জাতীয় ভাষার সমান্তরাল সর্বনাশী খেলা
নিবিড় ঘন আঁধারে
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
অন্ধ অন্ধকে পথ দেখালে দু’জনেই খন্দে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ বাংলাভাষাকে তুলে ধরে বাঙ্গালিকে পথ চেনাতে চাইছেন। বাংলা দৈনিকের এক পুরনো সম্পাদকের ভাষণ শোনার অভিজ্ঞতা হলো এই প্রতিবেদকের। আলুলায়িত ও অপ্রকৃতিস্থ চিন্তা দিয়ে তিনি দর্শকদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, বাঙ্গালি জাতি কীভাবে শেষ হয়ে গিয়েছে। দু’একটা নোবেল পুরস্কার, কিছু সাবেকি বাঙ্গালি চিত্র পরিচালক আর কবির দল ছাড়া এ জাতির দেশে বিদেশে কোথাও ঠাঁই নেই। বাংলা সিনেমার অধোগতি যে বাঙ্গালির পতনের একটি দিকনির্দেশ করছে- সেই হাস্যকর সমীকরণও তিনি টেনেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা তার থেকে পৃথক নয়। কারণ তৃণমূলনেত্রীর ‘বাঙ্গালি জাগো’ স্টাইলের দাবি তার উলটপুরাণ নয়। তারা যেখানে অপ্রকৃতিস্থ ভাবনার সওয়ারি, চরম উত্থান ও পতন সেখানে কেবল ধ্রুবক। একসময় ‘আমরা বাঙ্গালি’ বলে একদল মানুষ রেল স্টেশনের ইংরেজিতে লেখা নাম আর হোর্ডিঙে কালি লেপে বাংলায় লিখতে শুরু করেছিল। কিছু পরিত্যক্ত বামপন্থী তার নতুন সূচনা ঘটিয়েছে। বাতিল হয়ে যাওয়া বাম মানসিকতার
অকিঞ্চিৎকর অভিনেতারা তাতে জুড়ে গিয়েছে। সবাই মিলে সনাতনী হিন্দুত্ব ভাবনার প্রবল চাপ সামলাতে না পেরে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ছাতার তলায় জড়ো হয়েছে।
১৯৭৭ সালের বামবিরোধী ভোট ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১১-তে ৪৮ শতাংশে থামে। ২০১৯-এর পর থেকে বিজেপি এই রাজ্যে ৩৯ থেকে ৪১ শতাংশ ভোটের ধারা বজায় রেখেছে। এই ধারা বজায় থাকলে তৃণমূলের ৪৫ শতাংশ ভোটকে তারা শীঘ্র পেরিয়ে যাবে। ভাষার খেলায় তৃণমূলনেত্রী জিতলে রাজ্যবাসী, প্রকৃত বাঙ্গালিদের কপালে দুঃখ রয়েছে! এক অসম্ভব ভাবনায় বুক বেঁধেছে তৃণমূল। এক বিধায়কের দাবি ভুয়ো ভোটার আর বাংলাভাষার কালা জাদুই আগামী ভোটে মুখ্যমন্ত্রীর তুরুপের তাস। একটাই সমস্যা যে, বাংলাভাষা নিয়ে মিথ্যা ন্যারেটিভ তৈরির দক্ষতা তৃণমূলনেত্রীর দল বা প্রশাসনে কারুর নেই। তার রাজনৈতিক ইতিহাসের সত্য ন্যারেটিভটা ঘুরিয়ে দিতে পারে তেমন কেউ নেই। তার দলের সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বিজেপিকে বহিরাগত বর্গী বলে তৃণমূলনেত্রীর আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেটাই নাক ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন তৃণমূলনেত্রী। অথচ দিল্লিতে ‘অবাঙ্গালি’ কেন্দ্রীয় সরকারে চারবার মন্ত্রী হতে লজ্জা পাননি তৃণমূলনেত্রী। প্রথমে তেলুগুভাষী প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার, তারপর তিন বার প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারে দু’বার এবং তারপর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মা গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী কি ‘বাঙ্গালি’ হয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন? সারাটা জীবন অবাঙ্গালিদের দাক্ষিণ্যে বেড়ে ওঠা তৃণমূলনেত্রীর বাঙ্গালিয়ানা নাটুকেপনার অধিক! তিনি বাঙ্গালি আর বাংলাভাষা নিয়ে ডাহা মিথ্যা বলছেন। উদ্দেশ্য হলো বেআইনি মুসলমান ও রোহিঙ্গাদের
রাজ্যে ঘর পাইয়ে দিয়ে সেই অবৈধ ভোেট পকেটস্থ করা। দিল্লিতে কর্মরত থাকাকালীন এই প্রতিবেদকের কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। তখন দেখা যেত তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী ধরনের রাজনৈতিক সমর্থন ও সাহায্য করতেন অরুণ জেটলি, মণিশঙ্কর আইয়াররা। বিজেপির দুই মন্ত্রী তপন শিকদার ও সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের (জলু বাবুর) সঙ্গেও তার প্রভূত সখ্যের কথা রাজনৈতিক মহলে সর্বজনবিদিত ছিল। ২০০০-০১ সালের তহলকা কাণ্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যাবিনেট মন্ত্রীপদ ছেড়ে দিলে তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দলের ভিতর অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবাণী, অরুণ জেটলিরা যেভাবে লড়েছিলেন তা নজিরবিহীন। আজকে তাঁদের রাজনৈতিক উত্তরসূরীদের ‘বাঙ্গালি হন্তা’ সাজাচ্ছেন তৃণমূলনেত্রী। এটা লজ্জার যে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে নিজের ইতিহাসকেই আজ অস্বীকার করছেন! তার ঝুঁটি নেড়ে এ মাস থেকেই রাজ্য জুড়ে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হতে চলেছে। তাতে তৃণমূলনেত্রীর ঘুম উড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সত্যনিষ্ঠার প্রতি ভরসা না রেখে তার বিরোধিতা করে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়েছেন যে, তার ভোেট জেতার আড়ালে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।
এর আগে ১৯৯৭ সালে অসমে এবং ২০০৩ সালে বিহারে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন হয়েছিল। বিদেশি সিপিএমকে তাড়াতে সেই সময় তৃণমূলনেত্রী এই রাজ্যে তা চালু করার দাবি জানিয়েছিলেন। এখন তিনি বুঝেছেন যে, ভুয়ো ভোটারের ভূত তাড়াতে রাজ্যের মানুষ নির্বাচন কমিশনের ওঝা ডাকছেন। মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতা বোঝাচ্ছে যে, ভুয়ো ভোটারের বেশিরভাগটাই তার ভোটব্যাংকের অংশ। কোনো অন্যায় হলে বা জোর করে কারও নাম বাদ গেলে তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের একাধিক আধিকারিক, এমনকী সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত রয়েছে। তাহলে কাকে বা কীসে ভরসা করেন মুখ্যমন্ত্রী? মরিয়া মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনের নীচু তলার (বিএলওদের) উদ্দেশ্যে হুমকি দিচ্ছেন। তার সামনে নিবিড় ঘন আঁধার। তার পায়ের নীচে মাটি কি সরছে? কিন্তু কতটা?