অগ্নিযুগের বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ
দীপক খাঁ
শ্রী অরবিন্দ অনুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এক বিশিষ্ট সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁকে বিপ্লবীযুগের এক অগ্নিপুরুষ বলা হয়। বারীন্দ্রকুমারের বাবা ইয়ং বেঙ্গলের উত্তরসাধক ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ।সুচিকিৎসক হিসাবেযথেষ্ট সুখ্যাতিছিল তাঁর।বারীন্দ্রকুমারের মাস্বর্ণলতা দেবী যিনি আরার মন্ত্রদ্রষ্টা মনীষী রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। জাতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোর বারীন্দ্রকুমার এমন কিছু বিশিষ্ট শিক্ষকের সম্পর্শে আসেন যাঁরা জাতীয়তাবোধের আদর্শ। তাঁদের মাধ্যমেই বারীন্দ্রকুমার পরাধীন ভারতবর্ষের শোচনীয় অবস্থার কথা জানতে পারেন। বারীন্দ্রের অন্তরঙ্গ সহচররা বলে থাকেন, বারীন্দ্র চুপচাপ বসে থাকতেন, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, সবসময় তার মনের মধ্যে কী একটা ব্যাকুলতা,আমাদের মতো অহেতুক ছেলেমানুষি হই-হুল্লোড় মত্ত
থাকতেন না।
তখন শ্রীঅরবিন্দ ইংল্যান্ড থেকে ফিরে বরোদায় অধ্যাপনা করছেন। যশস্বী মহলে যথেষ্ট সম্মান আছে তাঁর। ভাই বারীন্দ্রকুমার দাদার কাছে আসেন ব্যবসার মূলধনের আশায়। বারীন্দ্রকুমার শ্রীঅরবিন্দের সংস্পর্শে এসে একেবারেই পালটে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তিত হয়-তিনি বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
বর্ধমান জেলার চান্না গ্রামের বীরযুবক যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরাজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন-পরবর্তীকালে তারইনাম হয় নিরালম্ব স্বামী। যতীন্দ্রনাথ বরোদায় এসে সৈন্য বিভাগে কাজ নিলেন। গোপনে মিলিটারি ট্রেনিং নিয়ে নিজেকে বৈপ্লবিক আন্দোলনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। তারই প্রভাবে
অরবিন্দ বৈপ্লবিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারতে আবির্ভূত হলেন। বারীন্দ্রকে তিনি তাঁর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন।বারীন্দ্র দাদার আদেশকে শিরোধার্য করে সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা এলেন।
মানিকতলার মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে যুগান্তর দলের গোপন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বারীন্দ্র এসে এই কেন্দ্রের দায়িত্ব হাতে নিলেন। অবিনাশ ভট্টাচার্য, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,হৃষীকেশ কাঞ্জিলালদের সঙ্গে নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করে তুললেন। বারীন্দ্রের কাজ ছিল বিভিন্ন শাখার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা, শুধু তাই নয়, গুপ্ত সমিতিগুলিকে লাঠি খেলা, তলোয়ার চালনা, সাইকেল চালানো, অশ্বারোহণ, বক্সিং, বন্দুক ছোঁড়া প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হতো। কিছুদিন বাদে যতীন্দ্র রসঙ্গে বারীন্দ্রের দ্বন্দ্বদু দেখা দেয়। অরবিন্দ কলকাতায় এসে এই সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে ছিলেন।
পূর্ববঙ্গের লেফটেনান্ট গভর্নর ফুলার ছিলেন খুবই অত্যাচারী। তার নির্দেশে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত বহুমানুষ নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছিলেন। বারীন্দ্রের ওপর একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়, যে করেই হোক ফুলারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে।তিনি রংপুরে গেলেন। প্রফুল্ল চাকী নামেএক তরুণ বিপ্লবীর
ওপর এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো- কিন্তু চেষ্টাকরেও তিনি বিফল হলেন, বারীন্দ্রর আর একটি গুরুত্বপূর্ণকাজ হলো, মজফ্রপুরের ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করা। এজন্য ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীকে নির্বাচন করা। এ কাজে তাঁরা সফল হন নি। মৃত্যুবরণ করে ভারতেরবুকে প্রবল চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন।
ইংরাজ সরকার কুখ্যাত দমননীতি প্রয়োগ করল। একটির পর একটি গুপ্ত ঘাঁটিতেঅভিযান চালাল।
মানিকতলার মুরারি পুকুর বাগানে গুপ্তঘাঁটি পুলিশ আবিষ্কার করল। পাওয়া গেল বোমা তৈরির যন্ত্রপাতি, ডিনামাইট, বন্দুক, পিস্তল, রাইফেল এবং বিভিন্ন বই ও কাগজপত্র।অনেক বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার মধ্যে অরবিন্দ, বারীন্দ্র, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, নরেন গোঁসাই, চারুচন্দ্র রায়, অবিনাশ ভট্টাচার্য সমেত চৌত্রিশ জন।
এই মামলা আলিপুর বোমার মামলানামে খ্যাত হয়। এই মামলা চলাকালীন বারীন্দ্র পুলিশের কাছে একটি সাহসোচিত স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে বারীন্দ্র দেশের জনগণের চোখে বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। ফল হলো উল্টো জনগণের চোখে এই স্বদেশী নায়করা হলেন ডাকাত-ইংরাজরা সুকৌশলে এই অপপ্রচার করেছিল।
বারীন্দ্র আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। তিনি অরবিন্দকে আলাদা রাখলেন। তিনি জানতেন অরবিন্দ দেশের সম্পদ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অক্লান্ত চেষ্টায় বিচারে অরবিন্দ মুক্তিলাভ করেন। ইতিমধ্যে তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তখন তিনি ঋষি হিসাবে আবির্ভূতহয়েছেন। শেষ অবধি বারীন্দ্রের মৃত্যুদণ্ড হয়। তার মৃতুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। এখানে মৃত্যুদণ্ডের বদলে সাজা দেওয়া হয় যাবজ্জীবন দীপান্তর-তাঁর সঙ্গে উল্লাসকর দত্তকেও দেওয়া হয় দ্বীপান্তর।
বারীন্দ্র কুমার ১৯০৯-১৯২০ সাল পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯২০ সালে বারীন্দ্রকুমার মুক্তি পান।তারপর পণ্ডিচেরীতে শ্রীঅরবিন্দের আশ্রমে বেশকিছুদিন ছিলেন। ১৯৫০ সালে হয়েছিলেন দৈনিক বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক। বারীন্দ্র কুমারের লেখা একাধিক গ্রন্থ বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। যেমন- ‘অগ্নিযুগ’, ‘ঋষি রাজনারায়ণ’, ‘দ্বীপান্তরেরবাঁশি’, ‘আমার আত্মকথা’, ‘দ্য টেল অফ মাই এক্সাইল’ এবং ‘শ্রী অরবিন্দ’ ইত্যাদি।
১৯৫৯ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতমাতার দামাল ছেলে মহানবিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ অমৃতলোক গমন করেন।