ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা ঘিরে নির্বাচন কমিশননের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিরোধীরা
কেন এত ভয়?
ফি বছর লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারীকে জাল নথি পাইয়ে দিয়ে ‘দেশি’ করে ফেলছেন শাসকদলের নেতারা, তারাই থাবা বসাচ্ছে এ রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাদের পেটের ভাতে।
প্রনবজ্যোতি ভট্টাচার্য
অভিযানের নাম বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা, সংক্ষেপে ‘এসআইআর’। কেন্দ্রীয় সরকার পক্ষের দাবি, এটি হলো ‘ভোটার তালিকার সাফাই অভিযান’। আর তুষ্টীকরণের রাজনীতি করা বিরোধীদের দাবি, ‘জবাই হচ্ছে গণতন্ত্র’। কংগ্রেসের ডিএনএ থেকে জন্ম নেওয়া পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস আরও একধাপ এগিয়ে বলছে ‘ভয়ংকর ষড়যন্ত্র’। প্রশ্ন হলো, কী এই এসআইআর? এক কথায় উত্তর হলো, এটি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করা হয়। এসআইআর প্রক্রিয়াটি নাগরিকত্ব যাচাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এটি একটি সংবেদনশীল বিষয় হয়ে উঠেছে। তার জেরেই গেল গেল রব তুলেছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ঈশান কোণে সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরাচ্ছেন বিরোধী দলগুলির নেতারা।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশে শেষবার এসআইআর হয়েছিল ২০০২-০৩ সালে। সদ্যই এই কাজ শেষ হয়েছে বিহারে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বাকি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে শুরু হতে চলেছে এই কাজ। এর পরেই গেল গেল রব তুলে সোচ্চার হয়েছেন বিরোধীরা। এর প্রধান কারণ হলো, বিহারে এসআইআর প্রক্রিয়ার খসড়া ভোটার তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে প্রায় ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম। ২০০২ সাল থেকে এরা দিব্যি ছিল ভোটার তালিকায়। অর্থাৎ এদের একটা বড়ো অংশই অংশগ্রহণ করেছেন নির্বাচনে। সে তিনি নিজের ভোট নিজেই দিন, কিংবা তাঁর হয়ে ভোট দিয়ে দেয় কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয় ও প্রশ্রয় প্রাপ্ত মস্তানরা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, যাঁরা বেশ কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন, ভোটার তালিকায় জ্বলজ্বল করছে তাঁদের নামও। বিজেপির অভিযোগ, এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়ে গদি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে অবিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যের শাসক দল।
এসআইআর প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী ২৬টি রাজনৈতিক দলের জোট ‘ইন্ডি’। এই ইন্ডি জোটেই রয়েছে তৃণমূলও। ছাব্বিশে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গে। তার জেরে সব চেয়ে বেশি ভয় বোধহয় পেয়েছে তৃণমূল। সেই কারণেই কলকাতায় ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ মঞ্চে এসআইআরের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই সভা থেকে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর-এ বৈধ ভোটারদের নাম বাদ গেলে ঘেরাও করা হবে নির্বাচন কমিশনের দপ্তর। সেই মোতাবেক সম্প্রতি এই প্রস্তাব পেশ করেন তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। সেই প্রস্তাব গ্রহণও করেছিলেন ইন্ডি জোটের নেতারা। ওই কর্মসূচিতে পোস্টারের ভাষা কী হবে, তাও ঠিক করে দিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সংসদ চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এসআইআর হলো সাইলেন্ট ইনভিজিবল
রিগিং’। তাঁর সেই কথা ধরেই এসআইআর-কে ‘চুপি চুপি ভোটে কারচুপি’ বলে কটাক্ষ করেছে তৃণমূল।
তবে বিরোধীদের এসব প্রতিবাদে কোনো কাজ হবে না বলেই নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর। জানা গিয়েছে, ভোটার তালিকায় থাকা নামের মধ্যে কারা মৃত, কারা অন্যত্র চলে গিয়েছেন, ভুয়ো ভোটারই-বা কারা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তা সমীক্ষা করে দেখবেন কমিশনের লোকজন। কমিশন সূত্রে খবর, সিইও-র নেতৃত্বে জেলা নির্বাচনী আধিকারিক বা জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলাশাসক, ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার, অতিরিক্ত ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার এবং বুধ লেভেল অফিসাররা একত্রে ভোটার তালিকায় নাম থাকা প্রত্যেক ভোটারের বাড়ি গিয়ে সমীক্ষার কাজটি করবেন। এতে একটি ফর্ম ফিল-আপ করে প্রয়োজনীয় তথ্য দাখিল করতে হবে ভোটারদের। পরে সেটি যাচাই করা হবে।
তবে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশিত এসআইআর তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের অতিরিক্ত নথি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার যাঁদের অভিভাবকদের নাম সেই তালিকায় রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও সমস্যা নেই। তবে সেই তালিকায় যাঁদের নাম নেই, নয়া ভোটার কিংবা অন্য রাজ্য থেকে চলে আসা কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা ফর্ম পূরণ করতে হবে, দাখিল করতে হবে প্রয়োজনীয় নথিও। ২০০২ সালের তালিকায় যাঁদের নাম নেই, তাঁদের পারিবারিক ও এদেশের নাগরিকত্বের যোগসূত্র খুঁজতে যাচাই করা হবে নথি। পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবেন রাজনৈতিক দলগুলির বুধ লেভেলের প্রতিনিধিরাও।
তার পরেও কেন গণতন্ত্র জবাই হচ্ছে বলে রব তুলেছেন বিরোধীরা? কেনই-বা এসআইআর প্রত্যাহারের দাবি তুলছেন তাঁরা? তাঁরা কি চান না বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হোক স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ? অথচ লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী বলেন, ‘এই লড়াই রাজনৈতিক নয়, বরং সংবিধান রক্ষার লক্ষ্যে। এই লড়াই এক ব্যক্তি, এক ভোটের জন্য এবং আমরা একটি পরিষ্কার, বিশুদ্ধ ভোটার তালিকা চাই।’
রাহুল যা চান, প্রযুক্তিসম্পন্ন মানুষ তো তাই চায়। বলা ভালো, নির্বাচন কমিশনও তো সেটাই চায়। তার পরেও এসআইআর প্রত্যাহারের দাবি উঠছে কেন? কেনই-বা তৃণমূল এ নিয়ে সুর চড়াচ্ছে? রাজনৈতিক মহলের মতে, বছর ঘুরলেই এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এসআইআর হলে বাদ যাবে প্রায় ২ কোটি ভোটারের নাম। ২০০৩ সালে এসআইআরের পর যেসব অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে পশ্চিমবঙ্গে এবং তৃণমূলের জমানায় যারা বেনোজলের মতো ঢুকেছে এ রাজ্যে, তাদের সিংহভাগই হয় বাংলাদেশি মুসলমান, নয়তো রোহিঙ্গা মুসলমান। প্রথমে বাম এবং পরে তৃণমূলের নেতারাই এদের জাল নথি বানিয়ে এ রাজ্যের ‘স্থায়ী বাসিন্দা করে দিয়েছে। যার জেরে তারা যেমন রেশন-সহ সরকারের নানা দাক্ষিণ্য পাচ্ছে, তেমনি ভোট দিয়ে ঋণ শোধ করছে শাসক দলের নেতাদের। এরাই বিভিন্ন বুথে গিয়ে ছাপ্পা ভোট দেয়, এই অনুপ্রবেশকারীরাই ভোটের দিন শাসক দলের নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে ভোটারদের রক্তচক্ষু দেখিয়ে বলে, ‘লাইন ছেড়ে চলে যান, আপনার ভোট হয়ে গিয়েছে’।
যিনি ভোটার তিনি দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পরে জানতে পারেন, তাঁর ভোট হয়ে গিয়েছে। তাঁর হয়ে ভোট দেওয়ার মহান কর্তব্যটি করে দিয়েছে পাড়ারই পচা, ভাইটুরা। এই অনুপ্রবেশকারীরাই ভোটের দিন বুথের সামনে বোমা ফাটিয়ে ভোটারদের ঘরে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে ছাপ্পা মেরে দেয়। একে তো প্রাণের ভয়, তার ওপর চাকরি বাঁচানোর দায়, সর্বোপরি, ‘চুলোয় যাক গণতন্ত্র’ মার্কা মনোভাব নিয়ে নির্বিকার চোখ-কান বুজে বসে থাকেন প্রিসাইডিং অফিসার-সহ ভোট কেন্দ্রের বাকি কর্মীরা। এই ত্রিফলায় পোয়াবারো হয় পচা, ভাইটুদের। শাসক দলের ছত্রছায়ায় থেকে তারা যাতে মৌরসিপাট্টা চালাতে পারে, তাই বছরের পর বছর ধরে কুকীর্তি করে চলে তারা। আর দিব্যি গতি আঁকড়ে বসে থাকেন শাসক দলের নেতারা। ভোটের পরে এদের পুরস্কারও দেওয়া হয়। কোথাও সস্তার মুরগি-মাংস, ভাত, কোথাও আবার গরম গরম খাসির ঝোল দিয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে পরবর্তী নির্বাচনে কী করতে হবে, তার আঁক কষতে শুরু করে পচা, ভাইটুরা।
তাই এসআইআর হলে সব চেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে অবিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যের শাসক দল। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, তাই তারাই সব চেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছে এসআইআর নিয়ে। প্রায় দু’যুগ এসআইআর না হওয়ার সুফল কুড়িয়েছে এই রাজনৈতিক দলগুলি। বহিরাগতদের কল্যাণে (ভুয়ো নথি দিয়ে যাদের দেশীয় তকমা দেওয়া হয়েছে) যারা বছরের পর বছর ধরে করেকম্মে খাচ্ছে, তারা। রাজনৈতিক মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর হলে বাদ যাবে বিপুল সংখ্যক ভোটারের নাম। তখন আর কেউ জিততে পারবেন না ছ’ লক্ষ-সাত লক্ষ ভোটে। কেউ আর দাঁত বের করে বলতে পারবেন না, হুঁ হুঁ বাবা, উন্নয়নের কারণেই বছরের পর বছর জিতে চলেছি আমরা। কারণ, রাজ্যে যদি প্রকৃতই উন্নয়ন হতো তাহলে দু’টো পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য ঘর-সংসার ফেলে ভিন রাজ্যে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে হতো না পশ্চিমবঙ্গের যুবকদের। এই যে ফি বছর লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারীকে জাল নথি পাইয়ে দিয়ে ‘দেশি’ করে ফেলছেন শাসকদলের নেতারা, তারাই থাবা বসাচ্ছে এ রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাদের পেটের ভাতে।
তাই কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে ছুটতে হচ্ছে এ রাজ্যের তরুণ- তরুণীদের। ভোটের আগে তাঁরা যাতে ঘরে ফেরেন, তাই পরিযায়ী শ্রমিক-ভাতাও চালু করা হচ্ছে। এতে মাস গেলে মিলবে হাজার পাঁচেক টাকা। অর্থাৎ দিন প্রতি ২০০ টাকারও কম। এই টাকায় সংসার চালিয়ে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা কীভাবে চালাবেন, তা বুঝতে পারছেন না পরিযায়ী শ্রমিকরাও। তাই এঁদের সিংহভাগই আর এরাজ্যে ফিরবেন না। তাঁরা ধরে ফেলেছেন রাজ্যের শাসক দলের ফন্দি। নানারকম ‘শ্রী’যুক্ত ভাতা দিয়ে বস্তুত ভিখিরি করে রাখবার মতলব এঁটেছে তৃণমূল নামক রাজনৈতিক দলটি। যে দলের একাধিক নেতা নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জেলের ঘানি টানছেন। কেউ আবার ধরা পড়ার ভয়ে সর্বক্ষণ জপছেন ইষ্টদেবতার নাম। দলীয় নেতাদের এই কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি থেকে রাজ্যবাসীর
নজর ঘোরাতে প্রয়োজন একটা আন্দোলনের।
সেই আন্দোলনের যৌক্তিকতা থাকুক কিংবা না থাকুক, আন্দোলন করতেই হবে পিঠ বাঁচাতে। জনগণ ক্ষেপে গেলে যে বিষম বিপদ। তখন তো আর ক্ষমতার শীর্ষে বসে ক্ষীর খাওয়া যাবে না। তখন তো আর বিক্রি করা যাবে না চাকরি কিংবা রেশনের চাল। অতএব, নানা ছুতোনাতায় আন্দোলন করো। সেজন্য প্রয়োজনে সংবিধান না মানলেও চলবে। না হলে কি আর একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন, ‘এসআইআর পরিচালনার নামে এনআরসি চালু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে যদি কাউকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তবে আমরা তা সহ্য করব না।’ বিশেষ নিবিড় ভোটার সমীক্ষায় তাই এত ভয় বিরোধীদের।