অখণ্ড ভারতের পূজারি
শ্রীঅরবিন্দ
রাজদীপ মিশ্র
শুক্রবার ১ মে, ১৯০৮। “জানতাম না এই দিনই আমার জীবনের একটা অঙ্কের শেষ পাতা। আমার সম্মুখে এক বছরের কারাবাস! এই সময়ের জন্য
মানুষের জীবনের সঙ্গে যত বন্ধন ছিল, সবই ছিন্ন হবে। এক বছরকাল মানবসমাজের বাইরে পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মতো থাকতে হবে। এবং আবার যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করব, সেই পুরাতন পরিচিত মানুষটি প্রবেশ করবে না। একটি নতুন মানুষ, নতুন বুদ্ধি, নতুন প্রাণ, নতুন মন নিয়ে নতুন কর্মভার গ্রহণ করে আলিপুরস্থ আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসবে। বলেছি এক বছরের কারাবাস। বলা উচিত ছিল এক বছরের বনবাস, এক বছরের আশ্রমবাস। অনেকদিন হৃদয়স্থ নারায়ণের সাক্ষাৎ দর্শনের জন্য প্রবল চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সহস্র সাংসারিক বাসনার টান, নানা কর্মে আসক্তি অজ্ঞানের প্রগাঢ় অন্ধকারে তা পারিনি। শেষে পরমদয়ালু সর্বমঙ্গলময় শ্রীহরি সকল বাধার শত্রুকে এককোপে নিহত করে যোগাশ্রম দেখালেন। সেই আশ্রম ইংরেজের কারাগার। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কোপ-দৃষ্টির একমাত্র ফল: আমি ভগবানকে পেলাম।”
এই অদ্ভুত বক্তব্য হলো আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লবী শ্রীঅরিবিন্দ ঘোষের। তাঁর বাবা ছিলেন কৃষ্ণধন ঘোষ, তিনি বিলেতফেরত নামজাদা ডাক্তার। অরবিন্দের বয়স যখন পাঁচ বছর, তাঁকে তাঁর দুই ভাই বিনয়ভূষণ ও মনমোহনের সঙ্গে দার্জিলিং লরেটো কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করা হলো। তিন ভাই দার্জিলিঙের সাহেবি স্কুলে আইরিশ নানদের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া শিখতে লাগলেন। দু’ বছর পর ১৮৭৯ সালে তিন ছেলেকে বিলেত পাঠালেন বাবা। ম্যাঞ্চেস্টার শহরে পাদরি উইলিয়াম ডুয়েট ও তাঁর স্ত্রীর কাছে বাড়িতে বসেই অরবিন্দের প্রথম পাঠ শুরু। বয়স তখন মাত্র সাত। বাবার উদ্দেশ্য ছিল
ছেলেরা নিখাত ব্রিটিশ তৈরি হোক। লন্ডনের সেরা স্কুল ‘সেন্টপলস’-এ ভর্তি হলেন অরবিন্দ। অসামান্য মেধা। নিজের ক্লাস পেরিয়ে বড়োদের ক্লাসে ঢুকে পড়ল স্কলারশিপ পেয়ে। মূল ভাষায় পড়ছেন ভার্জিল, সিসেরো, ইউরিপিডিস। গ্রিক ভাষায় পড়ছেন, নিউ টেস্টামেন্ট। মাতৃভাষার মতো শিখে ফেলেছে
জার্মান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ। স্কুল পাঠ শেষে বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হন কেমব্রিজের কিংস কলেজে। এক বছরে কলেজের গ্রিক ও ল্যাটিনের সমস্ত পুরস্কার পেলেন। দ্বিতীয় বছরে ট্রাইপস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন।
বাবা কৃষ্ণধন আদবকায়দায় সাহেব হলেও তাঁর মনটি ছিল খাঁটি ভারতীয়। ভারতবর্ষে ইংরেজদের অত্যাচারের যেসব খবর, ‘বেঙ্গলি’ সংবাদপত্রে বেরোেত সেগুলি তিনি তরুণ অরবিন্দকে পাঠাতে শুরু করলেন। কেমব্রিজে ‘ইন্ডিয়ান মজলিশ’ বলে একটি সভা ছিল। সেখানে তিনি বিপ্লবের কথা, স্বাধীনতার কথা দৃপ্তকণ্ঠে বলতেন, একটির পর একটি ভাষণে তিনি ইংরেজদের মুখের ওপর বলতে লাগলেন- ‘তোমরা সারা বিশ্বে এমন একটা ভান দেখাও, যেন তোমাদের মতো ভদ্রলোক আর নেই। সমস্ত ব্যাপারেই তোমাদের রায় সুবিচারের পক্ষে। কিন্তু এতবড়ো মিথ্যা আর কোথায় পাব?’ আবার একদিন তিনি বলেন, ‘তোমাদের গ্ল্যাডস্টোন পার্লামেন্টে যা কিছু করেন, যা কিছু বলেন তার মধ্যে কোনো উচ্চাদর্শ তো নেই-ই, তিনি ভেতরে ভেতরে সারাক্ষণ ভারতের ক্ষতি করে যাচ্ছেন।’ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঘোষণা করল অরবিন্দই ইংরেজের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু- ‘The most dangerous Indian.’
বাবার ইচ্ছানুসারে ১৮৯০ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে আইসিএস পরীক্ষায় ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় রেকর্ড নম্বর নিয়ে প্রথম হলেন। কিন্তু হাকিম হয়ে ইংরেজের গোলামি করতে তাঁর মন চাইল না। কিন্তু বাবার মনে দুঃখও দিতে চাইলেন না। তাই সিভিল সার্ভিসে শিক্ষানবিশ হলেন কিন্তু ইচ্ছে করেই ঘোড়ায় চড়ার পরীক্ষাতে হাজির হলেন না।
বরোদার মহারাজা সয়াজিরাও গায়কোওয়াড় তখন বিলেতে। অরবিন্দের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তিনি তাকে তৎক্ষণাৎ কাজে নিয়োগ করে দেশে ফিরতে বলেন। দেশে ফিরে কাজ করতে করতে বাংলা, সংস্কৃত, গুজরাটি, মরাঠি শিখলেন। একে একে গীতা, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, অন্যান্য শাস্ত্র, কালিদাস ও ভবভূতির কাব্য পড়লেন। একটি প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, ‘আমাদের শত্রু বাইরের কেউ নয়, নিজেদের ভীরুতা ও দুর্বলতাই শ্রীবৃদ্ধি হয়। তোমার সকল কর্মের সর্বপ্রধান আমাদের শত্রু।’
অরবিন্দ তখন বরোদা স্টেট সার্ভিসের রাজস্ব বিভাগে কাজ করতেন। এমন সময় ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে বঙ্গের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিতে চারদিক কেঁপে উঠল। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবিত অকাল রাখিবন্ধনে সবাই মেতে উঠল, মুখে সবার ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গান জাতীয় পদ্ধতিতে জাতীয় শিক্ষার জন্য তখন গঠিত হয়েছে জাতীয় কলেজ। বরোদার ৭৫০ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে বরোদা স্টেট কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনার কাজে নিজেকে যুক্ত করলেন তিনি, পরে ওই কলেজের উপাচার্য পদ অংলকৃত করেন। ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলতেন- ‘তোমরা লেখাপড়া শিখবে দেশের জন্য। দেশের জন্যই তোমরা তোমাদের দেহ, মন গঠন করবে। তোমরা অর্থ উপার্জন করবে দেশসেবার জন্য দেহধারণ করতে। তোমরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবে যাতে উন্নত জ্ঞান আহরণ করে দেশের উন্নতি করতে পার। সর্বদা এমন কাজ করবে যাতে দেশের উদ্দেশ্য হবে দেশের কল্যাণ।’
অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে অরবিন্দ সকলের অগোচরে সাধনা শুরু করলেন। কিন্তু ভাস্কর লেলে নামে এক মরাঠি যোগীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। লেলের সঙ্গে তিনি তিনদিন ধ্যানে মগ্ন থাকলেন। সেই যোগী শ্রীঅরবিন্দের একাগ্রতা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। শেষে একদিন তিনি বললেন, ‘এখন থেকে ভগবানই তোমাকে চালিয়ে নেবেন। ভগবানই তোমার গুরু হবেন। তোমাকে আর আমার কিছু জানাবার নেই।’ এই সময়েই তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সংসারধর্মে ছিলেন চির উদাসীন। দেশমাতৃতার মুক্তি সংগ্রামের ভাব অরবিন্দকে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসে। তিনি হয়ে উঠলেন জাতির মুক্তির পথপ্রদর্শক, অখণ্ড ভারতের সাধক তথা একজন পরিপূর্ণ মানব। বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি যোগ দিলেন। পুলিশ এই সভা ভেঙে দিল। ফলত, অরবিন্দ বিপিনচন্দ্র পালের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায় ঘুরে সভাসমিতিতে ভাষণ দিতে থাকলেন। অনুজ বারীন ঘোষের প্রস্তাবে তিনি ‘যুগান্তর’ পত্রিকা বের করলেন যাতে প্রকাশ্য বিদ্রোহের কথা এবং গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি সম্বন্ধেও প্রবন্ধ লেখা হতো। বিপিনচন্দ্র তাঁর হাতে অর্পণ করলেন ইংরেজি বন্দেমাতরম্’ কাগজের কার্যভার। সেই পত্রিকায় তিনি ঘোষণা করলেন- দুর্বলের মতো পরের কাছে আর ভিক্ষা নয়। আবেদন নিবেদন নয়। চাই স্বাধীন দেশের জীবন- পূর্ণ স্বরাজ।’ তিনি লিখলেন, ‘দুয়ারে মায়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তিনি প্রবেশের আগে অপেক্ষা করছেন, অপেক্ষা করছেন সেই ডাক শোনার জন্য সে ডাক সত্যের ডাক, সে ডাক আমাদের হৃদয় থেকে উৎসারিত। তিনি শুধু চান আমাদের মন, আমাদের প্রাণ। তিনি আমাদের ডেকে বলেছেন- তোমরা কতজন আমার জন্য বাঁচতে চাও? কতজন আমার জন্য প্রাণ দিতে পার? মা আমাদের উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছেন।’ শ্রীঅরবিন্দের কলম দিয়ে তখন আগুন ছুটছে।
ইংরেজ সরকার শ্রীঅরবিন্দের লেখার তেজ দেখে ভয় পেল। রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করল। জাতীয় কলেজ যাতে রাজনৈতিক হাঙ্গামায় জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য তিনি অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করলেন।
৩০ এপ্রিল ১৯০৮ মজফফরপুরে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর ছোঁড়া বোমায় প্রাণ দিলেন মিসেস কেনেডি ও মিস কেনেডি। লক্ষ্য ছিল কিংসফোর্ড। শ্রীঅরবিন্দ কারারুদ্ধ হলেন। শুরু হলো ঐতিহাসিক ‘আলিপুর বোমা মামলা’। কারাগার হলো তার যোগাশ্রম। সারাক্ষণ ধ্যানস্থ থাকেন। জেলের মধ্যেই তিনি ভগবান দর্শন করেন। যেদিকে তাকান দেখেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সামনে দেখেন গাছ, গাছ তো নয় যেন স্বয়ং বাসুদেব। সেপাই সান্ত্রীরা চলাফেরা করছে, তিনি দেখছেন বাসুদেব তাকে পাহারা দিচ্ছেন। কম্বলে শুয়ে আছেন, মনে হয় যেন স্বয়ং নারায়ণ তাঁকে কোলে করে রয়েছেন। জেলের সব কয়েদিদের দিকে তাকান, দেখেন তাদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং নারায়ণ। তিনি তাকে ডেকে বলছেন, ‘এদের জন্য আমার হয়ে তোমাকে কাজ করতে হবে। তাই তোমাকে এখানে এনেছি। এই মুঢ় ম্লান জাতিকে আমি জগতের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমি আছি এদের মধ্যে। তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার এই মামলার
ভার আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমাকে আরও বড়ো কাজ করতে হবে।’
৬ মে ১৯০৯। শ্রীঅরবিন্দ মুক্তি পেলেন। নতুন দুটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন। ইংরেজিতে ‘কর্মযোগিন’ আর বাংলায় ‘ধর্ম’। কিন্তু জেলের মধ্যে বাসুদেব দর্শনের ফলে তিনি রাজনৈতিক বিমুখতার কবলে পড়লেন। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি বিখ্যাত উত্তরপাড়া অভিভাষণে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে অসাধারণ ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, ‘যখন বলা হয় যে, ভারত মহান হবে, তার অর্থ এই যে, সনাতন ধর্ম মহান হবে। এই ধর্মের জন্য এবং এই ধর্মের দ্বারাই ভারত বেঁচে আছে। ধর্মটিকে বড়ো করে তোলার অর্থ দেশকেই বড়ো করে তোলা। … জগতের সম্মুখে হিন্দুধর্মের রক্ষা ও অভ্যুত্থান- আমাদের সামনে এটিই হলো কাজ। কিন্তু হিন্দুধর্ম কী? এই যে ধর্মকে আমরা বলি সনাতন, সর্বকালিক- এই ধর্ম কী? এটি হিন্দু ধর্ম, কেবল এই জন্যই যে, হিন্দুজাতি এই ধর্মকে রেখেছে, হিমালয় ও সমুদ্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত এই উপদ্বীপে নিরালায় এই ধর্ম গড়ে উঠেছে। …যাকে আমরা হিন্দুধর্ম বলি বস্তুত সেটি হচ্ছে সনাতন ধর্ম, কারণ সেটি বিশ্বজনীন ধর্ম, অন্য সকল ধর্মই তার অন্তর্গত। কোনো ধর্ম যদি সর্বজনীন না হয় তবে তা সনাতন হতে পারে না। এটিই হচ্ছে একমাত্র ধর্ম যা মানবজাতিকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়, ভগবান আমাদের কত নিকট, কত আপনার, মানুষ যতরকম সাধনার দ্বারা ভগবানের দিকে অগ্রসর
হতে পারে সবই এর অন্তর্গত। …আমাদের পক্ষে সনাতন ধর্মই হচ্ছে জাতীয়তা। এই হিন্দু জাতি জন্মেছিল সনাতন ধর্ম নিয়ে, এর সঙ্গেই সে চলে, এর সঙ্গেই সে বিকাশ লাভ করে; যখন সনাতন ধর্মের অবনত হয় তখনই জাতির অবনতি হয়, আর যদি সনাতন ধর্মের ধ্বংস হওয়া সম্ভব হতো, তাহলে সনাতন সনাতন ধর্মের সঙ্গে এই জাতিটাই ধ্বংস হতো।’
ভগিনী নিবেদিতার পরামর্শে এরপর শ্রীঅরবিন্দ কিছুদিন চন্দননগরে আত্মগোপন করে থাকেন। সেখান থেকেই জাহাজে পণ্ডিচেরী চলে আসেন। এখানেই শুরু তাঁর জীবনের আর এক নতুন অধ্যায়। ১৯১০ সালের ৪ এপ্রিল, পণ্ডিচেরীতে তিনি সাধনায় মগ্ন হলেন। পৃথিবীর সকল মানুষের মুক্তির জন্য, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা, রোগ-শোক, জরা মৃত্যু থেকে উদ্ধারের জন্য শ্রীঅরবিন্দের এই সাধনা। তিনি বুঝলেন ভারত স্বাধীন হবেই। কিন্তু তারপর? বাকি যাত্রাপথে কী হবে ভারতের কাজ ও আদর্শ? একটি বাক্যে তিনি বলেছেন- ‘India would be able to fulfil her mission and destiny which is to lead humanity to the light of the spirit.’ জগৎকে আত্মার আলোর পথ দেখাবে ভারত। সেই আলোর সাধনায় একটি ঘরের মধ্যে ২৫ বছর একটানা মগ্ন থাকলেন মহাসাধক শ্রীঅরবিন্দ। এই সময়ে তিনি লিখলেন ‘সাবিত্রী’ এবং ‘The Life Divine’। শেষোক্ত বইটির জন্য পাঁচবার তাঁর নামও প্রস্তাবিত
হয়েছিল নোবেল পুরস্কারের জন্য।
শ্রীঅরবিন্দের সমগ্র জীবন সাধনা অখণ্ড মাতৃভূমিকে সামনে রেখেই সিদ্ধিলাভ হয়েছে। অখণ্ড ভারতমাতাই ছিল তাঁর সাধনার কেন্দ্র। ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে বরোদায় শ্রীঅরবিন্দের পরিচয় হয়। নিবেদিতার সাধনার অন্যতম দিক ছিল ‘অখণ্ড ভারত’। নিবেদিতা এক জায়গায় তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘মাতৃভূমি ভারতবর্ষ বস্তুত অখণ্ড। উত্তর ও দক্ষিণাংশ পরস্পর অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তাই রাজনীতি, জাতি বা ভাষার ভিত্তিতে কোনো ভূভাগের ইতিহাস কখনো ভারতের প্রকৃত ইতিহাস হইতে পারে না।’ ভগিনী নিবেদিতার এই অখণ্ড ভারত চেতনার প্রভাব শ্রীঅরবিন্দের ওপর পড়েছিল।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আমরা স্বাধীনতা পেলাম, কিন্তু তা হলো খণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতা। অরবিন্দ এই খণ্ডিত স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি। এই ভারত ভূমিকে তিনি জগজ্জননীর জীবন্ত প্রতিমূর্তি বলে মনে করেছেন এবং বলেছেন, ‘তিনিই জগন্মাতা, আদিশক্তি, মহামায়া ও মহাদুর্গা- আমরা তাঁকে দর্শন করতে পারি ও তাঁর পূজা করতে পারি।’ তিনি এই দেশকে নদী-পাহাড়-মাঠ-ময়দানের সমষ্টি হিসেবে দেখতেন না। এ এক চিন্ময়ীসত্তা অর্থাৎ চৈতন্যময় অস্তিত্ব। চৈতন্যকে ভাগ করা যায় না। তাই ভারতের ভূমি ভাগ করা হলেও, তার আত্মাকে ভাগ করা যায় না। এই ভাগ স্বাভাবিক নয়। এই ভাগ কৃত্রিম। শ্রীঅরবিন্দের ভাষায়- ‘Partition shall and must go.’ এটাই নিয়তি, এটাই মায়ের ইচ্ছা।
প্রবল প্রতাপান্বিত আমেরিকার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে উত্তর ভিয়েতনাম ও পশ্চিম ভিয়েতনাম যদি জোড়া লাগতে পারে, কমিউনিস্ট শাসনকে উপেক্ষা করে যদি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি জোড়া লাগতে পারে, ১৮০০ বছর পর ইহুদিরা যদি তাদের হৃত জমি ফিরে পেতে পারে- তা হলে ৭৮ বছর আগের হারানো জমি আমরা কেন উদ্ধার করতে পারব না? চাই বিশ্বাস, সংকল্প, সাহস ও সক্রিয়তা। ভারতবাসীকে ঋষিবাক্যের ওপর ভরসা রেখেই এগিয়ে যেতে হবে।