গুরুপূর্ণিমার তৎপর্য এবং পদরজেই যেতে হবে অন্যান্য বালকদের গুরু-শিষ্যের ভূমিকা
শ্রীমৎ দেবানন্দ ব্রহ্মচারী
ভারতবর্ষের সনাতন হিন্দুধর্ম যে চারটি মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হলো জন্মান্তরে বিশ্বাস, কর্মফলে বিশ্বাস, আত্মার অবিনশ্বরত্ব এবং গুরু পরম্পরা। ব্যক্তিজীবনে গুরু বা আচার্যের ভূমিকার কথা এবং তাঁর উপদেশাবলীর প্রয়োনীয়তার কথা ভারতবর্ষ সুপ্রাচীনকাল থেকে উপলব্ধি করে এসেছে। তাই আচার্য বা গুরুকে দেবতার আসনে বসিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করার কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে- মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব, তেমনই আবার বলা হয়েছে- আচার্যদেবো ভব। পিতা, মাতা, অতিথি ও আচার্যকে দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। ভাগবত পুরাণে ভগবান বলেছেন, গুরুকে আমারই স্বরূপ বলে জানবে- আচার্যানাং মাং বিজানীয়াৎ।
ভারতবর্ষে হিন্দু সমাজের কাছে গুরুপূর্ণিমা একটি পুণ্যতিথি। আষাঢ় মাসের পবিত্র পূর্ণিমাই গুরুপূর্ণিমা তিথিরূপে পরিচিত। জগদ্গুরু ভগবান ব্যাসদেব এই তিথিতে নারায়ণের অংশে ধরাধামে আবির্ভূত হয়ে আচার্য রূপে হিন্দুধর্মের প্রচার ও সংরক্ষণ করেছিলেন। মহাভারত, অষ্টাদশ পুরাণ, ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা এবং বেদের বিভাজন করে, শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে সেগুলির প্রচারের ব্যবস্থা করে তিনি এক মহান কীর্তি স্থাপন করেছেন। আজ হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুসমাজ এই ধর্মগ্রন্থগুলির দ্বারা সঞ্জীবিত হয়ে চলেছে। তাই হিন্দুসমাজ ব্যাসদেবের আচার্যত্বকে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর আবির্ভাব তিথিকে অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে থাকে। এইদিন সবাই নিজ নিজ গুরুদেবকে ব্যাসাসনে স্থাপন করে গুরু পরম্পরা অনুযায়ী পূজা করে থাকে।
জাগতিক বিদ্যা থেকে ব্রহ্মবিদ্যা পর্যন্ত যেকোনো বিদ্যা অর্জনের জন্যই শিক্ষক বা আচার্যের প্রয়োজন রয়েছে। আর ভারতের মহান পুরুষগণ বরাবর নিজেদের জীবনে আচার্য বরণের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। প্রাচীনকালে দ্বাদশবর্ষ সকলকেই গুরুগৃহে অবস্থান করে পরাবিদ্যা
ও অপরাবিদ্যা (পারমার্থিক ও জাগতির) অর্জন করতে হতো। উভয় বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে, আচার্যের আশীর্বাদ নিয়ে শিষ্য যৌবনকালে সংসার জীবনে প্রবেশ করতেন। মাঝে মাঝে তাঁরা গ্রহণ করতেন গুরুদেবের উপদেশ এবং লাভ করতেন তাঁর পবিত্র সঙ্গ। তাই তখন ধর্মের অনুশাসনেই পরিবার ও সমাজ পরিচালিত হতো এবং স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত ছিল ধর্মরাজ্য।
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এবং তাঁর ভাইদেরও উপনয়ন সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। কুলগুরু বশিষ্ঠদেব এসেছিলেন তাঁদের গুরুগৃহে নিয়ে যাবার জন্য। রাজা
দশরথ বহুমূল্য বসন, দ্রব্যসামগ্রী ও রথের আয়োজন করেছিলেন রাজপুত্রদের জন্য। বশিষ্ঠদেব বাধা দিয়েছিলেন। রাজপুত্র হলেও সাধারণ বসন পরিধান করে এবং পদব্রজেই যেতে হবে অন্যান্য বালকদের মতোই। দ্বাদশবর্ষ গুরুগৃহে অবস্থান করে, সর্বপ্রকার বিদ্যা অর্জন করে রাজধানীতে ফিরে এসে পরবর্তীকালে শ্রীরামচন্দ্র রাজ্যভার গ্রহণ করেছিলেন। রাজা হলেও তাঁদের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন কুলগুরু ঋষি বশিষ্ঠ।
আবার অত্যাচারী কংসকে বধ করে কংসের পিতা উগ্রসেনকে রাজসিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। মাতা দেবকী ও পিতা বসুদেবকে মুক্ত
করেছিলেন কারাগার থেকে। কর্তব্যকর্ম সমাধা করে বালক শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম যাত্রা করেছিলেন গুরুগৃহে। সন্দীপনী ঋষির আশ্রমে দ্বাদশবর্ষ অবস্থান করে সর্বশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তারপর ফিরে এসে সংসারজীবনে প্রবেশ করে শৌর্য, বীর্য, ত্যাগ ও প্রেমের মাধ্যমে রাষ্ট্রজীবনকে ধর্মপথে পরিচালিত করার গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। স্বয়ং ভগবানকেও গুরুকরণের আদর্শ গ্রহণ করতে এবং গুরুগৃহে গুরু সেবার আদর্শ স্থাপন করতে হয়েছিল।
আবার আচার্য শঙ্কর উপনয়ন সংস্কারের পর পাঁচবছর বয়সে গিয়েছিলন গুরুগৃহে অধ্যয়ন করতে। আটবছর বয়সে গৃহত্যাগ করে নর্মদাতীরে এসেছিলেন। গুরু গোবিন্দপাদ তখন এক গুহার মধ্যে ধ্যানমগ্ন। তাঁর ধ্যানভঙ্গ হলে আত্মসমর্পণ করেছিলেন শ্রীগুরুর চরণে। তারপর দীক্ষা ও সন্ন্যাস নিয়ে কঠোর তপস্যায় জুটে
গিয়েছিলেন আচার্য শঙ্কর। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের একজন বলিষ্ঠ আচার্য ও ধর্ম প্রচারক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আচার্য শঙ্কর। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, বালানন্দ ব্রহ্মচারী প্রমুখ জীবনে আচার্য বরণ করেছিলেন এবং ধর্ম ও অধ্যাত্ম সাধনায় পূর্ণতা অর্জন করে আত্মনিয়োগ করেছিলেন দেশমাতৃকার সেবায়।
‘গুরু’ শব্দের দ্বারা আমরা সাধারণত আধ্যাত্মিক জগতের পথপ্রদর্শককেই বুঝে থাকি। কিন্তু জীবনের প্রাথমিক স্তর থেকে অন্তিম স্তর পর্যন্ত আমরা যাঁর কাছ থেকে সামান্যতমও কিছু শিখে থাকি, ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁকেও গুরুর সম্মান প্রদান করা হয়েছে। সেদিক থেকে বিচার করলে মাতা-পিতা ও শিক্ষকগণও আমাদের কাছে গুরুস্থানীয়। তাঁদের উপদেশ ও শিক্ষার দ্বারাই সম্যকরূপে গড়ে ওঠে আমাদের জীবন। এরপর যদি কারুর মধ্যে ধর্মজিজ্ঞাসা ও অধ্যাত্মপিপাসা জাগ্রত হয়, তাহলে সাধনার উচ্চভূমিতে প্রতিষ্ঠিত, অনুভূতিসম্পন্ন, সামর্থ্যবান কোনো আচার্যের চরণতলে তাকে অবশ্যই উপনীত হতে হবে। মুণ্ডক উপনিষদে (১।২।১২) এবিষয়ে এক অপূর্ব উপদেশ রয়েছে- তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেব অভিগচ্ছেৎ সমিৎপাণিঃ শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্। অর্থাৎ সেই পরমাত্মাতাকে জানবার জন্য সে (শিষ্য) হাতে সমিধ (হোমের কাঠ বা কোনো শ্রদ্ধার্ঘ্য) গ্রহণপূর্বক শ্রোত্রীয় ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর নিকট গমন করবেন। উপনিদের এই মন্ত্রটির মধ্যে গুরু-শিষ্যর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। শিষ্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য গুরুর সান্নিধ্য লাভ করতে হবে; জাগতিক কোনো লাভের জন্য নয়। আর কেমন গুরুর কাছে যেতে হবে? শ্রোত্রীয় (শাস্ত্রের মর্মজ্ঞ) এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ (ব্রহ্মজ্ঞ) আচার্যের নিকট যেতে হবে।
এরপর শ্রুতি বললেন, এই জ্ঞানবান গুরু তখন প্রশান্তচিত্ত, শমযুক্ত, সম্যকরূপে গুরুর অনুগত শিষ্যকে যে বিদ্যার দ্বারা সত্যস্বরূপ পরমাত্মাকে জানা যায়, সেই ব্রহ্মবিদ্যা কৃপাপূর্বক উপদেশ করবেন (মুণ্ডক উপনিষদ ১।২।১৩)। আচার্যের কৃপা ও উপদেশ ছাড়া শ্রেষ্ঠ ও সূক্ষ্মবিদ্যা ‘ব্রহ্মবিদ্যা’ লাভ করা যায় না। তাই ছান্দোগ্য উপনিষদ বললেন, আচার্যবান্ পুরুষো বেদ। অর্থাৎ যিনি আচার্যের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তিনিই সেই পরমাত্মাকে জানতে পারেন।
গুরু কোনো ব্যক্তিবিশেষ নন। গুরুশক্তি পরমাত্মারই একটি বিশেষ শক্তি যা কোনো ব্যক্তি, মূর্তি বা প্রতীকের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়ে আমাদের পথপ্রদর্শন করেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ একলব্যের জীবনের ঘটনা। ব্যাধপুত্র একলব্য অস্ত্রবিদ গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে প্রার্থনা জানালেন তাকে অস্ত্রশিক্ষা দান করার জন্য। এবং এও জানালেন যে, দ্রোণাচার্যকেই তিনি অন্তরে গুরু রূপে বরণ করে নিয়েছেন। কিন্তু ক্ষত্রিয় না হওয়ার জন্য দ্রোণাচার্য তাকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে অস্বীকার করলেন। একলব্য কিন্তু নিজের সংকল্প থেকে বিচ্যুত হলেন না। অরণ্য মধ্যে দ্রোণাচার্যের মৃন্ময় মূর্তি স্থাপন করে নিত্য
পূজা করতেন এবং সূক্ষ্ম আশীর্বাদ নিয়ে বাণ চালনা অভ্যাস করতেন। অভ্যাস করতেন। গুরুশক্তির কৃপায় একলব্য একদিন দ্রোণাচার্যের প্রিয়শিষ্য অর্জুনের থেকেও শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হয়ে উঠলেন। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দ্রোণাচার্য একদিন অনুসন্ধান করতে করতে উপস্থিত হলেন একলব্যের সাধনক্ষেত্রে। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কার কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করেছ? তোমার গুরু কে? একলব্য প্রণাম করে সবিনয়ে বললেন, আপনিই তো আমার গুরু। তারপর তার আরাধ্য মূর্তির কাছে দ্রোণাচার্যকে নিয়ে গেলেন। অবাক হলেন দ্রোণাচার্য, বুঝলেন, গুরুশক্তিই মূর্তির মধ্য দিয়ে একলব্যকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছে।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রতীকী উপাসনারও স্বীকৃতি রয়েছে। দেশভক্তি ও ব্যক্তি চরিত্রের ভিত্তিতে প্রকৃত মানুষ তৈরির কাজে যে প্রতিষ্ঠান ব্রতী আছে সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কোনো ব্যক্তিগুরুকে নয়, পরম পবিত্র গৈরিক পতাকাকে গুরু হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্য, পরম্পরা, ত্যাগ, তপস্য এবং শৌর্যবীর্যের প্রতীক এই গৈরিক পতাকা। তাই সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা প্রতিদিন গৈরিক পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে প্রার্থনা করেন এবং দেশভক্তি ও আদর্শ চরিত্র গঠনের শিক্ষা গ্রহণ করেন। শ্রীগুরুপূর্ণিমা তিথিতে স্বয়ংসেবকরা পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের দ্বারা দক্ষিণা সমর্পণ করেন গুরু গৈরিক পতাকার বেদীমূলে।
গুরু কেবল অধ্যাত্ম জীবনের পথপ্রদর্শক নন, তিনি রাষ্ট্রভক্তির ক্ষেত্রেও প্রেরণা দান করে থাকেন। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তাঁর গুরু রামদাস স্বামীর প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর গুরুদেব নিজের উত্তরীয় দান করে বলেছিলেন, বৈরাগীর উত্তরীয় পতাকা করিয়া নিও’। অর্থাৎ ত্যাগ ও রাষ্ট্রপ্রেমই তোমার আদর্শ হোক। তাঁর গুরু শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, বিধর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় সহযোগিতাও করেছেন।
গুরু নানকদেব প্রবর্তিত শিখপন্থের দশমগুরু গোবিন্দ সিংহ যেমন অধ্যাত্ম সাধনায় একজন দিকপাল ছিলেন, তেমনই একজন বীর যোদ্ধাও ছিলেন। ধর্মরক্ষায় তিনি তাঁর অনুগামীদের নিয়ে বিধর্মী মুঘলদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। গুরু গোবিন্দ সিংহের পরে আর কোনো ব্যক্তি-গুরু হননি। সেই গুরুর স্থান গ্রহণ করেছেন গুরু গ্রন্থসাহেব। সকল ধর্মের সার কথা নিয়েই রচিত হয়েছে গুরু গ্রন্থসাহেব। এই গ্রন্থসাহেবই এখন গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত। স্বামী রামদাস এবং গুরু গোবিন্দ সিংহের নামে আজও সমগ্র ভারত শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করে।
প্রাচীনকালে ব্যাস, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রমুখ এবং বর্তমানকালে রামদাস স্বামী, গুরু গোবিন্দ সিংহ, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, শঙ্করাচার্য, তথাগত বুদ্ধ প্রমুখ মহাপুরুরুষ নানাভাবে ব্যক্তিজীবন তথা রাষ্ট্রজীবনে আচার্যের ভূমিকা পালন করে গেছেন। আবহমানকাল থেকে গুরু-শিষ্যের মধুর সম্পর্কের পরম্পরাই ভারতবর্ষ তথা হিন্দুধর্মকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত রেখেছে। একজনের আশ্রয় দান, অপরের সমর্পণ; একজনের পথপ্রদর্শন, অন্যজনের আজ্ঞাবহতা এর মধ্যে দিয়েই অধ্যাত্মজ্ঞান ও রাষ্ট্রভক্তির সমন্বয় সাধন হয়েছে ভারতবর্ষে।