সম্পদ হরণকারী শাসকের চেয়ে শাসক-হন্তা কেন প্রেয়?
তৃণমূলি দুর্যোধন
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
পুকুর মানে জলের ভাণ্ডার। সংস্কৃত শব্দ পুষ্করিণী থেকে তার সৃষ্টি। অপভ্রংশে হয়েছে পুকুরি বা পুকুর। তা থেকে পুকুর। যেখানে পদ্মফুল জন্মায়। তবে ফুলের পাশাপাশি তৃণমূলের জমানায় সে পুকুরে গোবর, কাদা আর পাঁক-দার নেতাও জন্ম নেয়। তারা মানুষের সম্পত্তি হরণ করে দুর্যোধনের মতো জলে লুকিয়ে থাকে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাণ্ডবদের ভয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকিয়ে ছিল দুর্যোধন।
তেমনই দল আর নিজের চুরি লুকোতে মোবাইল সমেত পুকুরে ঝাঁপ দেয় এক নিকৃষ্ট তৃণমূল নেতা। তার নাম লিখতে ঘেন্না করে। তার এতটাই নিম্নমান আর নিম্নরুচি। মহাভারতে বিকর্ণ বাদে সব কৌরব ভ্রাতার নাম ‘দু’ দিয়ে শুরু। এমনকী বোন দুঃশলা পর্যন্ত। নদী যেমন ‘নাদ’ বা শব্দ থেকে তৈরি। পুকুরের জন্য পানীয় কথাটি সেই কারণে ব্যবহৃত হয়। পুকুরকে ‘নিজস্ব সম্পত্তি’ হিসেবে দেখানো হয় যা কিনা মানুষের সম্পদ। যেকোনো চুরির বিশালত্ব বোঝাতে তাই ‘পুকুর চুরি’ কথাটি ব্যবহার করা হয়।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল পুকুর চুরিতে হাত পাকিয়েছে। বালিশ চুরিতে নয়। বালিশ চুরি মানে ছোটোখাটো চুরি। আর পুকুর চুরি হলো বৃহৎ চুরি। এর কারণ তৃণমূল নাকি কোনোদিন আশা করেনি যে, সিপিএমের মতো অত্যাচারী দলকে সরিয়ে তারা ক্ষমতায় আসবে এবং তিন দফায় ক্ষমতায় টিকে যাবে।
স্বপ্নপূরণ হওয়ার সঙ্গেই নাকি তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল স্থির করে ফেলেছিল চুরি আর তোলাবাজি করে এত সম্পত্তি বানাবে যে, ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও তাদের চতুর্দশ প্রজন্ম দুধে-ভাতে থাকবে। আর ঘটেছেও তাই! রাজ্যের মানুষের কিয়দংশ, মুসলমান ভোটব্যাংক, অনুপ্রবেশকারী, মৃত ও ভুয়ো ভোটার এবং ভোট জালিয়াতির দৌলতে তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০২৬-এর ভোটের পর তৃণমূল দল যদি নতুন করে আবার লুঠপাটের সুযোগ পায়, তার জন্য রাজ্যের মানুষদের একটি অংশ আর বিরোধীরা সমানভাবে দায়ী থাকবে। রাজ্যে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভোটার তালিকায় বিশেষ, নিবিড় সংশোধন, অবাধ নির্বাচন ও ভোটগণনা না হলে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতাও হয়তো প্রকট হয়ে উঠতে পারে। তিনবারের ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল যে রাজ্যের মানুষের তিনকালকে এককালে নিয়ে ফেলেছে, তা স্বচ্ছন্দে বলা যায়।
রাজ্যপাটের পৃষ্ঠাতেই এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছিল যে, কেবল তৃণমূলের ভরাডুবি এ রাজ্যকে বাঁচাতে পারে। সেরকম ধারণা ঘিরে এত সত্বর কোনো ঘটনা ঘটবে ভাবিনি। ছাগলের গাছ-পাতা খাওয়ার মতো তৃণমূল সমর্থকদের ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটে ব্যালট খেতে দেখেছে রাজ্যবাসী। ‘পরশপাথর’ চলচ্চিত্রের নায়কের মতো। সে পুলিশের সামনেই পরশপাথর গিলে ফেলে হজম করে ফেলে। তৃণমূলের তস্কর নেতা পুকুরে লাফ দিয়ে বাঁচতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
এখন তৃণমূল একটি বহুস্বরা তস্করের দলে পরিণত হয়েছে। এইসব অভিযোগে তাদের নেতাদের কিছু যায় আসে না। কারণ ‘তস্করপনা’ তাদের রাজনৈতিক ধর্মে পরিণত হয়েছে। আড়ালে আবডালে তা মেনে নিলেও লোভ আর লাভের আশায় তাদের অনেক নেতাই দল ছাড়তে পারেন না। কিছুদিন আগে একজন প্রাক্তন আমলা অনেক হিসাব নিকাশ করে তৃণমূল থেকে সরে আসেন। সিবিআই তদন্ত এড়াতে তিনি মমতাপন্থী হয়েছিলেন। বিপদ আর নেই বুঝে সরে এসেছেন।
মিথ্যাবাদী আর চোর অভিযোগ দু’টি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রীর গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসের আঁতুড় ঘরে তৈরি বলে তা রপ্ত করতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। কংগ্রেসি সংস্কৃতি তাকে কেবল ক্ষমতায় থাকার শিক্ষা দিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসের সমস্ত নির্বাচনী জয় গুরুত্বহীন। আশির দশকে বিজেপির উত্থানের আগে পর্যন্ত কংগ্রেস দেশে কোনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তৈরি হতে দেয়নি। চাণক্য সম্পদ হরণকারী শাসককে হত্যার নিদান দিয়েছিলেন। চোর শাসকের মতো হৃত সম্পদকে নিজেদের সৃষ্টি বলে চালায় তৃণমূল।
কোনো তস্কর প্রধান দলের হরণ করা মাছ শাক দিয়ে ঢাকা যায় না। ছুঁড়ে দেওয়া তীর আর রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতের বাইরে চলে গেলে আর ফেরে না। ১৯৩৭-এর পর কংগ্রেসে মোহনদাস গান্ধী আর ২০১১-র পর সিপিএমে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরিণতি দেখলে তা বোঝা যায়।
অরির শেষ রাখতে নেই। সিপিএম আর কংগ্রেসের পড়ে থাকা ১০-১২ শতাংশ ভোটের পুরো ফয়দা নিচ্ছে তৃণমূল। এই উচ্ছিষ্টকে তারা আশীর্বাদ হিসেবে ব্যবহার করছে। পিঠ বাঁচাতে ‘কোনো ভোট কারুর ব্যক্তিগত বা পৈতৃক সম্পত্তি নয়’ স্লোগান হলো সিপিএমের শেষ কুযুক্তি। অবশ্য তা মানলে সবার আগে তাদের দলীয় সংবিধান পুড়িয়ে ফেলা উচিত।
তৃণমূল দুর্যোধনদের দল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের ভিতর দিয়ে সেখানে মুষলপর্ব আসন্ন। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার রাজ্যের ভোটদাতা এবং প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে করতে হবে।