাজ তাঁর রাজ্য ‘হিন্দু পুনর্নির্মাণ সমিতি’ নামে একটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ধর্মান্তরিত হিন্দুদের জন্য ছিল। শম্ভাজী মহারাজের আমলে হরসুল গ্রামের কুলকার্ণী নামে একজন ব্রাহ্মণকে মুঘলরা জোর করে মুসলমানে ধর্মান্তরিত করেছিল। তিনি হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু গ্রামের স্থানীয় ব্রাহ্মণরা তার কথায় কর্ণপাত করেননি। অবশেষে কুলকর্ত্রী শম্ভাজী মহারাজের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে তার দুর্দশার কথা জানান। শম্ভাজী মহারাজ তৎক্ষণাৎ তার পরাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং তাকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনেন। শম্ভাজী মহারাজের এই মহৎ প্রচেষ্টা অনেক ধর্মান্তরিত হিন্দুকে হিন্দুধর্মে আবার প্রত্যাবর্তনে সাহায্য করেছিল। ছত্রপতি শম্ভুরাজে তাঁর প্রজাদের সুখ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতেন। রাজ্যের দারিদ্র্য ও খাদ্য ঘাটতি পুরণের জন্য তিনি ১৬৮০ সালে ঔরঙ্গজেবের খানদেশ সুবার রাজধানী বুরহানপুর আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে মরাঠারা একটি বিশাল পরিমাণ ধনসম্পদ হস্তগত করে।
মহীশূর আক্রমণ : খানদেশ এবং বুরহানপুরে মুঘলদের পরাজিত করার পরে সম্ভাজী মহারাজ মহীশূর আক্রমণ করেন। ১৬৮১ সালে তিনি মহীশূর জয় করে গিয়েছেন।
পর্তুগিজদের এলাকা আক্রমণ : পর্তুগিজরা মুঘলদের বাণিজ্যে সাহায্য করেছিল এবং মুঘলদের তাদের অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতের অনুমতি দিয়েছিল। শম্ভাজী মহারাজের মূল লক্ষ্য ছিল মুঘল- পর্তুগিজদের মধ্যে জোট ভেঙে ফেলা। এই কারণেই শম্ভাজী যুদ্ধে পর্তুগিজদের আক্রমণ করে পরাজিত করেন, পর্তুগিজ কোষাগার ও অস্ত্রভাণ্ডার দখল করেন এবং পর্তুগিজ সেনাপতি (জেনারেল) তথা অফিসারদের মৃত্যুদণ্ড দেন।
শম্ভাজী মহারাজ ভারত থেকে মুঘলদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই পরিকল্পনা এবং পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য সঙ্গমেশ্বরে একটি গোপন সভা করেছিলেন। গণোজী শিরকে ছিলেন শম্ভাজী মহারাজের শ্যালক। শম্ভাজী মহারাজ স্পষ্টতই তাকে বতন্ডারি, জাহাঙ্গিরি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তাই গণোজী শিরকে মুঘলদের সঙ্গে হাত মেলান। গণোজী শম্ভাজীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং মুঘল সর্দার মুকারম খানকে জানান যে শম্ভাজী মহারাজ সঙ্গমেশ্বরে আছেন। শম্ভাজী রাজে তাঁর অভিযানে যে গোপন পথগুলি ব্যবহার করতেন তা কেবল মরাঠারাই জানতো। গণোজী মুকারর্ম খানকে সঙ্গমেশ্বরের গোপন রাস্তার কথা বলেছিলেন। শম্ভাজী মহারাজ কিছু সর্দার এবং বিশ্বস্ত মন্ত্রীদের সঙ্গমেশ্বরে ডেকেছিলেন। এই গোপন বৈঠকের পর গ্রামবাসীদের অনুরোধে তিনি তাদের কথার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি হন। তিনি তার সঙ্গের সেনাবাহিনী রায়গড়ে পাঠান এবং তার সঙ্গে মাত্র ২০০ সেনা, তাঁর বন্ধু কবি কালশ এবং ২৫ জন বিশ্বস্ত উপদেষ্টা রাখেন। যখন শম্ভাজী মহারাজ গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছিলেন তখন ১০ হাজার মুঘল সৈন্য তাকে এবং তার সঙ্গীদের ঘিরে ফেলে। সবাই অতি সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। এক ভয়াবহ রক্তপাত ঘটে যেখানে শম্ভাজী মহারাজের সেনাবাহিনী তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে বিশাল মুঘল সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়। অবশেষে ১৬৮৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শম্ভাজী এবং তাঁর বন্ধু কবি কালশ বিশ্বাসঘাতক মুঘলদের হাতে বন্দি হন।
এবং কবি কালশকে বাহাদুরগড়ে নিয়ে যায়। তারপর তাদের শেষ দিনগুলিতে তাদের ভীম, ভামা এবং ইন্দ্রায়নীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত তুলাপুর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঔরঙ্গজেব তাদের উভয়ের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। ঔরঙ্গজেব শম্ভু রাজে এবং কবি কালশকে জোকারের পোশাক পরিয়ে এবং উটের সঙ্গে বেঁধে অপমান করে। মুসলমান সেনারা কেউ পাথর, কাদা, গোবর ইত্যাদি ছুঁড়ে মারে। শম্ভাজী এবং কবি কালশ উভয়েই তাঁদের পূজিত দেবীর নাম ‘জগদম্বা’, ‘জগদম্বা’ জপ করতে করতে সমস্ত কিছু সহ্য করেছিলেন। অপমানজনক ব্যবহারের পর শম্ভাজী মহারাজকে ঔরঙ্গজেবের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঔরঙ্গজেব প্রাণ ভিক্ষার জন্য শম্ভাজী মহারাজের সামনে তিনটি শর্ত রাখে। (১) সমস্ত মরাঠা দুর্গ মুঘলদেরকে দিয়ে দিতে হবে। (২) মুঘল দরবারের কর্মকর্তা যারা মরাঠাদের গোপনে সাহায্য করে থাকে তাদের নাম বলে দিতে হবে। (৩) ইসলাম গ্রহণ করতে হবে।
শম্ভাজী মহারাজ সব শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন। এরফলে ঔরঙ্গজেব আরও বেশি করে শম্ভাজী মহারাজ ও কবি কালশের ওপর অত্যাচার ও অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। মুঘল সৈন্যরা ধীরে ধীরে চিমটা দিয়ে তাদের নখ টেনে বের করে এবং তার পর একে একে তাদের আঙুল কেটে ফেলে। প্রতিটি নৃশংসতার পর ঔরঙ্গজেব শম্ভাজীকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলে, কিন্তু প্রতিবারেই অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতেন। একদিন রাগে ঔরঙ্গজেব শম্ভাজী মহারাজের জিহ্বা কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়। এর কয়েকদিন পর শম্ভাজীর শরীরের চামড়া তুলে ফেলা হয়। তারপর গরম লোহার রড দিয়ে তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়। কয়েকদিন পর শম্ভাজী মহারাজের দুটি হাতই একে একে কেটে ফেলা হয়। সবশেষে তাঁর শিরশ্ছেদ করা হয়। একটি বিশেষ অস্ত্র দিয়ে তার মাথা দুই টুকরো করা হয় এবং মুঘলরা তুলাপুরে ভীমা নদীর সঙ্গমস্থলে সেই সমস্ত টুকরো ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এভাবে শম্ভাজী মহারাজ নিজের জীবন উৎসর্গ করেও তাঁর স্বধর্ম এবং আত্মসম্মান ত্যাগ করেননি। তাঁর আত্মত্যাগের কারণে সমস্ত মরাঠা এবং অন্যান্য হিন্দু রাজা একত্রিত হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। যার কারণে কয়েক বছরের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। শিবাজী মহারাজের হিন্দুস্বরাজ্য রক্ষা এবং হিন্দু ধর্মের পরিচয় রক্ষার জন্য ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজকে ‘ধর্মবীর’ উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর সাহসিকতা এবং উচ্চ চরিত্র আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
শম্ভাজী মহারাজের মৃত্যুর বদলা কীভাবে মরাঠারা নিয়েছিলেন? ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজের রাজত্বকালে সন্তাজী ঘোরপড় ছিলেন একজন বিশিষ্ট সেনাপতি। সন্তাজী ঘোড় পড়ে মারাঠা সাম্রাজ্যের জ্যেষ্ঠ ঘোরপড়ে বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সন্তাজী এবং ধনাজী যাদব একসঙ্গে মুঘলদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। যখন ঔরঙ্গজেব বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজকে বন্দি করে হত্যা করে, তখন মালহোজী ঘোরপড়েও ছত্রপতি শম্ভাজীর সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেন। এই মালহোজীর ঘোরপড়ের পুত্র ছিলেন সান্তাজী ঘোরপড়ে। এই ঘটনা সমগ্র মরাঠা সাম্রাজ্যকে ক্ষুব্ধ করে এবং সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়। এরপর শম্ভাজী মহারাজের পর তার ছোটো ভাই রাজারাম মরাঠা সাম্রাজ্যের ছত্রপতি হন। ঔরঙ্গজেব তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মহারাষ্ট্রের তুলাপুর নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে।
হঠাৎ সন্তাজী ও ধনাজী তুলাপুর আক্রমণ করেন। গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী সন্তাজী তার মরাঠা যোদ্ধাদের নিয়ে আহত বাঘের মতো ঔরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন। সন্তাজী তার সঙ্গীদের নিয়ে গাজর-মুলার মতো মুঘলদেরকে হত্যা করা শুরু করেন। তুলাপুরে সন্তাজীর নেতৃত্বে মরাঠাদের অতর্কিত আক্রমণের ফলে মুঘলরা দিশাহারা হয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। একদিকে পুরো মুঘল সেনাবাহিনী ঔরঙ্গজেবের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল এবং অন্যদিকে মরাঠারা মুঘলদের মৃতদেহ স্তূপ করে রাখছিল। মরাঠারা মুঘল শিবিরে প্রবেশ করে। এত বেশি মুঘল সৈন্য মারা গিয়েছিল যে ঔরঙ্গজেব কোনোভাবে নিজের জীবন বাঁচতে পেরে পালিয়ে যায়। পরের দিন সকালে ঔরঙ্গজেব মুঘলসেনার মৃত্যুর দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায়। এই ঘটনার পর মুঘল এবং তাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুঘল ইতিহাসবিদ কাফি খানের মতে, যে কোনো মুঘল সৈন্য ভয়ংকর সন্তাজীর মুখোমুখি হলে হয়তো নিহত হতো নয়তো বন্দি হতো। এই ঘটনার মাত্র দুই দিন পরে সন্তাজী রায়গড় দুর্গ আক্রমণ করেন। ছত্রপতি শম্ভাজীর স্ত্রী যেশুবাঈকে বন্দি করে রাখা মুঘল সর্দার জুলফিকার খানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার পর তিনি রায়গড় দুর্গে হত্যালীলা চালান এবং অসংখ্য ঘোড়া ও হাতি-সহ মুঘলদের অমূল্য ধনসম্পদ দখল করে পানহালায় ফিরে আসেন। এবার মুকারম খানের পালা, যে ছলনা ও প্রতারণার মাধ্যমে ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজকে বন্দি করেছিল। ঔরঙ্গজেব মুকারম খানকে মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর ও কোঙ্কন প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত করেছিল। ১৬৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মরাঠারা মুকারম খানের বিশাল সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলে এবং তুলজাপুরে যে হত্যা চালিয়েছিল তারই দৃশ্য পুনর্নির্মাণ করে, ভয়াবহ যুদ্ধে সন্তাজী ঘোরপড়ে মুকারম খানকে তাড়া করে হত্যা করেন। রক্তাক্ত মুকারম খানের দুর্দশা দেখে মুঘল সেনাবাহিনী তাকে নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়, কিন্তু মুকারম খান সেখানেই যন্ত্রণায় মারা যায়। মুকারম খানকে হত্যা করে মরাঠারা ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়। সম্ভাজী ঘোরপড়ের সাহস ও বীরত্বে খুশি হয়ে ১৬৯১ সালে ছত্রপতি রাজারাম মহারাজ তাকে মরাঠা সাম্রাজ্যের সেনাপতি ঘোষণা করেন। এরপর সন্তাজী দ্বিগুণ উৎসহ নিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার মরাঠা সেনাবাহিনী নিয়ে কর্ণাটকের দিকে যাত্রা করেন। কৃষ্ণা নদী পার হওয়ার পর তিনি একের পর এক মুঘল অধিকৃত অঞ্চলে মরাঠা সাম্রাজ্যের বিজয় ঘোষণা করেন এবং ঔরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে উৎখাত করেন। মরাঠাদের ভয়ে ঔরঙ্গজেব সহ্যাদ্রি পর্বতমালার এখানে সেখানে ছুটে বেড়াতে লাগলো। ২৭ পছর ধরে মরাঠারা ঔরঙ্গজেবকে এতটাই তাড়া করে যে তার পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মরাঠাদের হাতে মুঘলদের ক্রমাগত পরাজয়ের পর, ঔরঙ্গজেব হতাশ হয়ে পড়ে। সন্তাজী ঘোরপড়েই তাঁর যুদ্ধ অভিযানের মাধ্যমে ঔরঙ্গজেবের নাক কেটে দিয়েছিলেন এবং ইতিহাসে ঔরঙ্গজেবকে পলাতক ও ভীরু প্রমাণ করেছিলেন।
সন্তাজী ঘোর পড়ে কে? সন্তাজী ঘোরপড়ের জন্ম ১৬৬০ সালে মালহোজী ঘোরপড়ের ঘরে। মরাঠারা গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ ছিল। রাজারাম ভোঁসলের রাজত্বকালে সন্তাজী ছিলেন ষষ্ঠ মারাঠা সেনাপতি। তিনি যুদ্ধে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এবং শম্ভাজী মহারাজকেও সমর্থন করেছিলেন। তিনি সারাজীবন মরাঠা সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত ছিলেন এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত স্বরাজ্যের জন্য নিঃস্বার্থভাবে সেবা করে গেছেন।