আপন প্রতিভা বলেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি
দীপক খাঁ
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ, মা সারদার চতুর্দশ সন্তান হিসেবে পৃথিবীর আলো দেখেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মমতে
দীক্ষিত।
ছেলেবেলায় তেরো বছর আট মাস বয়সে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রথম স্বনামে কবিতা ছাপা হয়- ‘হিন্দুমেলার উপহার’। দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চা করত। তাঁদের আড্ডায় যোগ দেন অক্ষয় চৌধুরী, বিহারীলাল চক্রবর্তী, নবীনচন্দ্র সেন। এঁদের সঙ্গে কিশোর রবীন্দ্রনাথ যোগ দিতেন।
১২৮৪ বঙ্গাব্দে দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘ভারতী’ প্রকাশিত হলো- সেখানে নিয়মিত লিখে চলেন রবীন্দ্রনাথ। বৈষ্ণব কবিতার ভাবনির্যাস শিশু বয়স থেকেই
‘ভানুসিংহের পদাবলী’- ব্রজবুলি ভাষায় এই কবিতাগুলি লেখা। এবার কবি লিখলেন, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নামের গীতিনাট্য। রবীন্দ্রাথের ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও বৌঠান কাদম্বরী দেবী তখন থাকতেন চন্দননগরে- বাড়ির পাশেই গঙ্গা, কবি লিখছেন- সেই প্রথম আমি অনুভব করলাম বাংলাদেশের নদীই বাংলাদেশের প্রাণের বাণী বহন করে। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন- ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাস। প্রতাপাদিত্যের জীবন অবলম্বন
করে এই কাহিনি গড়ে উঠেছে। পরে সদরস্ট্রিটের বাড়িতে- ‘তখন সূর্যোদয় হইতেছিল, বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেই দিকে চাহিলাম, হঠাৎ মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন। আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোকে একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল।’ এই অপূর্ব অনুভূতির মধ্য দিয়ে তিনি লিখলেন বিখ্যাত কবিতা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।
ঠাকুর বাড়িরই এক কর্মচারীর কন্যা- বয়স বারো, নাম- ভবতারিণী। তাঁর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয় ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর। বিয়ের পর নতুন কন্যার নাম হলো মৃণালিনী দেবী। পাঁচ মাস পরেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলেন। তিনি যে শুধু রবীন্দ্রনাথকে স্নেহ করতেন তাই নয়,
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা। সমস্ত জীবন ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অসংখ্য রচনায় বউদির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর দার্শনিক মানুষ। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সরকারি চাকুরি করতেন। অন্য ছেলেরা জমিদারি দেখাশোনার কাজে উপযুক্ত ছিলেন না। তাই সব ভার এসে পড়ল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর। বঙ্গের গ্রামেগঞ্জে নদীপথে ঘুরতে ঘুরতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তা তাঁর সাহিত্যকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল।
তাঁর জীবন প্রকৃত অর্থেই ছিল প্রবহমান নদীর মতো। বন্ধু শ্রীশচন্দ্র ‘হিতবাদী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন। রবীন্দ্রনাথ হলেন এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক। সেই সময় তিনি জমিদারির কাজে নিয়মিত শিলাইদহে যেতেন- সেখানকার মানুষজনের ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখের আলোয় জন্ম নিতে থাকে একের পর এক ছোটো গল্প। যেমন, দেনাপাওনা, গিন্নি, পোস্টমাস্টার, ব্যবধান, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা। প্রতিটি গল্পই প্রকাশিত হয় ‘হিতবাদী’ পত্রিকায়।
পরে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রেরা মিলে একটি পত্রিকা প্রকাশ করল, নাম ‘সাধনা’। তাতে রবীন্দ্রনাথের কলমে গল্পের জোয়ার বইতে শুরু করল। প্রথম গল্প- খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, সম্পত্তি সমর্পণ, কঙ্কাল, জীবিত ও মৃত, স্বর্ণমৃগ, জয়পরাজয়, দালিয়া- প্রতিটি গল্পই বিয়োগান্তক। জমিদারির কাজে রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফাল্গুন মাস, কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই, হঠাৎ কবির মধ্যে জেগে উঠল বার্ষধারার আবেগ। লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা- ‘সোনার তরী’, গানে গরজে মেঘ ঘন বরষা কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’।
এই কবিতা নিয়ে সমসাময়িককালে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। আসলে এক শ্রেণীর মানুষ তাঁর খ্যাতি প্রতিভায় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কবির
সৃজনী শক্তির পথে তারা কোনরকম প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে পারেনি।
প্রকৃত অর্থেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বদেশ প্রেমিক। নিজের দেশ ও দেশবাসীর প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন- ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’, ‘ইংরেজের আতঙ্ক’, ‘সুবিচারের অধিকার’, ‘রাজা ও প্রজা’। প্রতিটি রচনায় ফুটে উঠেছে তাঁর গভীর দেশাত্মবোধ।
১৩০১ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা হলো বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাতে লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হয় সেই ব্যাপারে তাঁর ছিল সুতীব্র আগ্রহ। প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম বঙ্গের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি দেশের শিক্ষিত মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশের ছড়া সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এই সময় দক্ষিণারঞ্জন রচনা করলেন ‘ঠাকুমার ঝুলি’। পরের বছর প্রকাশিত হলো রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রা’ আর চৈতালি’। চিত্রায় কবি স্বপ্নলোক থেকে বাস্তব জীবনের পটভূমিতে নেমে এসেছেন। এতে সংকলিত কবিতাগুলি হলো- এবার ফিরাও মোরে, পূর্ণিমা, স্বর্গ হইতে বিদায়, ঊর্বশী, ব্রাহ্মণ। এছাড়াও দুটি জনপ্রিয় কবিতা ‘পুরাতন ভৃত্য’ ও ‘দুই বিঘা জমি’-তে অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি সমবেদনা ফুটে উঠেছে।
দেশের অতীত ইতিহাস, তার গৌরবগাথা, মানুষের ত্যাগের মহিমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তারই প্রকাশ ঘটেছে ‘কথা ও
কাহিনি’র কবিতাগুলির মধ্যে। সাহিত্য জগতের মানুষ হয়েও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল। ভারতে বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটাবার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অপরিসীম। জগদীশচন্দ্র বসু তখন বিলেতে গবেষণা করছেন, তাঁর অর্থের প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের শরণাপন্ন হলেন। মহারাজা রবীন্দ্রনাথকে দশ হাজার টাকা দিলেন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে নতুন করে ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পাদক। প্রবন্ধ কবিতার সঙ্গে প্রকাশিত হলো নতুন উপন্যাস- ‘চোখের বালি’।
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুদিন সপরিবারে থাকার পর শান্তিনিকেতনে এলেন। এখানে প্রতিষ্ঠা করলেন, আবাসিক বিদ্যালয়। তাঁর ইচ্ছা ছিল প্রাচীন
ভারতবর্ষের আশ্রমের আদর্শে এখানে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় কলকাতায় নিয়ে আসা হলো। কিন্তু অল্পদিনেই তাঁর মৃত্যু হলো। মৃণালিনী দেবীর বয়স তখন ত্রিশ আর রবীন্দ্রনাথের একচল্লিশ বছর। তাঁদের তিন কন্যা- মাধুরীলতা, রেনুকা, মীরা। দুই পুত্র- রবীন্দ্রনাথ ও সমীন্দ্রনাথ। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই কন্যা রেণুকা অসুস্থ হয়ে পড়ল। কবির আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানো গেল না। তখন রেণুকার বয়স মাত্র তেরো বছর। তাঁর অল্পদিন আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। পর পর দুটি বিয়োগ ব্যথায় রবীন্দ্রনাথ কিন্তু থেমে যাননি।
সেইসময় বড়লাট কার্জন বঙ্গদেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে সচেষ্ট হলেন। বহু মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলনের ফলে সে প্রচেষ্টা সফল না হলেও বেশ কিছু সমস্যা
রয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন এদেশের মূল সমস্যা দারিদ্র, প্রয়োজন গ্রমীণ ক্ষেত্র উন্নয়ন, পল্লীসংগঠন। তাঁর সেই অভিমত সে সময় কোনো গুরুত্ব না পেলেও উত্তরকালে সকলেই তাঁর গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। সে যুগে ধনী পরিবারের সকলেই পুত্রদের বিলেতে পাঠাতেন হয় আইসিএস কিংবা ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথকে এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্রকে আমেরিকায় পাঠালেন কৃষি ও গোপালন সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য, যাতে তারা গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে নিজেদের সংযুক্ত করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের এই প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল শ্রীনিকেতনে।
কবির ভাবনা বিকশিত হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতন ও শিলাইদহে। তার পাশাপাশি চলতে থাকে গীতাঞ্জলি লেখার কাজ। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে কবি লিখতে আরম্ভ করলেন বিখ্যাত ‘গোরা’ উপন্যাস। প্রায় দীর্ঘ তিন বছর ধরে ‘গোরা’ প্রকাশিত হলো ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। হিন্দু সমাজ, জীবন, তার ধর্মীয় সংকীর্ণতা, জাতিভেদের ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথ এক সত্যের ইঙ্গিত করেছেন এই উপন্যাসে। শান্তিনিকেতনে বসে কবি লিখলেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য নাটক ‘ডাকঘর’।
পুত্রবধূ প্রতিমাকে নিয়ে এবার বিলেতে গেলেন। প্রতিমা গগনেন্দ্রনাথের বোন বিনয়নী দেবীর কন্যা। অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছিলেন। সেই বালবিধবার সঙ্গে
নিজের পুত্রের বিবাহ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার কোনো তুলনা হয় না। বিলেতে কবির সঙ্গে পরিচয় ঘটে কবি ইয়েট্স-এর।
ইয়েট্স রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন। ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হলো গীতাঞ্জলি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বের হলো।
১৯১৩ সালের ১৫ নভেম্বরে কবির কাছে সংবাদ এল তাঁকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তিনিই প্রথম প্রাচ্যবাসী যিনি এই পুরস্কার
পেলেন। পুরস্কারের মূল্য এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা।
অর্থ, যশ, খ্যতি কবির জীবনকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারেনি। প্রয়াগরাজে এক আত্মীয়দের বাড়িতে চোখে পড়ে বউদি কাদম্বরী দেবীর একটি
ছবি। লিখলেন নতুন কবিতা ‘ছবি’। তারপর একের পর এক সৃষ্টি হতে থাকে ‘বলাকা’-র অবিস্মরণীয় সব কবিতা। সবুজের অভিযান, শঙ্খ, শাজাহান, ঝড়ের খেয়া, বলাকা ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনই নারীকে অন্তঃপুরের বাসিন্দা হিসেবে দেখতে চাননি। নারীদের স্বতন্ত্র মর্যাদায় বিশ্বাস রাখতেন। তারই প্রকাশ ঘটল ‘সবুজপত্রে’
একের পর এক প্রকাশিত ছোটো গল্প। এই গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- হৈমন্তী, বোষ্টমী, স্ত্রীর পত্র। ‘স্ত্রীর পত্র’ সেই সময় শিক্ষিত মহলে যথেষ্ট ঝড় তুলেছিল। ১৯১১ সালের ১৩ এপ্রিল ইংরেজ সৈন্যরা জালিয়ানওয়ালাবাগে ৩৭৯ জনকে নৃশংস হত্যা করে। এই ঘটনার তীব্র ঘৃণায় রবীন্দ্রনাথ চেমসফোর্ডকে লেখা এক খোলা চিঠিতে সরকার প্রদত্ত ‘নাইট হুড’ উপাধি ত্যাগ করবার কথা ঘোষণা করেন। ইংরেজ শাসক এতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হলো। কিন্তু দেশের মানুষ তাঁকে অভিনন্দন জানাল। দেশাত্মবোধ এতটাই প্রবল ছিল যে, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ওটেন সাহেব যখন ছাত্রদের হাতে মার খেলেন, অনেকে ছাত্রদের নিন্দা করলেও তিনি তা করেননি। ছাত্র শাসন প্রবন্ধে লেখেন- ‘ছাত্ররা যদি প্রতিনিয়ত বিদেশি অধ্যাপকের কাছে তাদের দেশের, জাতির, ধর্মের অপমানকর কথা শোনে, ক্ষণে ক্ষণে তারা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করবেই। যদি সেটা না করে সেটাই হবে লজ্জা আর দুঃখের বিষয়।’
অন্যদিকে চৌরিচৌরার ঘটনার পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্রোধকে উত্তেজিত করে তারপর অহিংসার মন্ত্র দ্বারা সে রিপুকে বশ
মানানো যায় না। ক্রোধ তার ইন্ধন খোঁজে।’ দেশের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের প্রসঙ্গে তিনি লিখলেন- ‘ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তাহলে হিন্দু-মুসলমান
কেবল মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে… এক্ষেত্রে শুধু চরকার সুতো কাটলে সমস্যার সমাধান হবে না, বিদেশিকে বিদায় করলেও আগুন
জ্বলতে… এমনকী স্বদেশী রাজা হলেও দুঃখ দহনের নিবৃত্তি হবে না।’ রবীন্দ্রনাথের এই প্রকার দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়, স্বাধীনতার সুদীর্ঘকাল পরেও সাম্প্রদায়িক হানাহানির মাধ্যমে। তখন কবি প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেছেন। পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে রচনায় ফুটে ওঠে পরিবর্তনের ছোঁওয়া। এই সময় লিখলেন ‘রক্তকরবী’, ‘চণ্ডালিকা’। রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা কবির ভালো লেগেছিল- নতুন দেশ গড়ার উদ্যম কবিকে মুগ্ধ করেছিল। লিখলেন-
‘রাশিয়ার চিঠি’।
শান্তিনিকেতনের জন্য কবির ভাষায়- ‘ভিক্ষাপাত্র’ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। তাছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক আসে। কাউকেই ফেরাতে পারেন
না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে বক্তৃতা দেবার জন্য কবিকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনিই প্রথম বেসরকারি ব্যক্তি যিনি এই সম্মান পেলেন। বহুদিনের চিরচারিত প্রথা ভেঙে কবি বাংলায় বক্তৃতা দিলেন।
কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় মর্মাহত হলেন। তিনি লিখলেন- কংগ্রেসের
অন্তঃসঞ্চিত তাপ হয়তো তাঁর অস্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠছে।
শুধুমাত্র স্বদেশের মধ্যকার মানুষদের বিবাদ-বিসংবাদ নয়, ইউরোপের বুকে জার্মানির আগ্রাসন, চীনের উপর জাপানের অত্যাচার কবিকে মর্মাহত
করত। তিনি জাপানি কবি ইয়াস নোগুচিকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন- আমি জাপানিদের ভালোবাসি, কিন্তু তাদের জয় কামনা করতে পারি না।
অনুশোচনার ভিতর দিয়ে তাদের প্রায়শ্চিত্ত হোক। ১৯৪০ সালের ৭ আগস্ট অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শান্তিনিকেতনে কবিকে ডক্টরেট উপাধি
দেওয়া হলো। দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা কবিকে সম্মান জানাল। জনৈক প্রবীণ সমালোচক লিখেছেন- সাধারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লোকের রক্ষণশীলতা বাড়ে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় হয়েছে ঠিক তাঁর উলটো, যত বয়স বেড়েছে ততই তিনি মুক্ত হয়েছেন।