ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার শুল্কযুদ্ধঃ সমস্যা ও প্রতিকার
আজ সময় এসেছে আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আজও যদি আমরা একই রকমভাবে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নিতে পারি এবং আমেরিকার পণ্য পরিষেবাকে সর্বাত্মকভাবে বয়কট করতে পারি তাহলে ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।
অম্লান কুসুম ঘোষ
একটি নিস্তরঙ্গ জলাশয় যেমন হঠাৎ করে তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে কোনও একটি আকস্মিক আঘাতের অভিঘাতে, সেরকমইবর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অঙ্গন তরঙ্গবিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার সাম্প্রতিক শুল্কযুদ্ধ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে।
শুল্ক যুদ্ধ কী? আমেরিকা সরকার বর্তমানে ঘোষণা করেছে ভারত থেকে আমেরিকায় রপ্তানি হওয়া প্রতিটি পণ্যের ওপর তারা প্রচুর পরিমাণে শুল্ক ধার্ষ করবে, এই ঘটনাটিকেই বলা হচ্ছে আমেরিকার শুল্কযুদ্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এজিনিস শুধু আমেরিকা ভারতের সঙ্গে করছে তানয় অনেকগুলি দেশেরবিরুদ্ধেই তারা শুল্কযুদ্ধ শুরুকরেছেতবে ভারতের বিরুদ্ধেই তাদের আস্ফালন সর্বাধিক।আপাতদৃষ্টিতে মনেহতে পারে যে কোনো দেশ অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর কত শুল্ক বসাবে তা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে এক্ষেত্রে আমেরিকার অন্যায় কিছু নেই কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়, শুল্কযুদ্ধকী তাজানতে গেলে আমাদেরফিরে যেতে হবে বেশ কিছুটা পথ।
দীর্ঘদিন ধরে গোটা পৃথিবীর বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি তার পুতিগন্ধময় অস্তিত্ব নিয়ে মহাকালের আস্তাকুঁড়ে বিদায় নেবার পরপরই গত শতকের নব্বই দশকের গোড়ার দিকে যখন ডব্লিউটিও স্থাপিত হয়েছিল, সে সময় স্থির হয়েছিল এক বিশেষ শুল্ক নীতি। স্থির হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যারা ডাব্লিউটিওর অন্তর্গত হচ্ছে তাদের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চলবে এবং এই মুক্ত বাণিজ্যের ওপর যথেচ্ছ শুল্ক বসানো চলবে না। এই
বাণিজ্য নীতিতে কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের পণ্য আমদানিতে কতখানি শুল্ক বসাতে পারবে তাও নির্ধারিত করা হয়েছিল।অর্থাৎ ভারত আমেরিকাতে পণ্য রপ্তানি করলে তার ওপর আমেরিকা কত শতাংশ আমদানি শুল্ক বসাতে পারবে এবং ভারতে পণ্য রপ্তানি করলে ভারত তার ওপর কত শতাংশ আমদানি শুল্ক বসাতে পারবে তা নির্ধারিত হয়ে গেছিল সেই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হবার সময়ই এবং স্থির ছিল যে এই চুক্তির বেশি শুল্ক কোনো দেশ বসাতে পারবে না।
এই চুক্তি অনুযায়ী শুরু হয়েছিল নতুন দুনিয়ার মুক্ত বাণিজ্য নীতি, মুক্ত অর্থনীতি, বিশ্বায়িত অর্থনীতির এই পথ চলা। সেই পথ চলার সাড়ে তিনদশক অতিক্রম করে এখন ডব্লিউটিও’র প্রবক্তা দেশ আমেরিকা নিজেইভাঙতে চলেছে তাদের নিজেদেরই প্রবর্তিত সেই চুক্তি অনুযায়ী স্থিরীকৃত শুল্কনীতি। তাদের বক্তব্য, ভারত থেকে তাদের দেশে আমদানি হচ্ছে অনেক বেশি, তুলনায় তাদের দেশ থেকেভারতে রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম, তাই তারা ভারতথেকে যেকোনো পণ্য বা পরিষেবা আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসাবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ডব্লিউটিওর স্রষ্টা দেশ আমেরিকা, চুক্তিপত্র নির্মাণের আগে তারা ভাবেনি যে এরকম ঘটতে পারে,ভারত তাদেরকে বাণিজ্যে পরাজিত করতে পারে। তাহলে তারা তখন চুক্তি করল কেন?
প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে আছে এক অমোঘ সত্য। সাড়ে তিন দশক আগে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় যখন এই ডব্লিউটিও চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল সেই সময়কার বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি এবং ভারত ও আমেরিকা এই দুই দেশের পারস্পরিক অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।তৎকালীন প্রযুক্তিতেউন্নত আমেরিকা মনে করেছিল তৎকালীন প্রযুক্তিতে অনুন্নত ভারতকে তারা সহজেই বাণিজ্যযুদ্ধে পর্যুদস্ত করতে পারবে এবং ভারতেরবিশাল বাজারকে তারা কুক্ষিগত করতে পারবে। বিশেষত পরিষেবা নির্ভর বাণিজ্যজগতের নতুন বাহন হিসেবে তখন সে সময় বিশ্ববাজার মাত করে রেখেছিল কম্পিউটার এবং কম্পিউটারনির্ভর
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প।কম্পিউটারের ব্যবহার এবং কম্পিউটার নির্ভর তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের উপর আমেরিকার দখল তখন প্রশ্নাতীত,আর ভারত তখন কম্পিউটারের ব্যবহারে একেবারেই অনভিজ্ঞ।তথ্য প্রযুক্তি বিষয়টিই তো ভারতের ছাত্র ও শিক্ষকরা প্রায় কেউই জানেন না। শিল্প ও বাণিজ্যের পরিকাঠামোগত অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভারত তখন আমেরিকার থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল।আমেরিকা এটারই সুযোগ নিয়েছিল,তারা ভেবেছিল ভারতীয়দের এই অনভিজ্ঞতার সুযোগ
নিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিকে শোষণ করে ছিবড়ে করে দেবে।কিন্তু ৯০ দশকের শেষ ভাগ থেকেই সময় চক্র ঘুরেছিল এবং পরিস্থিতি বদলে ছিলশিক্ষা ব্যবস্থার। ৯০ দশকের শেষের দিকে তৎকালীন ভারত সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ফলে ভারতীয় ছাত্ররা কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত দক্ষতা লাভ করে এবং আমেরিকাকেও অনেকাংশে ছাপিয়ে যায়। পাশাপাশি তৎকালীন ভারত সরকারের উন্নততর পরিকাঠামো নির্মাণের সুবাদে ভারতের অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নতি হয় এবং তারাও আমেরিকার বাজার দখল করতে অনেকটাই সফল হয়। এই সব কারণেই বিগত তিন সাড়ে তিন দশক ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাপকাঠিতে ধীরে ধীরে ভারতের কাছে পরাজিত হয়েছে আমেরিকা এবং ভারত সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে। তাই এখন প্রত্যেক বছরই ভারতের আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকে আর এই জিনিসটি আমেরিকার স্বার্থ চিন্তায় ঘা দিয়েছে এবং সেই জন্যই তারা ভারতের বিরুদ্ধে এই নিম্নমানের শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছে। অর্থাৎ ভারতকে শোষণের জন্য বানানো ডব্লিউটিও’র চুক্তিপত্র অনুযায়ী ব্যবসা করেও তারা ভারতের সঙ্গে পারছে না তাই ভারতের বাণিজ্যের অগ্রগতিকে থামানোর জন্য নিজেদেরদ্বারাই স্থাপিত ডব্লিউটিও’র নিয়ম বহির্ভূত শুল্ক নিজেরাই বসানো শুরু করেছে। অর্থাৎ নিজেদের তৈরি নিয়ম নিজেরাই ভাঙছে নিজেদের স্বার্থে অন্যায়ভাবে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার এই অন্যায় শুল্কের প্রাচীর গড়ে তোলার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্র, ব্যাহত হবে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার উপার্জন। ভারতের কর্মসংস্থানের সংকোচন ঘটবে এবং সামগ্রিকভাবে আঘাত আসবে ভারতীয় অর্থনীতিরবিকাশের উপর। তাই আমাদের দেশের উন্নততর ভবিষ্যতের স্বার্থেই এই শুল্ক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
এই শুল্কযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কীভাবে গড়ে তুলতে হবে? প্রতিরোধের আছে একটাই পথ, সেটা হলোস্বদেশী।স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ এবং বিদেশি দ্রব্য বর্জন। এই মন্ত্রেই আজআমেরিকার বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। সমস্ত রকম আমেরিকান পণ্য বয়কট করা যেকোনো দেশপ্রেমিক ভারতীয়রই এখন কর্তব্য।দুধ,দইকে থালাতে স্থানদিয়ে পেপসি,কোলাকে নালাতে ফেলা এখন সময়ের দাবি। ম্যাকডোনাল্ড কে এফ সি’র খাবার আর কিনলে’র পানীয়- এসবের মোহ থেকে মনকে মুক্ত করে শুধুমাত্র স্বদেশী পণ্যের দিকেই আস্থারাখা দরকার এবং তার সঙ্গে দরকার ভীষণভাবে আমেরিকানই-কর্মার্স কোম্পানিগুলিকে বয়কট করা অর্থাৎ আমাজন, ফ্লিপকার্ট এগুলিকে বয়কট করা। এই কোম্পানিগুলি রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের মতো ভারতীয় অর্থনীতিকেশোষণ করতে চায়। খুব সস্তায় তারা বহু পণ্য সরবরাহ করে ভারতের ঘরগুলিতে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রের এই পণ্যগুলি তারা কোনও ভূয়ো ভারতীয় কোম্পানির নামেই দেখায় এবং সেই কোম্পানিশুলির ৪৯ শতাংশ শেয়ার তাদের নিজের হাতে রাখে। প্রয়োজনে নিজেদের লাভ বাদ রেখেবা একটু ক্ষতি স্বীকারকরেও তারা সস্তায় পণ্য ভারতের ঘরগুলিতে বিক্রি করে এবং ভারতীয় পরিবারগুলিও ধীরেধীরে তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এর ফলে বিপদে পড়ছে সাধারণ দোকানদাররা। এর ভবিষ্যৎ কিন্তু ভয়াবহ হবে। দোকানদাররা ব্যবসা না চালিয়ে যখন দোকান গুটিয়ে নেবে তখন খুচরো জিনিস কেনার জন্য সম্পূর্ণভাবেই আমাজন বা ফ্লিপকার্ডের উপরে নির্ভর করতে হবে সাধারণ ক্রেতাদের এবং তখন কিন্তু এরা প্রচুর দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্তকরে ছাড়বে। সে কারণেই আমেরিকান ই-কমার্স কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বয়কট চালানো দরকার।
ব্রিটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশী যুগে ভারতবাসী স্বদেশী গ্রহণ বিদেশি বর্জন, বিদেশি পণ্য বয়কট ব্রিটিশ পণ্য বয়কট ধ্বনি দিয়ে এই চিন্তাভাবনার উপর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং সেই প্রতিরোধের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল ব্রিটিশ শক্তিকেও। চীনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অতীতে আমরা এইরকম
প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। আজ সময় এসেছে আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধেপ্রতিরোধ গড়ে তোলার। আজও যদি আমরা একই রকমভাবে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নিতে পারি এবংআমেরিকার পণ্য পরিষেবাকে সর্বাত্মকভাবে বয়কট করতে পারি তাহলে ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন
লবে।