শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য
আটশত বৎসরের ইসলামি শাসন এবং দুইশত বৎসরের ব্রিটিশ শাসনেও বঙ্গপ্রদেশে,বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষায় এত দুর্দিন বোধ হয়আসে নাই। স্বাধীন ভারতেপশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্র ও স্বজনপোষণের শুরু বাম শাসনকালে হইলেও তাহার অন্তর্জলিযাত্রা বর্তমান রাজ্য সরকারের শাসনকালেই প্রকট হইয়াছে।বাম শাসনে প্রতিবাদী মুখ না থাকিবার কারণেতাহা প্রকাশ্যে আসিবার সুযোগ পায় নাই। বর্তমান সময়ে বিচার বিভাগের তৎপরতা এবং অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ন্যায় বিচারপতিদিগের সদিচ্ছার কারণেই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে দ্রুত দুর্নীতিরপঙ্কে নিমজ্জিত হইতেছে,তাহা জনসমক্ষে আসিয়াছে। ২০২২ সালের ২৩ জুলাই বর্তমান রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটেরহস্তে গ্রেপ্তারি প্রমাণ করিয়াছে রাজ্যের শিক্ষার অন্তর্জলিযাত্রায় রাজ্য সরকারই শামিল রহিয়াছে। যোগ্য শিক্ষক প্রার্থীদের বঞ্চিত করিয়া বিশালপরিমাণ উৎকোচের বিনিময়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করিয়া বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন চালাইয়াছে রাজ্য প্রশাসন। রাজ্যের সম্পূর্ণ শিক্ষাবিভাগ এইদুর্নীতিতে জড়িত রহিয়াছে। বিচার বিভাগের তৎপরতায় শিক্ষাবিভাগের আধিকারিকগণ কারান্তরালে গিয়াছেন। বাম আমলে শুরু হইলেও বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলেই শিক্ষাক্ষেত্রে সার্বিক অবক্ষয়ের চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে। শিক্ষার হারে যে পশ্চিমবঙ্গ একসময় প্রথম সারিতেঅবস্থান করিত তাহা আজ একেবারে তলানিতে ঠেকিয়াছে। সিবিআই তদন্তেই উঠিয়া আসিয়াছে, বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে বিদ্যালয়স্তরে এসএসসি-র মাধ্যমে আটহাজারেরও বেশি অযোগ্য প্রার্থী অনৈতিকভাবে উৎকোচ প্রদান করিয়া, যোগ্যদিগকে বঞ্চিত করিয়া শিক্ষকনিযুক্ত হইয়াছে। গ্রুপ ডি এবং সি-রও অধিকাংশ একেবারে সাদা খাতা জমা করিয়া চাকুরি পাইয়াছে। শিক্ষাব্যবস্থায় দৈন্যের কারণে রাজ্যেরকলেজগুলিতে পড়ুয়ারা ভর্তি হইতে সাহস পাইতেছে না। ইহার বড়ো প্রমাণ হইল, ২০২৪ সালে এই রাজ্যের কলেজগুলিতে ত্রিশ শতাংশ আসন খালি পড়িয়াছিল। বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অভিভাবকগণ সরকারি বিদ্যালয়ে তাহাদের ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করাইবারসাহস পাইতেছেন না। এই বৎসরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদপত্রে চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে দেখা গিয়াছে, প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় মিলিয়া রাজ্য সরকার আটহাজারেরও অধিক বিদ্যালয় চিহ্নিত করিয়াছে যেগুলিতে ছাত্রসংখ্যা ত্রিশেরও কম।
রাজ্যে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করিতেছে। খুবই চিন্তার বিষয় যে, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ভর্তির হার জাতীয়গড়ের চাইতে অনেক পিছিয়ে। জনমোহিনী নীতির বশবর্তী হইয়ারাজ্য সরকার গত দশ বৎসরেরাজ্য জুড়িয়া ১৯টিরও বেশি সরকারিবিশ্ববিদ্যালয়তৈরি করিয়াছে। দলীয় রক্তচক্ষুর কারণেরাজ্যে বহু মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে।বহু মেডিক্যালকলেজেও পরিকাঠামো ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে কমতি রহিয়াছে। চিন্তা করিবার বিষয় হইল, সমগ্র দেশে মেডিক্যালের আসন যেখানে বৃদ্ধি করাহইতেছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের চিত্র ঠিক বিপরীত। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ২৬টি আসন কমাইয়া দিয়াছেন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন। এনআরএস, আরজি কর, কেএমসি-তে এমডি বা এমএস আসন সংখ্যা কমানো হইয়াছে। রাজ্যের মহাবিদ্যালয়ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ওবিসি সংরক্ষণ ১৭ শতাংশ হইবে না ৭ শতাংশ, এই আইনি জটিলতার কারণেউচ্চশিক্ষায় ভর্তির প্রক্রিয়া স্থগিতরাখিয়াছে রাজ্য। ১০ শতাংশ আসন ওবিসি সংরক্ষিত থাকিবে কিনা, এই প্রশ্নের উদ্রেক করিয়া ৯০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীকে সরকারি শিক্ষা হইতেবঞ্চিত রাখিবার প্রয়াস চলিতেছে। শুধু শিক্ষাব্যবস্থা নহে, সম্পূর্ণ রাজ্যকে নৈরাজ্যে পরিণত করিবার দায় বর্তমান রাজ্য সরকারকেই লইতেহইবে।শিক্ষা যে জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষকগণই যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মাণের কারিগর -দুর্নীতি ও ক্ষমতার লোভে পড়িয়া শাসক দলের নেত্রী এইআপ্তবাক্যটিকেই ভুলিয়া গিয়াছেন। রাজ্যটিকে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত করিয়া অশিক্ষিত ও মূল্যবোধহীন নাগরিক তৈরি করাই তাঁহারলক্ষ্য। শাসকদলে ইহাদেরই প্রাধান্য পরিলক্ষিত হইতেছে। ভারতের নবজারণের পীঠস্থান বঙ্গভূমিকে বাঁচাইতে হইলে সর্বপ্রকার দুর্নীতিতেনিমজ্জিত এই রাজ্য সরকারের অপসারণই যে একমাত্র পথ,তাহারই সংকল্প রাজ্যবাসীকে করিতে হইবে।