১৬ দিনে কর্ণের পতন, আর ১৫ বছরে মমতার?
দীঘার সার্কাসেই তৃণমূলনেত্রীর রথচক্রগ্রাস
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
মহাভারতের আঠারো দিনের যুদ্ধে ১৬ দিনে পতন হয় কর্ণের। সপ্তদশ দিবসে। ১৫ বছরের শাসনে পা রাখতে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কর্ণ পারেননি। মমতা পারবেন? কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যায়। গত ২৭ জুন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রথচক্রগ্রাস হয়। দিঘালি অতিথি নিবাসের সামনে তা থমকে যায়। কার দায়িত্বে ছিল রথ? জামিনে থাকা কর্ণের শল্যরূপী চালক। রাজ্যের সর্বোচ্চ পুলিশকর্তা রাজীব কুমার। তাতে শেষরক্ষা হয়নি। কুমার ছাড়া অন্য কেউ হলে চাবকে পিঠের চামড়া তুলে দিতেন মমতা। কিন্তু এক্ষেত্রে তা অসম্ভব। মমতার অন্যায়ের কবচকুণ্ডল কুমারের হাতে বাঁধা। সারদা কেলেঙ্কারি থেকে সন্দেশখালির শেখ শাজাহান। কুরুসভায় দ্রৌপদীর অসম্মানের সঙ্গী ছিল কর্ণ। তাঁকে বহুগামিনী বলতে সে পিছপা হয়নি প্রমাণকোটিতে বিষ প্রয়োগ আর বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের হত্যার মূল চক্রী ছিল কর্ণ। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ট্র্যাজিক হিরো বানিয়েছেন। তাই বাঙ্গালি কর্ণ ভজনায় মত্ত। আমার মতে কর্ণের মতো দ্বৈত চরিত্র মহাভারতে দুটি নেই। কিছু ঘটনায় সে যেন শকুনিকেও হার মানায়। মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে একাংশ বাঙ্গালির প্রায় এক আবেগ। তা অসাড় ও অর্থহীন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো আন্দোলনে গুরুত্ব দিত না বিদেশি সিপিএম। তাই জোর করে জাতীয় সড়ক আটকালেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাকে গ্রেপ্তার করেননি। সিপিএম জমানায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো জেল খাটেননি বা পুলিশ লকআপে বন্দি থাকেননি। তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। ১৯৯৩-এর জানুয়ারিতে মহাকরণ নাটকের পর পুলিশ সদর দপ্তরে তাঁকে মধ্যরাত পর্যন্ত আটকে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের
আন্দোলন ক্ষতিকারক হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিদেশি বামেরা আটকে রাখত। পশ্চিমবঙ্গবাসীর একটা বড়ো অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়ানোয় হেরে ভূত হয় সিপিএম। তারা ভাবতেই পারেনি সেই ‘খেলো’ মমতা একদিন তাদের ধূলিসাৎ করে দেবে।
কর্ণকে বধ করে অর্জুন তার সমস্ত পাপ ক্ষালন করেছিলেন। ২০০৬ সালে তাপসী মালিক হত্যায় অভিযুক্ত হয় সিপিএমের দুই নেতা। তার আগে বানতলায় মহিলাদের ওপর অত্যাচারের প্রধান অভিযুক্তকে আড়াল করে বামেরা। আরজি কর কাণ্ডে অভয়াকে অত্যাচার করে মারার পর তার দেহ হাপিশ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ আর স্থানীয় পৌর প্রতিনিধি। সেই মাতৃগর্ভের লজ্জাটিকে পৌরনেতা বানিয়ে পুরস্কার দেন মমতা। কসবার আইন কলেজে তরুণীর উপর তৃণমূল কংগ্রেসের ছোটো নেতারা যে অশ্লীল অত্যাচার করেছে, তাতে তৃণমূলকে কেউ ‘ধর্ষক পার্টি’ বলতেই পারে। দীঘা সার্কাসের ‘হালাল’ প্রসাদ খাইয়েও সে পাপ মিটবে না।
এখন সিপিএম আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চুনোরা সান্ধ্য চ্যানেলে একসঙ্গে বলেন যে, ২০২৬-এর ভোটে বিজেপি-র কোনো সম্ভাবনা নেই। ২০২১ থেকেই লজ্জা আর অপমান মাথায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময়ের ঘরের লোক শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হারের চেয়ে ১৯৯০-এ লালু আলমের লাঠি মমতার কাছে অনেক আরামের। কংগ্রেস ভেঙে উপদল গড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখাই আজ তার কাছে একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। তাই এখনই উত্তরসূরী বানাতে নারাজ তিনি। হিন্দু বাঙ্গালির কাছে ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি পুরীকেন্দ্রিক। বিজেপির ‘জয় শ্রীরাম’-এর পালটা হিসেবে মমতা তা আমদানি করতে চান। কোনো সুস্থ ভাবনার মানুষ এই কৌতুকে আগ্রহ দেখাবেন না।
ইতিমধ্যেই বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের লক্ষ্যে ‘স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন’-এর ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। পশ্চিমবঙ্গেও অদূর
ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিতে হতে পারে ভোটার তালিকা সংশোধন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিরে সংক্রান্তি। গোদের উপর বিষফোঁড়া দীঘার সার্কাস। আনুমানিক ৪০ শতাংশ ভোটার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মিম বানানোর চরিত্র ভাবেন। কৌতুকাভিনেতা। কোনো গুরুত্ব নেই। সেই ফাঁদ পেতে মমতা দু’টি বড়ো নির্বাচন জিতেছেন। বিরোধীদের বোকা বানাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের লোকেরা তার মিম বানিয়ে নেতিবাচক প্রচার করেন। ফলে কবিগুরুর ট্র্যাজিক হিরো কর্ণের মতো তিনিও বাঙ্গালি মনে হয়ে ওঠেন সেই ট্র্যাজিক নেত্রী, যিনি ‘অবাঙ্গালি, বহিরাগত, হিন্দিভাষী’ বিজেপি-র বিরুদ্ধে একাই লড়ছেন। যেমন লড়েছিলেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, বিদেশি সিপিএম নয়। এই প্রহসন কাটাতে হবে। তাতেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা পাবেন প্রাণের ঠাকুর শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সার্কাসে তৈরি জগন্নাথদেব নন। এটা দেখার, ২০২৬-এই মমতার রাজনৈতিক খেলার শেষ হয় কিনা। আর ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকলেও ক্ষেত্রজ্ঞরা সক্রিয় কিনা?