শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ (১৮৭৪-১৯৩৭)
ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের যোগ্য সন্তানরূপে ১৮৭৪ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি শ্রীধামে পুরীতে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের সন্নিকটে ‘নারায়ণ ছাতা’য় শ্রীল প্রভুপাদ আবির্ভূত হন। মাতা শ্রীভগবতী দেবী বিমলাদেবীর প্রসাদ দ্বারা অন্নপ্রাশনকালে এঁর নাম ‘বিমলাপ্রসাদ’ রাখেন। কিছুদিন পরে রথযাত্রাকালে শ্রীজগন্নাথ দেব নিজ প্রসাদী মাল্য দ্বারা কৃপাভিষিক্ত করেন। বিদ্যাবিলাসকালে লাইব্রেরির সমস্ত প্রকার শাস্ত্র অনুশীলন করেন। তিনি ছোটো থেকেই নিষ্ঠাবান, ধর্মানুরাগী ও সদাচারী ছিলেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। জাগতিক জ্ঞান অর্জনে বিশেষ তৎপর না হয়ে কিছুদিন ত্রিপুরা এস্টেটে কর্ম করার পর শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের কৃপায় সদগুরুর দর্শন পান। শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ পরীক্ষা নিয়ে ১৯০০ সালে জানুয়ারী মাসে ভাগবতী দীক্ষা প্রদান করেন। তারপর শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের গৌরধাম, গৌরনাম ও গৌরকামের প্রচার অভিলাষ বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য বিপুল উদ্যমে প্রচার শুরু করেন। তিনি কিছুদিন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের সঙ্গে ওড়িশার বিভিন্ন তীর্থ দর্শন করেন। তিনি চিরদিনই সত্যের নির্ভীক বক্তা ছিলেন। ভক্তিবিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত ও অশাস্ত্রীয় কথার চিরদিনই প্রতিবাদ করেছেন। কর্মজড়-স্মার্তবাদ ও শুদ্ধবৈষ্ণব ধর্মের নামে যত অপসম্প্রদায় ছিল তাদের মতবাদকে খণ্ড-বিখণ্ড করে শুদ্ধভক্তির ধারা পুনরায় জগতে প্রচার করেছিলেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের আদেশে তিনি শ্রীধাম মায়াপুরে চাতুর্মাস্য ব্রতকালে শতকোটি নামযজ্ঞ করেছিলেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ও শ্রীগৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের অপ্রকটের পর অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে শুদ্ধভক্তির প্রচার বিষয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। ওই সময় পঞ্চতত্ত্বাত্মক শ্রীগৌরসুন্দর ও সকল শ্রীগুরুবর্গ স্বপ্নের মধ্যে দিব্য মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে শ্রীল শ্রীমদ্ভক্তি কেবল ঔডুলোমি মহারাজ প্রভুপাদকে পূর্ণ উদ্যমে শুদ্ধভক্তি প্রচার
কার্যে অগ্রসর হবার নির্দেশ প্রদান করেন। এ বিষয়ে তাঁরা সকলেই পিছন থেকে তাঁকে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯১৮ সালে ২৭ মার্চ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর ত্রিদণ্ড সন্ন্যাস লীলা আবিষ্কার করেন এবং সেই সময় ‘শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ’ নামে অভিহিত হন। তারপর চৈতন্য মঠ স্থাপন পূর্বক একে একে ভারতের সর্বত্র প্রায় ৬৪টি গৌড়ীয় মঠ স্থাপন করেন এবং অতি অল্পদিনের মধ্যে বহু বৈষ্ণব ধারায় এবং বিভিন্ন ভাষায় পত্রিকা প্রকাশ পূর্বক সমগ্র বিশ্বে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন স্থানে বিগ্রহ স্থাপন, শ্রীমন্মহাপ্রভুর পাদপীঠ স্থাপন ও পারমার্থিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাঁর প্রচার বৈশিষ্ট্যের কোনো তুলনা নেই।
অবদান বৈশিষ্ট্য:
১. শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীকৃষ্ণপ্রেষ্ঠ মহাজনরূপে অবতীর্ণ হয়ে অর্চনপ্রধান পঞ্চরাত্র এবং কীর্তন প্রধান ভাগবতের সমন্বয় গুরু ছিলেন।
২. তিনি দৈববর্ণাশ্রমের মর্যাদা সংস্থাপন, যুক্তবৈরাগ্যের আদরকারী এবং বিধির আকারযুক্ত রাগমার্গীয় অনুশীলনকারী শিক্ষক ছিলেন।
৩. তিনি ‘কীর্তনীয় সদা হরি’- এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে হরিকীর্তনময় মঠ-মন্দির স্থাপন পূর্বক গৃহী, ত্যাগী সকল শ্রেণীর ভক্তের আশ্রয়দাতা ও সেবাদাতা রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন।
৪. শ্রীনবদ্বীপধামে পরিক্রমার পুনঃপ্রবর্তন করেন এবং দেশে দেশে, গ্রামে-গঞ্জে প্রচারক পাঠিয়ে গৌরধাম, গৌরনাম ও গৌরকামের সর্বশ্রেষ্ঠ সেবকরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
৫. কনক-কামিনী প্রতিষ্ঠায় অনাদর প্রদর্শনপূর্বক তিনি অকিঞ্চন ভগবৎ ভক্তের শুদ্ধদাসত্ব শিক্ষা দিয়েছিলেন।
৬. শুদ্ধ রূপানুগ ধারার সংরক্ষণপূর্বক তিনি শুদ্ধ ভক্তিসিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ মত সম্পূর্ণরূপে দলন করেছিলেন।
শ্রীল প্রভুপাদের বার্তা :
উপদেশ বা বাণী:
১. বিষয় বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র ভোগী, তদ্ব্যতীত সবই তার ভোগ্য।
২. হরিভজনকারী ব্যতীত সকলেই নির্বোধ ও আত্মঘাতী।
৩. শ্রীহরিনাম গ্রহণ ও শ্রীভগবৎ সাক্ষাৎকার-দুই একই।
৪. সহ্য করতে শেখা মঠবাসীর একমাত্র কর্তব্য।
৫. শ্রীমন্মহাপ্রভুর শিক্ষাষ্টকে লিখিত ‘পরম বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তনম্’-ই শ্রীগৌড়ীয় মঠের একমাত্র উপাস্য।
৬. আমরা সৎকর্মী, কুকর্মী বা জ্ঞানী, অজ্ঞানী নহি, আমরা অকৈতব হরিজনের পাদত্রাণবাহী, ‘কীর্তনীয় সদা হরি’ মন্ত্রে দীক্ষিত।
৭. রূপানুগের কৈঙ্কর্য্য ব্যতীত অন্তরঙ্গ ভক্তের আর কোনো লালসা নেই।
৮. কেবল আচরণ রহিত প্রচার কর্মাঙ্গের অন্তর্গত।
৯. কৃষ্ণেতর সংগ্রহই আমাদের মূল দাবি।
ঘটনাবলী:
১. ১৯১৬ সালে ২৭ মার্চ কীর্তন প্রচারাঙ্গরূপে ভাগবত মুদ্রায়ন কৃষ্ণনগরে প্রথম স্থাপিত হয়। উহাই পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে বৃহৎমৃদঙ্গযন্ত্রালয় রূপে
কলকাতা বাগবাজার মঠে পুনঃস্থাপিত হয়।
২. ১৯১৮ সালে শ্রীধাম মায়াপুরে চৈতন্যমঠ স্থাপন করেন।
৩. ১৯১৮ সালে ১৮ এপ্রিল শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোস্থিত ভবনে আলাপ হয়।
৫. ১৯৩০ সালে কলকাতা বাগবাজার শ্রীগৌড়ীয় মঠ স্থাপিত হয়।
৬. ১৯৩১ সালে শ্রীধাম মায়াপুরে পারমার্থিক শিক্ষার অনুকূলে ‘ঠাকুর ভক্তিবিনোদ ইন্সটিটিউট’ স্থাপিত হয়।
৭. ১৯৩৪ সালে ২৪ এপ্রিল ভারতসচিব জেটলান্ডের সভাপতিত্বে ‘লন্ডন গৌড়ীয় মিশন সোসাইটি’ স্থাপিত হয়।
শ্রীল প্রভুপাদ সম্পাদিত পত্রিকা :
১. ১৮৮১ সালে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর দ্বারা প্রথম ‘সজ্জনতোষণী’ বা ‘The Harmonist’ রূপে প্রকাশিত হয়, পরবর্তীকালে শ্রীল প্রভুপাদ
১৯১৫ সালে মার্চ মাসে পুনঃস্থাপন করেন।
২. ১৯২২ সালে ১৯ আগস্ট কলকাতা শ্রীগৌড়ীয় মঠ হতে পারমার্থিক পত্রিকা রূপে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়।
৩. ‘দৈনিক নদীয়া প্রকাশ’ ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে শ্রীল প্রভুপাদ কর্তৃক দৈনিক পত্রিকা রূপে শ্রীধাম মায়াপুর প্রকাশিত হতে প্রকাশিত হয়।
৪. ‘ভাগবত’ ১৯৩১ সালে ৮ নভেম্বর শ্রীনৈমিষারণ্য পরমহংস মঠ হতে হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত হয়।
৫. ‘কীর্তন’-১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অসম গোয়ালপাড়া প্রপন্নাশ্রম হতে শ্রীল প্রভুপাদ অসমীয় ভাষায় মাসিক পত্রিকারূপে প্রকাশ করেন।
৬. ‘পরমার্থী’ কটক শ্রীসচ্চিদানন্দ মঠ হতে উৎকল ভাষায় ১৯৩২ সালে ১৬ মে পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।