বাঙ্গালি ভাবাবেগ উসকে দিয়ে আদতে অনুপ্রবেশকারী মুসলমান ও রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে চাইছেন মমতা (১৮৭৪-১৯৩৭)
প্রণবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় মাস সাতেক পরেই পড়বে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের ঢাকে কাঠি। এই নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় ফিরতে মরিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। এজন্য তিনি বেছে নিলেন ধর্মতলার ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চকে। সেখানেই জানিয়ে দিলেন আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের নয়া হাতিয়ার কী হতে চলেছে।
পরপর তিনটি টার্মে মুসলমানদের দাবার বোড়ে করে বিরোধীদের মাত দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। বারবার ব্যবহারে সেই অস্ত্র এখন ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। তাই এবার নয়া হাতিয়ার তৈরি করে ফেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটাই ছিল শেষ ২১ জুলাই। এদিন ধর্মতলার জনসভায় (পোশাকি নাম শহিদ দিবস। তবে এটা বললে যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের অপমান করা হয়। কারণ যেদিনের ঘটনা নিয়ে এদিন সভা করা হলো, সেটি ছিল আদতে একটি নিখাদ রাজনৈতিক কর্মসূচি। তাও আবার তৃণমূলের নয়, যুব কংগ্রেসের। কংগ্রেসের দাবি, তাদের কর্মসূচিকে হাইজ্যাক করা হয়েছে) আগামী বিধানসভা নির্বাচনের সুর বেঁধে দিয়েছেন তিনি।
ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের তুরুপের তাস যে হতে যাচ্ছে বাঙ্গালি ভাবাবেগ, এদিন তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো স্বয়ং। একটি সার্কুলার তুলে ধরে তিনি জানান, এটি বাঙ্গালি বিরোধী সার্কুলার। এই সার্কুলারে বলা আছে স্রেফ সন্দেহের বশে মানুষকে এক মাসের জন্য আটকে রাখা যাবে। তিনি বলেন, ‘এক হাজারের ওপর মানুষকে মধ্যপ্রদেশ, কাউকে ওড়িশা, তো কাউকে রাজস্থানের জেলে ভরা হয়েছে।’ তাঁর দাবি, কেন্দ্র ঘুরপথে এনআরসি করার চেষ্টা করছে। বাঙ্গালিদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চলছে। তৃণমূল নেত্রীর শ্লেষ, ‘বাংলা ভাষায় নাকি কথা বলা যাবে না।’ তার পরেই তাঁর হুংকার, ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে যদি বাংলা বলার জন্য বাইরে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে এই লড়াই কিন্তু দিল্লিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে ভাষা আন্দোলন হবে। দেখে নেব, কত জেল আছে, কত ডিটেনশন ক্যাম্প আছে।’
এদিন মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে প্রত্যাশিত ভাবেই উঠে এসেছে বিহারের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘বিহারের ভোটার তালিকায় যেভাবে নাম বাদ পড়েছে, সেভাবে এই রাজ্যে বাদ দিতে এলেই আন্দোলন হবে।’ নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
এতো গেল তৃণমূল নেত্রীর হুমকি-বার্তার কথা। মেঠো রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি বরাবর যে ভাষায় কথা বলেন, এদিনও তাই করেছেন, নতুন কিছু নয়। এবার ফিরে আসা যাক মুদ্রার উলটো পিঠে। সেখানে কী দেখছি আমরা? আমরা দেখছি, শুধু বিহারেই ব্যাপক গলদ ধরা পড়েছে ভোটার তালিকা
সংশোধনের লক্ষ্যে আয়োজিত বিশেষ নিবিড় সংশোধন অভিযানে। ইতিমধ্যেই ৯৫ শতাংশ ভোটারের সমীক্ষা হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে ১১ হাজার ভোটারকে চিহ্নিতই করা যাচ্ছে না। তাদের দেওয়া ঠিকানায় কোনো বাড়ি নেই, তাদের সম্পর্কে কিছু জানেন না প্রতিবেশীরাও। ঘটনার প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের এক কর্তা জানান, এই ১১ হাজার ভোটার সম্ভবত বাংলাদেশি মুসলমান এবং রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী, যারা বিহারে ভুয়ো ভোটার কার্ড তৈরি করেছে। যদিও বিহার নয়, তারা বসবাস করছে আশপাশের রাজ্যগুলিতে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এই অনিয়মগুলির পেছনে দায়ী আগের পর্যালোচনার সময় অবহেলা বা দুর্নীতি, যার ফলে অননুমোদিত ব্যক্তিরাও ভোটার তালিকায় ঢুকে পড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দেওয়া ঠিকানায় কোনো ঘরই নেই, এমনকী প্রতিবেশীরাও তাদের চেনেন না। এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো বিহারের ভোটার তালিকা সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিমুক্ত করা এবং নিশ্চিত করা যাতে শুধুমাত্র যোগ্য ভারতীয় নাগরিকরাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তাদের দাবি, রাজ্যের ৪১.৬৪ লক্ষ ভোটারকে তাদের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সূত্রের খবর, এসবের মধ্যে ১৪.২৯ লক্ষ ভোটারকে সম্ভবত মৃত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯.৭৪ লক্ষ ভোটার স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে গিয়েছেন এবং ৭.৫০ লক্ষ ব্যক্তির নাম একাধিক জায়গায় রয়েছে। প্রায় ১১ হাজার ভোটারকে
‘আনট্রেসেবল’ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই বিশেষ নিবিড় সংশোধন অভিযানে গিয়ে বুথ লেভেল অফিসাররা নেপাল, বাংলাদেশ ও মায়ানমার থেকে আসা বেশ কিছু বিদেশিকেও আটক করেছেন। এদের কাছে মিলেছে ভারতীয় নথিপত্র যেমন আধার কার্ড, রেশন কার্ড ও বসবাসের জন্য শংসাপত্র। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পরেই শুরু হয়েছে তদন্ত। বিদেশিরা কীভাবে এসব সরকারি নথি জোগাড় করল, জালিয়াতির শেকড়ই-বা কতদূর বিস্তৃত, তা জানতেই শুরু হয়েছে তদন্ত।
বিহারের এই ছবি থেকে একটা কথা অন্তত স্পষ্ট, কেন মুখ্যমন্ত্রী ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে অস্ত্র করলেন বাঙ্গালির ভাবাবেগকে? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে প্রশ্নের মধ্যেই। ছাব্বিশের নির্বাচনে এই ‘বিদেশি’রাই ভারতীয় ভোটার সেজে ভোট দেবে তৃণমূলকে। এই অনুপ্রবেশকারীদের সিংহভাগই বাংলাদেশি মুসলমান। মায়ানমার থেকেও যারা এদেশে ঢুকে পড়েছে অবৈধভাবে, তারাও মুসলমান (স্থানীয় ভাষায় রোহিঙ্গা)। কলকাতা তো বটেই, বিধাননগরেরও বেশ কিছু অঞ্চলের বস্তিতে ভারতীয় মুসলমানদের ভিড়ে মিশে রয়েছে এরা। এদেরই ভোট পেয়ে লোকসভা নির্বাচনে ভাইপো জেতেন ৭ লক্ষ ভোটে (অবশ্য ছাপ্পাও ছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ)! যে কায়দায় সিপিএমের একাধিক নেতা জিততেন লক্ষ লক্ষ ভোটে, সেই কায়দায়ই ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে জিতেছেন ভাইপো! এই বিদেশিদেরই হারতে চাইছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কারণ তারা ভাগ বসাচ্ছে ভারতবাসীর ভাতে। সস্তার শ্রমিকের পর্যাপ্ত জোগান হওয়ায় ভারতীয় শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না কাজও। অথচ পশ্চিমবঙ্গে কাজ না পেয়েই তাঁরা হয়ে গিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিক কিংবা ভিন রাজ্যের চাকুরে।
সবাই জানে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের লক্ষ্য বিদেশি বিতাড়ন। তাই শুরু হয়েছে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন অভিযান। এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তৃণমূল নেত্রী, ক্ষমতার চিটেগুড়ে যাঁর পা আটকে গিয়েছে। নবান্নের ১৪ তলাকে তিনি পারিবারিক সম্পত্তি বানাতে চান! প্রথমে তিনি, তারপর তাঁর ভাইপো, তারপর এই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারেরই কেউ বসবেন নবান্নের ওই ১৪ তলার ঠাণ্ডা ঘরটায়। সেই কারণেই কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারকে উৎখাত করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং! একটি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পদে বসে কীভাবে তিনি অনুপ্রবেশকারীদের হয়ে সওয়াল করেন, তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না শিক্ষিত বাঙ্গালিরাও। এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন এ রাজ্যের বিদ্বজ্জনেরা। বুদ্ধদেবের জমানায়ও এঁরাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী (পড়ুন, বুদ্ধজীবী।) এখনো এঁরাই এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়! তবে এখন এঁরা ভজনা করেন মমতার। তাই রাজ রোষানলে পড়ে সব খোয়ানোর ভয়ে মুখে লাগাম এঁটেছেন এঁরা।
এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করছেন এ রাজ্যের বহু বাঙ্গালি। চাকরি সূত্রেও অনেকেই হয়েছেন ভিন রাজ্যের বাসিন্দা। কই, বিজেপি শাসিত রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁরা তো বাঙ্গালি খেদাও অভিযানের কোনো অভিযোগ করেননি? উত্তরপ্রদেশের কথাই ধরা যাক। সেখানকার নয়ডা-সহ অন্যত্র পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন বহু বাঙ্গালি। চাকরিও করেন অনেকে। তাঁদের ভিড়েই মিশে রয়েছে বাংলাদেশি মুসলমান ও রোহিঙ্গারা। তারাই ভাগ বসিয়েছে ভারতীয় বাঙ্গালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ভাতে। তাই পেটে টান পড়েছে এদেরই। কাজ না পাওয়ায় কেন্দ্রের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছেন তাঁরাও। এ রাজ্যের বহু বাঙ্গালি ছেলে-মেয়ে রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছে বেঙ্গালুরুতে। কই, তাঁরাও বাঙ্গালি খেদাও বলে তৃণমূল নেত্রী যে অভিযোগ করছেন, তেমন কোনো অভিযোগ করেননি।
তাহলে কেন জনসমাবেশে মিথ্যে প্রচার করে বিজেপির বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী খেপিয়ে তুলছেন বাঙ্গালিদের? এর এক ও একমাত্র কারণ, তিনি চান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকতে। সেই কারণেই বাঙ্গালি ভাবাবেগ উসকে দিয়ে তিনি আদতে আড়াল করতে চাইছেন বাংলাদেশি মুসলমান ও রোহিঙ্গাদের মতো দুধেল গাইদের। যারা কোনো তৃণমূল নেতা বা নেত্রীর হাত ধরে জাল নথিপত্র বানিয়ে ‘বাঙ্গালি’ হয়ে গিয়েছেন সেই কবেই! এঁদের কাঁধেই ভর করে পর পর দু’বার ভোট বৈতরণী পার হয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। প্রথমবার তিনি জিতেছিলেন অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটে।
তৃণমূল নেত্রী অবশ্য এরই মধ্যে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদি দিল্লিিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কলকেটা পাওয়া যায়, তাহলে নবান্নে ভাইপোকে বসিয়ে পিসি রওনা দেবেন দিল্লির উদ্দেশে।
তবে দিল্লি যে বহু দূর এবং একটি আঞ্চলিক দলের নেত্রী হয়ে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখা যে বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর শামিল, তা বোধহয় নিজেও জানেন। আর জানেন বলেই তিনি চাইছেন, পাকাপাকিভাবে নবান্নের গদি দখল করে রাখতে। নবান্নে যে ‘মধু’র স্বাদ তিনি পেয়েছেন, ক্ষমতায় না এলে তা কী সম্ভব হতো! গত ১৫ বছরে কালীঘাট অঞ্চলে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সম্পত্তির যে বহর হয়েছে, টালির চালের ঘরে থাকা কোনো মানুষের পক্ষেই বোধহয় তা কোনোভাবেই সম্ভব নয় এত অল্প সময়ে। তা যদি হতো, তাহলে এ দেশের কাউকে প্রধানমন্ত্রী যোজনায় ঘর দিতে হতো না।
মুখ্যমন্ত্রীকেও ভোট ‘কিনতে’ নানা ‘শ্রী’ নামের আড়ালে ‘ভিক্ষে’ (পড়ুন, ঘুষ) দিতে হতো না বাঙ্গালিদের! এই খয়রাতির ও তোষণের রাজনীতি করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির হাঁড়ির হাল করে দিয়েছেন মমতা। তাই দিল্লির বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন টাকা না দেওয়ার।
কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন খাতে যে টাকা দিয়েছে, তা অন্য খাতে খরচ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। তাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় অনুদানের পরিমাণ। ভোটের হাওয়া গরম করতে সেটাকেই হাতিয়ার করছে তৃণমূল। এর সঙ্গে উসকে দিলেন বাঙ্গালি ভাবাবেগকে।