বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ছিলেন অনুপ্রবেশের বিপক্ষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অনুপ্রবেশের পক্ষে
বিশ্বপ্রিয় দাস
রাজ্যের শাসক দলের বার্ষিক উৎসব হয়ে গেল। এই উৎসবে আসা মানুষেরা নেচে, গেয়ে, বহুরূপী সেজে অনুষ্ঠানটিকে রঙিন করে তুলেছিল। যাঁদের উদ্দেশ্যে এই সভা, তাঁরা হয়তো ভাবতেই পারেননি, তাঁদেরকে নিয়ে এই ধরনের একটা উৎসব হবে। এবার ২১ জুলাই রাজ্যের শাসক দলের কাছে ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। মনে সংশয় ছিল যে ভিড় ঠিক ঠাক হবে তো? ইতিমধ্যেই নানা ভিডিয়োতে সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে গেছে। সেখানে দেখা গেছে, টাকার বিনিময়ে এই সভায় মানুষজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। ওখানে থাকা পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, সভায় অন্য বারের তুলনায় মানুষজন অনেকটাই কম এসেছে। যে মিছিলগুলি বিভিন্ন রাস্তা ধরে এসেছে, সেগুলির কলেবর ছিল অনেকটাই ছোটো। এছাড়াও গাড়ির সংখ্যা আগের তুলনায় বেশ কম। ওই সভায় যারা গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারা গেছে, বাইরে থেকে আসা গাড়িগুলিতে সংখ্যায় লোক ছিল কম। অনেক গাড়ি ১০ থেকে ১২ জন নিয়ে এসেছে।
আবার দেখা গেছে সকালে সভাস্থলে মানুষ এসে বেশিক্ষণ থাকেনি। অনেকে অভিষেক ব্যানার্জি ভাষণ শুরু হবার আগেই সভাস্থল ছেড়েছেন। আবার এও দেখা গেছে যে যখন তৃণমূল সুপ্রিমো ভাষণ দিচ্ছেন, সেই সময় দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আসা বহু গাড়ি বাড়ির দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছে। এবারে আগের রাত্রে বিভিন্ন জায়গায় যে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে থাকা রান্নার দায়িত্বে থাকা একটি বিশেষ সূত্র বলছে, গতবারে যে পরিমাণ রান্না হয়েছিল, তাঁর থেকে ২০ শতাংশ কম হয়েছে। এদিকে যখন মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চ কাঁপিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য দরদে গলা ফাটাচ্ছেন, সেই সময়ে কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে, চিড়িয়াখানায়, ভিক্টোরিয়ায়, জাদুঘরে, এমনকী রেসকোর্সের লাগোয়া এলাকায় ভিড় ছিল উপচে পড়া। বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামেও ভিড় ছিল মিছিলে আসা ব্যাচ লাগানো মানুষের। এই সব মানুষদের বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারা গেছে, এরা কেউ এসেছেন জঙ্গলমহল থেকে, বীরভূম থেকে, নদীয়া থেকে, কেউ উত্তরবঙ্গের কোনো জেলা থেকে। নিউ মার্কেটে এদিন জামাকাপড় কেনার ভিড় ছিল খুব। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন অনেক কিছুই। আদতে তাঁর ডাক আর সেই মতো যে কাজে আসছে না, সেটা তিনি এবারে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
সারা রাজ্য থেকে তৃণমূল সমর্থকরা এই বার্ষিক রাজনৈতিক উৎসবে আসেন, মুখ্যমন্ত্রী কী বলেন, সেটা শোনার জন্য। সামনে নির্বাচন। তাই এবারের এই ২১ জুলাই উৎসব ছিল শেষ উৎসব। ফলে রাজনৈতিক বক্তব্য শোনার জন্য বেশ কিছু সমর্থক এসেছিলেন। এবারের এই মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড (ভাইপো) বাঙ্গালি প্রীতির একটি ইস্যু তুলেছেন। যে ইস্যু অনুপ্রবেশকারীদের বৈধতা দেবার জন্য রাজ্য সরকারের উদোগকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যে ইস্যু নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে ১৩টি তাজা প্রাণের বিসর্জন দিয়েছিলেন। আজ সেই অনুপ্রবেশকারীদের বৈধতা দিতে তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন। বিশেষ করে সারা পৃথিবীর সমস্যা, সেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য। যারা মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে এই দেশে অনুপ্রবেশ করেছে, শুধু তাই নয় বাংলাদেশ থেকে খোলা সীমান্ত দিয়ে বহু বালাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলমান এই পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছে। তাঁদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড তৈরি হয়ে গেছে শাসক দলের সহযোগিতায়। যেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।
মুখ্যমন্ত্রী আঙুল তোলেন কেন্দ্রের দিকে। কেননা সীমান্ত রক্ষা করেন বিএসএফের জওয়ানরা। কেউ যদি খোলা সীমান্ত এলাকায় গিয়ে থাকেন, দেখবেন যেখানে তারকাঁটার বেড়া নেই, সেই অঞ্চলে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতকারীদের অবাধ আনাগোনা। পাচার নিত্যনৈমিত্তিক একটা বিষয়। আগের বাম সরকারও বেড়া দিতে দেয়নি, এই সরকারও একই পথে হাঁটছে। মানুষ, সোনা, গোরু থেকে ড্রাগ সব এই পথ ধরেই যাওয়া আসা করে। আর অনুপ্রবেশকারীরা আসে এপারের দালাল, ওপারের দালালের সহযোগিতায়। এই প্রতিবেদকের সুযোগ হয়েছিল এই দৃশ্য দেখার। সন্ধ্যা নামলেই বিএসএফ কোনো বাঁশের মাচার মতো চৌকিতে আর থাকতে চান না। তাঁদের জিজ্ঞেস করলে, জানা গিয়েছে, এখানে টহল দেওয়া সম্ভব নয়। ঝুঁকি আছে। না আছে আলো, না আছে বিদ্যুৎ। সেই সুবিধাটুকুও করতে দেওয়া হয়নি বিভিন্ন জায়গায়। সরকার অনুমতিও দেয়নি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেবার। দিনের বেলায় যতটুকু থাকে, সন্ধ্যা নামলে কিছুতেই থাকা সম্ভব হয় না সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। ফলে তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওদিকে সীমান্ত লাগোয়া বহু ‘নো ম্যানস ল্যান্ড দখল’ হয়ে গেছে।
এছাড়াও বহু সরকারি জমিতে বসবাস করছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন যে এদের নিয়মিত যাতায়াত আছে বাংলাদেশে। এখানে পয়সা দিলে আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড পাওয়ার কোনো অসুবিধা নেই। হাজারো দালাল আছে। এদের সবাই শাসক দলের সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত আছে। আর যারা অনুপ্রবেশকারী, তাদের আবার শাসক দলের হয়ে সব থেকে বেশি গলা ফাটাতে দেখা যায় এইসব এলাকায়। এই বিষয়ে
অসমের মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া একটি তথ্যকে মান্যতা দিতেই হবে, গত তিন দশক ধরে এই অনুপ্রবেশ সমস্যা রুখতে বদ্ধপরিকর অসম সরকার। অসমের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, যে অসমের ১০ লক্ষ একর জমি দখল করে নিয়েছে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা। যার ফলে নানা সমস্যা দেখা গিয়েছে অসমে। সেখানেও বাংলাভাষা বলেন অনেকেই। সেখানকার ভূমিপুত্ররা নানা জায়গায় বঞ্চিত হচ্ছেন এদের জন্য।
অন্যদিকে যে অনুপ্রবেশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ভোটের রাজনীতি সেদিনও করেছিলেন, আজও করছেন। সেদিন তিনি ছিলেন বিপক্ষে, আর আজ সপক্ষে। এটার সঙ্গে আবার বোকার মতো জুড়েছেন বাংলা বললেই বাঙ্গালি সেন্টিমেন্ট। সারা দেশে বাঙ্গালি হেনস্থার সেন্টিমেন্ট। এই সেন্টিমেন্ট আবার ২০২৬-এর ভোটের ইস্যুও বানিয়ে ফেললেন। সারা দেশে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া চলছে। পাশের রাজ্য বিহারের ভোটার তালিকা থেকে কয়েক লক্ষ নাম বাদ পড়েছে। সেখানেও দেখা গেছে বাংলা ভাষায় কথা বলা অনুপ্রবেশকারীরা রয়েছেন। যারা নিজেদের পরিচয়ের বা ভারতের নাগরিকত্বের সঠিক প্রমাণ দিতে পারেননি। দেখা গেছে বিপুল সংখ্যায় রয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমান। রোহিঙ্গাদের যদি ইতিহাস দেখা যায় এরা আরাকান হলেও, সিংহভাগ কিন্তু মায়ানমারে গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে গিয়েছিল সব থেকে বেশি। ফলে এদের অধিকাংশই বাংলা বলে। মায়ানমার সরকারের অর্থনীতিতে প্রবল চাপ পড়েছিল এই অনুপ্রবেশকারীদের জন্য। ফলে তাদের বিতাড়নের উদ্যোগ নেয় তারা। এরা সবাই মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দা। এই অনুপ্রবেশকারীদের সেই দেশের সরকার দেশের নাগরিকত্ব তো দেয়নি, উলটো তাঁদের দেশ ছাড়া করতেও পিছপা হয়নি।
ফলে এরা আশেপাশের বিভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আর নিজেদের শরণার্থী হিসেবে সেই দেশের সুবিধা ভোগের দাবি জানাতে থাকছে। এদের জন্য সেই দেশের ওপর অর্থনৈতিক চাপ পড়ছে। কোনো দেশই এদের নাগরিকত্ব দেয়নি। এমনকী বাংলাদেশও নয়। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্য সরকার এদের জামাই আদরে রাখতে শুরু করেছে। এদের সিংহভাগ বাংলাদেশের বলে এরা বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকে। ফলে রাজ্য সরকারের কাছে এরা বাঙ্গালি। আর এই
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা মুসলমান, যারা নদীপথে এই পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে, তারা ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। একটি সূত্র বলছে, কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চলের বাসিন্দারা এই সব অচেনা মুখকে গত নির্বাচনের সময়ে দেখছেন। এমনকী এই সব অচেনা মুখগুলি শাসক দলের ঝান্ডা নিয়ে রাস্তায় মিছিলেও হেঁটেছে।
ফলে এদেরকে নিয়ে বেশিদূর আর অভিযোগের তির এগোননি। সবাই বাংলা ভাষায় কথা বললেও, এরা বাংলাদেশি মুসলমান। এদিকে পাড়ায় পাড়ায় এখন প্যান কার্ড, আধার কার্ড তৈরির দালাল রয়েছে। ফলে পয়সা দিলেই হয়ে যাচ্ছে সব। পশ্চিমবঙ্গ এখন অনুপ্রবেশকারীদের স্বর্গ রাজ্য। বাইরে যে সব বাংলাভাষী
অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছে, তদন্তে দেখা গেছে, এদের আধার কার্ড, ও ভোটার কার্ড তৈরি হয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গ থেকে। আর সেগুলি ভুয়া নাম, পালটানো নাম দিয়ে। এমনকী দেখা গেছে, একজন মুসলমান, এই রাজ্যে এসে হিন্দু নাম নিয়েছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী যে বাঙ্গালি সেন্টিমেন্টের নোংরা খেলা খেলতে চাইছেন, সেটা প্রকারান্তরে এই ভারতে এক বাংলা ভাষীদের সঙ্গে লড়াই লাগিয়ে দেবার জন্য, গৃহযুদ্ধ লাগাবার একটা পরিকল্পনা।
শেষে আসি তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ডের কথায়, তিনি এত বছরের সাংসদ। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, সংসদে ভারতীয় সংবিধানের ১২০ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করেই বলা আছে, কেউ যদি হিন্দি বা ইংরেজিতে তাঁর বক্তব্য না রাখতে পারেন, তখন স্পিকার সেই সাংসদকে মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ দেন। ফলে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড যে ভুল বোঝাচ্ছেন বা মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন, সেটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি তাঁর মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখলে কেউ তাঁকে থামাবে
না, আর বের করেও দেবে না। তাঁর সুবিধা আছে, তাঁর মাতৃভাষা বাংলা। ফলে তার হুংকার যে মিথ্যা সেটা প্রমাণ হয়ে যায়। অন্য ইস্যু কাজে এল না, তখন বোকার মতো এই ইস্যু নিয়ে এলেন বাঙ্গালি। বাঙ্গালি তাঁর চালাকি ধরে ফেলেছে সেদিনই, যেদিন মুখ্যমন্ত্রী বহিরাগত অবাঙ্গালিকে সংসদে পাঠিয়েছিলেন।