দিদির প্রেম শুধুই মুখে মুখে
কন্যাশ্রীপ্রেমীযু দিদি,
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এই চিঠি। কেন ক্ষমা চাইলাম জানেন? কারণ, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার সব ভালোবাসাই বকধার্মিকের মতো। মুখের কথায় ভালোবাসা। ঠিক যেমন কন্যাশ্রী নামে ডেকে প্রেম দেখালেও আপনি আদৌ রাজ্যের কিশোরীদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে পারেননি।
দিদি, সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে নাবালিকার মৃত্যুর লজ্জা থেকে যেন মুক্তি নেই রাজ্যবাসীর। উন্নয়নের যত প্রমাণ পেশ করছে রাজ্য সরকার, তার বিপরীতে সাক্ষ্য দিচ্ছে নাবালিকা বিবাহ, নাবালিকার গর্ভধারণ এবং প্রসূতিমৃত্যুর পরিসংখ্যান। কিন্তু কেন? রাজ্যের কয়েকটি জেলায় প্রতি দশজনে ছ’ জনের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগে।
দিদি, সম্প্রতি একটা খবর দেখে আমি শিউরে উঠেছি। মালদহের এক কিশোরীর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু। মেয়েটি ষোলো বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। আর উনিশ বছর বয়সে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছে। এটা কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় দিদি।
গত বছর স্বাস্থ্য দপ্তরের সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছিল, বিভিন্ন জেলার ১৩০টি ব্লকে মোট প্রসূতির ২০-২৯ শতাংশ নাবালিকা। আরও ২৫টি ব্লকে আরও খারাপ। মোট প্রসূতির ৩০ শতাংশেরও বেশি নাবালিকা। এই রাজ্যে মেয়েদের স্কুলছুট এবং কম বয়সে বিয়ে বন্ধ করতেই তো দিদি আপনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েই কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছিলেন। তা হলে? বিয়ে না করলে তবেই তো শেষ কিস্তির ২৫ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। তা হলে কেন কমানো যাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গের এই প্রবণতা? দিদি, আপনিই জবাবটা দিতে পারবেন। কাটমানি নিয়ে কি আপনার ভাইয়েরা এখানেও দুর্নীতি চালাচ্ছে?
রাজ্যেরই রিপোর্ট বলছে, ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫, দু’টি অর্থবর্ষে মোট প্রসূতির মধ্যে নাবালিকা প্রসূতির হার ছিল ১৫ শতাংশ। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের অন্তত ১৪ শতাংশ নাবালিকা। যেখানে এমন মৃত্যুর সর্বভারতীয় গড় ৬ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে সেটা দ্বিগুণেরও বেশি। এসব সংখ্যা ভয়ানক সংকটের একটা ইঙ্গিত মাত্র। তবে পশ্চিমবঙ্গে কন্যাশ্রী প্রকল্প নিয়ে এত ঢাক পেটানোর মানেটা কী?
নাবালিকা প্রসূতির জীবনের ঝুঁকি যে প্রাপ্তবয়স্কদের চাইতে কয়েকগুণ বেশি, তা তো আপনার জানা দিদি। স্বাস্থ্যব্যবস্থার নিরিখে বিচার করলে এই মৃত্যুগুলি এক বৃহত্তর সংকটের প্রতিফলন। রাজ্যে সার্বিক প্রসূতিমৃত্যুর হারও এক লক্ষ প্রসবে ১০৩, যেখানে জাতীয় হার এক লক্ষে ৯৭।
এই কিশোরীরা যদি বেঁচে থাকত, যদি তাদের স্কুলে রাখা যেত, যদি তাদের জন্য ঘরে-বাইরে হিংসাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা যেত, যদি তাদের উচ্চশিক্ষা, রোজগারে যুক্ত থাকতে উৎসাহিত করা যেত, তবে তো রাজ্যের মঙ্গল হতো। দিদি, রাজ্যেরই রিপোর্ট বলছে মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরে দশজনের মধ্যে ছ’জন বালিকার বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগে। এই বিপুল ব্যর্থতার মোকাবিলা করতে হলে রাজ্যকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের খামতিগুলি তো স্বীকার করতে হবে দিদি?
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রচুর নম্বর দেওয়ার ‘নীতি’ যে মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখতে পারছে না তা তো মেনে নিতে হবে। স্কুলশিক্ষাকে ছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়, অর্থপূর্ণ করে তোলা গিয়েছে কি? এ রাজ্যে ফি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে খবর হয়, প্রসূতি পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরীক্ষা দিতে দিতেই প্রসব যন্ত্রণা। নাবালিকা একসঙ্গে চার সন্তানের জন্য দিয়েছেন।
কিন্তু এগুলো তো গর্বের নয় দিদি। লজ্জার। ভাবতে হবে রাজ্যে কী হয়ছে? জানেন দিদি, আপনার ভাইয়েদের হাতে হয়রানি, দুর্নামের ভয়ে দ্রুত মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এত এত পরিবারে। আপনাকে তো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এটা মনে রাখতে হবে যে, সুস্থ রাজনীতি কেবল শাসন করে না। সুস্থ প্রশাসনের অর্থ, তা উন্নততর জনজীবনের উপযুক্ত সংস্কৃতি নির্মাণ করে। মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের মধ্যেই রয়েছে, মেয়েদের শিক্ষার উন্নতি, প্রসূতিমৃত্যু হ্রাস, নারী সক্ষমতা বৃদ্ধি। এ সবই ভূলুণ্ঠিত হয় নাবালিকা মায়ের মৃত্যুতে। কিন্তু আপনি শুধুই রাজনীতি করে ১৪টা বছর কাটিয়ে দিলেন।