‘ছাওয়া’-এক নৃশংস নিষ্ঠুর ইতিহাসের আবরণ উন্মোচন
প্রবীর ভট্টাচার্য
মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে ঔরঙ্গজেবের কবর সরানোর কাল্পনিক বিষয়টিকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন ধরে দেশের সেকু-মাকু এবং তাদের দোসরদের দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। জেহাদিরা নাগপুর-সহ বেশ কিছু শহরের জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। কী চায় এরা? বিদেশি, অত্যাচারী শাসক ঔরঙ্গজেবের প্রতি এদের এত আবেগ কেন?
এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে দেখতেই হবে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ছাওয়া’ ছবিটি। ঔরঙ্গজেবের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এক মরাঠা যুবকের বীরত্বের কাহিনি। প্রবীণ মরাঠী লেখক শিবাজী সাওয়ান্তের উপন্যাস অবলম্বনে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ছাওয়া’ ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজের জীবন কাহিনি সারা দেশে আলোড়ন তুলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা করেছে হিন্দি ভাষায় নির্মিত এই ছবিটি।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেব ভেবেছিল হিন্দবী স্বরাজ দখল করতে মাত্র এক বছর সময় লাগবে। ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজের সিংহাসনে আরোহণের পরেই ঔরঙ্গজেব চলে আসে দাক্ষিণাত্যে। তখন মরাঠাদের চারিদিকে শত্রু। বিজাপুরে আদিল শাহ, গোলকুণ্ডা থেকে কুতুব শাহ, গোয়ায় পর্তুগিজ, রাজাপুরে ব্রিটিশেরা। এই সব কিছু ছাপিয়ে মুঘলদের বিশাল বাহিনী। ঔরঙ্গজেবের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় সাত লক্ষ। সেখানে ছত্রপতি শম্ভাজী মহারাজের সৈন্য মাত্র পঞ্চাশ হাজার। ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য থেকে ঔরঙ্গজেব আদেশ দেয় শম্ভাজীর দুর্গ দখল করার। কিন্তু কোনো সেনাপতিই তাতে সফল হয়নি। নাসিকের কাছে একটি ছোট্ট দুর্গ দখল করতে ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি শাহবুদ্দিন ফেলিজ বাদশার কাছে মাত্র দুদিন সময় চেয়েছিল। কিন্তু ৬ বছর ধরেও তা দখল করা সম্ভব হয়নি।
১৬৮৭ সালে ওয়াইয়ের যুদ্ধে প্রধান মরাঠা সেনাপতি হাম্বিররাও মোহিতে নিহত হন। এক নিকট আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৬৮৯ সালে সঙ্গমেশ্বরে মুকারম খানের বাহিনীর হাতে শম্ভাজী বন্দি হন। ঔরঙ্গজেব তার অসম সাহসিকতায় খানিকটা চমকিত ছিলেন। ভেবেছিলেন এই রকম এক যোদ্ধা যদি তার সেনাপতি হয়, তবে সমগ্র এশিয়া তার পদানত হবে। তিনি শম্ভাজীকে কলমা পরিয়ে ইসলাম গ্রহণ করার কথা বলেন। কিন্তু সিংহ শাবক শম্ভাজী তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। শম্ভাজীর উত্তর ছিল, ‘বার বার জন্মাবো, বার বার মরবো, কিন্তু হিন্দুধর্ম ছাড়বো না’। শম্ভাজী বলেছিলেন তুমি আমাকে মেরে ফেলবে, কিন্তু আমার স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলতে পারবে না। শম্ভাজীর মৃত্যুর পর মরাঠারা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসে এবং মুঘলদের ভীষণ লড়াই শুরু করে। এক বছরের মধ্যে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঔরঙ্গজেবকে সাতাশ বছর এখানে থাকতে হয়েছিল। দিল্লিতে ফিরে যাওয়া তার আর হয়নি। মরাঠা হিন্দু সাম্রাজ্য দখল করা সম্ভব হয়নি।
ছত্রপতি শম্ভাজী, মুঘলবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত। কিন্তু ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলিকেই এতদিন ঢেকে রাখা হয়েছিল। সেকু-মাকু এবং তাদের দোসরদের গাত্রদাহ এই কারণেই। কিন্তু সময় এসেছে এগুলির পুনর্মূল্যায়নের।
পরিচায়ক লক্ষ্মণ উতেকারের হিন্দি ছবি ‘ছাওয়া’ ইতিহাসের এই অনুচ্চারিত অংশগুলোই তুলে ধরেছে এক নৃশংস নিষ্ঠুর ইতিহাসের আবরণ উন্মোচন করেছে। সিনেমাটোগ্রাফি সৌরভ গোস্বামীর। ২০১৬ সালে উতেকারের ‘লাল বাগচি রানি’ সিনেমাটিও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু সে তো সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক প্রতিবন্ধী মেয়ের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ‘ছাওয়া’ একেবারেই ভিন্ন মাত্রার। ছত্রপতি শম্ভাজীর চরিত্রে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা ভিকি কৌশলের অভিনয় মনে রাখার মতো। ‘সর্দার উষ্ম’ ছবিতে উধম সিংহের চরিত্রে অভিনয় দেখে আঁচ করা গিয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিঙে স্নাতক এই তরুণ অনেকটা পথ হাঁটার জন্য বলিউডে এসেছেন। যেশুবাই চরিত্রে দক্ষিণী সুন্দরী রশ্মিকা মন্দানার কথাও বলতেই হয়। অসামান্য ফোটোগ্রাফি, এডিটিং সব কিছু নিয়ে ‘ছাবা’ দর্শকদের সব প্রত্যাশা পূরণ করেছে। ছবিটি দেখতে দেখতে একটাই কথা মনে হচ্ছিল- যশোর নরেশ প্রতাপাদিত্যকে নিয়েও এমন ধারার ছবি বাঙ্গালি পরিচালকেরা কি ভাববেন?