ত্রিপুরার মাতাবাড়ির দীপাবলী উৎসব
অপু সাহা
যখন কার্তিক মাসের অমাবস্যা রাত্রি নেমে আসে, তখন যেন সমগ্র উত্তর গোলার্ধ অন্ধকারে ঢেকে যায়। কিন্তু ঠিক সেই রাতেই ভারতভূমিতে জ্বলে ওঠে
অসংখ্য প্রদীপ, দীপাবলীর শিখা- যা জানিয়ে দেয়, অন্ধকার যত গভীরই হোক, আলোর জয় অনিবার্য। দীপাবলি কেবল একটি উৎসব নয়, এটি আলো, বিশ্বাস ও মানবতার অমর জ্যোতি।
পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, ভগবান রামচন্দ্র রাবণকে বধ করে অযোধ্যায় ফিরে আসার পর অযোধ্যাবাসীরা প্রদীপ জ্বালিয়ে শহর আলোকিত করে শ্রীরাম, মাতা সীতা ও লক্ষ্মণকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই দিন থেকেই দীপাবলী উৎসবের শুরু। আবার অন্য মতে, এই দিনেই সমুদ্র মন্থনের সময়
মা লক্ষ্মী আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি শান্তি ও সমৃদ্ধির দেবী। তাই দীপাবলী কেবল আনন্দের উৎসব নয়- এটি শুভ শক্তির জয়গাথা।
এই পবিত্র দীপাবলীই যখন উদ্যাপিত হয় ত্রিপুরার মন্দিরনগরী উদয়পুরের মতাবাড়িতে, তখন তো যেন হয়ে ওঠে স্বর্গের এক ঝলক পৃথিবীতে। মাতাবাড়ি-
যেখানে অধিষ্ঠিত মা ত্রিপুরাসন্দরী, দেবী শক্তির জীবন্ত প্রতিমূর্তি।
তিন দিন ধরে চলে এই উৎসবের আবেশ। মাতাবাড়িতে দীপাবলীর পুজার নিয়ম ও পদ্ধতি সম্পর্কে পুরোহিত সঞ্জয় চক্রবর্তী জানান, তান্ত্রিক মতে মায়ের
পূজার্চনা হয়। দীপাবলীর দিন ভোর ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত চণ্ডীপাঠ হয়। সকাল ৮টায় মাকে স্নান করানো হয় এবং ৯.৩০-এ মায়ের নিত্য পূজা শুরু হয়। দুপুর ১২টায় প্রথমে মহারাজার নামে পাঁঠা উৎসর্গ করা হয়। দু’দিনের জন্য পুষ্পাঞ্জলির আয়োজন স্থগিত থাকে। দুপুর ১.৩০-এ মাকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। অন্নভোগের পর ১ ঘণ্টার জন্য মন্দিরের দরজা বন্ধ রাখা হয়। ৩টায় ভক্তদের জন্য মন্দিরের দরজা খোলা হয়। শুধুমাত্র দীপাবলীর জন্য আবার স্নানের পর মাকে নতুন বস্ত্র, অলংকার দিয়ে সাজানো হয়। মায়ের অপরূপ দর্শন ভক্তদের মনকে মোহিত করে, হৃদয়ে ভক্তি ও শান্তির আলোকস্রোত বয়ে আনে। স্নানের পর সন্ধ্যারতি শুরু হয়। উলুধ্বনি ও ঢাকের শব্দে চারদিক ভরে ওঠে। প্রার্থনার সুর, ভক্তির ছন্দ ও আনন্দ উদ্যাপনের এক অমলিন আভা, যা হৃদয়কে ভরে দেয় পবিত্রতা ও আনন্দে। প্রথমে দীপাবলীর পূজা তারপর শ্যামা মায়ের পূজা। শ্যামাপূজার পর বলি দেওয়া হয়। এরপর হোম যজ্ঞ। হোম যজ্ঞের পর মাকে শীতল ভোগ নিবেদন করা হয়। এরপর ৫ মিনিটের জন্য মন্দিরের দরজা সামান্য বন্ধ রাখা হয়।
কার্তিক অমাবস্যার সেই রাতে মন্দির, মন্দির প্রাঙ্গণ এবং সমগ্র উদয়পুর শহর আলোকিত হয়ে ওঠে অসংখ্য প্রদীপে। বাতাসে ধুপের গন্ধ, ভজনের সুর, আর আরতির শঙ্খধ্বনি মিলেমিশে যেন তৈরি করে এক নৈসর্গিক পরিবেশ। চারদিকের আলোর রাশি যেন ঘোষণা করে- ‘মা এসেছেন, আশীর্বাদ দিচ্ছেন তাঁর সন্তানদের।’
দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত এই সময় উদয়পুরে আসেন। কেউ আসে পাহাড় পেরিয়ে, কেউ নদী পার হয়ে- কেবল এক ঝলক মায়ের দর্শনের জন্য।
তাঁদের চোখে থাকে অগাধ ভক্তি, কণ্ঠে থাকে মন্ত্রধ্বনি, আর অন্তরে থাকে অনন্ত আশার আলো। এই মিলনমেলা, ধর্ম, জাতি ও ভাষার সীমানা পেরিয়ে সবাইকে একাত্ম করে মাতৃভক্তির স্রোতে। এই দীবাবলী আমাদের শোখায়, যেমন- প্রদীপ জ্বালিয়ে মানুষ অন্ধকার দূর করে, তেমনই আমাদের হৃদয়ে জ্বালাতে হবে সত্য, শুভ ও প্রেমের আলো। মা ত্রিপুরাসুন্দরীর আশীর্বাদে যেন আমরা প্রত্যেকে আলোকিত হই- ভালোবাসায়, ন্যায়ে ও মানবতায়।

















