ভোটার তালিকায় বিশেষ সংশোধনের বিরোধিতার মাধ্যমে সংবিধান ও গণতন্ত্রের অসম্মান করছে
বিরোধী জোট
ড. রাজলক্ষ্মী বসু
বিরোধিতার আওয়াজ কখনোই দমে যাবে না- এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের বিশেষত্ব। যদি ‘ঠাকুরঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি’ গোছের বিরোধিতাও হয়, তখনও সংকীর্ণতার গণ্ডি অতিক্রম করে সেই যথেচ্ছ রকম বিরোধিতা কিন্তু সহনীয় হতে পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে, অরাজকতা সৃষ্টির ছক কষে যদি সরকার, প্রশাসন, বিচারবিভাগ এমনকী নির্বাচন কমিশনের মতো স্বশাসিত, সাংবিধানিক সংস্থারও বিরুদ্ধাচরণ করা হয় এবং দেশজুড়ে তৈরি করা হয় চরম নৈরাজ্য, তবে দেশের আইন-কানুন, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বিরোধী সেই ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সম্প্রতি বিহারে সংঘটিত হয়েছে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন। ভোটার তালিকা সংশোধনের এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এমনই এক তুমুল রাজনৈতিক বিরোধিতা শুরু করেছে ইন্ডিজোটের সব শরিকরা, তাও আবার এক সুরে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে এই তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস একটা বিধানসভা আসন নিয়ে বিগত দিনে রীতিমতো বাঁদরের পিঠে ভাগ করেছে। অথচ দেশের গণতন্ত্র সুরক্ষায় যেই না বিহারে ভোটার তালিকায় এই বিশেষ নিবিড় সংশোধন শুরু হলো,
অমনি বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র যেন রসদ পেল। বিহারে যখন লালুপ্রসাদ যাদবের জমানায় দুর্নীতি হয়, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির হিমালয়ের সন্ধান মেলে, খোঁজ পাওয়া যায় জঙ্গি ঘাঁটির, অথবা কেরালায় যখন সোনাপাচার চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়, তখন না তৃণমূল চিৎকার করে তেজস্বী যাদবের বিরুদ্ধে, না তেজস্বী তেজ দেখায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, স্তালিন বা হেমন্ত সোরেনের বিরুদ্ধে। রাহুল গান্ধী কখনও ‘চেতনা মার্চ’ করেন না স্তালিন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এর কারণ কী? ইন্ডিজোটে এরা হলো পরস্পরের জোটসঙ্গী এবং আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েও সততার স্বঘোষিত পরাকাষ্ঠা। ভারতীয় ‘গণতন্ত্র’ রক্ষায় একজোট হয়েছে বলে এই বেশিরভাগ পরিবারতান্ত্রিক দলগুলির দাবি! তাই বিহারে বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কাজ শুরু হতেই রাহুল গান্ধী এবং ইন্ডিজোটের পক্ষ থেকে ‘ভোট চোরি’-শীর্ষক অপপ্রচার শুরু হয়। তাদের বক্তব্য হলো ভোটার তালিকায় এই সংশোধনী হলো ভোট চুরির কৌশল। ডিএমকে-র কানিমোঝি থেকে পিডিপি-র মেহবুবা মুফতি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে রাহুল গান্ধী- সবাই আপাতত এই ইস্যুতে আন্দোলনরত এবং তাদের প্রধান টার্গেট হলো কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের অফিস এবং সংসদ ভবন। বিহারে ভোটার তালিকায় যেহেতু বিশেষ নিবিড় সংশোধন হলো, তাই বিহার বিধানসভাও এখন এই সংশোধনীর কাজের বিরোধিতার স্বর রেওয়াজের উর্বর ভূমি। বিশেষ নিবিড় সংশোধন আর কিছু পারুক, না পারুক, লোকসভা নির্বাচনের পর এই প্রথম আবার সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিতে একত্রিত করেছে। যদিও কোনো সাধু উদ্দেশ্য তাদের একজোট করেনি। একত্রে দাঁড়িয়ে,
নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপের যুক্তিহীন বিরোধিতার সুযোগে বেশিরভাগ আঞ্চলিক দলগুলি জাতীয় স্তরে বিরোধ প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে। এই বিরোধে চোখে পড়ছে তাদের শৌখিনতা ও উদ্ভাবনীশক্তি। গত ৬ আগস্ট, নির্বাচন কমিশনের বিরোধিতার ডাক দিয়ে তার ইন্ডিজোটসঙ্গীদের একটি নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। যেন চেটেপুটে, কবজি ডুবিয়ে খাওয়াদাওয়া করে রাজনৈতিক মশলা মাখানো ইস্যুটাকে মানুষকে খাওয়ানো যায়। দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গেও নির্বাচন কমিশনের এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনের বিরুদ্ধে বেশ প্রো-অ্যাকটিভ।
এখন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে কয়েকটি প্রশ্ন। ‘বুথ লেভেল অফিসার’ নিয়োগের নিয়মটি কাদের শাসনকালে তৈরি হয়? কেন এই নিয়ম তৈরি হয়? তখন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কে ছিলেন? এর উত্তর হলো- সময়টা তখন ছিল ২০০৯ সাল। অর্থাৎ ইউপিএ-২ সরকার তখন ক্ষমতায়। দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার তখন নবীন চাওলা। এই নিয়ম চালু করার বিষয়টি সম্পর্কে তখন তিনি বলেন- ‘We decided to adopt a completely new method to ensure as accurate an elec- toral roll as possible, particularly to counter the effect of people moving between states, cities, and within cities, often beyond the jurisdiction of election office due to their movements.’
তিনি এও বলেন যে, নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য হলো এমন একটি সিস্টেম তৈরি, যার মাধ্যমে নাগরিকদের অসুবিধায় না ফেলে ইলেক্টোরাল মেশিনারি তৈরি হতে পারে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সেই সিদ্ধান্ত থেকেই সৃষ্টি হয় ‘বুথ লেভেল অফিসার’-এর পদটি। ঠিক হয় যে, এই নির্বাচনী আধিকারিকরা বুথস্তরে দায়িত্বে থাকবেন এবং ভোটার তালিকা দেখভাল করবেন। তালিকায় নানা সংশোধনের মধ্যে নতুন ভোটারদের নাম সংযোজন, স্থানান্তরিত ভোটারদের নাম বিয়োজন, প্রয়াত ব্যক্তিদের নাম অপসারণ- এই বিষয়গুলিই গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় ভোটার লিস্ট মেন্টেন করার দায়িত্ব এই সরকারি আধিকারিকদের দেওয়া হয়। ২০১০ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়- সিস্টেমিক ভোটারস্’ এডুকেশন অ্যান্ড ইলেক্টোরাল পার্টিসিপেশন। সরকার বা সাংবিধানিক
সংস্থার বিরোধিতার স্বাদ মেটাতে ভারতীয় জনতা পার্টি কিন্তু সেদিন এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে পথে নামেনি। সেই সময় এর বিরুদ্ধে সরব হয়নি তৃণমূল
কংগ্রেসও। সেদিন কি তবে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকার বা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ‘ভোট চুরি’র লক্ষ্যেই এই নতুন প্রক্রিয়া শুরু করে? সেদিন যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা লালুপ্রসাদ যাদবদের বিচারে নির্বাচন কমিশন প্রণীত, ভোটার তালিকা সংক্রান্ত এই ব্যবস্থাটি অসহ্য ঠেকত, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে যদি সেই যাত্রায় তারা রুখে দিতেন এই কর্মসূচি, তবে আজ হয়তো নিবিড় সংশোধনের ভূত তাড়াতে নির্বাচন কমিশনের অফিসে ওঝার মতো তাদের চড়াও হতে হতো না। বিএলও এবং নিবিড় সংশোধন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সুস্থ, স্বাভাবিক নির্বাচনের লক্ষ্যে ভোটার তালিকা সংশোধনী প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই সুদৃঢ় করে। রাহুল গান্ধী নৈশভোজে যতই ভালো-মন্দ মেনু রাখুন, তাতে তো আর লঙ্কার স্বাদ মিষ্টি হবে না। ঠিক তেমনই বিরোধীরা অতি উৎসুক হয়ে ধরনা, পদযাত্রা, কালোপতাকা হাতে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও ইত্যাদি করলেও তাতে প্রশাসনকে তার কর্তব্যনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য করা যাবে না। সংসদে বিরোধীদের হইচইয়ের ফলেও কমিশনের সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয় না। ভোটার তালিকায় এই বিশেষ, নিবিড় সংশোধনের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় আগামীদিনেও হয়তো কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, কিন্তু নিয়মিতভাবে ভোটার তালিকা সংশোধনটা যে জরুরি তা মেনে নেওয়াটাই
মনে হয় দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলির কাছে বুদ্ধিমানের পরিচয় হবে।
বিহারে নিবিড় সংশোধনে প্রায় ৬৫ লক্ষ নাম বাদ যেতেই নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে তামাম বিরোধী পক্ষ। এনিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে বলে কিছু অনুপ্রাণিত সংবাদমাধ্যমেরও দাবি। এই প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের বিরোধী, অগণতান্ত্রিক ইত্যাদি বলে হাজার তর্জা, দৌড়োদৌড়ি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। বিষয়টি এখন যদিও আর কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম, ডিএমকে, আরজেডি বা আপের আওতায় নেই। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে এটি বর্তমানে বিচারাধীন। বিরোধীদের কাজ রাস্তাঘাটে ফাঁকা উদ্বেগ রটনার। বিহারের কথাই ধরা যাক। ২০০৩ সালে বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ, নিবিড় সংশোধন হয়। তার ভিত্তিতেই তখন সেই রাজ্যে তৈরি হয়েছিল ভোটার তালিকা। নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে, বিহারের ক্ষেত্রে ২০০৩-এর জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, জীবিত থাকলে তাঁদের নাম এবারও অবশ্যই থাকবে। নিবিড়
সমীক্ষার আওতায় আসবে ২০০৩ পরবর্তী এই ২২ বছরের সময়কাল। একইভাবে, পশ্চিমবঙ্গে এই বিশেষ নিবিড় ভোটার সমীক্ষা হয়েছিল ২০০২ সালে। তাই এই বছর এ রাজ্যে ভোটার তালিকায় বিশেষ সংশোধনীর কাজ শুরু হলে ২০০২-পরবর্তী সময়কাল সমীক্ষার আওতায় আসবে এটা ধরে নেওয়াই যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ওই ‘৬৫ লক্ষ’ সংখ্যাটাই যথেষ্ট। বিহারের ভোটার তালিকা থেকে বাতিল হওয়া ৬৫ লক্ষের মধ্যে ২১ লক্ষ লোক প্রয়াত। ৩১ লক্ষ লোক অন্যত্র চলে গিয়েছেন, অর্থাৎ স্থানান্তরিত। দেড় লক্ষের মতো ভোটারের ক্ষেত্রে মাল্টিপল এন্ট্রির সমস্যা। অর্থাৎ দুই বা একাধিক জায়গায় স্থানীয় ভোটার তালিকায় তাদের নাম বিদ্যমান। এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রাহুল গান্ধী কী চাইছেন? এই নামগুলি তালিকায় থেকেই যাক? তাতে ভোটের অঙ্কে কার লাভ? এতো সেই ‘ঠাকুরঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি’-র মতো ব্যাপার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুমকি মাখানো বক্তব্যও ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়েছে। বুথ লেভেল অফিসারদের রীতিমতো শাসিয়ে তাঁদের উদ্দেশে তিনি
বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন কিন্তু থাকবে নির্বাচনের সময়টুকুই; তার আগে এবং পরে তো আপনারা রাজ্য সরকারের কর্মচারীই থাকবেন।’
অর্থাৎ তিনি চাইছেন এ রাজ্যের যত ভূতুড়ে ভোটার, অনুপ্রবেশকারী ভোটার সবাই গণতন্ত্রের নামে এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করুক। তবেই না তার দুর্নীতিতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী ও অটুট থাকবে! কোনো শুভ উদ্যোগকে বিতাড়িত করার কাজে তার সমান্তরাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কমই রয়েছে। যেমনভাবে, টাটাকে এবং শিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে এ রাজ্য থেকে তিনি বিতাড়িত করেন, তেমনভাবেই হয়তো ভাবছেন নির্বাচন কমিশনের বিশেষ, নিবিড় সংশোধন বা ভোটার সমীক্ষার প্রক্রিয়াটাকেও তিনি বিতাড়িত করবেন। বিহারের ভোটার তালিকায় সংশোধনীর ক্ষেত্রে ১১টি নথির মধ্যে যেকোনো একটি নথি সংগ্রহের
বিষয়টি নির্দিষ্ট করে দেয় নির্বাচন কমিশন। ভোটার তালিকায় কোনো নাম সংযোজন, বিয়োজন ইত্যাদির বিষয়ে বিহারে নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত প্রতিটি রাজনৈতিক দল, এমনকী স্থানীয় বাসিন্দাদের যেকোনো মতামত প্রকাশ, বিতর্ক উত্থাপন বা প্রশ্ন রাখার পূর্ণ অধিকারও রয়েছে। কিন্তু দেশের কোনো প্রান্তের ভোটার তালিকায় বিশেষ, নিবিড় সংশোধন করতেই দেবো না, ওটা ভোট চুরির ফন্দি- এহেন উসকানিমূলক মন্তব্য রাজনৈতিক বিরোধ নয়, রাজনৈতিক দুর্গতি-প্রসূত অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ। যুক্তিহীনভাবে রাহুল গান্ধীরা বলে চলেছেন যে, তাহলে কি অবৈধ ভোটারে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত
হলো? তবে তো সেই নির্বাচনটাই ইনভ্যালিড! তারা হয়তো জানেন না তাদের এই যুক্তিটাই আসলে ইনভ্যালিড। ১৯৫২ সালের আগে সঠিক ও নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরির লক্ষ্যে সর্বাধিক গুরুত্বদান করেন ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। ১৯৫২-র সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি নিজেই বলেন- ‘too many glitches.’
সেই যুক্তিতে জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্ব তাহলে ইনভ্যালিড? অন্তরের অন্তঃকরণে ভোট-পূর্ব যাত্রাপালার ইচ্ছে জাগলে রাহুল গান্ধীর মতো বিরোধী নেতারা এমন অনেক আবোলতাবোল বলেন, যা শেষমেশ কোভিড- রাফাল ইত্যাদি বিতর্কের মতো হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। শীর্ষ আদালত থেকে একাধিকবার তিরস্কার জুটেছে রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের। তবুও সাগরপারের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার, এমনকী দেশের সাংবিধানিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তাদের সর্বাত্মক বিরোধে কোনো লাগাম নেই। পাকিস্তান, বাংলাদেশের মতো একই কায়দায় ভারতেও তাদের লক্ষ্য হলো ‘রেজিম চেঞ্জ’। নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে ভোটচোর বলছেন রাহুল গান্ধী! একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে- ‘চোরের মায়ের বড়ো গলা।’ ১৯৮০ সালে নয়াদিল্লিতে সোনিয়া গান্ধীর নাম ভোটার তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব পান ১৯৮৩-তে। ১৯৮০-তে ভোটার তালিকায় সোনিয়া গান্ধীর নামের অন্তর্ভুক্তি অবৈধ। কিংবা তার দেওয়া ভোটটি ইনভ্যালিড। তা নিশ্চিতভাবে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশনের দিকেও এক্ষেত্রে অভিযোগের আঙ্গুল উঠতে পারে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশনের ডানা কিন্তু কংগ্রেস আমলেই ছাঁটা হয়েছিল? বড্ড কড়া ছিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষণ। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কঠোর নীতিবান ও দায়িত্বশীল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও তড়িঘড়ি শেষণে ভূত দেখলেন। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে পরিবর্তিত করল কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। ১৯৯৩ সালে যুক্ত করা হয় আরও দুই নির্বাচন কমিশনার – এমএস গিল এবং জিভিজি কৃষ্ণমূর্তিকে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেও সেদিন কেউ কিন্তু এই ধরনের কংগ্রেসি ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন করেননি। মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। যদিও আইনের দৃষ্টিতে নরসিংহ রাও ভুল প্রমাণিত হননি। আইনত ভুল হয়তো সে যাত্রায় প্রমাণিত হয়নি কংগ্রেস। কিন্তু এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে নির্বাচন কমিশনের সাহসী পদক্ষেপ বা কমিশনের সক্রিয়তায় বিচলিত হয় কংগ্রেস। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো- ‘অ্যাক্ট অফ ফেইথ’। সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ নির্বাচন কমিশন। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের ‘স্যাটিসফ্যাকশন’ তার দায়িত্ব নয়। কমিশনের কাজের বিরোধিতার মধ্যে যদি কোনো সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ থাকে, যদি সাধারণ মানুষের কানে কমিশনের
বিরুদ্ধে মন্ত্র দেওয়ার কাজ চলতে থাকে, তবে অচিরেই দেশের গণতন্ত্রের দুর্দিন উপস্থিত হতে পারে। দেশের গণতন্ত্রকে মজবুত করাই নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য। সেই প্রয়োজনীয়তার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করার পরিবর্তে যদি দৃষ্টি ঘোরাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরোধিতা চলে, তবে তা বেশি সময় স্থায়ী হয় না। ভোটার তালিকায় বিশেষ, নিবিড় সংশোধনের লক্ষ্যে ঠিক পথেই এগোচ্ছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। আর তাই ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইন্ডিজোট।
২০২৪-এর লোকসভা ভোটের পর সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল এই জোট। এর অস্তিত্বের কথা ভুলতে বসেছিল সবাই। এখন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে এরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। হয়তো পরিকল্পনা রয়েছে এই ইস্যুতে দেশজুড়ে বড়ো কোনো গোলমাল পাকানোর। বিভিন্ন রাজ্যে এই জোটের শরিক দলগুলি পরস্পরের রাজনৈতিক শত্রুও বটে। জাল ভোটার-মুক্ত তালিকা তৈরিতে এরা সিঁদুরে মেঘ দেখছে। আগামীদিনে রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কায় নিজেদের একটি ঐক্যবদ্ধ রূপ তুলে ধরার কুনাট্যে মত্ত ইন্ডিজোটের শরিক দলগুলি।