ভারতবর্ষের প্রাচীন ও যোগভিত্তিক সাধনপন্থা
অপু সাহা
এটি শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক ধারা, যেখানে তন্ত্র, যোগ, দেহতত্ত্ব, শক্তিসাধনা ও গুরুপরম্পরা মিলিত হয়ে এক অনন্য জীবনদর্শন গড়ে তুলেছে। নাথ সম্প্রদায় মূলত যোগসাধক, যাঁরা আত্মজ্ঞান এবং চূড়ান্ত মুক্তির সাধনায় ব্রতী। ‘নাথ’ শব্দের অর্থ প্রভু স্বামী বা গুরু। নাথ সম্প্রদায়ের মূল কথা হলো- নিজেকে শুদ্ধ করে শিবতত্ত্বে বিলীন হওয়া। এই সম্প্রদায়ের মূল ভিত্তি হলো: যোগ সাধনা, কুণ্ডলিনী জাগরণ, শক্তি ও চক্রতত্ত্ব, আত্মজ্ঞান ও মুক্তি।
নাথ সম্প্রদায়ের সূচনা হিন্দুধর্মের শৈব ও তান্ত্রিক ধারার মিলনবিন্দু থেকে। নাথ সম্প্রদায়ের উত্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা নাথ সম্প্রদায়ের বিকাশ অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীতে। এই সম্প্রদায়ের মূল প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয় দেবাদিদেব শিবকে, যিনি ‘আদি যোগী’ বা ‘আদিনাথ’ নামে পূজিত। তাঁর কাছ থেকেই মৎস্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানলাভ করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথ এই ধারার বিস্তার ঘটান। এ সময় মৎস্যেন্দ্রনাথ ও গোরক্ষনাথ যোগচর্চা, দেহতত্ত্ব, চক্রসাধনাকে কেন্দ্র করে নাথ সম্প্রদায়ের ভিত্তি গড়ে তোলেন।
মৎস্যেন্দ্রনাথকে নাথ সম্প্রদায়ের আদি গুরুরূপে গণ্য করা হয়। তিনি বঙ্গভূমি, অসম, নেপাল, তিব্বত-সহ বিভিন্ন স্থানে নাথ সম্প্রদায়ের প্রচার করেন। গোরক্ষনাথ ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথের প্রধান শিষ্য। তিনি হঠযোগের প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত। গোরক্ষপুর, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র-সহ অন্যান্য স্থানে নাথ সম্প্রদায় প্রচার ও বিকাশে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি ভগবান শিবের অবতার রূপে পূজিত হন।
নবনাথ হলেন নাথ ধর্মাবলম্বীদের নয়জন গুরু, সাধক। তাঁরা একক বা সম্মিলিতভাবে পূজিত হন। নবগুরুরা হলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ, জালন্ধরনাথ, কানিফনাথ, চর্পাটনাথ, নাগনাথ, ভর্তৃনাথ, রেবণানাথ, গহিনীনাথ। বিভিন্ন ধারণামতে নবগুরুরা যোগ ও ধ্যানচর্চা, আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও শিক্ষা প্রদান, সেবামূলক জীবনযাপন, দর্শনের প্রচার-সহ বিভিন্ন সামাজিক ও আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড করে থাকতেন। নাথ মতাবলম্বীদের ৮৪ জন সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন, যাঁরা দেহতত্ত্ব, প্রাণায়াম, কুণ্ডলিনী, যোগ ও তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে পরম সিদ্ধি অর্জন করেন। এই ৮৪ সিদ্ধ পুরুষ বিভিন্ন অঞ্চলে নাথ সম্প্রদায়ের সাধন তত্ত্ব প্রচার করেন এবং তাদের অনেকের নামে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। নাথ সম্প্রদায়ের গুরু পরম্পরায় ৮৪ জন সিদ্ধের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।
নাথ সম্প্রদায়ের মূল দর্শন হলো ‘আত্মজ্ঞানই মুক্তি।’ তারা বিশ্বাস করে দেহের মধ্যেই চৈতন্য লুকিয়ে আছে এবং কুণ্ডলিনী জাগরণের মাধ্যমে সেই শক্তিকে জাগিয়ে পরম শিবতত্ত্বে লীন হওয়া যায়। প্রধান সাধনাপদ্ধতি দেহকে ‘মন্দির’ মনে করা হয়, তাই দেহতত্ত্ব ও যোগসাধনার গুরুত্ব অপরিসীম।
নাথ মতানুসারীদের মধ্যে ‘নাথ’, ‘দেবনাথ’, ‘শিব’ এই তিনটি মূল পদবি। এগুলো শুধুমাত্র নামের অংশ নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক পরিচয়। নাথ সম্প্রদায়ের মূলধারা এই ‘নাথ’ উপাধিকে আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে। অনেক সাধারণ অনুসারীও তাঁদের নামের শেষে ‘নাথ’ ব্যবহার করেন। দেবনাথ ‘নাথ’ মতাবলম্বীদের একটি প্রচলিত পদবি।
নাথ সম্প্রদায়ের অনুগামীরা দেশব্যাপী বিভিন্ন আখড়া (মঠ) প্রতিষ্ঠা করেছেন। উল্লেখযোগ্য নাথ মন্দির হলো গোরক্ষনাথ মঠ (গোরক্ষপুর, উত্তর প্রদেশ),
পশুপতিনাথ মন্দির (নেপাল), মৎস্যেন্দ্রনাথ মন্দির (কাঠমাণ্ডু), চুরাশি নাথ মঠ (রাজস্থান, হিমাচল, গুজরাট), নাথ আখড়া (কলকাতা, অসম, সিলেট
অঞ্চলে)।
পার্বত্যরাজ্য ত্রিপুরায় তিনটি গোরক্ষনাথ মন্দির রয়েছে। ধলেশ্বর আগরতলায় মহাযোগী শ্রীশ্রী গোরক্ষনাথ মন্দির। ১৯৮৪ সালে (১৩৯১ বঙ্গাব্দ) নেপালের
রাজগুরু ড. নরহরি নাথ মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৩ সালে নাথ গুরু গোরক্ষনাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন মহন্ত শিবনাথ (ওড়িশা) ও স্বামী কৈবল্যনাথ (অসম, বঙ্গাইগাঁও)। মন্দিরটি গোরক্ষপুর মন্দিরের আদলে নির্মিত। ২০১৪ সাল থেকে বর্তমানে বার ভেগ পন্থের সভাপতি যোগী আদিত্যনাথ এই
মন্দিরে ২ বার আসেন। প্রতি বছর মন্দিরে ১২টি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়- শুভ নববর্ষ, শ্রীশ্রী গোরক্ষ জয়ন্তী, গুরু পূর্ণিমা, শ্রাবণ মাসের প্রত্যেক সোমবার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, পৌষ সংক্রান্তি, মহাশিবরাত্রি (সারারাত চতুঃপ্রহর পূজা), মহাশিবরাত্রি উপলক্ষ্যে পারণ উৎসব, দোল উৎসব। মন্দির কমিটি প্রতি বছর গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য অর্থ প্রদান করে। বাকি দু’টির একটি ধর্মনগর ও অন্যটি রানিরবাজারে অবস্থিত।
নাথ সম্প্রদায় গুরু, শিষ্য, দেহ, শক্তি ও চেতনার এক অভূতপূর্ব সংমিলন। শিব থেকে গোরক্ষ, গোরক্ষ থেকে হাজারো নাথগুরু- সবাই মানবমুক্তির,
চেতনার এবং যোগের এক নীরব ধারক।