সিএএ যথেষ্ট নয়: বাঙ্গালি হিন্দুর জন্য চাই ‘হিন্দু ল অব রিটার্ন’আইন প্রণয়ন
সাধন কুমার পাল
গত ১৬ আগস্ট উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠার খবর।শিরোনাম ছিল, ভোটার তালিকায় ‘বাংলাদেশি’ পরিবার। অভিযোগ, ক্ষিতীশ ঋষি নামে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদেরও এদেশে এনে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি ভোটার তালিকায় নাম তোলা থেকে শুরু করে আধার,র্যাশন ও প্যান কার্ড পর্যন্ত তৈরিকরিয়ে নিয়েছেন। স্থানীয় সূত্রেজানা গিয়েছে ক্ষিতীশ প্রথমে স্ত্রীকে নিয়ে এসেবসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে ছেলে ও মেয়েকেও বাংলাদেশ থেকেনিয়ে আসেন। ২০২৩ সালেক্ষিতীশের নাম ভোটার তালিকায় ওঠে। ২০২৫ সালে তাঁর ছেলে ও মেয়ের নাম ভোটার তালিকায় ওঠে।তবে স্ত্রী এখনো ভোটার তালিকায় নাম তুলতে পারেননি। পরিবারের সদস্যদের নামে অন্যান্য সরকারি নথি
যেমন আধার কার্ড, র্যাশন কার্ড এবং প্যান কার্ড তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বামপন্থী কৃষ্ণকান্ত রায় প্রশাসনকে লিখিতভাবে এই পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে বলে অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশের নাগরিক কি না, এমন প্রশ্নে তিনি স্বীকার করেন,হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশ থেকে এসে এসেছি। যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন আমার বাবা-মা ও শশুর-শাশুড়ি খান সেনাদের (পাকিস্তান সেনা) গুলিতে মারা যান।আমি স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসি। পরে আবার দেশে ফিরে যাই।কিন্তু অত্যাচারের কারণে বেশিদিন থাকতে পারিনি। ছেলেকে নিয়ে আবার ভারতে চলে আসি। মুসলমান অনুপ্রবেশ নিয়ে মুখে কুলুপ এটে থাকলেও বামপন্থী কৃষ্ণকান্তেরমতো
তৃণমূলে ও মিডিয়াতেও আত্মঘাতী হিন্দুরা রয়েছে এই অসহায় উদ্বাস্তুদের অন্তিম আশ্রয় থেকে উৎখাত করার জন্য। পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে এই
ক্ষিতীশরা ছড়িয়েরয়েছেন যারা তাদের শেষ আশ্রয় ভারতে থেকেও সপরিবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কায় দিন গুনছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে জন্মানোই
বাঙ্গালি হিন্দুর অভিশাপ। ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্ম হিন্দুদের জন্য এক মহা অভিশাপ হয়ে এসেছে। সংখ্যালঘুহিন্দুরা নিজ দেশেইনির্যাতিত, জমি-সম্পত্তিহারা, ধর্মান্তরণ এবং মেয়েরা বলপূর্বক অপহরণের শিকার।কিন্তু যখনই তারা ভারতে আশ্রয় চায়, তখনই প্রশ্ন ওঠে- ‘তোমাদের পূর্বপুরুষের নথি কোথায়?’
ইজরায়েলের মতো “The Law of Retur’আইন প্রয়োজন। ইজরায়েল ইছদিদের জন্য ‘ল অব রিটার্ন’আইন করেছে, যেখানে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের ইহুদি নথি ছাড়াই ইজরায়েলে নাগরিকত্ব পেতে পারে। কিন্তু হিন্দুদের জন্য এমন কোনো আইন নেই। ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এ লক্ষাধিক বাঙ্গালি হিন্দুশরণার্থী হয়ে ভারতে এলেও তাদের নাগরিকত্ব আজও অনিশ্চিত।
১৯৪৭-এ পকিস্তান সৃষ্টি: পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে।জমি দখল, জিজিয়া কর, ধর্মীয় হামলা শুরু হয়। ১৯৭১-এবাংলাদেশ স্বাধীন হলেও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার কমেনি। ভোটার লিস্ট থেকেনাম বাদ, জমি দখল, মন্দির ভাঙচুর এখনো চলছে। জনসংখ্যা হ্রাস:
মাত্র ৭ শতাংশ।
কেন এই ধরনের আইন প্রয়োজন?
১. নথিহীন শরণার্থীদের অধিকার: ১৯৭১-এ অনেক হিন্দু নথি ছাড়াই ভারতে এসেছে। তাদের নাগরিকত্ব দিতে এই আইন প্রয়োজন।
২. ধর্মীয় নির্যাতন থেকে মুক্তি: বাংলাদেশ-পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর জোরপূর্বক ধর্মান্তরণ, নারীদের অপহরণ চলছে। ভারতে আশ্রয় তাদের অধিকার।
৩.ইতিহাসের ঋণ শোষ:ভারত বিভাজনের সময়হিন্দুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন দেশের দায়িত্ব। ইজরায়েলের মতো ‘হিন্দুল অবরিটার্ন’প্রণয়ন করতে হবে, যেখানেবাংলাদেশ-পাকিস্তান থেকে আসা যেকোনো হিন্দুকে স্বয়ংক্রিয় নাগরিকত্ব দেওয়াহবে।
সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) একটি ভালো শুরু, কিন্তু তা শুধুমাত্র ২০১৪ সাল পর্যন্ত শরণার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করে। এই আইনের সময়সীমা বাড়ানো প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা হিন্দুদের নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টিকরা প্রয়োজন। হিন্দু বাঙ্গালিদের সুরক্ষায়’ল অবরিটার্ন’-এর আদলেআইন
প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা। ভারতবর্ষ বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে শত শত বছর ধরে হিন্দু ধর্ম ও বাঙ্গালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর
দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও প্রতিবেশী দেশগুলিতে (বিশেষত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) সংখ্যালঘুহিন্দুদের উপর নির্যাতনের ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালি হিন্দুকে তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
২০১৯সালেরনাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বাসিএএ কিছুটা সুরক্ষা দিলেও, এর কয়েকটি সীমাবদ্ধতা আজও হিন্দু বাঙ্গালিদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পথে বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিএএ আইনের প্রধান সীমাবদ্ধতা: তারিখের বাধা- শুধুমাত্র ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর মধ্যে ভারতে প্রবেশ করা হিন্দু, শিখ,বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টানরা এই আইনের সুবিধা পাবেন।
এর ফলে ২০১৪ সালের পরে যারা বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারের কারণে এসেছেন, তারা বাদ পড়ে যাচ্ছেন। প্রমাণপত্রের জটিলতা- ২০১৪ সালের আগে যারা এসেছেন, তাদেরও অনেকের কাছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বা বাসস্থানের সরকারি প্রমাণ নেই, ফলে তারা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারছেন না।
প্রশাসনিক বিলম্ব- অনেক রাজ্যে রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক কারণে আবেদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে।
ইজরায়েলের ল’ অব রিটার্ন: একটি কার্যকর মডেল: ইজরায়েল ১৯৫০ সালে ল’ অব রিটার্ন আইন প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকাইছদিরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইজরায়েলে এসে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার পায়। এই আইনে তারিখের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। প্রমাণের জন্য কেবল ইহুদি পরিচয়ের ভিত্তি থাকলেই যথেষ্ট।
এটি জাতি ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একটি নিরাপত্তা নীতি, যা ইহুদিদের সুরক্ষা দেয়।ভারতেহিন্দু বাঙ্গালিদের জন্য একই ধরনের আইন কেন প্রয়োজন ঐতিহাসিক দায়িত্ব বাঙ্গালি হিন্দুরা ভারতীয় সভ্যতা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। দেশ ভাগ ও তারপরে বারবার নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা ভারতে এসে নিয়েছেন,যা নৈতিকভাবে ভারত সরকারের রক্ষা করা উচিত।
জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সুরক্ষা: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল ও শহরে হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তারা যদি ভারতেও সুরক্ষাহীন থাকে, তবে একসময়হিন্দু বাঙ্গালি সংস্কৃতি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
সিএএ-র সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ:তারিখের শর্ত তুলে দিলে ২০১৪ সালের পরে আসা সমস্ত অত্যাচারিত হিন্দু বাঙ্গালিরাও নাগরিকত্ব পাবেন। জন্ম বা মাতৃভূমির প্রমাণ না থাকলেও জাতিগত পরিচয় ভিত্তিহিসেবে নেওয়া যেতে পারে, যেমন ইজরায়েল করে থাকে।
প্রস্তৰিত ‘ল’ অব রিটার্ন ফর বেঙ্গলি হিন্দুজ’ আইনের কাঠামো যোগ্যতা: যেকোনোহিন্দুবাঙ্গালি,যিনি বাংলাদেশ,পাকিস্তানবা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বাস করেন, ভারতবর্ষ এসে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন।
তারিখের সীমা নেই: যে বছরই আসুন না কেন, নাগরিকত্বের অধিকার থাকবে। পরিবারের অন্তর্ভুক্তি: স্বামী/স্ত্রী, সন্তান, নাতি- নাতনিরাও অন্তর্ভু হবেন।
তারিখের প্রক্রিয়া: ৬ মাসের মধ্যে নাগরিকত্ব প্রদান। জাতীয় সুরক্ষা ধারা: শুধুমাত্র গুরুতর অপরাধ বা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বাদ পড়বেন। ইজরায়েলের ল’ অব রিটার্ন আইনটি প্রমাণ করেছে যে জাতি ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মাতৃভূমিতে নাগরিকত্ব দেওয়া আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হতে পারে।ভারতযদি হিন্দু বাঙ্গালিদেরজন্য অনুরূপ আইন প্রণয়ন করে, তবে শুধু সংবিধানের নৈতিক দায়িত্বইপূর্ণ হবে না, বরং একটি সংকটাপন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্বও রক্ষা পাবে। এটি হবে মানবিকতা, ইতিহাস ও ন্যায়বিচারের মিলিত প্রতিফলন।
ল’অব রিটার্ন, ইজরায়েল, প্রণয়ন সাল: ১৯৫০ (পরে কয়েকবার সংশোধিতহয়েছে- ১৯৭০ সালে বড়ো সংশোধন হয়)।
১.উদ্দেশ্য: এই আইনটি ইজরায়েলের মূল আদর্শ ইহুদিদের জন্য মাতৃভূমি’ ধারণাকে আইনি রূপ দিয়েছে। ইহুদি জনগোষ্ঠী পৃথিবীরযেকোনো দেশে থাকুক না কেন, তারা চাইলে ইজরায়েলে ফিরে এসে বসবাস করতে এবং নাগরিকত্ব পেতে পারে- এই নীতিই এই আইনের ভিত্তি।
২.প্রধান ধারাগুলি: অধিকারভিত্তিক অভিবাসন (Aliyah): যে কোনো ইছদি ব্যক্তি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেইজরায়েলে এসে স্থায়ী হতে চাইলে, তাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আবেদন করার পর সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যে নাগরিকত্ব মঞ্জুর হয়। কে ‘ইছদি’হিসেবে গণ্য হবেন যার মা ইহুদি অথবা, যে ব্যক্তি ইহুদি মতে দীক্ষিতহয়েছেন (conversion to Judaism) এবং অন্য কোনো মতে দীক্ষিত হননি। পরিবার-সংশ্লিষ্ট অধিকার ইহুদি ব্যক্তির স্ত্রী/স্বামী ইহুদিব্যক্তির সন্তান ও নাতি-নাতনি তাদের স্বামী/স্ত্রী, এই পরিবার সদস্যরাও ল’ অব রিটার্ন আইনের অধীনে নাগরিকত্ব পেতে পারেন, যদিও তারা নিজেরা ইহুদি নাও হতে পারেন।
নাগরিকত্বের প্রক্রিয়া: অভিবাসন প্রক্রিয়াকে হিব্রু ভাষায় বলে ‘আলিয়াহ’। আবেদনকারীকে প্রমাণ দিতে হয় যে তিনি/তিনি বা তার পূর্বপুরুষ ইহদি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রযাচাইয়ের পর তাকে ইজরায়েলে স্থায়ী বসবাসের অধিকার ও নাগবিকত্ব দেওয়া হয়।
৩. সীমাৰদ্ধতা: ল’ অব রিটার্ন আইন অনুযায়ী, নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানানো যেতে পারে যদি আমেবদনকারী ইজরায়েলের নিরাপত্তার জন্য ছমকি হন।
আবেদনকারী অপরাধমূলককর্মকাণ্ডে জড়িত থাকেন এবংল গুরুতর অপরাধের জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত হন। আবেদনকারী জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হন।
৪. ১৯৭০ সালের সংশোধনী: ১৯৭০ সালের সংশোধনীতে ‘ইহুদি’ শব্দের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়; যে ব্যক্তি ইছদি পরিবারে জন্মেছেন এবং অন্য কোনো মতেদীক্ষিত হননি। ধর্মান্তরিত ইছদিরাও নাগরিকত্ব পেতে পারেন যদি তারা ইহুদি মতে দীক্ষিত হয়ে থাকেন এবং অন্য কোনো মতে দীক্ষিত না হন। নাতি-নাতনি পর্যন্ত রক্তসম্পর্কে নাগরিকত্বের যোগ্যতা বিবেচিত হয়।
৫. অন্যান্য দেশের সঙ্গে পার্থক্য: অধিকাংশ দেশে নাগরিকত্ব জন্মস্থান বা দীর্ঘকাল বসবাসের উপর ভিত্তি করে হয়।কিন্তু ইজরায়েলের ল’অবরিটার্নজাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়কে ভিত্তি করে তৈরি। এর ফলে, বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশে জন্মানো ইছদিরা নাগরিকত্বের অধিকার পায়, যদিও তারাআগে কখনো ইজরায়েলে বসবাস না করে থাকেন।
ল’ অবরিটার্ন আইনটি ইজরায়েল দেশের অস্তিত্বের অন্যতম মূল স্তম্ভ। এটি পৃথিবীর সমস্ত ইহুদি জাতিরজন্য একটিনিরাপদ আশ্রয়নিশ্চিতকরে, যাতে কোনো দেশ বা অঞ্চলে নিপীড়ন বা বিপদের মুখে পড়লে তারা ইজরায়েলে এসে নিজের মাতভূমিতে বসবাস করতে পারেন।।