জাতি-জনজাতির মিলনক্ষেত্র শ্রীশ্রী মাত্রিপুরেশ্বরী
অপু সাহা।
সেই আনন্দঘনময় দিন। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিক মাসের অমাবস্যায় মা ত্রিপুরেশ্বরীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মন্দিরটি একান্ন পীঠের এক পীঠ। পুরাণমতেশিব যখন সতীদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন, তখন শ্রীবিষ্ণু সুদর্শনচক্র দ্বারা সতীদেহকে খণ্ডবিখণ্ড করেন। সতীদেহের পবিত্র অংশ যে স্থানে পতিত হয়েছিল, সেই সকল স্থান মহাপীঠে পরিণত হয়। পীঠমালা তন্ত্রানুসারে- ‘ত্রিপুরায়াং দক্ষপাদো দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী।
ভৈরব্রস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বাভীষ্ট প্রদায়কঃ।।’ অর্থাৎ, ত্রিপুরায় সতীর দক্ষিণ পদ পতিত হওয়ায়, সেখানে পীঠদেবী ত্রিপুরাসুন্দরী বিরাজমান। উদয়পুর নগরে
ভৈরবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত।
মন্দির প্রাঙ্গণের আকৃতি কুর্ম অর্থাৎ কচ্ছপের মতো, সেজন্য এই পীঠ কুর্মপীঠ নামেও পরিচিত। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কত রাজা, মহারাজা চলে গেলেন, মন্দিরের কত পরিবর্ধন ও পরিবর্তন হলো, কিন্তু মা একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন।মায়ের পূজার রীতিনীতি একই পদ্ধতিতে চলমান।
উদরপুরে মা ত্রিপুরেশ্বরীকে প্রতিষ্ঠা করার আগে যে স্থান থেকে আনা হয় তার বর্তমান স্থল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের নিকটবর্তী বরাককুণ্ড। শ্রীকৃষ্ণ দেওয়ান
রচিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুররাজ ধন্যমানিক্য চট্টগ্রামের সদরঘাট হতে মা মাগধেশ্বরীর মূর্তিনিয়ে উদয়পুরে স্থাপন করার উল্লেখ রয়েছে। এই তথ্যানুসারে জানা যায়, ত্রিপুরেশ্বরীর আদি নাম ছিল মাগধেশ্বরী। উদয়পুরে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নাম হয় শ্রীশ্রীত্রিপুরেশ্বরী। ৫০০ বছর আগে থেকে এই পীঠস্থানটি সকল স্তরের মানুষের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
মন্দিরেরইতিহাস: উদয়পুর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটি। মন্দিরটি কচ্ছকাকৃতি। মন্দিরের মূল ফটক পশ্চিমদিকে। তারপর চাতাল,
আবার সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের মূল চাতালে প্রবেশ করতেহয়। মন্দিরের উত্তর দিকে একটি দরজা আছে। উত্তর দিকের মূল ফটকের পরেই আছে শিবমন্দির। তবেশিবলিঙ্গটিভৈরবের নয়। মন্দির থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে ভৈরবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত।
মন্দিরের বর্ননা: প্রথমটি বলিঘর। দ্বিতীয়টি নাটমন্দির। সর্বশেষ মায়ের গর্ভগৃহ। সত্ত্ব, রজ, তম-এই তিন গুণের ভিত্তিতে মন্দিরটি ভাগ করা হয়েছে বলে মনে করাহয়। এই তিন গুণেই মা গুণাতীত। প্রথমেই বলিঘর যা তমোগুণের প্রতীক। দ্বিতীয় অংশটি নাটমন্দির যেটি ব্রজমন্দির নামে পরিচিত। এখানে মায়ের আরাধনা, সংগীত, স্তোত্র পাঠ করা হয়। সর্বশেষ মায়ের গর্ভগৃহ যেটি সত্ত্বগুণের আধার।
মূল মন্দিরের গঠনটি নয়নাভিরাম। মন্দিরের গঠন ত্রিপুরার নিজস্ব স্থাপত্যের প্রকাশ। চারচালাকৃতি দেবালয়, সম্পূর্ণ পোড়া মাটির তৈরি। গর্ভগৃহের উভয়পাশে একটি করে দরজা আছে। মন্দিরের ভেতরের পরিমাপ ১৬ × ১৬ ফুট। বাইরের পরিমাপ ২৪ x ২৪ ফুট। চারপাশের দেয়াল ৮ ফুট চওড়া। উচ্চতা ৭৫ ফুট।মন্দিরের উপরের গম্বুজ বৌদ্ধরীতি অনুকরণেনির্মিত। এর উপর সপ্তকলস। তার উপরে ধ্বজ্রদণ্ডে পিতলের পতাকা শোভমান।
পশ্চিম দিকের দরজা ব্যবহৃত হয় মায়ের দর্শনের জন্য। নাট মন্দির থেকে মায়ের অপরূপ দর্শন পাওয়া যায়। দেবী: মায়ের প্রতিমাটি কষ্টিপাথর দিয়ে নির্মিত। বিগ্রহটি উচ্চতা ১ মিটার ৫৭ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ৬৪ সেন্টিমিটার। দেবী শায়িত শিবের বুকের উপর পা দুটি স্থাপন করে দাঁড়িয়ে আছেন। দেবীর চার হাত। বাঁ দিকের উপর হাতে খঙ্গা এবং নীচের হাতে অসুর মুণ্ড। ডান দিকের উপর হাতে বরমুদ্রা এবং নীচের অভয়মুদ্রা। মুখমণ্ডল লম্বাটে, চোখ
দুটি তুলনামূলকভাবে ছোটো। নাক চ্যাপ্টাকৃতি ও ছোটো। মাথায় মুকুট ও জটারাশি।
মাতৃপূজাঃ সম্পূর্ণ তন্ত্রমতেই দেবীর পূজার্চনা হয়। মন্দিরটি ৫০০ বছরের অধিকাল পুরনো হলেও পূজার্চনার নিয়মাবলী অপরিবর্তনীয়। প্রথমে মঙ্গলারতি, তারপর একে একে বাল্যভোগ, মাতৃস্নান, মাতৃপূজা, বলি (ঐতিহ্য অনুযায়ী দশমী তিথিছাড়া প্রতিদিন বলি হয়), অঞ্জলি, অম্লভোগ। মন্দিরের গর্ভগৃহ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এরই মাঝে অন্নভোগ বিতরণ করা হয়, সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি (১ বৈশাখা থেকে ৩১ আশ্বিন পর্যন্ত সন্ধ্যা ৭টা এবং ১ কার্তিক থেকে ৩ চৈত্র পর্যন্ত সন্ধ্যা ৬ টায়) এরপর শীতল ভোগ, সর্বশেষ শয়নারতি।
বিশেষ পূজার্চনাঃ নিত্য পূজার পাশাপাশি বিশেষ তিথিতে বিশেষ পূজা করা হয়।
দীপাবলী: দীপাবলির সময় মন্দিরের চারপাশে উৎসবমুখর হয়ে উঠে। সেই দিন দুটি পূজা দেওয়া হয়।
প্রথমেনিশি পূজা। নিশি পুজান্তে দীপাবলী পূজা। এই মনোরম অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার জন্য রাজ্য, বহিঃরাজ্য ও অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। এছাড়াও অষ্টমী পূজা, মহালয়া এবং প্রতি মাসের অমাবস্যায় বিশেষ পুজা করা হয়। পরিচালন ব্যবস্থা: আগে মন্দির পরিচালন করার অধিকারছিল
রাজ পরিবারের হাতে। কিন্তু বর্তমানে রাজ্য সরকার মন্দির পরিচালনাকরে। মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির উন্নয়ন কমিটি এবছরের ২১ মে থেকে ‘মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির উন্নয়ন কমিটি’তে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ট্রাস্টের চেয়ারম্যান পদে আসীন।
মাতাবাড়ীর পেড়া: মাতাবাড়ীর পেড়ার বিশেষ গুণ রয়েছে। এই পেড়া স্বাদে যেমন সুস্বাদু তেমনি অনেকদিন রাখা যায়। নষ্ট হয় না। রাজ্যের কোথাও এমন সুস্বাদু পেড়া পাওয়া যায় না। মাতাবাড়ীর অন্যতম আকর্ষণ এই পেড়া। প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই পেড়ার ব্যবসা চলে আসছে।
কল্যাণ সাগর: মন্দিরের পূর্বদিকে এই বিশাল দীঘিটি রয়েছে। এই দীঘিটি মহারাজা কল্যাণ মাণিক্যের (১৬২৫-১৬৬০ খ্রিঃ) আমলের। এইদীঘিটি ৬.৪ একর জুড়ে রয়েছে, দৈর্ঘ্যে ২২৪ গজ এবং প্রস্থে ১৬০ গজ। এই দীঘিটি মন্দিরের সৌন্দর্যায়নে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। দীঘিটির চারপাশ বাঁধানো। এই দীঘিটি কচ্ছপ, মাছ ও অন্যান্য প্রজাতির জলজ প্রাণীতে পরিপূর্ণ।ভক্তরা এইসব জলজ প্রাণীদের দীঘির পাড় থেকেবিস্কুট, মুড়ি ইত্যাদি কিনে খাওয়ান। কথিত, কল্যাণ সাগরের কচ্ছপরা মৃত্যুর সময় সিঁড়ি বেয়ে মায়ের মন্দিরে উঠে মৃত্যুবরণ করে।
মন্দির সংস্কার: মায়ের প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশ কয়েকবার মন্দির সংস্কার করা হয়। ১৬৮১ সালে একবার সংস্কার করা হয়। তাছাড়া উদয় মাণিক্যের রাজত্বকালে মন্দির সংস্কার করা হয়। তাছাড়া ১৭৭৯ সালে এবং ১৯০৪ সালে রাজা রাধাকিশোর মাণিক্য কর্তৃক মন্দির সংস্কার করা হয়। বর্তমানে স্বদেশ দর্শন (।।) এবং প্রসাদ প্রকল্পের মাধ্যমে মাতাবাড়ি উন্নয়নের কাজ চলমান।
জন্মলগ্ন থেকেই মাতাবাড়ি সম্প্রতিরমিলন ক্ষেত্র। যুগ যুগ থেকেই জাতি-জনজাতি উভয়ের মিলন ক্ষেত্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।