দেশ রক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে চলেছে ভারতীয় নৌবাহিনী
দুর্গাপদ ঘোষ
তিন দিক সমুদ্রঘেরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা তথা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে ভারতীয় নৌবাহিনী। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌবাহিনীর নাম ১৯৩৪ সালে রাখা হয়- ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি’। এই বাহিনীর নামই স্বাধীনতা লাভের পর পরিবর্তিত হয়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই বাহিনী তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কিন্তু ১৯৭১ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর
রেখেছে। তবে ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয়ে থাকে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজকে। জলসীমায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনিই প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে নৌবাহিনী গঠন করেন। সেই বাহিনীর প্রধান ছিলেন কানহোজী আংরে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের বিভীষিকা ও গ্লানি হজম করে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত তথা স্বাধীন হওয়ার বছর তিনেকের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী গঠন করা হলেও ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তেমন কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেনি এই বাহিনী। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন ভাইস অ্যাডমিরাল এমএস নন্দ একটি ইংরেজি সাময়িক পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে যদি আবার যুদ্ধ বাধে তাহলে ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তানের বৃহত্তম ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর করাচি-সহ সে দেশের নৌঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেবে-‘…if war were to break out again, the Indian Navy would carry its right into the enemy’s biggest Port like Karachi’। তাঁর এই দৃপ্ত ঘোষণা করেন ফাঁকা আওয়াজ ছিল না। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলেছে ১৯৭১, ১৯৯৯ ও ২০২৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়। তিনবারই ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন সব কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে যাতে পাকিস্তানের কালঘাম ছুটে যাবার উপক্রম হয়েছে। তিনবারই এই নৌবহর করাচি বন্দরকে নিশানা করে পাকিস্তানকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে।
নৌবাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন সব কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে যাতে পাকিস্তানের কালঘাম ছুটে যাবার উপক্রম হয়েছে। তিনবারই এই নৌবহর করাচি বন্দরকে নিশানা করে পাকিস্তানকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে।
১২ বছর কেটে গেলেও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নেহরুর আমলে এই বাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ তেমনভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি। নেহরু মন্ত্রীসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন এদিকে নজর দেবার কথা তেমনভাবে ভাবেননি। ১৯৬২ সালে ভারতে চীনা আক্রমণের কেন্দ্র ছিল মুখ্যত ভারতের উত্তর এবং উত্তর- পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা। বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশ। কিন্তু ওই যুদ্ধ যদি জলসীমা পর্যন্ত গড়াত তাহলে ভারতের সার্বভৌমত্ব বজায় থাকত কিনা তখনকার প্রেক্ষিতে এখনো সেটা একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আছে। তা সত্ত্বেও তৎকালীন ভারত সরকারের ঘুম ভাঙতে দেখা যায়নি। এরপর ১৯৬৪ সালের ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী হয়েই লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করেন। তিনি তাঁর স্বল্পকালের সরকারের আমলে স্থলবাহিনী যতটা শক্তিশালী করতে পেরেছিলেন বিমান ও নৌবাহিনীকে ততটা করে উঠতে পারেননি। বস্তুত সময়ও তেমন পাননি। অন্যদিকে আমেরিকার মদতে পাকিস্তান তাদের বায়ুসেনা ও নৌবাহিনীকে তুলনামূলক ভাবে বেশ কিছুটা শক্তিশালী করে ফেলেছিল। পাকিস্তান মনে করেছিল ১৯৬২ সালের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ভারতের আরও অনেক বেশি সময় লাগবে। পরিস্থিতি তাদের অনকূলে মনে করে যুদ্ধবাজ পাকিস্তান ১৯৬৫ সালে ফের হামলা চালিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।
তারপর ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রচেষ্টায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে পাক রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি তথা অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর তার পরদিনই তাসখন্দে শাস্ত্রীজীর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। ওই যুদ্ধে ছাম্ব এলাকায় পাকিস্তান ভারতীয় স্থল বাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত হলেও তাদের নৌবাহিনী ৭-৮ সেপ্টেম্বর গুজরাট পর্যন্ত চলে আসতে সক্ষম হয় এবং দ্বারকা বন্দরে ছোটোখাটো হামলা চালায়। যদিও তাতে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল নিতান্ত নগণ্য। অতি সম্প্রতি এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে অবসরপ্রাপ্ত একজন পদস্থ নৌ-কর্তা রবি শর্মার এক বক্তব্যে।
শ্রী শর্মা আরও জানিয়েছেন যে ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের সময় ভারতীয় নৌবহরের বৃহত্তম রণতরী আইএনএস বিক্রান্ত মেরামতির জন্য ভারতের প্রধান নৌঘাঁটি বিশাখাপত্তনমের ডকইয়ার্ডে রাখা ছিল। ফলে নৌশক্তিতে ভারত কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই ঘাটতি কাটিয়ে এই বাহিনীকে সক্রিয় করে তোলার কাজ শুরু হয় ১৯৬৬ সাল থেকে। মাত্র বছর তিনেকের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী এক্ষেত্রে যে বেশ ভালোরকম উন্নতি করেছে সেটা সম্ভবত পাকিস্তান ঠাহর করতে পারেনি। স্বভাবমতো পাকিস্তান ফের রণহুংকার চালিয়ে যেতে থাকে। আস্ফালন করে যেতে থাকে তাদের নৌশক্তির। এই প্রেক্ষিতেই ১৯৬৯ সালে ভারতের ওয়েস্টার্ন নেভাল কমান্ডের তৎকালীন প্রধান তথা ভাইস অ্যাডমিরাল নন্দ সরাসরি করাচি বন্দরের নাম করে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দেন। ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতীয় নৌবাহিনী তার প্রমাণও দেয়। সেই ঘটনার বিবরণ তুলে ধরার আগে ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ এবং ২০২৫ সালে ‘অপারেশন
সিঁদুর’ অভিযানের সময় এই নৌবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল তার সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরা যাক।
ভারতীয় নৌবাহিনীর পোশাকি নাম হলো ‘ইন্ডিয়ান নেভি’। এই নেভি এখন এতটাই শক্তিশালী যে সারা বিশ্বের সমস্ত দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে বর্তমানে তার স্থান হলো চতুর্থ। এখন প্রায় সমগ্র বিশ্বই ভারতীয় নৌবাহিনীকে রীতিমতো সমীহর চোখে দেখে। ১৯৭১ থেকেই পাকিস্তান এই বাহিনীর ক্ষমতার প্রমাণ পেয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ হয়েছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে, অনেক উঁচু পাহাড়ি এলাকায়। তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ
এবং পাক সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশারফের ধারণা ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর ভারত ওই যুদ্ধে কেবল পাহাড়ি এলাকাতেই সেনা মোতায়েন করবে। কিন্তু ৩ মে থেকে শুরু এবং ২৬ জুলাইয়ে সরকারিভাবে শেষ হওয়া ওই যুদ্ধের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তানকে কার্যত প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল।
প্রসঙ্গত, শত্রুপক্ষকে অবরুদ্ধ করাটা যুদ্ধের একটা অতি কার্যকরী কৌশল। প্রাচীনকাল থেকেই এই কৌশল চলে আসছে। প্রতিপক্ষ আগেকার দিনে একে অন্যকে দুর্গবন্দি করে রাখত। যাতে রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রসদের অভাবে দুর্গবন্দিরা এক সময় দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে হয় যুদ্ধে অবতীর্ণ নয়তো আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হতো। কার্গিল যুদ্ধের সময় বাজপেয়ী সরকারও এই কৌশল নেয়। ভারতের পক্ষ থেকে ওই যুদ্ধের সাংকেতিক নাম দেওয়া
হয়েছিল ‘অপারেশন বিজয়’। পাশাপাশি ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন তলোয়ার’। কার্গিল যুদ্ধ জলসীমার ধারে-কাছে কিংবা উপকূল এলাকার কাছাকাছি ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান তাদের সেনাবাহিনীর জন্য রসদ জোগান বিশেষ করে রণসম্ভার নিয়ে যাবার জন্য যানবাহন চালানোর তেল এবং
খাদ্যসামগ্রী যাতে ঠিকমতো না দিতে পারে সেজন্য তাদের মূল সাপ্লাই লাইনের ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করতে নৌবাহিনীকে কাজে লাগানো হয়েছিল। যৌথভাবে ওই অভিযান চালিয়েছিল ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম নেভাল কমান্ড। উত্তর আরব সাগরের পথে, বিশেষ করে ইরানের হরমুজ প্রণালী দিয়ে আসা-যাওয়াকারী পাকিস্তানের তেলবাহী ট্যাঙ্কারগুলো ছাড়াও তাদের নৌ-বাণিজ্য পথকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার জন্য ভারতীয় নৌবহর তখন আক্রমণাত্মক মেজাজে
আরব সাগরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। মূল লক্ষ্য ছিল চাপে পড়ে গিয়ে পাকিস্তান যাতে কার্গিল থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর এই কৌশলগত ভূমিকায় মাকরান উপকূলে পাকিস্তানি তেলবাহী জাহাজগুলো বিপাকে পড়ে যায়। ভারতের এই কৌশলী অভিযানের জন্য পাকিস্তানের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে ভারতের পক্ষে কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তানকে পর্যুদস্ত করার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হলেও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে নামানোর দরকার পড়েনি। স্থলসেনার বীরত্বের পাশাপাশি নৌবাহিনীর দাপট পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল।
এ বছরের ৭ থেকে ৯ মে পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সরকার ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে যে অভিযান চালিয়েছে তাতে স্থলবাহিনীর বস্তুত তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। প্রত্যাঘাতে প্রধান ভূমিকায় ছিল বিমানবাহিনী। কিন্তু কার্গিল যুদ্ধ বা ‘অপারেশন বিজয়’-এর সময় স্থলবাহিনীর কাজ সহজ করার জন্য নৌবাহিনী যেমন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তেমনি এবার ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময়ও নিয়েছে। এই অভিযান খুব অল্পদিন আগের ঘটনা। এ সম্পর্কে সকলেই এখনও যথেষ্টভাবে ওয়াকিবহাল ও অবহিত। তাই বিস্তারিত বিবরণের তেমন প্রয়োজন আছে মনে হয় না। ২০০০ মেরিন কমান্ডো এবং ৫৮ হাজার ৩৫০ জন সক্রিয় নৌসেনার এই বাহিনীর একটা বড়ো অংশকে এবারও রীতিমতো আক্রমণাত্মকভাবে আরব সাগরে মোতায়েন করা হয়েছিল। যেমনটি করা হয়েছিল ১৯৭১ থেকে ১৯৯৯ সালে। প্রধান নিশানা ছিল করাচি বন্দর। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘বিক্রমাদিত্য’ এবং দূরপাল্লার সাবমেরিন ‘সিন্ধুরক্ষক’ ছাড়াও ভারতীয় নৌবহরে অন্যান্য রণতরী, ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট ইত্যাদি-সহ মোট ৩৬ খানা যুদ্ধজাহাজ এবং একাধিক সাবমেরিন মোতায়েন করা হয়েছিল। সেগুলো দিনরাত আরব সাগর তোলপাড় করা ছাড়াও পাকিস্তানের উপকূল এলাকায় নিরন্তর নজরদারি চালাতে থাকে। এবারও লক্ষ্য ছিল সরবরাহ লাইন আটকে
দিয়ে গোটা পাকিস্তানকে অবরোধ করে রাখা। এছাড়া করাচি নৌঘাঁটি থেকে কোনো রণতরী কিংবা কোনো সাবমেরিন যাতে বেরতে না পারে সেটাও অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল। ৮ মে মাঝরাতের মধ্যেই করাচি বন্দরকে যাকে বলে অবরুদ্ধ করে ফেলে ভারতীয় নৌবাহিনী। ওই বন্দর ছাড়াও গোটা করাচি শহরকে নিশানা করে ঝাঁকে ঝাঁকে মিসাইল এবং বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে ফাইটার বিমানগুলো যাতে কার্পেট বম্বিং করতে পারে তার পুরো ব্যবস্থা করে ফেলা
হয়েছিল।
করাচির ওপর মিসাইল হামলার জন্য তৈরি ছিল ভারতের সাবমেরিনগুলোও। যুদ্ধজাহাজ থেকে এমনকী ব্রহ্মোস মিসাইল দাগার ব্যবস্থাও ছিল। তড়িঘড়ি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির কাতর আবেদন না এলে কিংবা পাকিস্তান আরও বেচাল আচরণ করলে বন্দর-সহ সিন্ধু প্রদেশের ওই রাজধানী শহরকে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর। সেইসঙ্গে ভারতের প্রধান নৌবন্দর বিশাখাপত্তনম থেকে বেশ কয়েকটা রণতরী এবং রসদবাহী জাহাজ নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছিল গুজরাটের রাজকোট বন্দরে। যাতে সেগুলো করাচিকে ঘিরে রাখা নৌবহরকে প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দিয়ে যেতে পারে। ভারতীয় নৌবাহিনীর এইসব ভূমিকায় করাচি বন্দর থেকে পাক নৌবাহিনীর কোনো যুদ্ধ জাহাজ কিংবা সাবমেরিন বেরিয়ে আসতে পারেনি। ভারতের নৌকর্তারা ২৪ ঘণ্টার প্রতি পলে তাদের লোকেশন ট্র্যাক করে যাচ্ছিলেন।
পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো এবং পাক সেনাপ্রধান আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খানের জমানায় ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে নামে। খান সেনাদের দমন-পীড়ন-অত্যাচার যখন সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন ভারত সরকার সেখানে সেনা অভিযান শুরু করে সে বছরের ৩ ডিসেম্বর। তার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে পরাজিত হয়ে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে। ওই যুদ্ধে পাকিস্তান ও ভারত দু’পক্ষই স্থল, জল ও বায়ু সেনাবাহিনীর তিন শাখাকেই নামিয়েছিল। তখন পাক নৌবাহিনী ভারতের তুলনায় খুব বেশি দুর্বল ছিল না।
ভারতের কাছে বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্ত ছিল বটে অন্যদিকে পাকিস্তানি নৌবহরের বড়ো ভরসা ছিল দূরপাল্লার বড়ো সাবমেরিন পিএনএস গাজি। শুরু থেকেই তার লক্ষ্য ছিল বিক্রান্তকে টর্পেডোর আঘাতে ডুবিয়ে দেওয়ার। কিন্তু ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তির পাশাপাশি রণকৌশল এত সুচারু ছিল যে পাকিস্তান বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। ‘বিক্রান্ত’ তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেনি। তার মোট ৪টি বয়লারের মধ্যে প্রযুক্তিগত কারণে একটি বয়লার তখনও কার্যশীল ছিল না। তা সত্ত্বেও রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএইচ শর্মার নেতৃত্বাধীন ইস্টার্ন ফ্লিট-এর রণসজ্জায় বিক্রান্তকেই অগ্রণী ভূমিকায় রাখা হয়েছিল। তখন ভারতীয় নৌবাহিনীর কৌশল ছিল পাকিস্তানের রসদ সরবরাহ বিপর্যস্ত করা। তাদের যুদ্ধ জাহাজগুলো তো বটেই, রসদ বহনকারী অন্যান্য জলযানগুলোও যাতে করাচি থেকে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ দিক বেড় দিয়ে এসে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরে সহজে না পৌঁছতে পারে। তাছাড়া ভারতীয় নৌবাহিনী সেবার করাচির ওপরও প্রচণ্ড আঘাত করেছিল।
ভারতের সেনা অভিযান শুরুর প্রথম দিনই অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর আইএনএস রাজপুত নামের এক যুদ্ধজাহাজ থেকে ছোঁড়া দুটো টর্পেডোর আঘাতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের নৌবহরের বৃহত্তম সাবমেরিন পিএনএস গাজিকে। ফলে যুদ্ধের শুরুতেই বড়ো ধাক্কা খায় পাকিস্তান। এর পরদিনই ‘সি হক’ এবং সাবমেরিন ধ্বংসী যুদ্ধবিমানগুলো বিক্রান্ত থেকে উড়ে গিয়ে লাগাতার বোমাবর্ষণ শুরু করে। লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মঙ্গলা ও চালনায় পাকিস্তানের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত ও বিধ্বস্ত, বন্দর পরিকাঠামো ব্যাহত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। বিশেষ করে কক্সবাজারে
বোমা বর্ষণের ফলে পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড প্রায় পঙ্গু হয়ে যায়। দারুণভাবে ব্যাহত হয় পাকিস্তানের সেনা মোতায়েন ও সরবরাহ ব্যবস্থা। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বিক্রান্তর যুদ্ধবিমানগুলো যেমন আকাশপথের দখল নিয়ে নিয়েছিল সেই সঙ্গে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় নৌবহরের অন্যান্য জাহাজ বিশেষ করে আইএনএস, বিয়াস (বিপাশা), আইএনএস ব্রহ্মপুত্র এবং আইএনএস কামোর্তা সমুদ্রের দখল নিয়ে বিক্রান্তর নিরাপত্তা নিরঙ্কুশ করে ফেলেছিল।
ওই যুদ্ধের প্রায় মাঝখানে ৯-১০ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবহরের এটি যুদ্ধজাহাজ পাকিস্তানের বেআইনি ধাড়িবাজি তথা কুকীর্তি ধরে (ইন্টারসেপ্ট করে) ফেলে। আইএনএস বিপাশা জানতে পারে আনওয়ার বক্, তথা আজুল হাসান মারু নামের বাণিজ্যতরীতে শ্রমিকের ছদ্মবেশে পাক সেনাদের কক্সবাজারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইন বিরোধী। সঙ্গে সঙ্গে ওই পাক জাহাজকে আটক করে ১৮ জন খানসেনাকে নিজেদের কবজায় নিয়ে নেয় বিপাশার নৌসেনারা। এই ঘটনায় পাকিস্তান আরও বেশি বিপাকে পড়ে যায়। ইতিমধ্যে ভারতীয় নৌসেনা, বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসফ) জওয়ানরা মঙ্গলা, চালনা এবং খুলনায় প্রবল আক্রমণ শানায়। একাজে তাদের সহযোগিতা করেছিল আইএনএস পানভেল। অন্যদিকে ৪-৫
ডিসেম্বর ‘অপারেশন পাইথন’ (অজগর) অভিযান চালিয়ে করাচি বন্দরকে প্রায় তছনছ করে দেয়।
৯ ডিসেম্বর অপারেশন ট্রাইডেন্ট-এর মাধ্যমে করাচির ওপর ক্ষেপণাস্ত্রও বর্ষণ করে। ভারতীয় নৌবাহিনীর ওই অভিযানের ফলে প্রায় ৭ দিন ধরে জ্বলেছিল পাকিস্তানের ওই প্রধান নৌবন্দর। গোটা করাচি শহরটা ঘেরাবন্দি করে ফেলা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর এই সমস্ত ভূমিকার কারণেও পাকিস্তানের রণে ভঙ্গ দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। একদিকে পদাতিক ও বায়ুসেনার আক্রমণ, অন্যদিকে নৌবাহিনীর তৎপরতার কাছে নতি স্বীকার করে ১৬ ডিসেম্বর ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের লে: জে: জগজিৎ সিংহ অরোরার কাছে পাকিস্তানের লে: জে: একে নিয়াজি সরকারিভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারতীয় নৌবাহিনী উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য আইএনএস বিয়াস এবং আইএনএস পানভেল-এর দুই নেভাল কমান্ডার যথাক্রমে সামন্ত এবং
নরোনহা-কে মহাবীর চক্রে সম্মানিত করা হয়েছিল।