দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার স্বার্থেই জরুরি
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হইল ভারত। ইহা প্রতিটি ভারতবাসীর গৌরবের বিষয়। এই গণতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় করিয়াছে ইহার নির্বাচনী ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো হইবার কারণে ভারতে প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে এই দেশের গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ উৎসব বলা হইয়া থাকে। গণতন্ত্রে নির্বাচনী ব্যবস্থা অপরিহার্য। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের ভালো-মন্দের প্রতি জনগণের মতামত ও ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় এবং ইহার ফলে সরকার গঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনের মাধ্যমে জনকল্যাণ কার্যের নিরিখে জনগণের সমর্থন আদায় করিয়া থাকে। কাজেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হইবার প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হইলে তাহার ফলাফল সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হইয়া থাকে এবং দেশে বা রাজ্যে একটি স্থিতিশীল সরকার গড়িয়া ওঠে। স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জয়ী ও পরাজিত উভয় পক্ষই ফলাফলকে সম্মান করিয়া থাকে। এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখিবার জন্য ভারতে নির্বাচন কমিশন নামে একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থার সৃষ্টি করিয়াছেন আইন প্রণেতাগণ। নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানেই সময়ে সময়ে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কার্য হইয়া থাকে। এই প্রক্রিয়া ভারতে ইতিপূর্বে বহুবার সংঘটিত হইয়াছে। ইহার ফলে মৃত ভোটার, স্থানান্তরিত ভোটার, নূতন ভোটার এবং অবৈধ ভোটারের বিশেষ সমীক্ষা হইয়া থাকে। ইহাতে কোনো রাজনৈতিক দলের আপত্তি থাকিবার কথা নহে। এতদিন কেহ আপত্তিও করে নাই। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এইবার নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিপক্ষ দলগুলি আপত্তি তুলিয়াছে। ইহার কারণ হইল, আগামী নভেম্বর মাসে বিহার রাজ্যে বিধানসভার ভোট হইবার কারণে নির্বাচন কমিশন বিহারে প্রথম ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের সমীক্ষা শুরু করিয়া বহু অসংগতি লক্ষ্য করিয়াছে। তাহার ফলে ওই রাজ্যের ভোটার তালিকা হইতে প্রায় ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ পড়িয়াছে। তাহাতেই প্রতিপক্ষ দলগুলি নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি দোষারোপ শুরু করিয়া অপপ্রচারে নামিয়াছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান, এই বিপুল সংখ্যক অবৈধ ভোটার প্রতিপক্ষ দলগুলির শক্তি। তাহা হাতছাড়া হইবার কারণেই তাহারা চিৎকার শুরু করিয়াছে।
আগামী বৎসরের মার্চ-এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটের কারণে নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কার্য শুরু করিবার নির্দেশিকা এই বৎসরই জারি করিতে পারে। বিহার রাজ্যের পরিণতি লক্ষ্য করিয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ভীত হইয়া পড়িয়াছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় এককোটিরও অধিক নাম বাদ পড়িবার সম্ভাবনা রাহিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী অগ্রিম বুথ স্তরের আধিকারিক এবং জেলা শাসকদিগকে হুমকি দিয়া রাখিয়াছেন যে একজন ভোটারেরও নাম বাদ দেওয়া যাইবে না। বাদ পড়িলে তিনি নাকি পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের দিল্লিতে লইয়া গিয়া নির্বাচন কমিশনের দপ্তর ঘোরাও করিবেন। অথচ তিনিই যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন তখন অবৈধ ভোটার ও অনুপ্রবেশকারীদের নাম ভোটার তালিকা হইতে বাদ দিবার দাবিতে লোকসভার স্পিকারের টেবিলে একগুচ্ছ কাগজ ছুড়িয়া দিয়াছিলেন। ক্ষমতার স্বাদ পাইয়া তিনি তাঁহার পূর্বের দাবি হইতে সরিয়া আসিয়া নির্বাচন কমিশনের ন্যায় একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে মাতিয়াছেন। নির্বাচন কমিশন পরিষ্কার জানাইয়াছে, এই সংশোধনীতে কোনো প্রকৃত নাগরিকের নাম বাদ যাইবে না। ইতিমধ্যেই ২০০২ সালে রাজ্যে বিশেষ নিবিড় সংশোধনীপূর্বক-কৃত ভোটার তালিকাটি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছে এবং কমিশন ঘোষণা করিয়াছে, যাহাদের নাম অথবা পিতা-মাতার নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় রহিয়াছে তাহারা বৈধ ভোটার। বাকিদের কয়েকটি প্রমাণপত্রের মধ্যে যেকোনো একটি থাকিলেই তাহারা বৈধ ভোটার বলিয়া পরিগণিত হইবে। তাহা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসকদলের নেতা-নেত্রীরা অপপ্রচার করিয়া চলিয়াছেন। আসলে বিহার রাজ্যে ৬৫ লক্ষ নাম বাদ পড়িতেই পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ বাড়িয়াছে। সত্য কথা হইল, দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার স্বার্থে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা স্বচ্ছ রাখিবার জন্যই নির্বাচন কমিশন এই প্রক্রিয়া শুরু করিয়াছে। প্রতিপক্ষ দলগুলি ইহা লইয়া রাজনীতি করিলেও প্রতিটি দেশভক্ত, ভারতীয় নাগরিক ইহাকে সাধুবাদ জানাইতেছেন।