ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বঙ্গের অবদান, বাঙ্গালির প্রাপ্তি
শিবেন্দ্র ত্রিপাঠী
আচ্ছা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় মুসলমানদের অবদান কী তা কি আমাদের জানা আছে? ১৮৫৭ সালে মহা বিদ্রোহের পর এদেশে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের যে বিরাট কর্মযজ্ঞ চলেছিল তাতে কজন মুসলমান ভাগ নিয়েছিল? সারা দেশে ফাঁসির মঞ্চেই হোক বা পুলিশের গুলিতে- ক’জন ওই সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণ দিয়েছে? আন্দামানের সেলুলার জেলে বা রেঙ্গুনের কালকুঠুরিতে কজনই-বা যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করেছে বলতে পারবেন? না, বলতে পারবেন না। দু’ একজন ব্যতিক্রমী বাদ দিলে সারা ভারতের এতো বড়ো স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমান সম্প্রদায়ের কোনো ভূমিকাই ছিল না। হিন্দুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা কোনোদিনই স্বাধীনতা আন্দোলনে পথে নামেনি। তাই গান্ধীজীকে ১৯১৯ সালে তাদের মন পেতে হাজার হাজার মাইল দূরের তুরস্কের খলিফাতন্ত্রের সমর্থনে ‘খিলাফত’ আন্দোলনকে সমর্থন করতে হয়েছিল, তাদের হাতে-পায়ে ধরতে হয়েছিল।
১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার পঞ্চাশবর্ষপূর্তিতে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিল, তাতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সারাদেশের কয়েকশো হুতাত্মার নাম আছে। তাতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মাত্র একটি নাম- উত্তরপ্রদেশের আসফাকুল্লা খান। ১৯২৭ সালে কাকোড়ী ষড়যন্ত্র মামলায় যাঁর ফাঁসি হয়েছে। সারা বইটি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আপনি দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম খুঁজে পাবেন না।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের যে তিনটি প্রদেশ বৈপ্লবিক আন্দোলনের পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হয় সেই মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব ও বঙ্গের মধ্যে আমাদের বঙ্গের ইতিহাসটা কী? আমাদের পড়ানো হয় হিন্দু-মুসলমানের সমবেত সংগ্রামে এদেশে স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু তথ্য কী বলে? ১৯৪৭ সালে দেশের স্বাধীনতার আগে অখণ্ড বঙ্গের মুসলমান ছিল ৫৪ শতাংশ, আর হিন্দু ছিল ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ বঙ্গ ছিল মুসলমান গরিষ্ঠ। তাহলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করলে প্রাণ দেওয়া বা জেলে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলমান বেশি আর হিন্দু কম হওয়ার কথা। এই বঙ্গে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী থেকে শুরু করে যে শতশত হুতাত্মার নাম আছে তারমধ্যে কজন মুসসলমান? মোট হুতাত্মার ৫৪ শতাংশ? আন্দামান বা মান্দালয়ে তাদের কতজনের নির্বাসন হয়েছিল, ৫৪ শতাংশ? আচ্ছা, ৫৪
শতাংশ না হোক, তার অর্ধেক ২৭ শতাংশ? আচ্ছা আরও কম ২০ শতাংশ, ১৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ, ৫ শতাংশ? তাও নয়। ফাঁসিতে গুলিতে বা কালকুঠুরিতে অবর্ণনীয় অত্যাচার সয়েছে এরকম দু’চারটি নামও কি খুঁজে পাওয়া যাবে? বিনয়-বাদল- দীনেশ, বাঘাযতীন-মাতঙ্গিনী- প্রীতিলতা, সূর্য সেন, লোকনাথ, মনোরঞ্জন- এরকম কয়েকশো নামের মধ্যে বঙ্গের দু’চারটি আব্দুল, আকবর, হজরত, বরকত আছে? না, নেই। অখণ্ড বঙ্গের কয়েকশো হুতাত্মার মধ্যে একজন মুসলমানের নাম আপনি খুঁজে দিতে পারবেন না। তবে দাঁড়াল কী? দেশের স্বাধীনতা যজ্ঞে ওই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব শূন্য। না, এ আমার বিশ্লেষণ নয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ প্রবন্ধে একই কথা বলেছেন, ‘হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে। এদেশে চিত্ত তাহাদের নাই।’
১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে হিন্দু ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। আর মুসলমান ৮০ শতাংশ। অথচ মাস্টারদার বিপ্লবী বাহিনীর ১৫০ জন সদস্যই ছিলেন ২০ শতাংশ হিন্দুর মধ্য থেকে। ৮০ শতাংশ মুসলমানের একজনকেও কেন মাস্টারদা তাঁর দলে আনতে পারেননি? মাস্টারদা তো হিন্দুর হোমল্যান্ড তৈরির জন্য লড়াই করছিলেন না। তিনি সমগ্র ভারতকে স্বাধীন করার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। মুসলমানরা কি নিজেদের ভারতীয় মনে করে না? তাহলে তাঁরা সেই করেছিল? একজনও নয়। সংগ্রামে তাঁর সঙ্গে আসেনি কেন?
বঙ্গপ্রদেশের প্রধান তিনটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল- অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর ও বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার, এই তিন দলে কয়েক হাজার সদস্য ছিলেন যাঁরা দেশমায়ের শৃঙ্খল মোচনে হেলায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এদের মধ্যে একজন মুসলমান সদস্যের নাম বলতে পারবেন? না, পারবেন না। কারণ এদের একজনও এই দলে ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গের ৪৬ শতাংশ হিন্দু তো সক্রিয় ছিল, কিন্তু ৫৪ শতাংশ মুসলমান ছিল নিষ্ক্রিয়। শুধু
নিষ্ক্রিয়ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশের সহযোগী। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ফরাসি দার্শনিক রোমাঁ রোলাঁকে এক চিঠিতে আক্ষেপ করে লিখেছেন- ‘খেলাফতের ব্যাপারে ভারতবর্ষের মুসলমানদের সাহায্য করতে গিয়ে গান্ধীজী যা করেছেন, তাতে তিনি যা চেয়েছিলেন- সেই ভারতবর্ষের ঐক্যের পক্ষে কাজ করেননি। কাজ করেছেন ইসলামের ঔদ্ধত্য এবং শক্তির পক্ষে। এবং সেটাই হিন্দু মুসলমানের প্রচণ্ড অশান্তির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। এ ব্যাপারে শোষোক্তরা ইংরেজ সরকারের গোপন সমর্থনপুষ্ট প্ররোচক’ (ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী-অবন্তী কুমার সান্যাল)। তাঁর শেষ তিনটি শব্দবন্ধ ‘গোপন সমর্থনপুষ্ট প্ররোচক’- তাদের কোন উদ্দেশ্য ও বিধেয়কে বিবৃত করে?
স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গপ্রদেশের কয়েকটি জেলার বীরত্ব ছিল অপরিসীম। তার মধ্যে মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম ছিল অগ্রণী। মেদিনীপুরের একজন জেলা মেজিস্ট্রেটও বিপ্লবীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। বার্জ-পেডি-কিংসফোর্ড- ডগলাস সবাইকে বেঘোরে মরতে হয়েছিল বেঙ্গল ভলেন্টিয়ারের ১৭/১৮ বছরের ক্ষুদিরাম, প্রদ্যোৎ, অনাথবন্ধু, মৃগেনদের হাতে। এদের মধ্যে একজনও কিন্তু মুসলমান বিপ্লবী ছিল না। একইভাবে চট্টগ্রামের কথাও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। শুধু চট্টগ্রামই-বা কেন? বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজসাহী, সিলেট, রংপুর- সর্বত্র সেদিন জ্বলে উঠেছিল বিপ্লবের বহ্নিশিখা। মাস্টারদার চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, মনোরঞ্জন- টেগরাদের জালালাবাদের পাহাড়ে অপরিসীম লড়াই- ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণের দল আত্মহুতি দিচ্ছিলেন স্বাধীনতার সেই মহাযজ্ঞে। কিন্তু তার মধ্যে কতজন মুসলমান অংশগ্রহণ করেছিল? একজনও নয়।
কিন্তু এত বিপ্লবের পরে যখন স্বাধীনতা পাওয়ার সময় এল তখন এরাই গর্ত থেকে পিল পিল করে বেরিয়ে এল নিজেদের দাবিসনদ নিয়ে। যে ৫৪ শতাংশ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণই করল না, ইংরেজের অনুগত থেকে গুপ্তচরের কাজ করল, তারাই ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে ‘পাকিস্তান’ গড়তে হাতে অস্ত্র তুলে নিল। দেশভাগের আগে সম্পূর্ণ বঙ্গ ভারতে থাকবে না পাকিস্তানে যাবে এই নিয়ে ১৯৪৭ সালে ৬ জুলাই গণভোট হয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট পড়েছিল ২,৮৯, ২৪৪টি ভোট আর ভারতের পক্ষে পড়েছিল মাত্র ২,৮৭৪টি ভোট। বঙ্গের ৯৯.০২ শতাংশ মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেই ৯৯.০২ শতাংশ মুসলমান, যারা সারা বঙ্গপ্রদেশকে সেদিন পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল তারা তো দেশভাগের পর পাকিস্তানে ফিরে যায়নি? ড. শ্যামাপ্রসাদের তৈরি বাঙ্গালি হিন্দুর এই হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গের স্থানে স্থানে বসে থেকেছে। তারাই তো আজ ছদ্ম বাঙ্গালির বেশ ধরে এই বঙ্গকে ঘুণ পোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরিয়ে দেশভাগের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় পড়েছিল বাঙ্গালি হিন্দু। মুসলিম লিগের ডাইরেক্ট অ্যাকশন কলকাতায়, নোয়াখালিতে হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল, হাজার হাজার মা-বোন ধর্ষিতা হয়েছিল। কারা করেছিল সেই অত্যাচার? যারা স্বাধীনতার জন্য এক বিন্দুও রক্ত ঝরায়নি। স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময় তাদের বন্দুক-তরবারি- সব আলমারিতে তোলা ছিল। কিন্তু যেই স্বাধীনতা পাওয়ার সময় এল তখন আলাদা দেশের দাবিতে সেই অস্ত্রগুলি বেরিয়ে পড়ল। পাকিস্তানের দাবিতে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের উপর যারা শরীরের ঘার রক্ত ঝরিয়ে দেশকে স্বাধীনতার দোরগোড়ায় পৌঁছে ছিল। দেশ ভাগ হলো, বঙ্গ ভাগ হলো। হিন্দু গণহত্যার যারা কুশীলব তারা কিন্তু দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে গেল না। থেকে গেল এই পশ্চিমবঙ্গে। তারাই হয়তো গ্রামে গ্রামে কলকাতার মহল্লায় মহল্লায় এক ‘বৃহত্তর বাংলাদেশ’ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে আবার কোনো ডাইরেক্ট অ্যাকশনের অপেক্ষায়।
বিনয়-বাদল-দীনেশ, প্রীতিলতা মাস্টারদার বাংলাদেশ আজ তাঁদের বলিদানকে উপহাস করছে। তাঁদের বংশধরেরা আজ সেখানে প্রতিনিয়ত অত্যাচারের শিকার। আর ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী, প্রফুল্ল, চাকী-সহ অজস্র বিপ্লবীর পশ্চিমবঙ্গ? সে কি আজ ভালো আছে? স্বাধীনতার পূর্ণ আস্বাদ গ্রহণ করতে পারছে? নাকি তোষণের রাজনীতি তাদের আত্মাহুতিকে আজ আবারও এক প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে? পশ্চিমবঙ্গেও ধীরে ধীরে ইসলামি মোল্লাবাদের কালো আঁধারে ছেয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় চুপ করে লুকিয়ে থাকা হায়না আর শেয়ালের দল ওতপেতে রয়েছে ড. শ্যামাপ্রসাদের গড়া বাঙ্গালি হিন্দুর হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। সেই লক্ষ্যেই চলেছে নিরবচ্ছিন্ন মুসলমান অনুপ্রবেশ আর রোহিঙ্গা বসতি নির্মাণ।
একসময় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় খুলনার শ্রীপুর থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এই পশ্চিমবঙ্গে। প্রফুল্ল সেন খুলনার সেনাহাটি থেকে, প্রফুল্ল ঘোষ ঢাকার মালিকান্দা থেকে, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ঢাকার হাসাড়া থেকে, জ্যোতি বসু ঢাকার বাদরি থেকে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ফরিদপুরের ঊনশিয়া থেকে। এসেছিলেন ইসলামি পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুবহুল পশ্চিমবঙ্গে। আজ যদি পশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশ হয়ে যায় তবে আর পালাবার পথ নেই। ঘরপোড়া হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখে আবার আতঙ্কিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ বুঝি আবার ১৯৪৬/৪৭-এর ঘোর অন্ধকারময় দিনগুলিতে ফিরে যাচ্ছে। দিকে দিকে ক্যানিং, কালিয়াচক, ধূলিয়ান, সুতি, সামশেরগঞ্জ, কাশিমবাজার, মহেশতলা, শ্যামপুর- এর যেন বিরাম নেই। ওদিকে বাংলাদেশে হিন্দু বাঙ্গালি চরম অত্যাচারের শিকার, আর এদিকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালি এলাকায় প্রাণ বাঁচাতে, মা-বোনের সম্মান রক্ষায় ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু আর বুঝি পালাবার পথ নেই। বাঙ্গালি যদি এখুনিই না ঘুরে দাঁড়ায় তবে মুসলমান তোষণকারী দলগুলির হাতে পড়ে তাদের অবস্থা ১৯৪৬/৪৭-এর মতোই হবে।
সেদিন তবু তাদের রক্ষায় একজন শ্যামাপ্রসাদ আর গোপাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন, কিন্তু আজ তাদের বাঁচাবার কেউ নেই। ওপার বঙ্গের হিন্দুর স্বাধীনতা তো শেষ হয়েছেই, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর স্বাধীনতাও আজ বিপন্ন। বাঙ্গালি হয় জাগো, নয় চির সমাপ্তির জন্য প্রস্তুত হও।