স্বাধীনতার মর্ম
স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ১৫ আগস্ট দিনটি ভারতবাসীর নিকট যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদের দিন। হর্ষ এই কারণেই যে এই দিনেই ভারতবাসী দীর্ঘ পরাধীনতার অবসানে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়াছে। বিষাদ এই কারণে, স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দেশমাতৃকার অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়াছে। ১৯৪৭ সালের মধ্যরাত্রিতে যখন ক্ষমতার হস্তান্তর চলিতে ছিল, দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী যখন আবেগমথিত কণ্ঠে ভাষণ দিতেছিলেন, সেই সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাটি হিন্দুর রক্তে লাল হইতেছিল। দিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যখন আনন্দে উদ্বেল, তখন ভিটেমাটি হারা, স্বজন হারা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর কান্নায় ভারতের আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত হইতেছিল। যাঁহারা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়াছিলেন সেই হুতাত্মা পরিবারগুলির মানুষজন স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যুষে বিদেশি নাগরিক হইয়া গেলেন। তাঁহারা তো দেশ বিভাজন প্রত্যাশা করেন নাই! ইতিহাস সাক্ষী, কতিপয় জাতীয় নেতার অদূরদর্শিতায় তাহা ঘটিয়াছে। ক্ষমতা ভোগ করিবার শীঘ্রতায় তাঁহারা সেইসময় পূর্ববঙ্গের বিনয়-বাদল-দীনেশ, সূর্য সেন, প্রীতিলতাদের পরিবারের কথা, লাহোরের ভগৎ সিংহ-সহ লক্ষ লক্ষ পরিবারের কথা ভাবিবার অবকাশ পান নাই। স্বাধীন দেশের শাসন ব্যবস্থায় অধিষ্ঠিত হইয়াও তাঁহারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের হিন্দুদিগের কথা একবারও চিন্তা করেন নাই। সেই হতভাগ্য হিন্দুদিগের কথা যিনি ভাবিয়াছিলেন সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে তাঁহারা সাম্প্রদায়িক বলিয়া দাগিয়া দিয়াছেন। বহু বৎসর ধরিয়া স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করিয়া শুধুমাত্র একটি পারিবারের গুণগান করিয়া আনন্দ উৎসবেই দিনটি তাঁহারা অতিবাহিত করিয়াছেন। দেশ বিভাজনের বিভীষিকার করুণ কাহিনি বর্তমান প্রজন্মের নিকট তুলিয়া ধরেন নাই। ঋষি অরবিন্দের ভবিষ্যদ্বাণী- ‘দেশ বিভাজন কৃত্রিম, তাহা একদিন অপসৃত হইবেই’ বর্তমান প্রজন্মকে স্মরণ করানো হয় নাই। আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হইতে আগত শরণার্থীদিগকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করিবার কথাও তাঁহারা ভাবিতে পারেন নাই। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, দীর্ঘদিন কংগ্রেসি শাসনে দেশে স্ব-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ লওয়া হয় নাই। বরং সর্বপ্রকারে দেশকে লুণ্ঠন করিবার প্রতিযোগিতা দেখা গিয়াছে।
ভারতবাসীর সৌভাগ্য যে, গত এক দশক হইতে দেশে স্ব-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার যাবতীয় কর্মকাণ্ড শুরু হইয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে দেশবাসীকে স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করাইবার জন্য ১৪ আগস্ট দিনটিকে ‘বিভাজন বিভীষিকা দিবস’ রূপে পালন করা হইতেছে। এই উপলক্ষ্যে দেশব্যাপী সভা সমিতির আয়োজন করিয়া দেশ বিভাগের ক্ষত এবং স্বজন হারানোর করুণ কাহিনি স্মরণ করা হইতেছে। দেশের স্থানে স্থানে স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং হুতাত্মাদিগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সংগ্রহশালা স্থাপন করা হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করিবার মতো বিষয় হইল, ১৯৪৭ সাল হইতেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকগণ স্বাধীনতা দিবসের দিনটিকে অখণ্ড ভারত দিবস রূপে সংকল্প গ্রহণ করিয়া আসিতেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ৭৮ বৎসরের এবং কেন্দ্রীয় সরকারের এক দশকের প্রচেষ্টায় দেশব্যাপী এক দেশপ্রেমের স্ফুরণ অনুভূত হইতেছে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও দেশের অভ্যন্তরেই ভোটভিখারি রাজনৈতিক দলগুলি এবং দেশ বিরোধী শক্তি দেশকে পশ্চাদপদ করিবার জন্য সতত ক্রিয়াশীল রহিয়াছে। দেশের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবৃন্দ যে শত্রুদেশ পাকিস্তানের পক্ষে রহিয়াছেন তাহা পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমেই স্বীকার করা হইয়াছে। দেশবাসী দেখিতেছে, দেশের নির্বাচন কমিশনের সদর্থক পদক্ষেপের বিরোধিতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী-সহ প্রতিপক্ষের নেতৃবৃন্দ কীভাবে করিতেছেন। শুধু তাহাই নহে, কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন ও স্ব-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞকে কীভাবে উপহাস করা হইতেছে। তাহা সত্ত্বেও দেশ আজ অগ্রগতির পথে চলিতেছে। ইহার কারণ, বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতার মর্ম দেশবাসীকে উপলব্ধি করাইতে সক্ষম হইয়াছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। মনে রাখিতে হইবে, স্বাধীনতা দিবস শুধুমাত্র হই-হুল্লোড়ের দিন নহে, দেশকে অগ্রগতির পথে লইয়া যাইবার সংকল্প গ্রহণের দিনও বটে।