ভোটার তালিকা সংশোধন
বাঙ্গালি আবেগের আড়ালে আসল উদ্দেশ্য
অখিলেশ বাজপেয়ী
নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকার বিস্তৃত সংশোধনের ক্ষেত্রে কী এমন সিদ্ধান্ত নিল যে বিপক্ষ দলগুলির মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত সমস্ত বিরোধীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। মমতা ব্যানার্জি হোক বা আসাদুদ্দিন ওয়েসি, কংগ্রেস নেতা হোক বা আরজেডি কিংবা আম আদমি পার্টি সকলেরই নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি রয়েছেন। তারা সকলেই কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে এনআরসি অর্থাৎ জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণের একটা কৌশল বলে মনে করছে এবং কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে ‘গরিব মুসলমানদের ভোটাধিকার হরণের ষড়যন্ত্র’ বলে বর্ণনা করছেন।
যদিও নির্বাচন কমিশন বার বার স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, তাদের এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক ও বৈধ নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রদান করা এবং ভোটার সূচিকে অধিকাধিক ত্রুটিমুক্ত ও স্বচ্ছ করে তোলা। কিন্তু বিপক্ষ নেতারা কমিশনের কোনোরকম যুক্তি শুনতে বা বুঝতে রাজি নন, যদিও এই এরাই বিগত কয়েকটি নির্বাচনে ভোটার তালিকাতে গণ্ডগোলের অভিযোগ করেছিলেন।
প্রশ্ন হলো, ভোটার তালিকা সংশোধন করতে কমিশন যদি কোনো অভিযান চালায় তাতে কারও আপত্তি হওয়ার কথা নয়, বরং এ তো কমিশনের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আর কমিশন যে ভোটার তালিকা নিয়ে সংশোধন প্রথমবার করছে, তাও তো নয়। এই প্রক্রিয়া সংবিধান স্বীকৃত ব্যবস্থার অভিন্ন অঙ্গ এবং নিরন্তর প্রক্রিয়া। দেশের সবচেয়ে পুরনো দল কংগ্রেসের শাসনকালেও বহু বার এই ধরনের সংশোধন হয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, দেশের ভোটার তালিকা সংশোধন করা কেন উচিত নয়? বস্তুত, বিপক্ষ দলগুলি এর কোন দিকটা অনুচিত বলে মনে করছে, যার কারণে এত চেঁচামেচি চলছে আর নেতারা তেলে-বেগুনে জ্বলছেন? একসময় এদেরই নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ভোটার তালিকা নিয়ে বড়ো রকমের গণ্ডগোলের অভিযোগ করেছিলেন। কংগ্রেস তো মহারাষ্ট্র থেকে শুরু করে হরিয়াণা পর্যন্ত হারের কারণ হিসেবে ভোটার তালিকাকেই দায়ী করেছে। কংগ্রেসের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা লোকসভার নেতা রাহুল গান্ধী তো ভোটার তালিকাকে ঠিকঠাক করতে শুধু ভাষণ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং একটা প্রবন্ধও লিখে ফেলেছেন। এত সবের পর যখন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন সেই কাজটাই করতে যাচ্ছে তখন এত বিরোধিতা কেন? এর একটাই কারণ চোখে পড়ে, বিরোধী দলগুলি এর ফলে নিজেদের
রাজনৈতিক সমীকরণে বড়ো ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে।
নির্বাচন কমিশন সময়ে সময়ে ভোটার তালিকার সংশোধন করে থাকে। নির্বাচন, তা সে পঞ্চায়েত বা স্থানীয় স্তরে হোক বা বিধানসভা, লোকসভা বা কোনো সাংগঠনিক স্তরেই হোক না কেন, তার আগে পূর্ববর্তী ভোটার তালিকাকে ঠিকঠাক করা নিয়ামক প্রক্রিয়ার একটি আবশ্যক শর্ত। কখনও তা সংক্ষিপ্ত আকারে হয়ে থাকে আবার কখনও সুবিস্তৃত, কখনও আংশিক আর কখনও অত্যন্ত গভীর।
সংশোধনের ক্ষেত্রে কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটার তালিকা ঠিকঠাক করতে নিযুক্ত কর্মচারী বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুসন্ধান করে তা ঠিক করেন। এই সংশোধনের মাধ্যমে একপ্রকার নতুন ভোটার তালিকা তৈরি হয়। বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন সেখানকার ভোটার তালিকার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর সঙ্গে আগামীতে এই প্রক্রিয়াকে সারা দেশে জারি করতে ২০২৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে সংশোধিত ভোটার তালিকা তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়। এর জন্য ২০০৩ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করা হয়েছে, কেননা এর আগে ২০০৩ সালেই ভোটার তালিকা সংশোধন হয়।
সংশোধনের জন্য কমিশন নিশ্চিত করে যে, যে ব্যক্তি ২০০৩ সালের পর ভোটার হয়েছে, তাকে তার জন্মের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। যার কাছে জন্মের প্রমাণপত্র নেই তাকে জানাতে হবে ২০০৩ সালের আগে তার বাবার নাম ভোটার তালিকার মধ্যে ছিল কিনা। আর যদি ২০০৩-এর আগের সূচিতে তার বাবার নাম থেকে থাকে তবে তার নাম তালিকাভুক্ত করা হবে। কিন্তু যার বাবার নাম তালিকাভুক্ত ছিল না তাকে ভোটার করা হবে না। আর কারও নাম ভোটার তালিকায় থাকার পরেও সন্দেহজনক মনে হয়, তবে তার ব্যাপারে তদন্ত হবে। তদন্তে যদি সে ব্যক্তি নিজের নাগরিকত্বের সপক্ষে প্রমাণ দিতে না পারে তবে তার বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্ত করা হবে। ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ সমস্ত কাগজ ও পরিচয়পত্র বাতিল করা হবে এবং তার প্রকৃত দেশের খোঁজ নিয়ে তাকে সে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। কমিশনের এই নির্দেশের কারণেই বিপক্ষে এত হইচই শুরু হয়েছে। এতে তাদের সমস্ত রাজনৈতিক সমীকরণের পরিবর্তন হতে দেখতে পাচ্ছে। এই বিষয়টা আর চাপা থাকছে না যে, বড়ো সংখ্যায় বাংলাদেশ, মায়ানমার ও পাকিস্তানের মুসলমান অনুপ্রবেশ করে ভারতে
চলে এসেছে, যারা প্রকৃতপক্ষে দেশের নাগরিকদের অধিকার ও সম্পদে ভাগ বসাতে শুরু করে। তার সঙ্গে দেশের আর্থিক ব্যবস্থার উপরও চাপ সৃষ্টি করছে। এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া না গেলেও শুধুমাত্র বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
অনুমান করা যায় যে, এর সঙ্গে মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা মুসলমান বা পাকিস্তান থেকে পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে এসে বিভিন্ন রাজ্যে আত্মগোপন করে থাকা মুসলমানদের সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। এমন অভিযোগ প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় যে, অনুপ্রবেশকারীরা বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে, আবার কোনো কোনে রাজ্যে স্থানীয় সরকারের অনুগ্রহে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সব বানিয়ে ফেলেছে। তার ফলে, দেশের বহু রাজ্যে এবং বহু জেলায় জনসংখ্যাগত পরিসংখ্যানে বড়ো ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেছে। হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে এবং মুসলমান জনসংখ্যা অপ্রত্যাশিতভাবে বহু গুণ বেড়ে গেছে। তার ফলে বহু জেলার জনবিন্যাসের সংখ্যার চরিত্রই পালটে গেছে।
বস্তুত কম-বেশি পুরো দেশেই এই অনুপ্রবেশের কারণে বা জনসংখ্যাগত তারতম্যের কারণে উদ্ভূত সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু রাজ্যে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বহু জেলা অনুপ্রবেশের কারণে প্রভাবিত। বিগত কয়েক মাসের ধরে দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে এর বিভিন্ন ঘটনা সামনে উঠে আসছে, যেখানে কিছু লোক প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে অন্য দেশের নাগরিক হওয়ার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ভোটার হওয়ারও দাবি করে এবং তারা বলে যে তারা বহুবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, ভবিষ্যতেও করতে থাকবে। এমন স্বীকারোক্তিও প্রকাশ্যে দেখা গেছে, যেখানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের ভারত ছেড়ে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই। এর থেকে বিষয়টির গুরুত্ব অনুমান করা যেতে পারে। অন্য কোনো দেশের নাগরিক অথচ ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে, কথাটা শুনতেই অবাক লাগে। এমতাবস্থায় যদি কমিশনের কোনো সিদ্ধান্তের ফলে অনুপ্রবেশ রোধ হয়, সেক্ষেত্রে বিপক্ষের প্রশংসা করার পরিবর্তে হইচই করা এবং তাতে আশঙ্কা হওয়া স্বাভাবিক যে এরফলে বিপক্ষের ভোট ভাণ্ডারে টান পড়ছে।
আসলে দেশের সংবিধান ও আইন অন্য কোনো দেশের নাগরিককে ভারতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অভিন্ন অঙ্গ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেয় না। সেক্ষেত্রে এ ধরনের লোককে ভোটার তালিকা থেকে বের করতে এবং দেশের বৈধ নাগরিকদের এতে নিজের নাম যুক্ত করার সুযোগ দিয়ে একে সুব্যবস্থিত করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে তাতে আপত্তিজনক কী আছে? কোনো বিদেশির কাছে দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কীভাবে থাকতে পারে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এপি তিওয়ারী নির্বাচনের সংখ্যাত্মক তথ্য এবং দেশের রাজনৈতিক পরিদৃশ্যের বিশ্লেষণ করার আবশ্যকতার কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশের অধিকাংশ বিরোধী দল দুর্ভাগ্যবশত এই অনুপ্রবেশকেই তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। স্বাধীন ভারতে প্রথম সরকার গঠনকারী কংগ্রেস তাদের ভোটব্যাংককে শক্ত করতে মুসলমান তুষ্টীকরণের যে খেলা শুরু করেছিল, তা আজ শুধু কংগ্রেস নয় বরং মমতা ব্যানার্জি, লালু যাদব, তেজস্বী যাদব, হেমন্ত সোরেন, অখিলেশ যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়াল-সহ বহু রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের দল সেই পথেই অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দেওয়ার কাজ করে চলেছে। অবৈধ উপায়ে ভোটার আইডি, আধার কার্ড বানিয়ে এই অনুপ্রবেশকারীরা সমস্ত বিজেপি বিরোধী দলের জন্য ভোেট জোটানো এবং জয়লাভের মাধ্যম হয়ে গেছে। বিপক্ষের ভয় আছে, যদি কমিশন তালিকা সংশোধন করতে নথিপত্র ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবে ভোটার তালিকা থেকে এদের নাম কাটা যাবে। আর যদি এদের নাম কাটা পড়লে তাদের ভোটে যথেষ্ট খারাপ প্রভাব পড়বে, কেননা তুষ্টীকরণের আগুনে ক্ষমতার রুটি সেঁকা লোকেরা জানে যে, দেশে প্রবহমান রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রবাহে বিজেপির সঙ্গে লড়াই করা তাদের পক্ষে খুব একটা সহজতর হবে না। তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়বে।
কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের যথাসাধ্য স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা নিশ্চিত করে যে, এই সংশোধনের জন্য কশিনের পক্ষ থেকে নিযুক্ত বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার) প্রত্যেক ভোটারের বাড়ি তিন বার যাবেন। তিন বারেও না পেলে তবেই তালিকা থেকে নাম বাদ যাবে। অনলাইনেও নাম যুক্ত করার বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কমিশন ঘোষণা করেছে, যে নাম কাটা হয়েছে এবং নতুন তালিকা তৈরি করা হয়েছে তার প্রতিলিপি শুধুমাত্র সব রাজনৈতিক দলকেই দেওয়া হবে তা নয়, বরং তা নিয়ে ওঠা আপত্তি বিষয়েও বিস্তৃত চর্চা আলোচনা করার পর চূড়ান্ত সূচি করা হবে। এসবের পরেও কমিশনের এই সিদ্ধান্তে বহু নাগরিকের নাম বাদ যাবে বলে বিপক্ষের আশঙ্কা হয়ে থাকে তবে অধ্যাপক তিওয়ারীর যুক্তিই সঠিক বলে মনে হয় যে, বিপক্ষের ছটফটানির আসল কারণ অনুপ্রবেশকারীদের ভোটার তালিকা থেকে বের করার ভয়। কারণ, দেশের প্রকৃত নাগরিকের ক্ষেত্রে অসম্ভব যে কারও বাবার নাম ২০০৩ বা তার আগে তালিকাভুক্ত ছিল না। শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব যারা ২০০৩ সালের পর অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে ভারতে এসেছে। এমতাবস্থায় বিগত কয়েক বছরের নির্বাচনী ফলাফল লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যে বিজেপির জয় রোধ করতে মুসলমান অধ্যুষিত আসন থেকে অনবরত জয়লাভ করা অমুসলিম জনপ্রতিনিধির বিপুল পরিমাণ ভোট পাওয়ার অজস্র উদাহরণ, তবে কমিশনের সিদ্ধান্তে বিপক্ষ দলগুলি গরিব বা বঞ্চিতদের জন্য চিন্তিত নয়, বরং দেশের পরিবেশ পরিস্থিতির উপর প্রভাব বিস্তারকারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অনুপ্রবেশ দমনকারী আইনের প্রয়োগে অনুপ্রবেশকারীদের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত।