বিশ্বের সামনে উদাহরণ সৃষ্টিকারী সমরস ও সংগঠিত ভারত নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সংকল্পবদ্ধ
বিশ্বের সামনে উদাহরণ সৃষ্টিকারী সমরস ও সংগঠিত ভারত নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সংকল্পবদ্ধ
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালুরু স্থিত চেন্ননহেল্লি নগরের জনসেবা বিদ্যামন্দির পরিসরে গত ২১,২২,২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। তিন দিবসীয় বৈঠকে সারা দেশ থেকে ১৪৮২ জন কার্যকর্তা অংশগ্রহণ করেন। সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় অধিকারী, কার্যকারী সদস্য, ক্ষেত্র ও প্রান্ত কার্যকরী সদস্য, নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং বিভাগ প্রচারকগণ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ধর্মজাগরণ সমন্বয়, সামাজিক সমরসতা, পর্যাবরণ, কুটুম্ব প্রবোধন, গ্রাম বিকাশ, গোসেবা- ছটি গতিবিধির প্রতিনিধি, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, বিদ্যা ভারতী, বিজ্ঞান ভারতী, সংস্কৃত ভারতী, ভারতীয় শিক্ষা উত্থান ন্যাস, ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, কিষাণ সঙ্ঘ, সংস্কার ভারতী, সংস্কৃতভারতী, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ, সহকার ভারতী, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, ক্রীড়া ভারতী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরোগ্য ভারতী, রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি, মহিলা সমন্বয়, প্রজ্ঞা প্রবাহ, ভারতী জনতা পর্টি প্রভৃতি সংগঠনের অখিল ভারতীয় স্তরের কার্যকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সরকার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোসবলে জানান, সারা দেশে সঙ্ঘ কাজের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৪-এর তুলনায় ১০ হাজার শাখা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মোট ৫১,৫৭০ স্থানে ৮৩, ১২৯ নিত্য শাখা; ৩২, ১৪৭ সাপ্তাহিক মিলন এবং ১২,০৯১ মাসিক মণ্ডলী চলছে। সারা দেশে আয়োজিত প্রারম্ভিক বর্গে ২,২২,৯৬২ জন স্বয়ংসেবক অংশগ্রহণ করেছে। এই বছর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী, যোগ্য প্রশাসক, অনবদ্য রাজনীতিবিদ তথা মহা পরাক্রমশালী কর্ণাটক রাজ্যের উল্লালের মহারানি আবাক্কার জন্মের ৫০০ বছর পূর্তি বর্ষ রূপে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বিশ্বের অজেয় সেনা বলে পরিচিত পর্তুগিজদের নিজ রাজত্বকালে বার বার পরাজিত করে স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখেন। অনন্য বীরত্বের কারণে ইতিহাসে তিনি ‘অভয়ারানী’ নামে পরিচিত। তিনি তাঁর শাসনে মন্দির ও তীর্থ সংস্কারের পাশাপাশি লোক সংস্কৃতির উন্নতিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
এবছর বিজয়াদশমীতে সঙ্ঘ শতবর্ষ পূর্ণ করবে। আগামী বছর সঙ্ঘকাজের প্রসার, পূর্ণ ও দৃঢ়ীকরণের লক্ষ্যে স্বয়ংসেবক-কার্যকর্তারা তৎপর হবেন। শতবর্ষ উদ্যাপন করা সঙ্ঘের উদ্দেশ্য নয়। আত্মচিন্তন, সঙ্ঘকাজ বৃদ্ধির জন্য সমাজ সমর্থনের স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সমাজকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে নিজেদের সমর্পিত করতে হবে। শতবর্ষে আরও ব্যাপকভাবে সতর্ক থেকে গুণমানসম্মত কাজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। উপস্থিত প্রতিনিধিদের অনুমোদনক্রমে প্রতিনিধি সভায় দুটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে-
প্রস্তাব-১
বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের পাশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়োনোর আহ্বান অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশে হিন্দু-সহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর ইসলামিক উগ্রবাদীদের দ্বারা অনবরত চলতে থাকা সুপরিকল্পিত হিংসা, অন্যায় ও অত্যাচারের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এটি সুস্পষ্ট মানবাধিকার হননের গম্ভীর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সরকার পরিবর্তনের সময় মঠ-মন্দির, দুর্গাপূজা প্যান্ডেল ও শিক্ষাকেন্দ্রে আক্রমণ, মূর্তি অপবিত্র করা, নৃশংস হত্যা, সম্পত্তি লুঠ, মহিলা অপহরণ ও অত্যাচার, ধর্মান্তরণের মতো অনেক ঘটনা অনবরত সামনে আসছে। এইসব ঘটনাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বলে এর সাম্প্রদায়িক দিককে অস্বীকার করার অর্ধ সত্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া, কেননা বেশিরভাগ অত্যাচারিত মানুষই হিন্দু-সহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশে হিন্দু সমাজ বিশেষ করে অনুসূচিত জাতি ও জনজাতি সমাজের উপর ইসলামিক উগ্রবাদীদের দ্বারা অত্যাচার কোনো নতুন কথা নয়। বাংলাদেশে ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকা হিন্দু জনসংখ্যা (১৯৫১-তে ২২ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৭.৯৫ শতাংশ) বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তাদের সামনে এখন অস্তিত্ব সংকটের সমস্যা। বিশেষ করে গত বছরের হিংসা ও বিদ্বেষ যেভাবে সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন প্রাপ্ত হয়েছে, তা খুব চিন্তার বিষয়। তার সঙ্গে বাংলাদেশে অনবরত ভারত-বিরোধী বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কে প্রচণ্ড ক্ষতি করে চলেছে।
কিছু আন্তর্জাতিক শক্তি জেনেবুঝে ভারতের প্রতিবেশী এলাকায় অবিশ্বাস ও সংঘর্ষের পরিবেশ নির্মাণ করে এক দেশকে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে অরাজকতা ছড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। প্রতিনিধি সভা চিন্তাশীল গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের অনুরোধ করছে যে, তারা ভারত-বিরোধী পরিবেশ, পাকিস্তান ও ‘ডিপ স্টেট’-এর সক্রিয়তার উপর নজর রাখুন এবং তা প্রকাশ করুন। প্রতিনিধি সভা এই তথ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় যে, এই সমস্ত ক্ষেত্রের একটি সমান সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে, যার দরুন এক জায়গায় হওয়া কোনো আন্দোলন সমগ্র এলাকাতেই তার প্রভাব ফেলে। প্রতিনিধি সভা মনে করে, সমস্ত জাগ্রত মানুষ ভারত ও প্রতিবেশী দেশের এই সমান ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করার বিষয়ে চেষ্টা করুন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বাংলাদেশের হিন্দুসমাজ এই অত্যাচারের শান্তিপূর্ণ, সংগঠিত ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাহসের সঙ্গে বিরোধিতা করছেন। প্রশংসনীয় বিষয় হলো, ভারত ও সারা বিশ্বের হিন্দু সমাজ একে নৈতিক ও ভাবনাত্মক সমর্থন জানিয়েছে। ভারত-সহ বিশ্বের বহু হিন্দু সংগঠন এই হিংসার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে এবং বাংলাদেশের হিন্দুদের সুরক্ষার দাবি তুলেছে। এর সঙ্গে সারা বিশ্বের অনেক নেতাও এই বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
ভারত সরকার বাংলাদেশের হিন্দু-সহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিজের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তারা এই বিষয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও উঠিয়েছে। প্রতিনিধি সভা ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ করছে, তারা যেন বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের সুরক্ষা, গরিমা ও স্বাভাবিক অবস্থা সুনিশ্চিত করার জন্য সেখানকার সরকারের সঙ্গে নিয়মিত বার্তলাপ চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব রকম চেষ্টা চালু রাখে।
প্রতিনিধি সভার মনে করে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের উচিত, বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতি অমানবিক আচরণের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা এবং এই সহিংসতা বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। প্রতিনিধি সভা হিন্দু সমাজের সঙ্গে অন্যান্য দেশের নেতাদের ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশি হিন্দু-সহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সমাজের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলতে।
প্রস্তাব-২
সঙ্ঘ শতাব্দী উপলক্ষ্যে সংকল্প
বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সমরস ও সংগঠিত হিন্দু সমাজের নির্মাণ অনন্তকাল ধরেই হিন্দু সমাজ এক সুদীর্ঘ ও অবিস্মরণীয় যাত্রায় সাধনারত থেকেছে, যার উদ্দেশ্য মনুষ্য একতা ও বিশ্ব কল্যাণ। তেজদীপ্ত মাতৃশক্তির সঙ্গে সন্ত, ধর্মাচার্য ও মহাপুরুষদের আশীর্বাদ ও কর্তব্যের কারণে আমাদের রাষ্ট্র বিভিন্ন বাধা বিপত্তির পরেও নিরন্তর অগ্রসর হয়ে চলেছে।
কালের প্রবাহে রাষ্ট্রজীবনে আসা বহু দোষ দূরীভূত করে এক সংগঠিত, চরিত্রসম্পন্ন ও শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে ভারতেকে পরম বৈভবে নিয়ে যেতে ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কাজ শুরু করেন। সঙ্ঘকাজের বীজ রোপণ করে ডাক্তারজী দৈনিক শাখা রূপে ব্যক্তি নির্মাণের যে অভূতপূর্ব কার্যপদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যা ভারতের সনাতন পরম্পরা ও মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনির্মাণের নিঃস্বার্থ সাধনা। ডাক্তারজীর জীবনকালেই এই কাজ একটি রাষ্ট্রব্যাপী একটি স্বরূপে বিকশিত হয়। দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক পূজনীয় শ্রীগুরুজীর (মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর) দূরদর্শী নেতৃত্বে জাতীয় জীবনের বিবিধ ক্ষেত্রে শাশ্বত চিন্তাভাবনার প্রকাশে সময়োপযোগী যুগানুকূল সংগঠনের নির্মাণ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়।
শতবর্ষের এই যাত্রায় সঙ্ঘ নিত্য শাখার দ্বারা অর্জিত সংস্কারের মাধ্যমে সমাজের অটুট বিশ্বাস ও ভালোবাসা পেয়েছে। এই সময়ে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকেরা ভালোবাসা ও আত্মীয়তার শক্তিতে মান-অপমান ও রাগ-দ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। সঙ্ঘকার্যের শতাব্দী কালে আমাদের কর্তব্য হলো, পূজনীয় সাধুসন্ত তথা সজ্জন শক্তি যাঁদের আশীর্বাদ ও সহযোগিতা সব রকম পরিস্থিতিতে আমাদের সহায়ক হয়েছে, জীবন সমর্পণকারী নিঃস্বার্থ কার্যকর্তা এবং মৌন সাধনায় রত স্বয়ংসেবক পরিবারগুলিকে স্মরণ করা।
আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ পরম্পরার অনুকূল সৌহার্দ্যপূর্ণ বিশ্ব নির্মাণ করার জন্য ভারতের কাছে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান রয়েছে। আমাদের চিন্তাভাবনা বিভেদকারী ও আত্মঘাতী প্রবৃত্তি থেকে মনুষ্য জাতিকে সুরক্ষিত রেখে বিশ্ব চরাচরে একতার ভাবনা ও শান্তি সুনিশ্চিত করে।
সঙ্ঘ মনে করে ধর্মের অধিষ্ঠানের উপর আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ সংগঠিত সামূহিক জীবনের ভিত্তিতে হিন্দু সমাজ তার বৈশ্বিক দায়িত্ব প্রভাবী রূপে পালন করতে পারবে। তাই আমাদের কর্তব্য সব রকম ভেদাভেদকে অগ্রাহ্যকারী সমরসতাযুক্ত আচরণ, পরিবেশের উপযোগী জীবনশৈলীর উপর ভিত্তি করে মূল্যবোধযুক্ত পরিবার, ‘স্ব’বোধের সঙ্গে ওতপ্রোত এবং নাগরিক কর্তব্যের প্রতি দায়বদ্ধ সমাজের চিত্র নির্মাণ করার জন্য আমরা সকলে সংকল্প করি। আমরা এর ভিত্তিতে সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান, বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়ে জাগতিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ সমর্থশালী রাষ্ট্রজীবন নির্মাণ করতে পারব।
অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা সজ্জনশক্তির নেতৃত্বে সমগ্র সমাজকে সংগঠিত করে বিশ্বের সামনে সমরসসম্পন্ন এক ঐক্যবদ্ধ ভারতের আদর্শ উপস্থাপনের লক্ষ্যে সংকল্পবদ্ধ।