ভারত বিরোধিতায় কি মাত্রাছাড়া হবেন ইউনুস?
স্বপন দাশগুপ্ত
একমাত্র চরমতম ভারত বিরোধিতাই বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে সহায়ক হতে পারে। এটা মাথায় রেখেই বাংলাদেশকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে হয়তো জোর দেবেন ইউনুস।
গত ২৪ মে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রধান উপদেষ্টার দ্বারা মঞ্চস্থ হয় তার পদত্যাগের একটি কুনাট্য। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, চাপের মুখে নুইয়ে পড়ার মতো ব্যক্তি তিনি নন। তার ন’মাসের নেতৃত্বে নানা কিছুর সাক্ষী থেকেছে বাংলাদেশ। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং এনজিও আইকন বা বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খ্যাত ব্যক্তি মহম্মদ ইউনুসকে আগামীদিনে দেশের ত্রাণকর্তা হিসেবে ভেবে স্বাগত জানিয়েছিল বাংলাদেশ। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঘুচে গিয়েছে সেই ভাবমূর্তি। ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থকারী, ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন একজন ধূর্ত ব্যক্তি হিসেবে বর্তমানে আত্মপ্রকাশ করেছেন ইউনুস। রাজনৈতিক ভিত্তির অভাব এবং জনপ্রিয়তার গ্রাফ নিম্নগামী হওয়া সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছেন ইউনুস গদিতে টিকে থাকার উদ্দেশ্যে ইউনুসের এহেন কৌশলের কারণে বাংলাদেশকেও চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলছে নানা রাজনৈতিক সংকট। এই সাম্প্রতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই ঢাকায় একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা। এরই মধ্যে ঘটে চলেছে নানা বিস্ময়কর ও আশ্চর্যজনক ঘটনা। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন করানোর ব্যাপারে বিশেষ জোর দিয়েছে। এই দাবিকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, লন্ডনে বসে বিএনপি-কে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া পুত্র তারেক রহমান। এদিকে ইউনুস বলেছেন যে, ২০২৬ সালের জুন মাসের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনা তার লক্ষ্য। এর সঙ্গে হাসিনা সরকারের যেসব নেতা-মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। গত বছরের আগস্ট মাসের পর বাংলাদেশে আবির্ভাব ঘটেছে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের। দলটির নাম হলো- ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি। অনেকেই দলটিকে উপহাস করে ‘কিংস্ পার্টি’ (রাজার পার্টি) বলছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন এই শাসক দলটির নেতা-কর্মীরা আগামী পাঁচ বছর ইউনুসেরই ক্ষমতায় থাকা উচিত বলে সম্প্রতি মতপ্রকাশও করেছে।
নির্বাচনী নির্ঘণ্ট নির্ধারণের এই লড়াইয়ের পিছনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লুকিয়ে রয়েছে। সেনাবাহিনী ও বিএনপি-র চোখে ইউনুস হলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব, যার কাঁধে একটি বড়ো দায়িত্ব বর্তমানে ন্যস্ত। অবাধ, সুষ্ঠু এবং সব পক্ষের অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি নির্বাচন সংঘটন হলো এই মুহূর্তে ইউনুসের মূল করণীয়। কমপক্ষে এক দশক অবাধ নির্বাচন দেখেনি বাংলাদেশ। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ইউনুস প্রশাসন সহায়ক হবে বলে মনে করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। হাসিনা-পরবর্তী অধ্যায়ে প্রাথমিকভাবে সরকারি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনা। এরপর হাল ধরেন ইউনুস। এই পর্যায়ে ইউনুস প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে সেনাবাহিনীর যা ধ্যানধারণা, তার থেকে এটা স্পষ্ট যে, সেনা মনে করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে বাংলাদেশে আগামীদিনে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, জনপ্রিয় সরকার বিশেষ প্রয়োজন।
একটি সরকার গঠনের লক্ষ্যে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করানো হলো ইউনুসের দায়িত্ব। এই প্রেক্ষিতে তার ভূমিকা অত্যন্ত সীমিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের উদ্ধারকর্তা হিসেবে তিনি নিজের ‘মসিহা’ রূপী যে চিত্রটি তুলে ধরছেন, তা তার ওপরে ন্যস্ত দায়িত্বের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রেস সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী, পূর্ববর্তী সরকারগুলির সমান ক্ষমতা ভোগ করে অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে ইউনুসের সহকর্মী রিজওয়ানা হাসান কিছুটা উদ্ধতভাবেই বলেছেন যে, কেবলমাত্র নির্বাচন করানোর জন্যই তারা নিযুক্ত হননি। ইউনুসের ভাষায়, তার আসল অ্যাজেন্ডা হলো বাংলাদেশের ‘রিসেট’। অর্থাৎ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশকে ‘নতুন পথে’ পরিচালিত করতে চান। ‘নতুন ভাবে’ তারা সবকিছু শুরু করার পক্ষপাতী।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস ও তার দ্বারা নিযুক্ত অন্যান্য উপদেষ্টাদের নতুন ভাবে পথ চলার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি। চট্টগ্রাম বন্দরের বেসরকারীকরণও এর অন্তর্গত। এই উপদেষ্টারা ছাড়া প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যরা নানা ক্ষেত্রে আরও মহান চিন্তাধারা পোষণ করেন! এইসব বড়োসড়ো ধারণা নিয়ে তারা রীতিমতো মাঠে নেমে পড়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। বাংলাদেশ হতে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ পর্যন্ত বিতর্কিত ‘মানবিক করিডোর ‘টি তারই প্রস্তাবিত। বাংলাদেশের অনেকেই এই করিডোরটিকে তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি মার্কিন হস্তক্ষেপের সূচনাপর্ব হিসেবে দেখছেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দখলদারির ব্যাপারেও বাংলাদেশের ভিতর মার্কিনি হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ তুলে সরব হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আসন্ন বিপদ সম্পর্কে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন সতর্কবাণী। এর বিপ্রতীপে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিকে চীন-প্রভাবিত বাজারের অন্তর্ভুক্ত করার মতো হাস্যকর ও অর্থহীন পরিকল্পনা নিজের মনে লালন করেন ইউনুস। স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত ক্ষেত্রে নির্বোধ ইউনুস প্রণীত এই নীতিটি প্রকাশ্যে আসতেই কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে নয়াদিল্লি। কৌশলগত বিষয়ে ইউনুসের এহেন অদ্ভুত মতপ্রকাশ দু’দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য রদ করার ক্ষেত্রে বস্তুত নয়াদিল্লিকে বাধ্য করেছে। এর পরিণামস্বরূপ, বাংলাদেশি রপ্তানিকারীদের এখন প্রায়
দু’হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।
গত ২৫ মে সংস্কারপন্থী কয়েকটি ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইউনুস। তাদের সামনে কেন তিনি পদত্যাগ করতে চান তার ব্যাখ্যা দেন। এই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চতুরতার সঙ্গে ভারতের দিকে আঙ্গুল তোলেন ইউনুস। টেনে আনেন ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ’-এর প্রসঙ্গ। তার মতে, আওয়ামি লিগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলার লক্ষ্যে হাত ধুয়ে নেমে পড়েছে ভারত।
ভারতকে ‘খলনায়ক’ প্রতিপন্ন করার এই প্রয়াসটি নিঃসন্দেহে ভালো! এক কথায় দারুণ! কারণ এহেন রাজনৈতিক বক্তব্য ও ভারতের বিরুদ্ধে
ব্যবহৃত নানা পরিভাষা নিশ্চিতভাবেই ইউনুসকে বাংলাদেশের একটা বড়ো অংশ এবং জামায়াত-ই-ইসলামির কাছে প্রবল জনপ্রিয় করে তুলবে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলতে যারা আগ্রহী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং সেই মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় নিদর্শন যারা মুছে ফেলতে চায়, তাদের আবেগকেও উসকে দেয় ইউনুসের এহেন কথাবার্তা। তাদের জন্য এ ধরনের বক্তব্য যথেষ্ট উৎসাহবর্ধক।
তবে ভারতের নিন্দা-সমালোচনা হলো ইউনুসের আস্তিনের তাস। এই রিজার্ভ কার্ডটি সম্ভবত এখনই খেলবেন না তিনি। বিএনপি ও সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার কেন্দ্র হতে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য এই মুহূর্তে ইসলামপন্থী, মোল্লাবাদীদের সঙ্গে এক ভয়ংকর দর-কষাকষির খেলায় নেমেছেন ইউনুস। আগামীদিনে কিছু ‘সংস্কার’ হয়তো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে যার ফলশ্রুতিতে ধ্বংস হতে পারে ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামো। ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেহাদি, রাজাকার আজহারুল ইসলামকে সম্প্রতি মুক্ত করেছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। তার মৃত্যুদণ্ড মকুব এবং জেলমুক্তির ক্ষেত্রে নির্লজ্জভাবে প্রভাব খাটিয়েছে বাংলাদেশ প্রশাসন। সমগ্র বিশ্ব যেখানে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলীকরণের পথে হেঁটে চলেছে, সেখানে তার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি চিত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইদানীং ফুটে উঠছে। সময়ের গতির উলটো দিকে হেঁটে চলেছে বাংলাদেশ। জঙ্গি আজহারুলের মুক্তি তারই উদাহরণ।
স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাসম্পন্ন স্বতন্ত্র দু’টি ধারার মিলন ইউনুসকে এনে দিতে পারে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস। তবে অস্থির অর্থনীতি, উন্মত্ত জনতা দাপিয়ে বেরানোর ফলে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভয়ভীতির পরিবেশ, রাস্তাঘাটে তাদের অলিখিত শাসন কায়েম হওয়া বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে সংকটের কালো মেঘকে প্রতিনিয়ত ঘনীভূত করে তুলছে। স্থানীয় স্তরে চাঁদা আদায়ের রাজনীতি এবং তোলাবাজির সীমাহীন জুলুমের কথা তো কহতব্যই নয়। এই পরিস্থিতিতে যত দিন এগোবে, দ্রুত নির্বাচন করানোর দাবি জোরালো হয়ে উঠবে। অচলাবস্থা থেকে মুক্তি চাইবে জনতা। অবস্থা বেগতিক বুঝলে ইউনুসের সামনে শেষ বিকল্প থাকবে ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন। তার আগে পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে মরিয়া প্রয়াস জারি রাখবেন ইউনুস।
বাংলাদেশ জুড়ে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সূত্র ধরে তার সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ সত্যিই কঠিন। এই পরিস্থিতি আগামীদিনে কী আকার ধারণ করবে তা অনুমান করাও আজ বেশ দুরূহ একটি কাজ। একটি ‘যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি’ তৈরি করতে চাইছে ইউনুস প্রশাসন। প্রতিনিয়ত নানা উস্কানিমূলক মন্তব্য করে চলেছেন ইউনুস। ক্রমাগত তিনি তুলে চলেছেন যুদ্ধের জিগির। অনবরত দিচ্ছেন বিভিন্ন ডাক। তার এইসব আহ্বানের মধ্যে রয়েছে নানা অশুভ সংকেত। ঢাকার রাজনৈতিক অচলাবস্থা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ইউনুসকে হয়তো ভারতকে প্ররোচিত করতে দেখা যেতে পারে। সেই প্ররোচনায় পা দিয়ে ভারত যাতে প্রত্যাঘাত করে সেটাই হয়তো ইউনুস চাইবেন। সেই ক্ষেত্রে হয়তো চরম ভারত বিরোধী অবস্থান নেবেন ইউনুস। কারণ একমাত্র এই চরমতম ভারত বিরোধিতাই বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে সহায়ক হতে পারে। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে হয়তো জোর দেবেন ইউনুস।
ইউনুস যা ভেবে বা আশা করে এই পদক্ষেপ নেবেন, তার ফলাফল সম্পূর্ণ বিপরীতও হতে পারে। আগামীদিনে এর হয়তো এক ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করে রয়েছে।