প্রত্যন্ত ত্রিপুরার কুল্লুক পূজা
অসিত দাস
প্রত্যন্ত ত্রিপুরায় চড়ক পুজার আগের দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির আগের রাতে কুল্লুক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ আবার কেমন পূজা, হিন্দুদের বারো মাসের তেরো পার্বণের শেষ পার্বণ হলো চড়ক পূজা। ছোটোবেলায় আর যুবক বয়সে এই পূজার জন্য আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। সে এক দিন ছিল! সবকিছু কেমন যেন হারিয়ে গেল। সংক্রান্তির ১৫ দিন আগে থাকতেই নানান পালাগান হতো, হ্যাজাক লণ্ঠন জ্বালিয়ে নানা রঙিন পোশাক পরে, লব-কুশের গল্প, রাজা-রানির উপাখ্যান, লক্ষ্মী-শনিদেবের উপাখ্যান, মহিরাবণের উপাখ্যান, রাবণ বধ, রাজা হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান ইত্যাদি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুরে ঘুরে পালা করতাম। ঢাকের তালে নেচে নেচে তির ধনুক আর তরবারি নিয়ে যুদ্ধের অভিনয়। এখন দূরদর্শন ও অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক মাধ্যম সবকিছু যেন গিলে খেল। ওখান থেকে যে চাঁদা সংগ্রহ হতো, তাই দিয়ে চড়ক পূজা হতো। গ্রামের মানুষ অতি সাধারণভাবেই জীবনযাপন করত, কিন্তু পূজার উৎসব অনুষ্ঠানে আনন্দের খামতি ছিল না। ছোটো বড়ো সকলে হাত লাগিয়ে পূজার সমস্ত কাজ আন্তরিকভাবে সম্পন্ন করতো। শহরের মতো নয় ডেকোরেটারদের হাতে দিয়ে নিজেরা কেবল দর্শক হয়ে থাকা।
কুল্লুক হলো শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি একটা আলম্ব যন্ত্রবিশেষ যাকে অবলম্বন করে চড়ক ঘুরতে থাকে, আসলে প্রকারান্তরে শিব ঠাকুরকে পূজা করা হয়। কুল্লুক পূজার দিন সকালবেলা কর্দমাক্ত মাঠে কাবাডি খেলাটা একটা রীতি ছিল। কাবাডি খেলার পর সকলে মিলে জঙ্গলে গিয়ে শক্ত খাইল্লাই বাঁশ কেটে আনত। এক একটা দিকে প্রায় বারোটা করে বাঁশ আড়াআড়ি করে বাঁধা হতো, তারপর চারিদিকে বাঁশের সরু পাতি দিয়ে গোল করে বেঁধে চারিদিকে রঙিন পতাকা দেওয়া হতো। দড়ি আর গামছা দিয়ে বসে থাকা শিবঠাকুরের মূর্তি (পোত্তল) উপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো।
সংক্রান্তির আগের দিন রাত্রিতে শুরু হতো কুল্লুক পূজা। ঢাকঢোল কাঁসরের শব্দের চারিদিকে মুখরিত হয়ে উঠতো, এই পূজার প্রসাদ হলো ফল-সিন্নি, খিচুড়িও দেওয়া হয় আর বড়োদের জন্য থাকে বিশেষ খাবার সুখা প্রসাদ-গঞ্জিকা। অন্য সময় এটা বড়োই দোষের। কিন্তু কুল্লুক পূজায় বড়োরা অনেকে কলকেতে সুখের টান দিয়ে থাকেন।
একবার তো যোগেন্দ্র জ্যাঠা বেশি টান দিয়ে কী বিপত্তিই না ঘটালেন, বাড়ির কাছে গিয়ে আমাকে বলেন, আরে এককানা ঘাঁডায় উডাই দিবিনি (নোয়াখালি ভাষা অর্থাৎ আমাকে একটু বাড়ির রাস্তায় উঠিয়ে দেবে কিনা), আরেকবার সুখেন কাকু রাস্তার মাঝে উপুড় হয়ে শুয়ে ধুলোয় সাঁতার কাটতে থাকেন- আর বলে, কত জল আই, কেননে যাইতাম। এরকম উলটপালট কাণ্ড কারখানা দেখে গ্রমের সকলেই মজা করত।
চৈত্র সংক্রান্তির সকালবেলা গ্রামের সব বাড়ির উঠোন গোবর দিয়ে নিকানো হতো, ঘরের দরজা ফুলের মালা আর ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হতো, গোরু-বাছুরকে স্নান করিয়ে গলায় ফুলের মালা দিয়ে পূজা করা হতো। দুপুর থেকে কুল্লুকের চারিদিকে বাঁশ বেঁধে তাতে চড়ক আকারে পরিণত করতেন গ্রামের বয়স্ক মানুষজন। চড়ক দণ্ড হতো শাল গাছের, ঘি-ডিম ভেঙে কুল্লুকের ভেতরে আর চড়ক দণ্ডের মাথায় লাগানো হতো যাতে ঘুরতে সুবিধা হয়। ঢাকঢোল কাঁসির ঝংকারে চড়ক ঘুরত বনবন করে, আমরা কয়েকজন আবার অতি উৎসাহিত হয়ে দড়ি বেয়ে কিছুটা উপরে উঠে যেতাম। ঘুরন্ত অবস্থায় কোনোরকম একটু নীচে নেমে লাফিয়ে নামতে হতো, প্রায় ২০ ফুট দূরে গিয়ে লাটুর মতো ছিটকে পড়তাম। হাত পা ছড়ে যেত অনেকের, তাতে কারোর কোনো ভ্রূক্ষেপ হতো না। চড়ক শেষে পোত্তল মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা, শিবঠাকুর স্থান হতো ঠাকুরঘরের এক কোণায়। গ্রামে এখন চড়ক কেমন হয় জানি না, এআই টেকনোলজির যুগ আর পঠনপাঠনের যেরকম চাপ তাতে এরকম দস্যিপনা করার মতো ছেলেপুলে গ্রামে আছে কিনা শিবঠাকুরই বলতে পারেন।