‘বাঙ্গালি-প্রেম’ মমতা ব্যানার্জির দেউলিয়া রাজনীতির নয়া ন্যারেটিভ
সুজিত রায়
‘বাঙ্গালির জাত গেল, মান গেল। ভিন রাজ্যে বাঙ্গালির অস্তিত্ব বিপন্ন’ বলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং শাসক দলের একমাত্র নেতা তথা নেত্রী মমতা ব্যানার্জি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রব তুলেছেন। বাঙ্গালি মাত্রেই জানেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই রব আসলে কমিউনিস্টসুলভ একটা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ
মাত্র। কারণ গত ১৪ বছর ধরে তিনি সরকার চালাননি, সার্কাস চালিয়েছেন। রাজ্যের দিকে দিকে মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন। খুন, ডাকাতি, জালিয়াতি বেড়েছে পৌনঃপুনিকহারে। বাঙ্গালি ২৬ হাজার শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। আরও ৩০/৩৫ হাজার শিক্ষক চাকরি হারাবার দিন গুনছেন। সরকারি হাসপাতাল আরজি করের চিকিৎসক অভয়া হত্যা হয়েছে। দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজে ছাত্রীকে গণধর্ষণ করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্রনেতারা। সব মিলিয়ে এ সরকার এখন দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। ভাণ্ডার শূন্য। সাড়ে সাত লক্ষ কোটি টাকার ঋণ খোলা বাজারে। সামাজিক প্রকল্পের বাহানায় লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা অবৈজ্ঞানিকভাবে ‘ভাতা’ হিসেবে বিলি করে ভোট কিনেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে রাজ্যের উন্নয়ন স্তব্ধ। রাস্তা মেরামতি হয় না। শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারী নিয়োগ হয় না। একটার পর একটা সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভাতা দেবার পরও স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। গত ১৪ বছরে প্রায় ৭ হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দৈন্য দেখলে চোখে জল আসে। মুখ্যমন্ত্রী তাই দেউলিয়া রাজনীতিতে ধামাচাপা দিতে নতুন ন্যারেটিভ নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন- যা হলো বাঙ্গালির অস্মিতা রক্ষা। যেন সব বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ রসাতলে। তিনি একা রক্ষাকর্ত্রী হয়ে বরাভয় দেবেন। বাঙ্গালি তাঁর ওপরই ছেড়ে দেবেন নিজেদের ভূত-ভবিষ্যৎ।
পাঠককুল, একটু ভালো করে কান পাতুন- শুনতে পাচ্ছেন কোনো বাঙ্গালির আর্তনাদ যে তাঁর মান-সম্মান, সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে? একটু কান পাতুন, কোনো রাজ্য থেকে অভিযোগ পাচ্ছেন- পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসী বাঙ্গালি চাকুরে বা ব্যবসায়ী সমাজ ‘সব গেল সব গেল’ বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন? আমার আপনার ঘরের ছেলেপুলেরা যারা পড়াশোনা করে, ভালো রেজাল্ট করে অন্য রাজ্যে ভালো চাকরি করতে গেছে শুধুমাত্র জন্মভিটেয় বেঁচে থাকার রসদ নেই বলে, সামনে স্বপ্ন দেখানোর মতো কোনো সঠিক প্রতিষ্ঠান নেই বলে- তাদের কেউ কি আপনার কাছে অভিযোগ করেছে- তাদের ওপর ভিনরাজ্যের মানুষ অত্যাচার করছে? আমি নিশ্চিত- প্রশ্নটা শুনে আপনারা হাসছেন। আমি হাসছি। কারণ আমার পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় সকলেই রাজ্য ছেড়ে প্রবাসী। কেউ মুম্বাইয়ে, কেউ পুনেতে, কেউ বেঙ্গালুরুতে, কেউ গ্রেটার দিল্লিতে। তাদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আমি নিজেও মাঝে মাঝে তাদের কাছে যাই- ‘আপ বাঙ্গালি, হ্যায়- তো ইহাঁ কিঁউ? বঙ্গাল মে যাইয়ে।’ এবং শুনতে হচ্ছে- ‘বঙ্গাল মে মমতাজী ইয়ে সব কেয়া
বতাতি? আপলোগকা তো জিনা হারাম কর দিয়া।’ লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে আসে। মনে পড়ে- এই রাজ্যেই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন প্রফুল্ল ঘোষ, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখার্জি, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মতো মানুষেদের কথা। তাঁদের হাতে রাজ্য দেউলিয়া হয়নি। অভয়ার মা, তমান্নার মাকে কেঁদে কেঁদে বলতে হয়নি- মুখ্যমন্ত্রী আপনি আমাদের মেয়েদের ফিরিয়ে দিন।
আসলে চিত্রটা কী? কেন এই মিথ্যা ন্যারেটিভ? প্রথম কারণ অবশ্যই ভোটব্যাংক নিয়ে আশঙ্কা। মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন- বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাঁর দরকার। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি ভোটে ঘুণ ধরেছে। অতএব মুসলমান ভোটই তাঁর ভরসা। তাই বাঙ্গালির নাম করে তিনি বাংলাদেশি মুসলমানদের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন যাদের জাল পাসপোর্ট, জাল আধার কার্ড, জাল ভোটার কার্ড তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে, ঝাড়খণ্ডে, বিহারে আর তারা দিব্যি রাতারাতি ভারতীয় নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন। দিদির ভোটব্যাংক মানেই এই সব বাংলাদেশিরা, যারা ওইসব সরকারি নথির ভিত্তিতেই অন্য কোথাও গিয়ে স্থায়ী হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ তাদের প্রথম আশ্রয়স্থল। অতএব বলতেই হবে, মানতেই হবে- মুখ্যমন্ত্রী হুংকার দিয়েছেন বাঙ্গালিকে রক্ষার জন্য নয়- বাংলাদেশি মুসলমানদের রক্ষার জন্য। যারা প্রতিদিন অরক্ষিত সীমান্ত পার করে তৃণমূলি নেতাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে- নগদ কড়ির বিনিময়ে পেয়ে যাচ্ছে নাগরিকত্বের
নথি। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, ২০২৬ ভোটে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করবে এই অনুপ্রবেশকারীরাই।
কমিশন। ২০০৩-এর পর এবছরই শুরু হয়েছে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন। অর্থাৎ এবার ভূতুড়ে ভোটারদের রেহাই নেই। বিহারে ২১ লক্ষ ৬০ হাজার ভূতুড়ে ভোটার ধরা পড়তেই লালু-তনয় তেজস্বী যেমন ভোট বয়কটের হুংকার ছাড়তে শুরু করেছেন— এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীও আগেভাগে বাঙ্গালির জন্য ‘আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান’ গোছের হুংকার ছেড়ে বাজার গরম করছেন। কারণ এরাজ্যে ভূতুড়ে ভোটারের সংখ্যাটা বিহারের দ্বিগুণ হবে। দলের নেতা, আমচা চামচারাও তেমনি- সব শেয়ালের এক রা। দিদি ভৌ ভৌ করা মানে তারাও ভৌ ভৌ করবে একসঙ্গে; সত্য, মিথ্যা, ন্যায় অন্যায়- এসব কিছু না ভেবেই। চুলোয় যাক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আগে তো নিজেদের পকেট ভরুক। বেকারের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ- তৃণমূলি দাদা-কাকা-ভাইপোরাই-বা করবেনটা কী? খেয়ে-পরে বাঁচতে তো হবে? কাটমানি, টেরর ভাতা, থ্রেট কালচার- এগুলোইতো ভরসা।
মুখ্যমন্ত্রীই এই ন্যারেটিভ সর্বৈব মিথ্যা, যেটা আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু একইসঙ্গে একটা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে- বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে বাংলাদেশি মুসলমানদের আশকারা দিচ্ছেন— তাতে আগামী ২০২৬-এর নির্বাচনের পর এ রাজ্যের ভূমিপুত্র বাঙ্গালিরাই ভিটে আঁকড়ে থাকতে পারবেন কিনা, তাই নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, দুই দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি-সহ বহু জেলায় অচেনা মুখের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এরা কারা? জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে ঝা তকতকে নতুন আধার কার্ড। নামে হিন্দু। আচারে পোশাকে মুসলমান। দ্বিতীয় আশঙ্কা- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিথ্যা ন্যারেটিভ অন্য রাজ্যে কর্মক্ষেত্রগুলিতে কর্মরত এবং বসবাসকারী নব প্রজন্মের ঝকঝকে মেধাসম্পন্ন বাঙ্গালি ছেলে-মেয়েদের জীবন বিপন্ন করে তুলবে নাতো?
ভিনরাজ্যে বাঙ্গালিদের ওপর অত্যাচার চলছে- এই সম্পূর্ণ নির্জলা মিথ্যে অভিযোগ ভিন রাজ্যের মানুষ ও প্রশাসনকে উসকানি জোগাচ্ছে। তাঁদের মনে যদি বিন্দুমাত্র বাঙ্গালি বিদ্বেষ সুপ্ত অবস্থায় থেকেও থাকে— তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর এই উসকানি আগুনে ঘৃতাহুতির সমান হবে। কোনো সন্দেহ নেই, মুখ্যমন্ত্রীর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আসলে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর নিবিড় রাজনৈতিক কৌশলের পরাকাষ্ঠা। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশি মুসলমানদের একটা বৃহত্তর অংশকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঠিক কী করতে চাইছেন- পৃথক দেশ গঠন করতে? যদি তাই হয়, তাহলে এবার বাঙ্গালির ফোঁস করা দরকার। বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোনো অধিকার তাঁর নেই সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। দেরি করলে বিপদ থেমে থাকবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিরুদ্ধে ছোবল বাঙ্গালিকে হানতে হবেই এবং আজই। পশ্চিমবঙ্গ বাঙ্গালির ছিল, আছে, থাকবে। বাংলাদেশি মুসলমানদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ নয়। বাঙ্গালি অন্য রাজ্যে ছিল, আছে, থাকবে। বাংলাদেশিরা নিপাত যাক। মুখ্যমন্ত্রী কোনো দেবী নন, অভিভাবক নয়, ম্যাজিশিয়ান নন যে তিনি যা বলবেন তাই হবে। তিনি যা করবেন তাতেই হ্যাঁ বলতে হবে।
তৃণমূলি বাঙ্গালি অশিক্ষিত হতে পারে। অকৃতজ্ঞ হতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মাটি যে বাঙ্গালির সে তো অশিক্ষিত নয়, অকৃতজ্ঞ নয়। ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল’কে বুকে নিয়েই বাঙ্গালি অভয়যাত্রায় অংশ নেবে। সরিয়ে দেবে মায়াবিনীর ছড়িয়ে দেওয়া সমস্ত কালো পর্দা যা বহু বাঙ্গালিকে আজও অন্ধ করে রেখেছে। আমরা আশাবাদী- কালো মেঘ কাটবে। সামনেই ২০২৬। প্রস্তুত হন, শপথ নিন- দশ কোটি বাঙ্গালির বাঙ্গালিত্ব রক্ষার। বাঙ্গালির অস্মিতা রক্ষারও। এই শপথ আমাদের ভবিষ্যৎ পশ্চিমবঙ্গের জন্য আশু প্রয়োজন।