তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন?
রবি মিশ্রা
‘ওভাল অফিসে আমি পৌঁছানোর আগেই এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আমাদের জয়লাভের পরেই রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান ভয়াবহ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। অবশ্যই হবে যুদ্ধবিরতি। যুদ্ধরত দু’পক্ষের মীমাংসাও অবশ্যম্ভাবী। জেলেনস্কি, পুতিন- দু’জনকেই আমি চিনি। সবাই দেখবেন যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব সমস্যার সমাধান সম্ভবপর হবে। অনেকে হয়তো বলতে পারেন যে, এইসব কথাবার্তা দম্ভের পরিচায়ক। যদিও এই যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হতে চলেছে।’- ২০২৩ সালেরজুলাই মাসে একটি রাজনৈতিক সমাবেশে কথাগুলি বলেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পরে ট্রাম্পের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি কি বাস্তবায়িত হয়েছে? ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘শান্তিস্থাপনকারী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি ট্রাম্প। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প পুরোপুরি ব্যর্থ। এছাড়াও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা দৌরাত্ম্য ঠেকানোর বড়োসড়ো দাবিও করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। তা সত্ত্বেও দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা আধিপত্যে রাশ টানতে ব্যর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প গৃহীত শুল্কনীতিও বেশ গোলমেলে এবং ব্যবসাবাণিজ্য কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাজনক নয়। ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্ত শুল্ক নীতি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। আফ্রিকা জুড়ে দেখা দিচ্ছে নানা নিত্যনতুন সংঘাত। ট্রাম্পের ‘বিশ্বশান্তি স্থাপনকারী’র দাবিটি যে একটি ফাঁকা আওয়াজ তা প্রমাণ করেছে সাম্প্রতিক ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধ। যুদ্ধ থামানো এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে
প্রয়াস চালানোর পরিবর্তে তিনি প্রতিনিয়ত আগুনে ঘি ঢালছেন।
বাস্তব পরিস্থিতি হলো, সম্প্রতি ইজরায়েল- ইরান সংঘাত সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এই যুদ্ধের অভিঘাতে জ্বলছে সমগ্র পশ্চিম এশিয়া। এতদিন লড়াইটা ছিল ইজরায়েল বনাম ইরানের প্রক্সি, অর্থাৎ হামাস, হুথি, হেজবোল্লার মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির। ইজরায়েলের সঙ্গে এই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির লড়াইয়ের আবহে গত ২ বছর ধরেই উত্তপ্ত পশ্চিম এশিয়া। বর্তমান ইরান-ইজরায়েল সংঘাত দুই দেশের সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের বিরুদ্ধে পরমাণু বোমা তৈরির অভিযোগ করে চলেছে ইজরায়েল। ইরান পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠলে তা ইজরায়েলের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে বলে বহু বিশেষজ্ঞেরও ধারণা। এই আবহে গত ১২ জুন ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিগুলি নিশানা করে আক্রমণ শুরু করে ইজরায়েল। এই সামরিক অভিযানের নাম ইজরায়েল দেয়- ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। এই অভিযানে ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা আধিকারিক এবং পারমাণবিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের অনেকেই নিহত হন। বহু বছর ধরেই ইজরায়েল দাবি করে আসছে যে, গোপনে পরমাণু বোমা তৈরি করছে ইরান। এই বোমা শুধুমাত্র ইজরায়েল নয়, সমগ্র পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের ক্ষেত্রেই বিপজ্জনক। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত প্রক্সি বা অন্যান্য জেহাদি সংগঠনগুলিকেও এই বোমা ইরান সরবরাহ করতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইজরায়েল।
ইরানকে পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠা থেকে বিরত রাখতে এই পদক্ষেপ বলে জানায় ইজরায়েল। ইজরায়েলি হানার পালটা হিসেবে ইরানও প্রত্যাঘাত করতে পারে বলে মনে করছিল বিশেষজ্ঞ মহল। ইরানের পরমাণুকেন্দ্র, সামরিক বাহিনীর কার্যালয় ও ঘাঁটিগুলিতে ইজরায়েল বড়ো মাপের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর ইরানের সেনাবাহিনী ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস্ (আইআরজিসি) তাদের পক্ষ থেকে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের ঘোষণা করে। তারা এই অভিযানের নাম দেয়- ‘অপারেশন টু প্রমিস-৩’। এরপর ইজরায়েলের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে ধেয়ে আসতে থাকে ইরানের ছোঁড়া অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্র। এর আগেও ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের সাক্ষী থেকেছে বিশ্ব। আগের বারের মতো এবারও ইরানের ছোঁড়া অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিহত করতে এবং আকাশপথেই সেগুলিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে ইজরায়েল। ১৪ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ইরান-ইজরায়েল উভয় পক্ষের যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং সামরিক উত্তেজনার ইতিবৃত্ত এই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হলো।
১২-১৩ জুন : ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার সঙ্গে ইরানের সামরিক নেতৃত্বকে নিকেশ করা ছিল ইজরায়েলের টার্গেট। সেই লক্ষ্যে এদিন অভিযান চালায় ইজরায়েলি বিমানবাহিনী। ইরানের নাতাঞ্জে অবস্থিত ‘ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট ফেসিলিটি’-কে (এই গবেষণাগারে ইউরেনিয়ামকে পরমাণু বোমা তৈরির উপযুক্ত করে তোলার কাজ হয়ে থাকে) টার্গেট করে বিমান হামলা চালায় ইজরায়েল। এছাড়াও ইরানের অন্যান্য স্থান থেকে পরিচালিত পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকেও নিশানা করে আক্রমণ চালায় ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান। ইজরায়েলের পক্ষ থেকে হওয়া আকস্মিক এই হামলায় ইরানের
শীর্ষস্থানীয় সামরিক আধিকারিকরা নিহত হন। ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন যে, ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানীরাও ছিলেন ইজরায়েলি হানার লক্ষ্যবস্তু। পালটা প্রত্যাঘাতে ইজরায়েলের বিভিন্ন শহরকে লক্ষ্যবস্তু বানায় ইরান। তাদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রের তিনটি ঢেউ ধেয়ে যায় ইজরায়েলের দিকে। ইজরায়েলের আঘাত এবং ইরানের প্রত্যাঘাতের এই আবহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে (ট্রাম্প মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজি গ্রুপ, অর্থাৎ টিএমটিজি-র মালিকানাধীন একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বা সামাজিক মাধ্যম হলো ট্রুথ সোশ্যাল) একটি পোস্ট করেন। এই পোস্টে তিনি লেখেন, “একটি ‘চুক্তি’তে আসার জন্য তিনি ইরানকে ৬০ দিনের আল্টিমেটাম বা চূড়ান্ত শর্ত দিয়েছিলেন। শর্ত মেনে এই সময়ের মধ্যে তাদের চুক্তিবদ্ধ হওয়া উচিত ছিল। আজ ৬১তম দিন!”
ইজরায়েলি বিমান হানায় ইরানের ৭ জন শীর্ষস্থানীয় সামরিক অফিসার নিহত হন বলে জানা গিয়েছে। তারা হলেন- ইরানের ড্রোন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক জেনারেল গোলাম আলি রশিদ, রেভোলিউশনারি গার্ডের কমান্ডার-ইন-চিফ এবং ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মেজর জেনারেল হোসেন সালামি, ইরানের প্রাক্তন সেনাপ্রধান এবং আয়াতোল্লা খামেইনির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কমান্ডার মেজর জেনারেল মহম্মদ বাঘেরি, কমান্ডার আমির আলি হাজিজাদেহ, জেনারেল মেহদি রাব্বানি, জেনারেল গোলাম রেজা মেহরাবি এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেইনির বিশেষ ঘনিষ্ঠ সামরিক অফিসার আলি শামখানি। ইজরায়েলি হানায় নিহত ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীরা হলেন- ফেরেদুন আব্বাসি, আকবর জাদে, আহমেদ রেজা দরইয়ানি, আমির হাসান ফাখাহি, মহম্মদ মহদি, সইদ বর্জি, আলি কাতিরিমি, আব্দ আল-হামিদ।
১৪ জুন: এদিন পশ্চিম ইরানের একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগারে হামলা চালায় ইজরায়েল। ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানায় যে, দক্ষিণ ইরানের একাধিক তৈলক্ষেত্র ও জ্বালানি মজুত কেন্দ্র লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেছে ইজরায়েল। বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্র হলো পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ‘দক্ষিণ পার্স’। ফজর জাম গ্যাস প্ল্যান্টের সঙ্গে দক্ষিণ পার্সেও হামলা চালায় ইজরায়েলি এয়ারফোর্স (আইএএফ)।
১৫ জুন : এদিন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে পারস্পরিক বিমান হামলা অব্যাহত থাকে। ইরানের সরকারি ভবনগুলি লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইজরায়েল। ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ ও নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রক এবং তেহরানে অবস্থিত পররাষ্ট্র মন্ত্রক হয়ে ওঠে ইজরায়েলি টার্গেট। এর বদলা নিতে ইজরায়েলের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে থাকে ইরান। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইরানের পক্ষ থেকে সংঘটিত এই ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইজরায়েলের বন্দর শহর হাইফার কাছে অবস্থিত ইজরায়েলের বৃহত্তম তৈল শোধনাগার এবং ইজরায়েলের বিখ্যাত গবেষণাকেন্দ্র ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স।
১৬ জুন: ইরানের জাতীয় সম্প্রচারকেন্দ্র লক্ষ্য করে এদিন হামলা চালায় ইজরায়েল। একই সঙ্গে ইরানের একটি সামরিক ইউনিটের কমান্ড সেন্টারে ইজরায়েল বোমা নিক্ষেপ করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি তেহরান বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা ইরানের এফ-১৪ যুদ্ধবিমানগুলিও ধ্বংস করে ইজরায়েল। এদিন ইজরায়েল দাবি করে যে, ‘প্রিসিশন এয়ারস্ট্রাইক’ বা নির্ভুল লক্ষ্যে বিমান হানার মাধ্যমে ইরানের চারজন শীর্ষ গোয়েন্দাকর্তাকে তারা হত্যা করেছে। ইজরায়েলের সেনাবাহিনী ‘দ্য ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস’ বা আইডিএফ জানায় যে, ১৫ জুন রাতে একটি ভবন লক্ষ্য করে তারা হামলা চালায়। এই ভবনটিতে তখন রেভোলিউশনারি গার্ড ও কুদস্ ফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক আধিকারিকরা একটি বৈঠক করছিলেন। পরিস্থিতি ভয়ংকর দিতে যেতে থাকায়, ১৬ জুন সকালে দক্ষিণ চীন সাগর ত্যাগ করে পশ্চিম অভিমুখে রওনা হয় মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিজ। ১২ জুন সংঘাত শুরুর প্রথম দিন থেকেই জানা গিয়েছিল যে ইরান-ইজরায়েলের দ্বন্দ্বের উপর কড়া নজর রাখছে আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি মন্তব্যে ইরানের রাজধানী তেহরানে লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আশঙ্কা ও আতঙ্ক। ট্রাম্প এদিন বলেন, ‘ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে না। এই কথা আমি বার বার বলেছি। এই পরিস্থিতিতে সকলের অবিলম্বে তেহরান ত্যাগ করা উচিত।’ ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরেই ইরানের রাজধানীতে ব্যাপক যানজট দেখা যায়।
১৭ জুন: ইরানের বিভিন্ন শহরে এদিন বোমা নিক্ষেপ করে ইজরায়েল। পালটা আঘাতে ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে ইরান।
ইজরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে সেই দেশের অনেক জায়গায় গিয়ে পড়ে কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানের তাবরিজ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিতে একাধিক ভবন, গুদামঘর, রাস্তা ও টানেল ইজরায়েলি হানায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাশহাদ বিমানবন্দরে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ইরানি ট্যাঙ্কার বিমানকে দেখা যায় বলে খবর। তেল আভিভ ও জেরুজালেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইজরায়েলি সেনা জানায় যে, ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ইজরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে যে, এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ইরানের সেনাপ্রধান (চিফ অফ স্টাফ) এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেইনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী আলি শাদমানিকে রাতে চালানো এক হামলায় তারা হত্যা করেছে। ট্রুথ সোশ্যালে ইরানকে হুমকি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে করতে থাকা একের পর এক পোস্টে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। একটি পোস্টে খামেইনিকে উদ্দেশ্য করে ট্রাম্প বলেন, “আমরা জানি তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ ঠিক কোথায় লুকিয়ে রয়েছেন। তিনি অতি সহজ টার্গেট হলেও যেখানে লুকিয়ে রয়েছেন, সেখানে তিনি নিরাপদ। আমরা তাকে বের করে হত্যা করব না। অন্ততপক্ষে আপাতত তো নয়।” এরপর তিনি একটি পোস্ট করেন, সেখানে তিনি লেখেন, ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ!’
১৮ জুন : ইরানের সরকারি সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইজরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে ২২০ জনের বেশি ইরানি নিহত এবং কমপক্ষে ১২০০ জন আহত হয়েছেন। ইরানের পালটা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রায় ৩০ জন ইজরায়েলি নিহত হয়েছেন বলেও এই
রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেইনি তার কট্টরপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কুখ্যাত। ইরান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন যে, ট্রাম্পের দেওয়া ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ বার্তার প্রেক্ষিতে ইসলামপন্থী নেতা খামেইনি কোনো জবাব দেবেন। এদিন সন্ধ্যায় কোনো একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে খামেইনির পক্ষ থেকে আসে একটি সতর্কবার্তা।
এই বার্তায় বলা হয় যে, ‘ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো মার্কিন হামলার পরিণতি হবে গুরুতর। আক্রমণকারীকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে ইরানের উপর এই যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়াবে ইরান। আত্মসমর্পণ করবে না ইরানি জাতি।’ এই সংঘর্ষে আমেরিকা যোগ দেবে কী না- এই প্রশ্নের উত্তরে তার অবস্থান স্পষ্ট করেননি ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে এদিন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময়ে ট্রাম্প বলেন, ‘বড়ো সমস্যায় পড়েছে ইরান এবং তারা আলোচনায় আগ্রহী।’ তিনি ফের বলেন যে, ইরানের হাতে কোনো পরিস্থিতিতেই পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে না।
১৯ জুন : সংঘর্ষের সপ্তম দিনে, ইরানের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলি মধ্য ও দক্ষিণ ইজরায়েলের বেশ কয়েকটি স্থানে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। আবার একই সময়ে ইরানের আরাকে ‘ভারী জল ব্যবহারকারী পারমাণবিক চুল্লি’তে ইজরায়েল আক্রমণ করে বলে জানা যায়। ইজরায়েলের বে-এরশেভার একটি হাসপাতালে আঘাতে হানে একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। তবে ইরানি রেভোলিউশনারি গার্ড দাবি করে যে, চিকিৎসাকেন্দ্রটি নয়, হাসপাতালের কাছে অবস্থিত ইজরায়েলের সামরিক পরিকাঠামো ছিল তাদের লক্ষ্যবস্তু। সারা দিন ধরে ইজরায়েলের বিভিন্ন স্থানে ইরানের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ার পর দিনের শেষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিপদ থেকে ইজরায়েল সুরক্ষিত থাকবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। ইজরায়েল দাবি করে যে, কয়েক ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। তার মধ্যে একটি ছিল নিষিদ্ধ ক্লাস্টার-বোমার ওয়ারহেড-সম্পন্ন। এই ইরানি হামলায় প্রায় ২৪০ জন আহত হয়েছে। ইজরায়েলি সেনাবাহিনী ঘোষণা করে যে, রাতভর ইরানের বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে তারা। ইরানে আরাকে ‘ভারী জল ব্যবহারকারী পারমাণবিক চুল্লি’তেও আঘাত করা হয়েছে। নাতাঞ্জের কাছে একটি স্থানকে লক্ষ্য করে আঘাতও ছিল এই অপারেশনের অংশ। উল্লেখযোগ্য যে, ইরান-ইজরায়েলের এই সংঘাতের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিল রাশিয়া। ইরানের ক্ষেত্রে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এদিন সতর্ক করে রাশিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই সংঘাতে জড়ানোর থেকে বিরত থাকতে হবে বলে জানিয়ে রাশিয়া বলে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হস্তক্ষেপ করলে তা হবে একটি বিপজ্জনক পদক্ষেপ। প্রকৃতপক্ষে তার পরিণতি হবে অপ্রত্যাশিত ও অত্যন্ত নেতিবাচক।
২২-২৩ জুন : গত ২২ জুন ইরানের নাতাঞ্জ, ফোরডো ও ইস্ফাহানের বেশ কয়েকটি পরমাণু কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটিতে যৌথভাবে বিমান আক্রমণ চালায় আমেরিকা ও ইজরায়েল। এই অভিযানে বি-টু বোম্বার স্টেলথ্ এয়ারক্র্যাফট (অত্যাধুনিক মার্কিন বোমারু বিমান যা শত্রুর রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম) ব্যবহার করে আমেরিকা। ইরানের পারমাণবিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য অ্যাটমিক এনার্জি অর্গানাইজেশন অফ ইরান’ এই হামলার কথা স্বীকার করে জানায় যে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি জারি থাকবে। এর প্রত্যাঘাতে গত ২৩ জুন আমেরিকার সহযোগী দেশ কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।
যুদ্ধের গ্রাসে বিশ্ব : এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড়ো প্রশ্ন হলো, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে কি ক্রমশ এগিয়ে চলেছে বিশ্ব? এটি একটি বড়ো সম্ভাবনা কারণ অনেক দেশই বর্তমানে বিভিন্ন ফ্রন্টে নানা লড়াইতে লিপ্ত। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের বিরোধ যেরকম তুঙ্গে পৌঁছেছে, ঠিক একইভাবে চীনের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলির বিরোধ দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে। এমনকী প্রতিবেশীদের নানা হুমকি দিয়ে চলেছে চীন। সাম্প্রতিক অতীতে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাক্ষী থেকেছে ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর, অর্থাৎ বিভিন্ন দেশে সরকার ভাঙাগড়ার খেলাও রয়েছে অব্যাহত। বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিবর্তন ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মতো দেশগুলিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। পরিণামে দেশগুলিতে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এমতাবস্থায়, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে ইতিমধ্যেই দীর্ণ-বিদীর্ণ বিশ্বকে আগামীদিনে আরও বিভক্ত ও বিভাজিত করবে পশ্চিম এশিয়ার ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা। বলা বাহুল্য যে, যেকোনো ধরনের উত্তেজনা এই অঞ্চলের অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকর হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে অন্যান্য যে দেশগুলির ভালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ভারত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, এই অঞ্চলটি সমগ্র বিশ্বের জ্বালানির (খনিজ তেল ও গ্যাস) অন্যতম বৃহৎ উৎস পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার পরিণামে বিভিন্ন দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। যুদ্ধ বন্ধের প্রয়াস এবং সমস্ত সমস্যার সমাধানের দ্বারা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থেকে সমগ্র বিশ্বের পরিত্রাণ বর্তমানে সময়ের দাবি।