মোদীজীর চেয়ে ‘চালাক’ দিদি
অসত্যপ্রেমীযু দিদি,
আপনি কিন্তু জোড়া মিথ্যা বলেছেন দিদি। আপনার এত প্রিয় ভাই হয়েও, আপনার চির অনুগত হয়েও তা না বলে পারছি না। বেশি খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে, নবান্নে বসে রাজ্যের সব মানুষকে জোড়া মিথ্যা বলেছেন আপনি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। খারাপ লেগেছে কারণ, রাজ্যের প্রধান সচিবালয়ে আপনি যেখানে বসেন তার ঠিক পিছনেই রয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকা। দিদি, জাতীয় পতাকার সামনে বসে গণতান্ত্রিক দেশের এক নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যা বলছেন তা একদমই শোভা পায় না। সেই সঙ্গে দিদি, আপনার দলের ভাড়াটে সংস্থা আইপ্যাকের কাণ্ডকারখানা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আমার। মনে হয়, এই প্রশ্ন রাজ্যের সব বাসিন্দারই। সবাই বুঝছে আপনি যেটাকে ‘বুদ্ধি’ ভাবছেন, সেটা আসলে ‘চালাকি’, যার দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয় না।
রাজ্য সরকার তথা আপনার উদ্যোগে ভোটের আগে ভোটারদের জন্য ভোগ নিবেদনের ব্যবস্থা করেছেন। ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’ প্রকল্প। বুথ পিছু দশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ। প্রতি বুথে এক হাজার ভোটার ধরলে মাথা পিছু এক হাজার টাকা। কিন্তু দিদি, ভোটের আগে এইসব কাজ কেন হবে?
আপনি তো বলেছেন ৯০ শতাংশ কাজই হয়ে গিয়েছে। তারপরেও? জানি, আসলে ভাইদের ধনী বানাতেই এই উদ্যোগ। আসলে সরকারি নয়, আইপ্যাকের ঠিক করা তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মসূচি। আগে যেমন ‘দিদিকে বলো’ হয়েছিল, তেমনই ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’। বুদ্ধি বটে আপনার! ভালো হবে তৃণমূলের সংগঠনের আর খরচ হবে সরকারের। সেটাও আবার রাজ্যের নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা। দিদি, আপনার ভাষায় মোদীবাবুর টাকায়।
কে, আমি তো কলা খাইনি’ টাইপের কথাবার্তার ঢঙে বলেছিলেন এটা রাজনৈতিক নয়, প্রশাসনিক কর্মসূচি। কেন বলতে গেলেন? তাতেই তো ধরা পড়ে গেলেন। কথায় বলে না, ‘চোরের মন বোচকার দিকে’। আমি তখনই বুঝেছিলাম গোটাটা আইপ্যাকের পরামর্শে। পরে দেখা গেল ঠিকই। আইপ্যাক জেলায় জেলায় মেল পাঠিয়েছে। আর নাম রয়েছে নবান্নের পক্ষে আমলা শর্মিষ্ঠা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। জেলাশাসকদের কী করতে হবে সে সব জানিয়ে নির্দেশ পাঠিয়েছেন আইপ্যাকে চাকরি করা আবেশ সিংহ। এটা আপনার প্রথম মিথ্যা ছিল যে, এই প্রকল্প নাকি সরকারি কর্মসূচি।
দিদি ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির জন্য টাকা জোগাড় করবেন বলে জানিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম নতুন করে ঋণ নিতে হবে। কিন্তু না। পরে দেখলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের টাকাতেই তৈরি হয়েছে গোটা প্রকল্প আর চালাকি করে নিজেরা তার কৃতিত্ব নিতে চাইছেন।
কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন প্রতি আর্থিক বছরে গ্রামীণ পরিকাঠামো খাতে অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। প্রতি বছর একটি গ্রাম পঞ্চায়েত এই খাতে কম-বেশি এককোটি টাকা পায়। কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, ‘টায়েড’ অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু কাজে এবং ‘আন-টায়েড’ অর্থাৎ নির্ধারিত নয় এমন খাতে এই অর্থ ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রাপ্ত অর্থের ৬০ শতাংশ খরচ হয় পানীয় জল, নিকাশি, সেচ, শৌচাগার নির্মাণের মতো বিভিন্ন ‘বেসিক ফেসিলিটি’ প্রদান বা গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে। কোন কোন খাতে অর্থ বরাদ্দ হবে তা কেন্দ্র ঠিক করে দেয়। বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করার কথা রাস্তাঘাটের ছোটোখাটো মেরামত, কালভার্ট, ছোটো সেতু নির্মাণ, শ্মশান-কবরস্থান, ওয়াই-ফাই পরিষেবা ইত্যাদিতে।
নতুন প্রকল্পে যে কাজগুলি করতে বলা হয়েছে, তার বেশিরভাগটাই কেন্দ্রীয় বরাদ্দেই হয়ে আসছে। আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছ ভারত মিশনের আওতাতেও বিপুল টাকা পেয়েছে রাজ্য। তাতেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিকাশি, শৌচালয় ইত্যাদির কাজ হয়ে থাকে। ফলে পাড়া কর্মসূচির তালিকাভুক্ত কাজের বেশিরভাগটা কেন্দ্রীয় বরাদ্দেই সেরে ফেলা সম্ভব। শেষ বেলায় রাস্তা মেরামতকেও কাজের তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। সেই টাকাও কিন্তু কেন্দ্রের। কারণ, সম্প্রতি অন্তত ৩,৩০০ কিলোমিটার রাস্তার অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্র। এ বাবদ খুব তাড়াতাড়ি কেন্দ্রের টাকা আসার কথা।
সকলের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি যে, ২০২৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে গোটা দেশে ষোড়শ অর্থ কমিশনের কাজ শুরু হবে। গত ৩ ডিসেম্বর ষোড়শ অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. অরবিন্দ পানাগড়িয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নবান্ন সভাঘরে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। কিন্তু নতুন টাকা পেতে গেলে তো আগে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের দেওয়া পুরো বরাদ্দ খরচ করতে হবে। এখন সেটাই করতে আট হাজার কোটি টাকা খরচের কথা বলেছেন আপনি। কিন্তু এমন করে বলেছেন যেন, আপনি খুব চিন্তিত। কোথা থেকে যে টাকা জোগাড় করি এমন একটা ভাব আপনার কথাবার্তায়। খুব চিন্তার বিষয়। কেন্দ্র তো টাকাই দেয় না। কিন্তু দিদি, আমি যা হিসাব দেখলাম তাতে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন পশ্চিমবঙ্গের জন্য মোট বরাদ্দ করেছে ২১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। স্বীকার করলে কী ক্ষতি হতো দিদি!