মণিপুরী হলেও ত্রিপুরী সংস্কৃতির অঙ্গ লাইনিংথৌ পাংখাবা মন্দির
ইন্দ্রজিৎ সাহা
রাজন্য ত্রিপুরায় প্রতিষ্ঠিত লাইনিংথৌ পাখাংবা বা পাগলা দেবতা মন্দির মোটর স্ট্যান্ডের একটু আগে অবস্থিত। এটিত্রিপুরায় একখণ্ড মণিপুর। ত্রিপুরায় রাজপরিবার মণিপুর রাজপরিবারে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যের মণিপুরী রানিরা তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ত্রিপুরার সংস্কৃতিতে যুক্ত করেছিলেন, তার একটি নিদর্শন এই মন্দির।
পাখাংবা মণিপুরী মেইতেই জনগোষ্ঠীর একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। তিনি প্রাচীন সর্প-ড্রাগন দেবতাহিসেবে পরিচিত। এই দেবতা মহাজাগতিক শক্তির প্রতীক।
পাংখাবাকে মেইতেই জনগোষ্ঠীর একজন আদিম দেবতা হিসেবে ধরা হয়। তবে মণিপুরীদের দেবতা পাখাংবা সাধারণত মন্দিরে পুজিত হন না।
এই লাইনিংথেী পাখাংবা মন্দির বা পাগলা দেবতা মন্দির প্রতিষ্ঠার পেছনে একটি কাহিনি আছে। ত্রিপুরার রাজপরিবারে রাধাকিশোর জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ায় মহারাজ
বীরচন্দ্র মাণিক্য তাকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন।কিন্তু সমরেন্দ্রনাথের প্রতি মহারাজ যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন। পাত্র-মিত্রদের বুঝিয়েদিতেন যে তার
প্রিয়তমা পত্নী ভানুমতীর গর্ভের সন্তান সমরেন্দ্রনার্থই তাঁর অধিক প্রিয়।কলকাতার সফরে অধিকাংশ সময় তিনি সমরেন্দ্রনাথকেই সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মাতা রাজেশ্বরী তা বুঝতেন। নিংথৌজা রাজবংশের রাজারা পাখাংবাকে তাদের পূর্বপুরুষ এবং প্রধান দেবতা হিসেবে মনে করতেন। মাতা রাজেশ্বরী যুবরাজ রাধাকিশোরের ভবিষ্যতের অমঙ্গল চিন্তায় পাখাংবা দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। পরবর্তী সময়ে রাধাকিশোর রাজা হলে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি পাখাংবা দেবতার পূজা দেন। সেই সময়েই মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য এই মন্দিরটি নির্মাণ করে পাখাংবা দেবতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। তবে অনেকে মনে করেন মহারানি রাজেশ্বরীই পাখাংবা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দিরটির গঠনশৈলী অনেকটা ত্রিপুরার অন্যান্য মন্দিরের রীতিতেই গড়া। মন্দিরটির চূড়ায় রয়েছে একটি সর্পপ্রতীক। মন্দিরে বর্তমানে দেবতা পাখাংবার যে মূর্তি আছে তা পিতলের তৈরি। মূর্তিটি রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহের সৃষ্টি। বুদ্ধিমন্ত সিংহ ‘ত্রিপুরার মনিপুরী নৃত্যশিল্পী এবং শান্তিনিকেতনের শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। মন্দিরে প্রতি শুক্রবারে পূজা হয়। তবে পাখাংবার সঙ্গে মন্দিরের সিংহাসনেলাইসানা লাইরাংবিকেও পূজা করা হয়। এ পূজার নৈবেদ্যর থালায় আস্ত ফলমূলই থাকে। এ পূজায় ফলমূল কেটে দেওয়ার রীতি নেই।
প্রতি শুক্রবারের পূজার নৈবেদ্য থালায় কোনো অন্নভোগ দেবারও কোনো রীতি নেই। নেই বলিপ্রথাও। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে মন্দিরের মূল দরজা বন্ধই থাকে। মূল মন্দিরেরসামনেই রয়েছে শিবমন্দির, যা পাগলা দেবতা মন্দিরেরই অংশবিশেষ। শিবমন্দিরে প্রতিদিনইপূজা হয়। পাগলা দেবতা মন্দিরের প্রবেশ
পথেই নুংজেম পোখরি নামক একটি বড়ো জলাশয়ও রয়েছে,যা মন্দিরে একটা বিশেষ আধ্যাত্মিক ছোঁয়া আনে। মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস, পাখাংবা এই পবিত্র পুকুরের তলদেশ দিয়ে এই মন্দিরে যাতায়াত করেন। মণিপুরের কাংলা দুর্গে অবস্থিত নুংজেম পোখরি নামক পবিত্র পুকুরেই পাখাংবা দেবতার বাসস্থান রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে মহাআড়ম্বরে মন্দির প্রাঙ্গণে মণিপুরী ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘লাইহারোবা’ পালিত হয়, যা শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। এই সময় পাখাংবা দেবতার কাছে নৈবেদ্যর থালায় অন্নভোগও নিবেদন করা হয়। এ সময় পাখাংবা দেবতার অনুচরদের উদ্দেশ্যে কাঁচা মাছও নিবেদন করা হয়। উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরায় প্রথমবারের মতো এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি প্রবর্তন করেছিলেন মহারানি রাজেশ্বরী।
পাখাংবা মেইতেই সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তার পূজা মণিপুরী সমাজে প্রচলিত। পাখাংবা দেবতার এ মন্দিরটি পাগলা দেবতার মন্দির নামেই অধিক পরিচিত।কিন্তু এই নামকরণের কারণ কী, তা জানা যায় না।