নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে অসম্মান এবং ইতিহাস বিকৃতির মতো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে সিপিএম
ধর্মানন্দ দেব
ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে যাঁরা সত্যিকারের বীরপুরুষ, যাঁরা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশকে মুক্তির পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক
দীপ্তিমান নক্ষত্র নিঃসন্দেহে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, কৌশলী সংগঠক এবং সর্বোপরি এক নির্ভীক বিপ্লবী। তাঁর চিন্তা, কর্ম ও আত্মত্যাগ একদিকে যেমন স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিল, অন্যদিকে ভারতীয় জাতিসত্তাকে দিয়েছে এক অদম্য আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আজ, সেই নেতাজীকেই বিকৃত করার, তাঁর আত্মত্যাগকে কলুষিত করার অপেচেষ্টা করছে একটি রাজনৈতিক দল- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), অর্থাৎ সিপিএম।
কেরালার একটি পাঠ্যপুস্তকে সম্প্রতি লেখা হয়েছে— সুভাষচন্দ্র বসু নাকি ব্রিটিশদের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন জার্মানিতে। এই একটি বাক্যই যথেষ্ট প্রমাণ
করার জন্য যে, ইতিহাস বিকৃতির যে বিষবীজ বপন বহু দশক আগে শুরু হয়েছিল, তা আজও বহমান। এটি নিছক কোনো ‘ভুল’ নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চক্রান্ত। কারণ, যে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, তারা আজও সেই একই মনোভাবকে আঁকড়ে ধরে আছে।
স্বাধীনতার লড়াইয়ের ইতিহাসে সিপিএম তথা ভারতের কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল লজ্জাকর। যখন ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের
ডাক দিলেন, তখন দেশব্যাপী স্বাধীনতার দাবিতে এক জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই জোয়ারে কাঁপছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। কিন্তু ভারতীয় কমিউনিস্টরা তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশদের পাশে। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, আর ব্রিটিশরা ছিল সোভিয়েতের মিত্র। মস্কোর নির্দেশই ভারতীয় কমিউনিস্টদের কাছে ছিল সর্বশেষ বাণী। তাই তারা জাতীয়তাবোধকে বিশ্বাসঘাতকতার তকমা দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে ভাঙতে তৎপর হয়েছিল। এই ভূমিকার কলঙ্ক আজও মুছে যায়নি।
অন্যদিকে, সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন- ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে হলে শুধু অভ্যন্তরীণ আন্দোলন যথেষ্ট নয়,
আন্তর্জাতিক সহায়তাও প্রয়োজন। সেই কারণে তিনি গোপনে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কলকাতা থেকে গোমো, তারপর কাবুল, মস্কো হয়ে বার্লিন- এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। এই যাত্রার উদ্দেশ্য একটাই- ভারতের স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করা।পরে মহাবিপ্লবী রাসবিহারীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ শুধু একটি সামরিক সংগঠন ছিল না, বরং ভারতীয়দের আত্মসম্মানের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসে সেই অগ্নিপথকে আজকের পাঠ্যপুস্তকে বিকৃত করে বলা হচ্ছে- তিনি নাকি ভয়ে পালিয়েছিলেন। এটি কেবল সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি অবমাননা নয়, বরং গোটা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি চরম অসম্মান।
কোনো জাতির ইতিহাসে তার নায়কের স্থান কেবল স্মৃতিচারণায় সীমাবদ্ধ থাকে না। নায়ক মানে হলো আদর্শ প্রেরণা, আত্মত্যাগের প্রতীক। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সেই আদর্শেরই প্রতিমূর্তি। তাঁর অগ্নিঝরা আহ্বান- ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’- আজও
প্রতিটি ভারতীয়ের রক্তকে উষ্ণ করে তোলে। তাঁর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের অগ্রযাত্রা ব্রিটিশদের মনে যে ভীতি সঞ্চার করেছিল, তা স্বাধীনতার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। সেই নেতাকে ভীরু আখ্যা দেওয়া মানে গোটা জাতির আত্মমর্যাদাকে পদদলিত করা। তবে এই প্রসঙ্গে একটি গভীর সত্যও মনে রাখা জরুরি। বাঙ্গালির ইতিহাসে হিরোর অভাব কোনোদিন ছিল না। বরং বলা যায়, বাঙ্গালি জাতির মধ্যে হিরো-ওরশিপ পর প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস পড়িয়ে নেতাজীর অবদানকে অস্বীকার বা নায়কপূজার প্রবণতা প্রবল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ করার চক্রান্ত করছে তারা। কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করে কোনো বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, জাতিকে দীর্ঘকাল বোকা বানানো যায় না। সত্য ইতিহাস শেষ পর্যন্ত
মধুসূদন দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শ্রীঅরবিন্দ, মাতঙ্গিনী হাজরা, আলো দেখবেই। প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম- এরকম অজস্র নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিই তাঁদের আদর্শ, তাঁদের ত্যাগকে আমাদের জীবনে ধারণ করি? নাকি শুধু জন্মদিন-মৃত্যুদিনে মাল্যদান করে দায় সেরে ফেলি, আর বাকি সময় তাঁদের ভুলে থাকি? নেতাজীর ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। আমরা তাঁকে নিয়ে আবেগপ্রবণ হই, শ্রদ্ধা জানাই, কিন্তু তাঁর কর্মধারা, তাঁর দর্শন, তাঁর আত্মত্যাগকে কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছি?
এখানেই সিপিএমের রাজনৈতিক মতবাদকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। বাঙ্গালিকে হেয় করা, বাঙ্গালির আত্মসম্মানকে পদদলিত করা যেন তাদের রাজনৈতিক ডিএনএতে গাঁথা। স্বাধীনতার লড়াইয়ে যে জাতি সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছে, সেই বাঙ্গালিদের আজও তারা হীন করে দেখাতে চায়। সিপিএমের সদর দপ্তর এ কে গোপালন ভবনে নেতাজীর ছবি নেই। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট বার্তা। আজকের সমালোচনার চাপে হয়তো তারা সামাজিক মাধ্যমে নেতাজীর ছবি টাঙাতে পারে, কিন্তু তাদের মূল মানসিকতা বদলায়নি। শুধু এ কে গোপালন ভবন নয়, পাহাড় থেকে সাগর পর্যন্ত তাদের পার্টি অফিসগুলিতে নেতাজীর ছবি নেই। আরও প্রশ্ন- সিপিএমের কোনো পার্টি অফিসে কি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ছবি আছে? বিনয়-বাদল-দীনেশের ছবি আছে? মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি আছে? উত্তর একটাই- না। কারণ সিপিএম বাঙ্গালি জাত্যভিমানকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর।
নেতাজী কেবল একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক অসাধারণ চিন্তাবিদ ও সংগঠক। তাঁর রচনাগুলো পড়লে বোঝা যায়, তিনি একটি নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন- যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচবে। তাঁর চেতনার মূল উৎস ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ প্রমুখ চিন্তাবিদরা। তিনি অহিংস আন্দোলনকে যেমন সম্মান করতেন, তেমনই বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র সংগ্রামের শক্তিতেও। তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল ভারতীয় ঐতিহ্য ও
স্বাধীনতার এক অনন্য সংমিশ্রণ। স্বাধীনতার পর ভারত যদি তাঁর চিন্তাকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারত, তাহলে দেশের রাজনৈতিক- সামাজিক বাস্তবতা আরও উন্নত হতো।
কেরলের পাঠ্যপুস্তকে নেতাজীর বিকৃতি তাই নিছক একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’ নয়। এটি সিপিএমের মূল চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতার সময় যেমন তারা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, আজও তারা একই পথে চলছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস পড়িয়ে নেতাজীর অবদানকে অস্বীকার করার চক্রান্ত করছে তারা। কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করে কোনো জাতিকে দীর্ঘকাল বোকা বানানো যায় না। সত্য ইতিহাস শেষ পর্যন্ত আলো দেখবেই।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু শুধুই একজন নেতা নন; তিনি হলেন ভারতীয় জাতিসত্তার প্রতীক। তাঁর সংগ্রাম, ত্যাগ, আদর্শ আজও প্রতিটি ভারতীয়ের কাছে প্রেরণা। সিপিএম যতই চেষ্টা করুক, নেতাজীর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। কারণ নেতাজী শুধু ইতিহাস নন, তিনি হলেন ভারতাত্মার এক জীবন্ত চেতনা।
আজ আমাদের দায়িত্ব- তাঁকে কেবল জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে স্মরণ করা নয়, তাঁর আদর্শকে আমাদের জীবনে ধারণ করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে তাঁর প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। কারণ নেতাজীকে স্মরণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হলে, আমাদেরও দেশের জন্য ত্যাগ, পরিশ্রম এবং দায়িত্বশীলতার পথে হাঁটতে হবে। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা থেকে বিরত থাকতে হবে। নতুন ভারত গঠনের লক্ষ্যে সবাইকে শাামিল হতে হবে।