বন্দে মাতরম
বন্দেমাতরম’
এক অবিরাম দেশশ্লোক’
ড. রাজলক্ষ্মী বসু
মল্লার রাগ, কাওয়ালি সুর। তারপর রবি ঠাকুরের ছোঁয়ায় তা নবজন্ম নিল ‘দেশ’ রাগে। সাহিত্য সৃষ্টির আঙিনা টপকে যে গান হলো দেশপ্রেমের সুর, বিদ্রোহের শিখা, স্বাভিমানের আগুন। যা শ্রীমদ্ভগবতগীতার মতো পবিত্র, যা তেজের প্রতীক, যা ত্যাগের প্রতীক- তাই-ই আসলে বন্দেমাতরম। এ কোনো ধ্বনি নয়, এ স্বদেশি অনুরণন। এ কোনো স্লোগান নয়, এ চিত্ত বিশুদ্ধ চিরন্তন বিশ্বাস। সুভাষচন্দ্র বসু অনুরোধ করলেন তিমিরবরণ ভট্টাচার্যকে, এই তেজসুর বন্দেমাতরমকে ‘রাগ দুর্গা’তে সুরারোপ করতে। আজাদ হিন্দ ফৌজ সিঙ্গাপুর থেকে যখন তার গঠন প্রস্তাব রাখল তখনও সিঙ্গাপুর রেডিয়ো মার্চিং স্টাইলে বন্দেমাতরম প্রচার করল। বন্দেমাতরম দেশপ্রেমের ভক্তিতে জারিত। তাই ১৯০১ কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে বন্দেমাতরম পরিবেশন করলেন দক্ষিণাচরণ সেন। রবি ঠাকুর যেন দেশপ্রেম যাপন করেছেন বন্দেমাতরমে। তাই ১৯০৪-০৫ রবি ঠাকুরের কণ্ঠে বন্দেমাতরম গ্রামোফোন কোম্পানি প্রকাশ করল। ১৯০৫ সালে সরলাদেবী চৌধুরাণী বারাণসী কংগ্রেস অধিবেশনে পরিবেশন করলেন এক মন্ত্রগীত। ১৯০৫ সালে হীরালাল সেন এক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন যার সমাপ্তিতে বন্দেমাতরম। ১৯০৭ সালে মাদাম ভিখাজি কামা ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকায় দেবনাগরীতে লিখলেন ‘বন্দেমাতরম’। ১৯০৯, ২০ নভেম্বর, ইংরেজিতে ঋষি অরবিন্দ অনুদিত বন্দেমাতরম- ‘Mother, I bow to thee’ প্রকাশিত হয় ‘কর্মযোগিন’
পত্রিকায়। ভগিনী নিবেদিতা তাঁর স্কুলে বন্দেমাতরমকে করলেন প্রার্থনা সংগীত। দেশ স্বাধীন হলো, সকাল ৬টা ৩০ মিনিট, ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের জলদগম্ভীর কণ্ঠে প্রচারিত হলো বন্দেমাতরম।
রাজপথ থেকে গলি, পাড়া থেকে জেলখানা, আন্দোলন থেকে ফাঁসির মঞ্চ, অত্যাচার থেকে উদ্বুদ্ধ উদ্বোধনে যদি সবার কোনো সাধারণ ভাষা থাকে, সাধারণ মনের অক্ষর থাকে, যদি দেশমাতৃকাকে সম্বোধন করার কোনো যথাযথ বাণী থাকে তবে তা নিশ্চিত ভাবেই বন্দেমাতরম। যার বিকল্প সে নিজেই। বঙ্গদর্শন পত্রিকার কর্মীকে বঙ্কিমচন্দ্র আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলছিলেন, ‘একদিন দেখবে, দেশ এই গানে মেতে উঠেছে। সেদিন আমি থাকব না, কিন্তু তুমি দেখে যেতে পারবে।’ তখন কিন্তু আনন্দমঠ প্রকাশিতই হয়নি। কাগজে খানিক জায়গা বাকি ছিল নীচের দিকে। ফাঁকা না রেখে প্রথম দু-লাইন প্রকাশিত হোক! তারপর তা হলো আগুন, তা হয়ে উঠল বিদ্রোহ, তা হয়ে উঠল স্বাধীনতা আন্দোলনের মন্ত্র। যখন নিষিদ্ধ হলো তখন তার জোর আরও বাড়ল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন আর বন্দেমাতরম যেন একে অন্যের জন্য গেঁথে গেল এক তালে। তবে একটা গানকে স্লোগানে রূপান্তরিত করলেন সরলা
দেবী। অবলা বসু, সরলা দেবী স্বদেশি আন্দোলনে ময়মনসিংহ সুহৃদ সমিতির মিছিলে যে উদাত্ত বন্দেমাতরম ধ্বনি দিলেন তা আসমুদ্রহিমাচলের প্রতিটা স্বাভিমানী ভারতীয়র স্পন্দনে জোয়ার আনল। মদনলাল ধিংড়া, প্রফুল্ল চাকী, ক্ষুদিরাম বসু, মাস্টারদা সূর্য সেন, মাতঙ্গিনী হাজরা সবার ব্রহ্ম সুর হয়ে
উঠল বন্দেমাতরম। এই ধ্বনির অপরাধে গ্রেপ্তার কত বিপ্লবী। এই ধ্বনির জোরেই তাঁরা বল পেয়েছেন। এই ধ্বনির জোরেই পরবর্তী প্রজন্মের বিপ্লবী তৈরি হয়েছে।
ইংরেজ শাসনে ভারতজুড়ে তখন হাহাকার। প্রদেশে প্রদেশে যন্ত্রণা। দুর্ভিক্ষ। চলছে মহাবিদ্রোহ এবং আরও অনেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আন্দোলন। কিন্তু কোথাও যেন এক সূত্রে জাতিকে, ভারতের সব সন্তানকে বাঁধার অভাব। হয়তো সেই অভাবের তাড়নাতেই তৈরি হলো আনন্দমঠ। ভবানন্দ জন্ম নিল সর্বাপেক্ষা তেজোদ্দীপ্ত স্বদেশ মন্ত্রে। বঙ্গদর্শনে ১৮৮১ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করে আনন্দমঠ। শেষ কিস্তি ছিল ১৮৮২, মে। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে
বঙ্গিমচন্দ্রের দেশরাগ শিল্পরূপ পেল। সেই শিল্পই হয়ে উঠল বিক্ষোভের লেলিহান শিখা। বাইরে থেকে মানুষের যন্ত্রণা বঙ্কিম মনে এতটাই আঘাত করেছিল, যা তাঁর ভিতরে এক ভবানন্দের জন্ম দিল। রবি ঠাকুর তাই বলছেন, “আমার কাছে এই জন্যই তো সমস্তটা একটা unreal phantasmagoria বলিয়া মনে হয়; জঙ্গলের মধ্যে এই ছায়াবাজির কোথাও একটু সমাজের সহিত নাড়ির সম্বন্ধ দেখিতে পাই না।
স্বীকার করি, এই সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ঐতিহাসিক সত্য; কিন্তু সেই ভিত্তিটুকুর উপর বঙ্কিমবাবু যে রোমান্সটি গড়িয়া তুলিলেন, কেন তিনি তাহাতে দেখাইতে চেষ্টা করিলেন না যে কেমন করিয়া কতকগুলো লোক আর অল্পে অল্পে তিলে তিলে সাংসারিক সমস্ত বিচ্ছেদ ব্যবধান অপসারিত করিয়া, একটা আইডিয়ায় অনুপ্রাণিত হইয়া পাশাপাশি আসিয়া দাঁড়াইল? একেবারে সমস্তটা খাড়া করিয়া হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে ধরিলেন। কত অত্যাচার, উৎপীড়ন, কত বেদনা, কত নিষ্ফল প্রয়াসের ভিতর দিয়া এই বিপ্লবী বীজ অঙ্কুরিত হইল, তাহার আভাসমাত্রও পাইলাম না। একেবারে বিদ্রোহের ছবি, সংসার হইতে
সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।”
আনন্দমঠ এবং তাতে ভবানন্দের গাওয়া বন্দেমাতরম আসলে এক বোধের আকুতি, দেশ মর্যাদার প্রতি মাথানত করার সুর, আত্মমর্যাদায় সুশৃঙ্খল স্বাধীনতার সত্যদীপ প্রজ্বলিত করার ব্রত। ইংরেজ সরকারের ঔদ্ধত্য ও উদাসীনতার বিরুদ্ধে এ হয়ে উঠল এক প্রতিবাদ। বিপ্লবীদের প্রজ্বলিত করেছে আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরম। আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন, ‘যে সব সন্ন্যাসী ফকিরেরা’ সত্য ইতিহাসের লোক, তাহারা… সকলেই নিরক্ষর, ভগবদ্গীতার নাম পর্যন্ত জানিত না।’ অর্থাৎ এই মন্ত্রই সবাইকে দেশরাগে বাঁধল। আদর্শ সন্তান তৈরি হলো বন্দেমাতরমে। তা কখনও ভক্তি, কখনও যোগ, কখনও-বা বিদ্রোহ। প্রাণবন্ত হয়ে উঠল বন্দেমাতরম। বন্দেমাতরম মানে রাজরোষ। বন্দেমাতরম মানে ইংরেজ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা। ইংরেজ নিন্দা থেকে অসন্তোষ- সব ভাব প্রকাশের ভাষা হলো বন্দেমাতরম।
ভবানন্দের কথা আছে আনন্দমঠে, তিনি বলছেন ‘আমরা অন্য মা মানি না। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি জন্মভূমিই জননী। আমাদের
মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই, স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই, আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা শস্যশ্যামলা,- ‘ভবানন্দ গেয়ে ওঠেন বন্দেমাতরম।’
বন্দেমাতরম এক অসমান্তরাল দেশবোধের আল্পনা। একে মাপা, ব্যাখ্যা করা মূর্খতা। কারণ এই গান জাতির মেরুদণ্ড গড়েছে। ভারতের বুকে যে যেই ধারার
রাজনীতিই করুক, বন্দেমাতরম হোক সবার মন্ত্র। ভূখণ্ড দেশ হয় এই তালে তালে সুরে অগ্নি দ্রোহে। বিপিন চন্দ্র পাল বন্দেমাতরম পত্রিকায় ১৯০৭-এ ‘ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র’ নামে যে নিবন্ধ প্রকাশ করেন তাতে বলেন, ‘Among the Rishis of the later age we have at least realised that we must include the name of the man who gave us the reviving Mantra which is creating a new India, the Mantra BandeMataram… The religion of patriotism, this is the master idea of Bankim’s writings… of the new spirit which is leading the nation to resur- gence and independence, he is the inspirer and political Guru… The third and supreme service of Bankim to his nation was that he gave us the vision of our Mother.’ এই শেষ শব্দ গুলিই লাখ কথার এক কথা- Vision of our Mother বোধের পূর্ণ শশীরূপ আমরা পেতাম না যদি ‘বন্দেমাতরম’ আমাদের চেতনা চৈতন্য বিশ্বাস বিদ্রোহে অঙ্গীভূত না হতো। আনন্দমঠের শেষে বঙ্কিমচন্দ্র কী চমৎকার লিখছেন, ‘বিষ্ণু মণ্ডপ জনশূন্য হইল। তখন সহসা সেই বিষ্ণু মণ্ডপের দীপ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল; নিবিল না। সত্যানন্দ যে আগুন জ্বালিয়া গিয়াছিলেন তাহা সহজে নিবিল না…’ রাজদ্রোহোদ্দীপক বন্দেমাতরম আবহমানকাল ধরে তেজোদ্দীপ্ত। পৃথিবীর কোনো সঙ্কট তাকে
স্পর্শ করতে পারবে না। তা সবার চেতনার বিচ্ছুরণ। চরমপন্থী রাজনীতির সূতিকাগৃহ বন্দেমাতরম। ১৯০৮, ২৯ জানুয়ারি, অমরাবতী ভাষণে বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ বলছেন বন্দেমাতরম গান নয়, মন্ত্র। এক শক্তি। কালী মাতার কাছে নিবেদিত এই গান হয়ে উঠল জাতীয়তাবোধের প্রতীক। চরমপন্থীর রণহুঙ্কার বন্দেমাতরম। ১৯০৬, ১৮ নভেম্বর, বোম্বেতে বাল গঙ্গাধর তিলকের সভাপতিত্বে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘বন্দেমাতরম আমাদের জাতীয় ধ্বনি’। বিনয়কুমার সরকার এই মন্ত্রের এক অনন্য ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর মতে ‘বন্দেমাতরম মন্ত্রের দেবী মামুলি হিন্দু দেব-দেবীর অন্যতম নন। এই দেবী
জলমাটির দেবী, পাহাড়ের দেবী, নদ-নদীর দেবী, দেশ দেবী, বঙ্গদেশ। নয়া আধ্যাত্মিকতার ফোয়ারা ছুটছে এই মন্ত্র থেকে। অথচ ইহার ভিতর বেদ-পুরাণ-তন্ত্রের নামগন্ধ নাই। বন্দেমাতরম হিন্দু আধ্যাত্মিকতার মন্ত্র, ভক্তিমার্গীক নাস্তিকতার সুরা। এই মন্ত্রে কঁৎ-পন্থী বঙ্কিম দর্শনের সমাজসেবা বা মানব
পূজা সরস মূর্তি পেয়েছে। স্বদেশ পূজা প্রবর্তক বঙ্কিম নবীন আধ্যাত্ম জীবনের ভগীরথ।’
বিপিন চন্দ্র পাল অনবদ্য ভাষণে বলেন, ‘বন্দেমাতরম গান নহে, মন্ত্র। প্রত্যেক মন্ত্রের একজন ঋষি ও এক বা ততোধিক দেবতা থাকেন। বন্দেমাতরম মন্ত্রের ঋষি সন্তান-সম্প্রদায়। প্রবর্তক মহাপুরুষ। পুরোহিত বঙ্কিমচন্দ্র। দেবতা জন্মভূমি। মন্ত্র অনেক সময় স্বল্প বর্ণাত্মক হয়। বিশেষ যে মন্ত্র সাধনা করিতে হয়, যে মন্ত্র সাধনা করিতে হয়, যে মন্ত্র সাধকের জপ মন্ত্র হইবে, সাধক যাহা নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে, শয়নে স্বপনে জপিবেন। জপিতে জপিতে তন্ময় হইয়া, আপনাকে সেই মন্ত্রের অগাধ রসে একেবারে ডুবাইয়া রাখিবেন, এমন সিদ্ধমন্ত্র প্রায়ই অতি সংক্ষিপ্ত, অতি স্বল্প পরিসর হওয়া আবশ্যক। বন্দেমাতরম এই
শব্দ দুটিই এজন্য প্রকৃত মন্ত্র। যে শক্তিশালী সঙ্গীতের শিরোভাগে ইহা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহার সমগ্রটা মন্ত্র নহে।… বন্দেমাতরম মন্ত্র; কারণ এই মন্ত্র ভক্তিরূপে জপ করিলে মায়ের স্বরূপ চিত্তে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে…’। অনুশীলন সমিতি এই গান, এই মন্ত্রকে বিদ্রোহ সঙ্কেতের মতো যাপন করেছে। দেশ
সঞ্জীবনী সঙ্গীত যদি কিছু হয় তবে তা বন্দেমাতরম। রণহুঙ্কার বন্দেমাতরম। মাতৃ আরাধনাও বন্দেমাতরম। দেশপ্রেম ভিক্ষাচর্যের মন্ত্র বন্দেমাতরম। মৃত্যুকে
আলিঙ্গন করার মাভৈঃ তান বন্দেমাতরম। এ বিজয়ধ্বনি। এ এক অবিরাম দেশশ্লোক।’

















