ব্রিকস কি ট্রাম্পের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে?
ব্রিকসের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ভারত এই গোষ্ঠীকে আমেরিকা বিরোধী গোষ্ঠীরূপে কখনো দেখেনি, বরং
ব্রিকস গোষ্ঠীকে বিশ্ব সংস্থার সংশোধনের জন্য উপযোগী একটি মঞ্চ হিসেবেই দেখে।
ড. অশ্বনী মহাজন
গত ৬-৭ জুলাই ব্রাজিলে ব্রিকসের ১৭তম শিখর সম্মেলন সম্পন্ন হয়। এই সম্মেলনের গুরুত্ব হলো যে, এতে ১০ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন, যার মধ্যে ইরান, মিশর, ইথিয়োপিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এই ৪ সদস্য দেশ গত বছর রাশিয়ায় আয়োজিত শিখর সম্মেলনে প্রথমবার সদস্য দেশ হিসেবে
অংশগ্রহণ করে। ২০২৫ সালের প্রথম দিকে ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে প্রথম ব্রিকস সদস্য হয়। বর্তমানে ব্রিকস বিস্তৃত রূপ নিয়ে ‘ব্রিকস প্লাস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই শব্দটি ২০২৪ সালে প্রথমবার ব্রিকস শিখর সম্মেলনে ব্যবহার করা হয়।
পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি
বিশ্বের উন্নত দেশ, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রভাবকে রীতিমতো স্পর্ধা দেখাচ্ছে ব্রিক্স। আমরা যদি এই গোষ্ঠীর প্রথম পাঁচটি দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার উপর নজর রাখি, তাহলে ২০১০ সালে বৈশ্বিক মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) এদের অবদান ছিল ১৮
শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে গিয়ে ২৬.৫ শতাংশে পৌঁছবে। এখন তারা পশ্চিমি দেশগুলির আর্থিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখোমুখি হতে শুরু করেছে। ডি-ডলারাইজেশন অর্থাৎ বাণিজ্য ও বিত্তের ক্ষেত্রে আমেরিকান ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কম করে পশ্চিমি ব্লকের আধিপত্য ভাঙার স্বর মুখর হচ্ছে। তারা বাস্তবে আমেরিকার আর্থিক ও ভূ-রাজনৈতিক অধিপত্যের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করে চলেছে। এটি ভারত, চীন ও রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চে শক্তিশালী করছে। ডলার এবং পশ্চিমি সংস্থাগুলো থেকে মুক্ত হয়ে বৈশ্বিক আর্থিক পুনর্বিন্যাসকে উৎসাহিত করছে, যা প্রকৃতপক্ষে বহুমুখী বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রতীক এবং
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তা সমর্থন করেন না। সম্প্রতি নতুন ৫ সদস্য যুক্ত হয়ে ব্রিকসের বিস্তার ঘটেছে। পশ্চিমি ব্লক, বিশেষত আমেরিকার তাতে চিন্তা বেড়েছে। ব্রিকস নিয়ে ট্রাম্পের বিরোধিতা ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থিক উভয় কারণের ফসল, কেননা এই গোষ্ঠীর সম্প্রতি বিস্তারের সঙ্গে বৈশ্বিকস্তরে
আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তার কয়েকটা কারণ রয়েছে।
ব্রিকস নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ হলো আমেরিকান ডলারের আধিপত্যে হস্তক্ষেপ। বাণিজ্য ও আর্থিক বিষয়ে ব্রিকসের দেশগুলি আমেরিকান ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কম করার প্রসঙ্গে আলোচনা করছে। অপরদিকে ট্রাম্প বরাবর ‘আমেরিকা প্রথম’-এর উপর জোর দিয়ে
চলেছে এবং সেক্ষেত্রে এই সব দেশের ডলারের থেকে দূরত্ব গড়ে তোলার চিন্তা নিশ্চিতভাবেই আমেরিকার আর্থিক প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতার শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।
দ্বিতীয় কারণ হলো, পশ্চিমের প্রতি ব্রিকসের ভূ-রাজনৈতিক বিরোধিতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড়ো চিন্তার কারণ। ব্রিকস নিজেকে জি-৭, আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো পশ্চিমি সংস্থার বিকল্প রূপে উঠে আসছে।
তৃতীয়, ব্রিকসের মাধ্যমে চীনকে বিশ্বস্তরে আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মঞ্চ করে দিয়েছে। বিকেন্দ্রিকতার আড়ালের চীনের বৈশ্বিক বিস্তারের একটি মাধ্যম হিসেবে আমেরিকা মনে করছে।
চতুর্থ, সৌদি আরব ও ইরান ব্রিকসে সম্মিলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই গোষ্ঠীর বৈশ্বিক ইন্ধনশক্তি (তেল) বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তৈরি করবে। ডলার বহির্ভূত মুদ্রায় (ইউয়ান অথবা ব্রিকস মুদ্রা) তেল বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে, যা পেট্রোডলার পদ্ধতিকেই দুর্বল করে ফেলবে।
পঞ্চম, ব্রিকসের বিস্তারের ফলে বৈশ্বিক দক্ষিণ (গ্লোবাল সাউথ) পশ্চিমি প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া এবং নিজেদের স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে উঠে আসা, এটাকে ট্রাম্প একটি সংকেত মনে করছেন।
ষষ্ঠ, আমেরিকাকে বাদ দিয়ে কোনো অপশ্চিমি গোষ্ঠীর উদয়কে ব্যক্তিগত ও দেশের অপমান হিসেবে দেখা হয়। রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ব্রিকসের কার্যকলাপে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং ব্রিকস দেশগুলির উপর অত্যধিক বাণিজ্য শুল্ক লাগানোর হুমকিও দেন। তিনি ব্রাজিলের উপর ৫০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক লাগানোর ঘোষণা আগেই করে ফেলেছেন।
ভারতের বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ
ভারত নিজে ব্রিকসের সদস্য হলেও তার মনোভাব অত্যন্ত সূক্ষ্ম, ভারসাম্যযুক্ত ও বাস্তবসম্মত। যার কারণে অন্যান্য ব্রিকস দেশগুলির থেকে ভারতের একটা পৃথক ভাবমূর্তি রয়েছে। ভারতের দৃষ্টিকোণ স্পষ্টভাবে তার জাতীয় কল্যাণে, রণনীতিগত স্বায়ত্ততা এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত। যদিও ভারত টাকার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অন্যান্য আর্থিক চুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং ডলারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের আর্থিক কল্যাণের বিষয়ে অধিক গুরুত্ব প্রদানের চেষ্টা করে চলেছে। ভারত ডলারের বিরোধী নয়, কিন্তু বৈশ্বিক আর্থিক পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য আনতে, একক মুদ্রার উপর নির্ভরতা কমাতে এবং একটি বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রচণ্ড প্রচেষ্টার দরুন ডলারের উপর নির্ভরতা কম করার পক্ষে রয়েছে।
ভারত বিশ্ব বাণিজ্য ও আর্থিক বিষয়ে ডলারের প্রভুত্বকে বুঝতে পারে এবং তারা এর পূর্ণ প্রতিস্থাপনের (অন্য শব্দে, ডলার- বিমুদ্রীকরণ) আহ্বান করেনি। এর পরিবর্তে তারা গচ্ছিত মুদ্রার (ইউরো, ইউয়ান এবং সম্ভবত ভারতীয় টাকা) সহ-অস্তিত্বের পক্ষে।
ব্রিকসের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ভারত এই গোষ্ঠীকে আমেরিকা বিরোধী গোষ্ঠীরূপে কখনোই দেখেনি, বরং ব্রিকস গোষ্ঠীকে বিশ্ব সংস্থার সংশোধনের জন্য উপযোগী একটি মঞ্চ হিসেবে দেখে। ভারত এমন একটি বিশ্বকে সমর্থন করে যেখানে একাধিক শক্তিকেন্দ্র হোক, যেখানে বৈশ্বিক দক্ষিণের সোচ্চার প্রতিনিধিত্ব হোক। ভারত দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রসঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো সংস্থার সংশোধনের দাবি জানাতে থাকে, যার বিষয়ে তাদের ধারণা হলো, এটি হলো পশ্চিমি প্রভুত্ববাদী এবং বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতাকে প্রতিভাত করে না। এই প্রসঙ্গে ভারতের জি-২০ সভাপতিত্বে বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থানের সংশোধন নিয়ে একটি নথি তৈরি করতে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা হয়েছিল। এই গোষ্ঠীর সহ সঞ্চালক ছিলেন লরেন্স সমর্স এবং এন কে সিংহ। ভারত নিজ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে ব্রিকসকে প্রযুক্তি, অর্থ, পরিকাঠামো এবং নিরন্তর বিকাশে সহযোগিতা প্রদানের জন্যই ব্যবহার করে, কোনোরকম আমেরিকা বিরোধিতার মধ্যে যায় না। আমেরিকা যদি ব্রিকসে চীনের অধিপত্য নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, তবে ভারতও ব্রিকসের মধ্যে চীনের
অধিপত্য নিয়ে সতর্ক থাকে এবং এমন যেকোনো গোষ্ঠী ব্যবহারকে অস্বীকার করে, যা কিনা তার সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে অথবা চীনের স্বার্থের কাছাকাছি হয়ে থাকে।
বৈশ্বিক স্তরে ভারতের ভারসাম্যযুক্ত দৃষ্টিকোণ দেশের উদ্দেশ্য পূর্তি এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার লক্ষ্য প্রাপ্ত করা। ভারতীয় টাকার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি ছাড়াও ভারত ডলারের বিমুদ্রীকরণ রোধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ডিজিটাল টাকায় লেন-দেনে উৎসাহ দিয়ে ভারত পশ্চিমি লেন-দেন পদ্ধতির একছত্র অধিকারকে টেক্কা দিচ্ছে। এই প্রচেষ্টাগুলিকে পৃথিবীতে প্রভুত্বস্থাপনকারী বলা সম্ভব নয়, বরং এই ব্যবস্থা অন্যকে ভারতের উপর প্রভাবী না হতে দিয়ে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য রয়েছে। অতীতে ভারত রাশিয়া ও ইরান থেকে তেল ক্রয় করে, ডিজিটাল লেন-দেনকে গুরুত্ব দিয়ে এবং
বিশ্ব সংস্থাগুলিতে সংশোধন আনতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সরব হয়ে নিজের শক্তির প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। মজার কথা হলো, এমনটা করাতে আমেরিকা ভারতের মধ্যে বিশেষ কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছে না এবং সম্ভবত ভারতকে চীন-সহ অন্যান্য দেশের প্রভুত্বকে ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি রূপে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
(লেখক দিল্লির পিজিডিএভি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং
স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের রাষ্ট্রীয় সহ সংযোজক)