জলের বদলে রক্ত?
ভারতের অধিকার রয়েছে চুক্তি বাতিল করার
১৯৬০ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জলচুক্তি হয়েছিল। সেসময়ে এই চুক্তির সঙ্গে জড়িয়েছিল ভারতের বদান্যতা। ভারত নদীপ্রবাহের উপরিভাগে থাকা দেশ হওয়া সত্ত্বেও জলবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী ৮০ শতাংশ জল পাকিস্তানকে দিয়ে এসেছে।
সিন্ধু জলচুক্তি করা হয়েছিল এই আশায় যে, দুই প্রতিবেশী দেশ এই উপমহাদেশে একসঙ্গে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কাজ করবে। পাকিস্তান অবশ্য এই পথে না হেঁটে ভারতের এই বদান্যতাকে দুর্বলতা ভেবে কৃষ্ণতার বদলে উপহার পাঠিয়েছে জঙ্গি, গ্রেনেড ও গোলাবারুদ।
২০০১ সালে ভারতের সংসদ ভবনে ভয়াবহ আক্রমণ থেকে শুরু করে ২০০৮ সালের ঘৃণ্য ও ভয়ংকর মুম্বই হামলা এবং ২০১৬-র উরি হামলার পর ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলা-সবই ছিল ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সুপরিকল্পিত ছায়াযুদ্ধ। এভাবে একের পর এক ভারতের ওপর হামলা সত্ত্বেও ভারত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে পাকিস্তানকে জল সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। প্রতিদান হিসেবে পাকিস্তান কিন্তু একনাগাড়ে ভারতের রক্ত ঝরিয়ে এসেছে।
কিন্তু গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে নিরপরাধ হিন্দু পর্যটকদের ধর্ম জিজ্ঞাসা করে যেভাবে হত্যালীলা চলিয়েছে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট ইসলামি জঙ্গিরা, তাতে স্বাভাবিকভাবে মোদী সরকার যেসব চুক্তি বাতিল করেছে তার মধ্যে সিন্ধুনদের জলবণ্টন চুক্তি প্রধান ও অন্যতম।
এই চুক্তি বাতিল একটি ছোটো ঘটনা নয়। বরং ভারত সরকারের তার দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে এক সঠিক পদক্ষেপ। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন খুব পরিষ্কার-‘যখন কোনো সন্ধি বা চুক্তির প্রাথমিক শর্ত উল্লঙ্গঘন হয় অথবা চুক্তির অপরপক্ষ শর্ত না মেনে তা লঙ্ঘন করে তবে অপর পক্ষের অধিকার রয়েছে সেই চুক্তি রদ করা অথবা চুক্তি থেকে সরে যাওয়া।
যখন কোনো দেশ বিনা প্ররোচনায় অন্য দেশের সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালায়, তখন
হামলাকারী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে শর্ত বা চুক্তি অন্য দেশের সঙ্গে রয়েছে, তার ওপর স্বাভাবিকভাবেই অধিকার হারায়। সিন্ধু জলচুক্তি কোনো আলাদা প্রকারের চুক্তি নয়, বরং এই চুক্তির প্রাথমিক শর্তই হলো পারস্পরিক বোঝাপড়া বা বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে। সেই বিশ্বাসের ওপর যখন অপরপক্ষ কুঠারাঘাত করে, তখন চুক্তি বাতিল হয়। এছাড়াও, বিশ্ব এই চুক্তি বাতিলের বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয় আদপে এমনটা নয়। আমেরিকা ২০০২ সালে একতরফাভাবে ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী চুক্তি বাতিল করেছিল এবং পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে আভ্যন্তরীণ সুরক্ষার অজুহাতে। যে কোনো সার্বভৌম দেশের অধিকার আছে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার এবং অন্য দেশের আগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করার। ভারত তার ব্যতিক্রম নয়।
সিন্ধু জলচুক্তির মধ্যে আবদ্ধ থাকা অবস্থায়ও পাকিস্তান বিশ্বাঘাতকতা করেছে ক্রমাগত। পাকিস্তান চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ভারতীয় পরিকাঠামো প্রকল্পের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে এবং ভারতকে তার প্রাপ্য জল থেকে বঞ্চিত করেছে। পাকিস্তান অতি নগণ্য কারিগরি ইস্যু তুলেছে আন্তর্জাইতক সালিশি সভায়। ভারত সেই বিবাদ থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি।
ভারত এখন পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তান যেন ভারতের সীমাহীন ধৈর্যকে দুর্বলতা না ভেবে বসে। ভিয়েনা কনভেনশানের ৬৯ নম্বর সন্ধিচুক্তির শর্তে বলা হয়েছে যে, কোনো দেশ যেকোনো চুক্তির শর্ত উল্লঙ্ঘন করলে অপর দেশ সেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে। যাইহোক, ভারত এখন পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এবং বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে সিন্ধু জলচুক্তি একেবারে খারিজ না করে চুক্তি রূপায়ণ আপাতত স্থগিত রেখেছে। ভারত এখনো এই মুলতুবি বিষয়টিকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছে যাতে পাকিস্তান নিজের আচরণ বদল করে। দুই দেশের সম্পর্কের যে সেতু এতকিছু ঘটার পরেও টিকে আছে, ভারত তা এখনই ভেঙে দিতে চায় না। এতকিছু সত্ত্বেও ভারত চাইছে না অববাহিকায় জল প্রবাহকে বিঘ্নিত করতে। ভারত এখনো মনে করে দেশের বৈরিতা পাক সরকারের সঙ্গে, পাকিস্তানের সাধারণ মানষের সঙ্গে নয়। ভারত বলেছে, তাদের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ মানবতা বিরোধী নয়। বরং উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে জলসরবরাহ মুলতুবি রাখার কথা চীনের কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেবার জন্য। কারণ চীন ইতিমধ্যেই নদী অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলোকে জল না দেবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তার ওপর চীন ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাঁধ তৈরি করেছে যাতে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে প্রবাহিত জলসরবরাহ কমে যায়।
পাকিস্তানের আর্থিক দৈন্য নিত্যসঙ্গী। সামরিক শক্তিতে ভারতের ধারেকাছেও নেই। ভারত বহুবার পকিস্তানেকে ভারত-বৈরিতা ছাড়তে বলেছে। তবু পাকিস্তান ভারত-বৈরিতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মাঝে মধ্যেই জেহাদের ডাক দেয়। পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দেয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুদ্ধের মাধ্যমে দুইদেশের মধ্যে যে ঘৃণার মনোভাব রয়েছে তার বিবর্তন হতে পারে। অবাক হবার মতো বিষয় যে, সম্প্রতি পহেলগাঁওয়ে নারকীয় হত্যাকণ্ডের পর পাকিস্তানের ঘাড়ের ওপর ভারতের রোষনিশ্বাস পড়ছে, তারপরেও তারা পরমাণু যুদ্ধের কথা বলে চলেছে।
এতকিছুর পরেও ভারত শর্তসাপেক্ষে জলবণ্টনে বিকল্প ব্যবস্থার কথা পাকিস্তানকে জানাতে পারে, কিন্তু সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি সর্বতোভাবে বিফল হয়েছে। ভারতের দিক থেকে সদিচ্ছা থাকলেও পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই। এখনো সে সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে। ভারতের ধৈর্য ঐতিহাসিক। ভারতবাসী সেই ধৈর্যের অবসান চায়।