বাঙ্গালি সেন্টিমেন্ট গেয়ে অনুপ্রবেশকারী মুসলমান রক্ষার কৌশল মমতা ব্যানার্জির
ড. রাজলক্ষ্মী বসু
নৈতিকতা রক্ষা এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে বড়োই বেকায়দায় ফেলে প্রতিবারের নির্বাচন। এখন আবার শুরু হয়েছে নতুন এক প্রিপোল ড্রামা- কিছুতেই ‘বাংলা-বাঙ্গালি-বাঙ্গালিয়ানা’ আক্রান্ত হতে দেবো না। যে মুহূর্তে এই নিবন্ধের অবতারণা, তার ঠিক কিছু সময় আগেই হরিয়ানার রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে একহাত নিলেন মমতা ব্যানার্জি। হরিয়ানা সরকার ৫২ জন বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিককে তাদের সন্দেহজনক গতিবিধি দেখে চিহ্নিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের যে সব জেলা থেকে তারা এসেছে বলে দাবি করেছে, তাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেই সকল জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের জানিয়েছে হরিয়ানা সরকার। ব্যাস্! এহেন ঘটনা ঘটলেই তাতে প্রবল বাঙ্গালি বিদ্বেষী মনোভাব দেখতে পান মমতা ব্যানার্জি। চোখে ভোটস্বপ্ন নিয়ে এক বিভ্রান্তিকর ন্যারেটিভ তৈরি করছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, ভারতের যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি পরিচালিত
সরকার রয়েছে, সেখানেই নাকি বাঙ্গালি-বিদ্বেষী আচরণ চলছে। প্রশ্ন হলো- সত্যিই কি তাই?
এটা তার একটি ডাহা মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়। কারণ সত্যিটা হলো ভারত জুড়েই বাংলাভাষী ধরা পড়ছে, যারা বাংলাভাষী হলেও ‘বাঙ্গালি’ নয়। সেই সব অসংখ্য বাংলাভাষী হলো অনুপ্রবেশকারী মুসলমান। দুর্নীতিগ্রস্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং রাজ্যের শাসক দলের মদতে এই অনুপ্রবেশকারীরা যাবতীয় নথি ও পরিচয়পত্র তৈরি করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে। তারা বাংলাদেশ বা মায়ানমারের বাসিন্দা, অর্থাৎ বিদেশি নাগরিক হলেও ভারতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়েছে। এই অনুপ্রবেশকারীরা ঘাপটি মেরে থাকে ভারতের বিভিন্ন দিকে। কোথাও তারা জেহাদি, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে যুক্ত, কোথাও তারা নানারকম জাল, অবৈধ লেন-দেন, মানুষ পাচার চক্র চালায়, কোথাও বা অঙ্গ পাচার, মাদক পাচার চক্রের তারা মাথা। তাদের অনেকেই আবার বিভিন্ন লোকের ঘর-গৃহস্থালিতে, দেশের নানা সংগঠিত-অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ তাদের ‘মুক্তাঞ্চল’। মায়ানমার, বাংলাদেশ থেকে এ রাজ্যে ঢুকে এই অনুপ্রবেশকারী জেহাদিরা ছড়িয়ে যায় ভারতের নানা প্রান্তে। তাদের চিহ্নিতকরণ ও বহিষ্কারের প্রক্রিয়া যদি চলে তবে তা হলো অনুপ্রবেশকারী বিতাড়ন। বাঙ্গালি নির্যাতন নয়। মমতা ব্যানার্জির চিলচিৎকার জুড়ে অভিযোগ করছেন যে, পরিযায়ী, বাংলাভাষী, বাঙ্গালি শ্রমিকদের হেনস্থা করা হচ্ছে, তাদের রোহিঙ্গা-বাংলাদেশি ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তাহলে তামিলনাড়ুর ঘটনাকে কী বলবেন মুখ্যমন্ত্রী? আপনার ইন্ডিজোট-সঙ্গী স্তালিনের রাজ্যেই গত ১৬ জুন তামিলনাড়ু সরকারের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স এক ঝটকায় ২৫ জনের উপর বাংলাভাষী অনুপ্রবেশকারীকে পাকড়াও করল। হতে পারে তারা বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা মুসলমান। জঙ্গিদের দ্বারা পহেলগাঁওয়ের নৃশংস ঘটনার পর প্রত্যেকটি রাজ্য সরকারকেই অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে সচেতন হতে নির্দেশ পাঠায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। শুধুমাত্র তামিলনাড়ুতেই ২০২২ থেকে এখনও পর্যন্ত মোট ২০২ জন অনুপ্রবেশকারীকে আটক করা হয়েছে এবং তারা সবাই বাংলাভাষী। বাংলাভাষায় তারা কথাবার্তা বললেও তারা কিন্তু কেউই ‘বাঙ্গালি’ নয়, কেউ বাংলাদেশি মুসলমান, কেউ রোহিঙ্গা মুসলমান। রাজনৈতিক স্বার্থে মমতা ব্যানার্জি বিজেপি শাসিত হরিয়ানার উদ্দেশ্যে অতি প্রতিক্রিয়াশীল হলেন এবং জোটসঙ্গী স্তালিন-শাসিত তামিলনাড়ুর বেলায় চুপ থাকলেন। এই ঘটনাতেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এটা তার কোনো প্রতিবাদ বা বাঙ্গালি-দরদ নয়। কেবলমাত্র ভোট সংক্রান্ত অঙ্ক কষে পশ্চিমবঙ্গের ভাতাপ্রিয় বাঙ্গালিকে স্নায়বিক স্তরে বিচলিত করার লক্ষ্যে এই নকল প্রতিবাদের নাটক করে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাদের সামনে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন যে, আমি আছি তাই বাঙ্গালিয়ানা জিইয়ে রেখেছি। বাস্তবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, মেলা-খেলা, কাটমানি-কারচুপি করে চলছে তাঁর দল ও সরকার। মাছ-ভাত প্রিয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গাঁ- গঞ্জ, ব্লক ও কার্ড, রেশন কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এমনকী
পাসপোর্ট পর্যন্ত মেলে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের জন্য। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের অনেক জেলা থেকে ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা গিয়েছে যে, একদল মানুষের এক হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট, অন্যহাতে ভারতের ভোটার আইডি কার্ড। এইসব ভূতুড়ে ভোটার
আসলে সন্ত্রাসী। তারা যে ভারতবিরোধী অপশক্তি এনিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তারা যে বাংলাভাষী তা একপ্রকার নিশ্চিত। তাদের অনেকেই ধরা পড়েছে তামিলনাড়ু বা কেরালার জঙ্গি ঘাঁটি থেকে। ২০১৮-১৯-এ বনগাঁতে জাল ভোটার কার্ড চক্র ধরা পড়ে। সীমান্তের ওপারের ভারত বিদ্বেষী, বাংলাদেশি, আরবি-জারিত বাংলায় কথা বলা জেহাদিরা ভারতে আসে ভারত বিরোধী চক্রান্ত সিদ্ধ করতে। তার প্রস্তুতির মুক্তাঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ। রত্না বিশ্বাসের মতো হাবরার তৃণমূলনেত্রীরা এদের দেয় ভোটার কার্ড তৈরি করে দেওয়ার আশ্বাস। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি বিরাট অংশ অরক্ষিত। জমি না দেওয়া-সহ রাজ্য সরকারের নানা অসহযোগিতার কারণে সেখানে কাঁটাতার দেওয়া এখনও সম্ভবপর হয়নি।
২০০৫ সালে কিন্তু মমতা ব্যানার্জির চোখে বাংলাদেশি মুসলমানরা ‘অনুপ্রবেশকারী’ই ছিল। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “The in- filtration in Bengal has become a disaster now. You can see the Bangladeshi and the Indian voters’ list. This is a very serious matter. I would like to know when would it be discussed in the House?” তারপর ২০১৮ সালে তিনি অবতীর্ণ হলেন এক নতুন রূপে। রাজ্যজুড়ে তিনি তুমুল ঝড় তুললেন সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) নিয়ে। সরকারপক্ষ প্রস্তাবিত কোনো বিলে যদি কোনো ভুলত্রুটি থাকে বা তা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, তবে বিতর্ক ও বিবর্তন সাপেক্ষে তা সংশোধিত ও পরিমার্জিত করার দায়িত্ব বিরোধীপক্ষের। কিন্তু তার বৃহত্তর উদ্দেশ্য যদি রাজনৈতিক ভোটসর্বস্বতায় ব্যর্থ হয়, তখন ওপারের আয়েশারা এপারে এসে ভুয়ো অনামিকা হয়ে যায়। ভারতের জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে তা হয় একটি বিপদ সংকেত। ২০০৫ সালে মমতা ব্যানার্জি জানতেন যে, পশ্চিমবঙ্গ হলো অনুপ্রবেশের উর্বর জমি। ওই বছরের ৪ আগস্ট বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জি
লোকসভার ডেপুটি স্পিকার চিরঞ্জিত সিংহ অটওয়ালকে লক্ষ্য করে তড়িৎবেগে অনুপ্রবেশকারীদের নাম-পরিচয় সংবলিত একটি কাগজের বান্ডিল ছুঁড়ে দেন। ১৯৯৮ সালে যখন তার দল তৃণমূল কংগ্রেস সদ্য গঠিত হয়েছে, তখন তিনি অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে একটু নরম অবস্থান নিয়েছিলেন। তৎকালীন মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার বেশ কিছু মুসলমান, পরিযায়ী শ্রমিককে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করে। সেই প্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৭ জুলাই সংসদে দাঁড়িয়ে মহারাষ্ট্র সরকারের উদ্দেশে মমতা ব্যানার্জি বলেন- ‘…even if somebody is a Bangladeshi, he should not be treated like cats and dogs, as we have traditional ties, ethnic and common culture with Bangladesh…’ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যখন অনুপ্রবেশের বাড়বাড়ন্ত, তখন সেই জাতীয় সংকটকে রুখতে কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্যের সরকার নানা ব্যবস্থা নিলে তা অনেক সময় দেশের নিরীহ, সাধারণ নাগরিকদেরও বিরক্তির কারণ হয়। কিন্তু প্রশাসনও কখনো কখনো কর্তব্যবোধে অবিচল থাকে। সংসদে দাঁড়িয়ে মমতা ব্যানার্জির দু’টি ভাষণ পাশাপাশি দেখলে একাধারে তার অনুপ্রবেশ বিরোধ এবং বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের প্রতি তার হালকা প্রীতি কেমন যেন মিলেমিশে একাকার মনে হবে।
১৯৯৮-এর সেই অল্পসংখ্যক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিষবৃক্ষের চারাটি শাখা-প্রশাখা মেলে আজ রীতিমতো মহীরুহে পরিণত হয়েছে। তার ডালে ডালে নৃত্য করছে জালি ভোটার, জঙ্গি, মোল্লাবাদ। পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে এরা গড়ে তুলছে অসংখ্য মিনি পাকিস্তান। পুলিশ পর্যন্ত সমঝে চলে এইসব
লুঙ্গিবাহিনীদের। এরা তৃণমূলের ভোটব্যাংক ও ভোট মেশিনারি। তৃণমূলের এই সম্পদদের ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু হলেই তৃণমূলের প্রচণ্ড ক্রোধ ঝরে পড়ে, চারিদিকে তারা তোলে গেল গেল রব। দেশজুড়ে যেই ভোটার তালিকা সংশোধনের পর্ব চলছে, অনুপ্রবেশকারীদের ধরপাকড় চলছে, সেই আবহে বাঙ্গালিয়ানার
তান ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ও তাঁর দল প্রচার শুরু করেছেন যে, দেখে দেখে বাঙ্গালি খেদাও, বাঙ্গালি ধরো, বাঙ্গালি হটাওয়ের প্রক্রিয়া দেশজুড়ে চলছে। এইসব রাজনৈতিক শ্লোকের মাধ্যমে মিথ্যাটা একবার সাধারণ বাঙ্গালি জনতার মগজে ঢোকাতে পারলেই তার কেল্লা ফতে! রেসের যে বিষয়টি রয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রেস বা জাতিটি যে দেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেই দেশের প্রতি আনুগত্যও। বাঙ্গালিয়ানার সঙ্গে ভারতবোধ বা রাষ্ট্রচেতনা তাই সম্পৃক্ত। ভারত (পশ্চিমবঙ্গ) ও বাংলাদেশের কালচারাল ও লিঙ্গুইস্টিক ন্যাশনালিজমের মধ্যে তফাত অসংখ্য মাইলের। যদিও পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এখন চূড়ান্ত প্রভাব রয়েছে রিলিজিয়াস (ইসলামিক) ন্যাশনালিজমের। একজন বাংলাভাষী মুসলমান ভারতীয় না বাংলাদেশি সেই পার্থক্য একজন তামিলনাড়ু বা গুজরাটের আধিকারিক সহজে ধরতে পারেন না। সেই সুযোগে ভারতীয় বাঙ্গালিদের সঙ্গে আরবি-মিশ্রিত বাংলাভাষায় কথা বলা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বা
চাটগেঁয়ে (চট্টগ্রাম ঘেঁষা) বাংলাভাষায় কথা বলা রোহিঙ্গাদের এক করে দিচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। ভোটব্যাংক এবং রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় সবাইকে এক ঘরের, এক শ্রেণীর বলে দাবি করছেন।
পরিশেষে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। উত্তরপ্রদেশের পিলিভিট। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে প্রায় ৩৭ হাজার উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালির ঠিকানা জোটে সেখানে। জায়গাটাকে অনেকে বলেন উত্তরপ্রদেশের ‘মিনি বাঙ্গলা’। বাঙ্গালিরা ওখানে মাছে-ভাতে ভারতীয়। কিন্তু একজন বাঙ্গালিও কোনো অবিশ্বাস-সন্দেহ-ভাষা
আক্রমণের শিকার হননি এতগুলো বছরেও। তাই তামিলনাড়ুতে আটক বাংলাভাষী বাংলাদেশি আর প্রবাসী ভারতীয় বাঙ্গালির পার্থক্যটা সকলের অনুধাবন করা প্রয়োজন। অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার সময়ে ভাষা-উচ্চারণ-শব্দ নয়, নাগরিকত্বের অনুসন্ধানটাই হওয়া উচিত প্রথম ও প্রধান উপকরণ। মমতা ব্যানার্জি জানেন সেটাই হতে চলেছে। আর জানেন বলেই ভোটব্যাংক এবং নিজের গদি বাঁচাতে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নেমে পড়েছেন। যেকোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি
ছড়াতে তিনি খুব ভালো পারেন। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে জনবিন্যাস পরিবর্তন যত বেশি হবে, তৃণমূলের ভোট তত বাড়বে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সেই অঙ্কে ওস্তাদ, তাই তিনি তার দুধেল গাই অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশিদের ভোটব্যাংক ও ভোট মেশিনারির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে ভালো জানেন। কে বাঙ্গালি তার বিচার করবেন উনি? ভাবাটাই বোকামি!