জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কর্মসূচিতে সমস্ত নাগরিকের সহায়তা করা উচিত
শিশির বল
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এদের বেশিরভাগের হাতে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড আছে এবং দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচক তালিকায় ইতিমধ্যে নাম নথিভুক্ত হয়েছে। ভারত সরকার এদের চিহ্নিত করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্র मारत निधन आ মন্ত্রক জাতীয় নির্বাচন কশিনের জ্ঞাতার্থে বিষয়টি আনার পর, বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে নির্বাচন কমিশন ভোটার
তালিকার এসআইআর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন যাতে বিএলও-রা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা আপডেট ও সংশোধন করবে, অনুচ্ছেদ ৩২৬ ও অনুচ্ছেদ ৩২৪(২), দ্য রিপ্রেজেন্টশন অফ দ্য পিপল্ অ্যাক্ট, ১৯৫১-এর ২১(৩) ধারা মেনেই নির্বাচন কমিশনকে এসআইআর করবার অধিকার দিয়েছে ভারতীয় সংবিধান।
প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ হলেও বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কাজ প্রতিবার হয় না। রাজনীতির নতুন ট্রেন্ড হলো নির্বাচনের জিতলে ক্রেডিট সেই দল ও দলের নেতৃত্বের, আর যদি হেরে যায় তাহলে যত দোষ নির্বাচন কমিশনের। মহারাষ্ট্র ও হরিয়াণা বিধানসভা নির্বাচনে ফলাফলের পর কংগ্রেসের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল নির্বাচন কমিশনকে। কংগ্রেস অভিযোগ করে নির্বাচনের আগে বিপুল সংখ্যক ভোটারের নাম ভোটার তালিকায় সংযুক্ত করার ফলে শাসক দলের বিশেষ সুবিধা হয়েছে। কংগ্রেসের দাবি ছিল ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করতে হবে। বিভিন্ন রাজ্যে দ্রুত নগরায়ন, ঘন ঘন অভিবাসন, তরুণ নাগরিকদের ভোটার হিসেবে যোগ্য হয়ে ওঠা, মৃত্যুর খবর না দেওয়া, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নাম অন্তর্ভুক্তির মতো একাধিক কারণে এই এসআইআর-কে প্রয়োজনীয় করে তুলেছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বলেছেন, নাগরিকরা যে এলাকার বাসিন্দা সেই এলাকায় ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন করতে হবে।
ইন্ডিজোট দাবি তুলেছে প্রতি বছর যখন নির্দিষ্ট সময় ভোটার তালিকা সংশোধন হয় তাহলে ঘটা করে এসআইআর-এর কী দরকার? এখন প্রশ্ন, যদি সংশোধন সঠিকভাবে হয়ে থাকতো তাহলে ভোটার তালিকায় এত মৃত ভোটার, একাধিক জায়গায় নাম আছে এমন ভোটারদের নাম রয়ে গেল কীভাবে? ১৯৫১-র পর থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ১৩ বার এসআইআর করেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। তাই বৈধ নাগরিকদের এসআইআর নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ২০০৩ সালের এপিক নাম্বার দিলেই হবে। ২০০৩ সালের পর যাদের নাম তালিকায় উঠেছে তাদের ফর্ম ফিলাপ করতে হবে। বিএলও বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই কাজ করবেন, তখন নতুন নাম তুলতে গেলে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই এর পর থেকে ২০০৪-এর ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা জন্মেছেন তাদের অথবা মা-বাবার কোনো একজনের বার্থ সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে।
ডিসেম্বর ২০০৪-এর পরে যাদের জন্ম তাদের মা-বাবা উভয়ের বার্থ সার্টিফিকেট বা জন্মস্থানের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। বৈধ নাগরিকদের
দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। নীচের ১১টি নথির একটি নথি থাকলেই তাদের নাম ভোটার তালিকায় থাকবে। (১) কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারি কর্মচারী অথবা
অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী হলে সেই পরিচয় পত্র, (২) ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে ব্যাংক, পোস্ট অফিস, এলআইসির নথি, (৩) বার্থ সার্টিফিকেট, (৪) বৈধ পাসপোর্ট, (৫) স্কুল সার্টিফিকেট যেখানে বাসস্থান ও বয়সের উল্লেখ আছে, (৬) এসসি, এসটি, ওবিসি সার্টিফিকেট, (৭) এনআরসি তালিকায় নাম, (৮) বনাঞ্চল আধিকারীদের শংসাপত্র, (৯) সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসের সার্টিফিকেট, (১০) রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের তৈরি করা পারিবারিক রেজিস্টার, (১১) বাড়ির দলিল বা পর্চা যা সরকার দ্বারা প্রদত্ত- এই সব তথ্যের যে কোনো একটি। নির্বাচন কমিশন দ্বারা উল্লেখিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা না করলে তারা ডি-ভোটার হয়ে যাবেন। যদি কোনো ব্যক্তির এই পদ্ধতির উপর আপত্তি থাকে বা এই নির্দেশের কারণে নাম বাদ গিয়ে থাকে তাহলে ইআরও-এর আদেশের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ও মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের কাছে আবেদন জানাতে পারবেন।
গত ২৪ জুন ২০২৫ থেকে বিহারে এসআইআর-এর কাজ শুরু হয়েছে এবছর নভেম্বরে ১ মাসের বেশি সময় ধরে এই কাজ চলেছে। ২০২৫-এ বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করার জন্য এই কাজ শুরু হয়েছে। বিহার থেকেই সর্বাধিক সংখ্যায় শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজের সূত্রে বসবাস করে। ফলে বিহারের ভোটার তালিকায় তাদের নাম আছে এবং কর্মসূত্রে বসবাসের স্থানেও নির্বাচন তালিকায় তাদের নাম নথিভুক্ত হয়েছে। এসআইআর করতে গিয়ে চমকে দেওয়ার মতো পরিসংখ্যান উঠে এসেছে- জেলা কিষাণগঞ্জ ৬৮ শতাংশ, মুসলমান বসবাসকারী আধার কার্ড ১২৬ শতাংশ, কাটিহার ৪৪ শতাংশ, মুসলমান আধার কার্ড ১৬৩ শতাংশ। অথচ বিহারের মোট নাগরিকের ৯৪ শতাংশ আধার কার্ড।
বিহারের মোট ভোটার ৭ কোটি ৯০ লক্ষের মধ্যে ৪ কোটি ৯০ লক্ষের নাম ২০০৩-এর আগেই ভোটার তালিকায় ছিল ২০০৩-এর পর ৩ কোটি নতুন নাম যুক্ত হয়েছে। এই ৩ কোটি লোককে নাগরিকত্বের প্রমাণ জমা দিতে হবে। আরজেডি-র মূল অভিযোগ হলো এত কম সময়ে এসআইআর করা সম্ভব নয়। বাস্তবে দেখা গেল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ৯৯.৮ শতাংশ মানুষ ফর্ম ফিলাপ করতে পেরেছে। মোট ৬৫ লক্ষ ৬৪ হাজার ৭৫ জনের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে। এর মধ্যে ১২ হাজার যাদের দুই জায়গায় নাম ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে লাফালাফি শুরু করেছেন এসআইআর করতে দেবেন না বলে। কলকাতার রাজপথে মিছিল করেছেন, কংগ্রেস নেতা শুভঙ্কর সরকার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন।কিন্তু কর্ণাটকে যখন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ধরে ডিপোর্ট করা হচ্ছে ২৪ পরগনা জেলা থেকে। কোচিতে ২৭ জন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছে, সিপিএম এই ব্যাপারে চুপ।
বিগত বাম আমলে ৩৪ বছরে এবং টিএমসি-র চোদ্দ বছরের শাসনকালে ২.৫ কোটি অনুপ্রবেশকারী পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে বহু জেলার জনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৬৬ শতাংশ ভোটার বৃদ্ধি হয়েছে শেষ ১০ বছরে মেখলিগঞ্জে ২৪.৭৭ শতাংশ, মাথাভাঙ্গায় ২১.৭৯ শতাংশ, ইসলামপুরে ৩৫.৪ শতাংশ, হরিশ্চন্দ্রপুরে ৩৭.৭১ শতাংশ, মেটিয়াবুরুজ ২৮ শতাংশ, রাজারহাট-নিউটাউনের ৪৭.৪৮ শতাংশ দমদমে ২৫ শতাংশ- গোটা পশ্চিমবঙ্গে ২১ শতাংশ গড় ৭ শতাংশ। ২০০৩ সালে মমতা ব্যানার্জি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ অনুপ্রবেশকারীতে
ভরে গেছে, ভোটার তালিকা সংশোধন করে অনুপ্রবেশকারীদের নাম বাদ দিতে হবে। এখন তিনি বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে কোনো অনুপ্রবেশকারী নেই। তিনি ভালোভাবেই জানেন, তৃণমূল নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকহারে অনুপ্রবেশকারী এই রাজ্যে প্রবেশ করেছে, ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করিয়েছে। রাজ্যে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনসংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লক্ষ, আধার কার্ড ৭ কোটি ৬০ লক্ষ। মালদায় ভোটার তালিকায় যা নাম আছে তার থেকে ১০ লক্ষ আধার কার্ড বেশি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা পশ্চিমবঙ্গে ঠিকমতো এসআইআর হলে কমপক্ষে ১ কোটি নাম বাদ যাবে আর এখানেই, মমতার ভয়। কারণ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনে টিএমসি জিতেছে এক থেকে ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটার থাকলে টিএমসি-র সুবিধা। ভোটের সময় এই রাজ্যে বিরোধী দলের এজেন্টদের বহু বুথে বসতে দেওয়া হয় না।
এর জন্য রাজ্য প্রশাসন বুথের মধ্যে থাকা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়। ভোট কর্মীদের প্রলোভন ও ভয় দেখানো হয়। ভোটার তালিকায় থাকা মৃত ও অনুপস্থিত ভোটারদের ভোটগুলি তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী টিএমসির পক্ষে পোল করিয়ে নেয়। এইভাবেই দিনের পর দিন টিএমসি ভোট ম্যানেজ করে চলেছে। টিএমসি যখন থেকে শুনেছে পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর হবে এবং নাগরিকত্বের নথি হিসেবে বার্থ সার্টিফিকেট, ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে, তখন থেকে টিএমসির নেতারা ভুয়ো বার্থসার্টিফিকেট, ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করিয়ে দিচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রিপোর্ট দিয়েছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পাঠানখালী গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে ৩৫৮টি ভুয়ো বার্থ সার্টিফিকেট এবং ৫১০টি ভুয়ো ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই অবৈধ অনুপ্রবেশকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গের জনঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। সরকার কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ, একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২৫ লক্ষ মানুষ এই রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই অনুপ্রবেশকারীরা বৈধ নাগরিকদের কর্মসংস্থান খাদ্য ও বাসস্থানের উপর ভাগ বসাচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা বিভিন্ন জেলার জনবিন্যাস পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এক সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলতেন সীমান্তের দুই দিকের মানুষের চেহারা এক, ভাষা এক, তাই এই অনুপ্রবেশ করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গে নাকি কোনো জঙ্গি নেই, মোল্লাবাদী চক্রান্ত নেই। সেই সময় বিএসএফ শক্ত হাতে অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে গেলে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতারা বলতো বিএসএফ অত্যাচার করছে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই মুম্বই থেকে অনুপ্রবেশকারীদের ধরে পশ্চিমবঙ্গে আনা হচ্ছিল পুশব্যাক করার জন্য, উলুবেড়িয়াতে ট্রেন থামিয়ে ফরোয়ার্ড ব্লক কর্মীরা অনুপ্রবেশকারীদের মুক্ত করে দেয়।
অতীতে সিপিএম যা করেছে বর্তমানে টিএমসি তাই করছে। ১৯৯৭ সালের ৬ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত লোকসভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ভারতে ১ কোটির বেশি বাংলাদেশি আছে। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন ১ কোটি ২০ লক্ষ ৫৩ হাজার জন বাংলাদেশি আছে। এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং সীমান্ত সুরক্ষা বাড়াতে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, পঞ্জাব এই তিন রাজ্যে বিএসএফ-এর কার্যক্ষেত্রে ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হয়েছে। মমতা ব্যানার্জির সরকার এই সিদ্ধান্তকে মানতে নারাজ। গত মে মাসে বিএসএফ ১২২১ জন পুশ ব্যাক করিয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ৪৫০ কিলোমিটার বর্ডারে ফেন্সিং নেই। ফেন্সিং করার জন্য মমতা ব্যানার্জির সরকার জমি দিতে চাইছে না। ক্ষমতায় টিকে থাকা টিএমসি-র কাছে দেশের সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু দেশের মানুষ চায় দেশ সুরক্ষিত থাকুক, আত্মনির্ভর হোক ভারত। এখন জিডিপি-র নিরিখে অর্থনীতিতে চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। সামরিক দিক থেকে
আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের পরেই ভারতের অবস্থান। প্রতিযোগিতা বাড়ছে, শত্রুরাও বসে নেই। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এই সময় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এসআইআর সময়ের দাবি।