রাখিবন্ধন ও জাতীয় সংহতি
অতুল কুমার বিশ্বাস
সংস্কৃত শব্দ ‘রক্ষাবন্ধন’ থেকে রাখিবন্ধন শব্দের উৎপত্তি। কথিত আছে, স্বর্গের অধিকার নিয়ে দেবতা ও দানবদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। দেবসেনাপতি দানবদের হাতে পরাজিত হচ্ছেন। দেবরাজ ইন্দ্র নিজে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্রের পত্নী দেবাদিদেব মহাদেবের
পূজা করে তাঁর নামে রঙিন সুতো দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে বেঁধে দিয়ে তাঁর সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। অনেকের ধারণা, এখান থেকেই রাখির উৎপত্তি। মহাভারতে দেখা যায় যে, মাতা কুন্তী তাঁর সদ্যোজাত পুত্রকে রাখি বেঁধে জলে ভাসিয়ে দিলেন, আর সেই পুত্র পরবর্তীকালে বীরত্ব ও রাজত্ব লাভ করল। এক্ষেত্রে মায়ের রক্ষাসূত্র পুত্রকে রক্ষা করল। সীতাদেবীর সন্তান জন্মাবার পর মহর্ষি বাল্মীকি শিশুর হাতে মন্ত্রপূত কুশ পরিয়ে দিয়ে তাঁদের রক্ষাবন্ধন করালেন এবং নামকরণ করলেন যথাক্রমে কুশ ও লব। মাতা যশোদাও শ্রীকৃষ্ণের কল্যাণ কামনায় রক্ষাবন্ধন করেছিলেন। আজও মায়েরা বিপত্তারিণী ব্রত করে ছেলে-মেয়েদের হাতে আশীর্বাদপূত তাগা বেঁধে দেন সন্তানদের মঙ্গল কামনায়, এটিও রাখির নামান্তর মাত্র। শ্রাবণী পূর্ণিমায়া রাখিবন্ধনের কথা বেদ সংহিতায় উল্লেখ আছে। দক্ষ বংশোৎপন্ন একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত রাজা শতানীকের মণিবন্ধে স্বর্ণিম রক্ষাসূত্র বন্ধন করে তাঁর মঙ্গল কামনা করেছিলেন। সমাজ সুরক্ষার জন্যে ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার রূপে মহাবলশালী দানবরাজ বলিকে এই রক্ষাবন্ধন সূত্রেই আবদ্ধ করেছিলেন। আজও কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে পুরোহিতরা তাঁদের যজমানদের হাতে কুশের তৈরি বলয় পরিয়ে দিয়ে মঙ্গলকামনা করেন।
শুধুই পৌরাণিক নয়, ঐতিহাসিক দিক থেকেও রক্ষাবন্ধন সমাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। পুরুর সঙ্গে আলেকজান্ডারের যুদ্ধের সময় গ্রিক রাজমহিষী পুরুর হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছিলেন স্বামীর সুরক্ষা কামনা করে। মোগল যুগে চিতোরের রানি কর্ণাবতী গুজরাটের নবাব বাহাদুর শাহের দ্বারা
আক্রান্ত হলে সাহায্য প্রার্থনা করে বাদশা হুমায়ুনের কাছে রাখি পাঠিয়েছিলেন। বাদশা সঙ্গে সঙ্গে কর্ণাবতীকে বোন বলে স্বীকার করেন এবং বোনকে রক্ষার জন্য সুদুর বঙ্গদেশ থেকে চিতোর যাত্রা করেন। কিন্তু বাদশা চিতোরে পৌঁছবার আগেই সম্মান রক্ষার জন্য আক্রান্ত রানি জহরব্রতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। প্রতি বছর শ্রাবণী পূর্ণিমায় ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে বোনেরা ভাইয়ের হাতে রাখি পরিয়ে ভাইয়ের মঙ্গলকামনা করে এবং ভাইয়েরাও বোনদের রক্ষার শপথ গ্রহণ করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অকালে রাখিবন্ধন করেছিলেন জাতীয় সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি বঙ্গের বিপ্লবী আন্দোলনকে দমন করার জন্য সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি প্রয়োগ করে বঙ্গকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে দুই ভাগে ভাগ করার চক্রান্ত করেছিল। সারা বঙ্গ জুড়ে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙ্গালি সমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিনে রবীন্দ্রনাথ রাখি হাতে পথে নেমেছিলেন বাঙ্গালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সংকল্প নিয়ে। সেদিন সকলের কণ্ঠে ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা গান- ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।
সেদিন বঙ্গে এমন কোনো নগর, গ্রাম, জনপদ ছিল না সেখানে রাখিবন্ধন উৎসবের কোলাহল উঠেনি। এমন তরুণ ছিল না যে সেদিন দেশের কাজে উদাসীন ছিল। সমস্ত বাঙ্গালিজাতি পরস্পরের হাতে রাখি বেঁধে বঙ্গকে অখণ্ড রাখার শপথ গ্রহণ করেছিল। রাখি যে একতাবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে তা সেদিন ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল। ফলস্বরূপ ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালি জাতির কাছে পরাজয় স্বীকার করে ১৯১১ সালে কার্জন বঙ্গভঙ্গ রদ করেন- দুই বঙ্গ আবার এক হয়েছিল।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ রাখিবন্ধন উৎসবটিকে একটি জাতীয় রূপ দিয়েছে। ভারতবাসীর মধ্যে একই সাংস্কৃতিক ধারা প্রবাহিত হলেও ভাষা-সম্প্রদায়-পন্থ ও
কর্মগত শ্রেণীবিভাগের কারণে সমাজের মধ্যে একাত্মতার অভাব অনুভূত হচ্ছে। ফলে সমাজের মধ্যে উচ্চ-নীচ ভেদ ভাব, ঘৃণা ও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ রাখিবন্ধন উৎসবের মাধ্যমে সমাজের সমস্ত ভেদভাব দূর করে সমাজকে একসূত্রে আবদ্ধ করে জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। বর্তমানে দেশের ছোটো-বড়ো বহু সংগঠনই রাখি উৎসবকে সামনে রেখে দেশবাসীর মধ্যে ভেদাভেদ ও অনৈক্যকে দূর করে দেশকে শক্তিশালী করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে রাখিবন্ধন উৎসব চিরাচরিত শাস্ত্রীয় বোন-ভাইয়ের মধ্যে সীমিত না থেকে সমাজের সর্বস্তরে মানুষে মানুষে ভাব বিনিময়, জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। রাখিবন্ধনের পুণ্য তিথিতে সমগ্র ভারতবাসী ভারতের জাতীয় ও সামাজিক সংহতি রক্ষায় এক সংকল্পসূত্রে গ্রথিত হোক- এই প্রার্থনা।