বিষ্ণুর নবম অবতার
সুগত বুদ্ধ
অবতীর্ণ হন তিনি
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। দেবতাদের অধীশ্বর এই ত্রিদেব। সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশের নিয়ামক তাঁরা। ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা। স্থিতি বা পালনের দায়িত্ব বিষ্ণুর। আর সবকিছুর বিনাশক হলেন মহেশ্বর বা শিব। এই ব্রহ্মাণ্ডে সাম্যের সহাবস্থান ঘটান তাঁরা।
এই ত্রিদেবের কাজের রূপটি একটু ভিন্ন। ব্রহ্মার সৃষ্ট জগতের বিলোপের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সবকিছুর সুসম বিন্যাসের দিকে থাকে বিষ্ণুর সদাসতর্ক দৃষ্টি। বস্তুত ধর্ম সংস্থাপন ও সংরক্ষণে সদাতৎপর তিনি। তার জন্য কখনো অলক্ষ্যে, আবার কখনো-বা
মরলোকে অবতীর্ণ হতে হয় তাঁকে।
ধরাধামে বিষ্ণুর এই যে অবতরণ তা কিন্তু সব সময় একই রকম নয়। কখনো তিনি স্বয়ং আসেন অবতাররূপে, কখনো-বা হয় তাঁর আংশিক অবতরণ। সাধারণ অভিধায় তাই অবতার দু’রকম- পূর্ণাবতার ও অংশাবতার। পূর্ণাবতারে বিষ্ণু প্রত্যক্ষভাবে আবির্ভূত হয়ে ঈশ্বরের সমস্ত শক্তি ও গুণাবলীর প্রকাশ ঘটান। বিষ্ণুর দশটি অবতারের মধ্যে নৃসিংহ, রাম, কৃষ্ণ হলেন পূর্ণাবতার। আংশিক অবতারেও বিষ্ণু প্রত্যক্ষভাবেই অবতীর্ণ হন, তবে এক্ষেত্রে আংশিকভাবে ঘটে তাঁর আত্মপ্রকাশ। আংশিক অবতারের মধ্যে রয়েছেন মৎস্য ও পরশুরাম।
পুরাণগুলিতে বিষ্ণুর অবতারের সংখ্যা কিন্তু এক নয়। সংখ্যাটা চার থেকে ঊনচল্লিশ। তবে সাধারণভাবে বিষ্ণুর দশটি অবতারের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এই দশ অবতারের মধ্যে প্রথম চার অর্থাৎ মৎস্য, কুর্ম, বরাহ ও নৃসিংহের ঘটে সত্যযুগে। ত্রেতায় আবির্ভূত হন-বামন, পরশুরাম ও অযোধ্যাপতি রাম। দ্বাপরে আবির্ভূত হন অষ্টম অবতার, কলিতে নবম অবতার বুদ্ধ এবং আবির্ভূত হবেন কল্কি- কলিযুগের শেষলগ্নে। অষ্টম অবতারের নাম নিয়ে অবশ্য আছে কিছু মতভেদ। কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, এমনকী বিষ্ণুরও উৎস এমন মতে বিশ্বাসীরা কৃষ্ণকে অবতারের তালিকায় রাখতে চান না। অন্যদিকে ওই তালিকায় থাকা কৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম সম্পর্কে আবার কারও কারও বক্তব্য, বলরাম হলেন শেষনাগের অবতার, তাই দশাবতারের তালিকায় তাঁর নাম রাখা সঙ্গত নয়।
বুদ্ধ অবতার
মহাবলীপুরমের আদিবরাহ গুহাদ্বারে উৎকীর্ণ লিপিতে (সপ্তম শতক) রয়েছে,-‘মৎস্য কুর্মো বরাহশ নরসিংহোহথ। বামনঃ। রামো রামশ্ব রামশ্চ বুদ্ধঃ কদ্ধিশ্চ তে দশঃ।।’
দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবও তাঁর দশাবতার স্তোত্রে এই ধারাতেই বলেছেন, ‘কেশবধৃত বুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে।’ বোঝা যাচ্ছে হিন্দুধর্মে বুদ্ধ অবতার রূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন বহু আগে থেকেই। সেই স্বীকৃতির পরম্পরাই রক্ষিত জয়দেবের স্তোত্রে। অবতার হিসেবে বুদ্ধ স্বীকৃতি পেয়েছেন পৌরাণিক যুগেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরাণ গ্রন্থগুলির লেখা শুরু হয় ৩৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। ওই পর্বে লেখা পুরাণগুলির মধ্যে আছে ব্রহ্মাণ্ড, দেবী, কুর্ম, মার্কণ্ডেয়, মৎস্য, বামন, বরাহ, বায়ু ও বিষ্ণুপুরাণ। পক্ষান্তরে অগ্নি, ভাগবত, ভবিষ্য, ব্রহ্মা, ব্রহ্মাবৈবর্ত, দেবী-ভাগবত, গরুড়, লিঙ্গ, পদ্ম, শিব ও স্কন্দ পুরাণগুলির রচনাকাল ৭৫০-১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
এইসব পুরাণের মধ্যে বুদ্ধ অবতারের কথা রয়েছে হরিবংশে (১/৪১), বিষ্ণুপুরাণে (৩/১৮), ভাগবত পুরাণে (১/৩/২৪, ২/৭/৩৭, ১১/৪/২২), গরুড় পুরাণে (১/১, ২/৩০, ৩/১৫), অগ্নি পুরাণে (১৬, ৪৯/৮), নারদীয় পুরাণে (২/৭২), লিঙ্গ পুরাণে (১/৭১), পদ্মপুরাণে (৩/৩৫২) বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে মেনে নিয়েছেন। এই পুরাণগুলির মধ্যে অগ্নি পুরাণের মন্তব্য, দৈত্যদের দমন করার জন্য বিষ্ণুই অবতীর্ণ হন বুদ্ধ অবতার রূপে।
ষষ্ঠ শতকের পর রচিত পরাশরের ‘বৃহৎ পরাশর হোরা শাস্ত্র’ পুস্তকের মধ্যেও (২/১-৫/৭) রয়েছে বুদ্ধাবতারের কথা। একইভাবে স্কন্দ পুরাণে (১৫১ অধ্যায়) বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধ হয়ে আমি ভ্রান্ত যুক্তি ও প্রতারণার মাধ্যমে আমি অসুরদের বিভ্রান্ত করব।’
শ্রীযোগাচার্য
হিন্দুশাস্ত্রে বুদ্ধকে বলা হয়েছে যোগাচার্য। সন্ন্যাসী দেবসুন্দর বুদ্ধের গায়ের রং হলুদ। গৈরিক বা রক্তাম্বরধারী বুদ্ধের পূজার কথা বলা হয়েছে বরাহ পুরাণে। বলা হয়েছে সৌন্দর্যদাতা বুদ্ধের পূজা করলে তিনি পূজকের বাসনা পূরণ করেন।
ব্রহ্মাণ্ডপুরাণের মতো কোনো কোনো পৌরাণিক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মোহনার্থ দানবানাং… ভগবান বাগভিরগ্রভির অহিংসা আচিভির হরিঃ- দৈত্যদের মোহিত করার জন্য বুদ্ধ দাঁড়ালেন পাশে শিশুর রূপে। মূর্খ জিন বা দৈত্য সেই শিশুকে সন্তান ভেবে ঘরে নিয়ে যায়। আর ওইভাবে বুদ্ধ অবতার রূপে সুচারুভাবে অহিংসার বাণীতে সঙ্গীসাথী-সহ জিনকে সম্মোহিত করলেন।
ভাগবতের প্রথম অধ্যায়েই বলা হয়েছে, কলিযুগের শুরুতেই দেব-শত্রুদের সম্মোহিত করতে তিনি অর্থাৎ শ্রীহরি বুদ্ধরূপে কিকতদেশে অঞ্জনার পুত্র হয়ে জন্ম নেন। -‘তথাঃ কলাসু সম্প্রব্রত্তে সম্মোহায় সুরাদ্বিষাম্। বুদ্ধ নামনাঞ্জন-সুতঃ কীকতেষু ভবিষ্যতি।।’ (১/৩/২৪)।
বহু পুরাণেই বলা হয়েছে, ভগবান বিষ্ণু বুদ্ধ অবতারে দৈত্য বা মানবজাতিকে বৈদিক ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন। যেমন ভবিষ্য পুরাণে আছে-কলিযুগে বিষ্ণু শাক্যমুনি গৌতম রূপে
জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দশ বছর বৌদ্ধমত শিক্ষা দিলেন। তারপর শুদ্ধোধনের কুড়ি বছরের রাজত্ব শেষে শাক্যসিংহ আরও কুড়ি বছর রাজত্ব করেন। কলিযুগের প্রথম দিকে সমস্ত বৈদিক পথ ধ্বংস হয় এবং সকলেই বৌদ্ধ হয়ে যান। যারা বিষ্ণুর পায়ে আশ্রয় চেয়েছিলেন তাঁরাও বিভ্রান্ত হন।
কনস্টানস এ জোনস এবং জেমস ডি. রায়ান তাঁদের এনসাইক্লোপিডিয়া অব হিন্দুইজম’ (২০০৬ খ্রি:) পৃ. ৯৬-এ সমকালীন হিন্দুধর্ম নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জানান, বুদ্ধকে যাঁরা হিন্দুধর্মেরই একটি রূপ বলে মনে করতেন, তাঁরাই বুদ্ধকে অবতারের মান্যতা দিয়ে তাঁকে দেবতার আসনে বসান। ত্রয়োদশ শতকের আগের কিছু কিছু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে অসুররা যাতে জীবহত্যা ত্যাগ করে তার জন্য বুদ্ধ তাদের ভুল পথে চালিত করেন। সাম্প্রতিককালেও বুদ্ধকে দেবতা হিসেবে পূজা করতে দেখা যায়। অর্থাৎ একটি পরম্পরা আজও অব্যাহত রয়েছে।
এক নন গৌতম ও সুগত বুদ্ধ
বুদ্ধ বিষ্ণুর অবতার। বিভিন্ন পুরাণে একথা বলার পরও প্রশ্ন ওঠে, এই বুদ্ধ কোন বুদ্ধ? তিনি কি গৌতম বুদ্ধ, নাকি সুগত বুদ্ধ? কোনো কোনো বৈষ্ণব সম্প্রদায় মনে করেন, দশাবতারে নবম অবতার হিসেবে যে বুদ্ধের কথা বলা হয়েছে তিনি গৌতম বুদ্ধ নন। তাঁদের মতে, সুগত বুদ্ধের জন্ম ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বোধিগয়া বা কিকটে। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতকে শাক্যবংশে আবির্ভূত সিদ্ধার্থ বা গৌতমবুদ্ধ নন। অগ্নিপুরাণ অনুযায়ী সুগত বুদ্ধ চতুর্ভুজ। তাঁর চার হাতে রয়েছে বেদ, পদ্ম, জপমালা এবং একটি ভিক্ষাপাত্র।
শিব পুরাণেও রয়েছে সুগত বুদ্ধের কথা। এখানে তিনি বিবর্ণ পোশাক পরা কেশহীন পুরুষ। ত্রিপুরাসুরকে বেদ ও শিবের উপাসনা ত্যাগ করানোর দায়িত্ব দিয়ে সন্ন্যাসী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল এবং সে কাজে সফলও হন তিনি।
ধর্ম সংস্থানাপার্থে
পুরাণ কথা, যুগে যুগে ভগবান শ্রীবিষ্ণু এই মরজগতে অবতীর্ণ হয়েছেন। কোনো কোনো যুগে তিনি আবির্ভূত হন
একাধিকবার। এবং প্রতিবারই তাঁর এই অবতরণ কোনো না কোনো ধর্ম সংকটের কারণে। যখনই ধর্ম বিপন্ন হয়েছে, অধার্মিক, দুর্নীতিপরায়ণের সংখ্যা বেড়েছে, যখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপথচ্যুত দৈত্য-দানব-অসুরদের অনাচার ও অত্যাচারে পীড়িত হয়েছে পৃথিবী, তখনই দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য অবতাররূপে আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর। ধর্মসংস্থাপনের পরই বিদায় নিয়েছেন তিনি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, নবম অবতার বুদ্ধ রূপে বিষ্ণু বা শ্রীহরির যে আবির্ভাব, তার কারণটি কী? এ ব্যাপারে আমাদের চোখ রাখতে হবে ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, শিব পুরাণের মতো পুরাণগুলির উপরে।
অহমিকার শাস্তি
বিভিন্ন পুরাণ থেকে জানা যায়, আত্মগর্বে স্ফীত দেবরাজ ইন্দ্রকে শিক্ষা দেবার জন্য এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরাসুরের অত্যাচারে পীড়িত মানুষ ও পৃথিবীকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই আবির্ভূত হন শ্রীবিষ্ণু এই পৃথিবীতে সুগত বুদ্ধরূপে।
দেব-সিংহাসনে বসার পর এক সময় ক্ষমতার মোহে মদমত্ত হয়ে ওঠেন ইন্দ্র। সে সময় এতটাই উদ্ধত হয়ে তিনি ঋষি, ব্রাহ্মণ দেবতা প্রভৃতি সকলকে শ্রদ্ধা জানানো দূরে থাক, সম্পূর্ণ অকারণে তাঁদের হতমানও করতে থাকেন। ওই অভ্যাসের বশেই একসময় তিনি দেবগুরু বৃহস্পতিকেও অপমান করেন। কেবল দেবগুরু নয়, গঙ্গাকেও তিনি অসম্মান করেন।
তাঁর ওই অহমিকা ও ঔদ্ধত্যে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন দেবগুরু বৃহস্পতি। এতদিন অন্যরা ইন্দ্রের অন্যায় আচরণ মেনে নিলেও বৃহস্পতি কিন্তু তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যই অভিশাপ দিলেন। বললেন, অচিরেই ইন্দ্র সব ক্ষমতা হারিয়ে ভিক্ষুকের মতোই ঘুরে বেড়াবেন। লাঞ্ছিত হবেন অসুর-দানবদের হাতে। হারাবেন সব মানসম্মান, মর্যাদা, সম্পদ ইত্যাদি সবকিছু। ইন্দ্র যে অভিশপ্ত হয়েছেন, একথা জানতে পারেন ইন্দ্রের জন্মশত্রু তারকাসুর। জানতে পেরেই উপযুক্ত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিন পুত্রকে স্বর্গ আক্রমণ করতে বলেন।
তারকাসুরের ওই তিন পুত্র তারকাক্ষ কমলাক্ষ ও বিদ্যুম্মালী পিতার নির্দেশ পেয়েই ইন্দ্রকে আক্রমণ করেন। ত্রিদেবের মতোই তারকাসুরের এই তিন পুত্রকে একসঙ্গে বলা হতো ত্রিপুরাসুর। কঠিন তপস্যার বলে তাঁরা ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন বিশেষ বর। একইসঙ্গে হয়েছিলেন লোহা, রুপা ও সোনা দিয়ে তৈরি তিনটি পুরীর অধীশ্বর। স্বভাব-বীর ত্রিপুরাসুর দৈববলে অপরাজেয় একথা জানতেন ইন্দ্র। সে কারণে তাঁরা স্বর্গ আক্রমণ করলে ইন্দ্র দেবসেনাদের অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যান। ইন্দ্রের এই কাপুরুষের মতো আচরণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন দেবাদিদেব মহেশ্বর। তাঁর কাছে আশ্রয়প্রার্থী দেবতাদের তিনি পাঠিয়ে দেন দধীচীর আশ্রমে। আর রাজা হয়ে কর্তব্য পালন না করার কারণে ইন্দ্রকে সিংহাসনচ্যুত করে তাঁর মর্যাদা এবং সব ক্ষমতা হরণ করেন। শুধু এটুকুই নয়, তিনি ইন্দ্রকে হত্যা করার জন্যও এগিয়ে আসেন। সেসময় ব্রহ্মা ও বিষ্ণু তাঁকে নিরস্ত না করলে শিবের হাতে সেদিন অবশ্যই মৃত্যু ঘটতো ইন্দ্রের। প্রাণ পেয়ে ইন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তিনি নন, তাঁর সব ক্ষমতার উৎস যে ঋষি, ব্রাহ্মণ, দেবতা এবং ত্রিদেব, এই সত্যটিও অনুধাবন করেন তিনি। কথা দেন, ভবিষ্যতে এমন ভুল তিনি আর কখনোই করবেন না।
ক্ষমতামত্ত ত্রিপুরাসুর
অহমিকার ফল কী হতে পারে তা বুঝলেন দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু তারকাসুরের পুত্রেরা ক্ষমতার আরকে হয়ে ওঠেন মাতাল। ব্রহ্মার বরে তারা এখন প্রায় অপরাজেয়-অমর। তবে ব্রহ্মার সেই বরে ছিল একটা ফাঁক। এক বিশেষ মুহূর্তে তাদের ওই তিনটি পুর একই রেখায় আসবে। সেই সময় কেউ যদি এক তিরে তিনটি পুরকে বিদ্ধ করতে পারেন, তাহলেই তাদের মৃত্যু হবে। অন্যদিকে তাদের শক্তির আরেক উৎস ছিল তাঁদের স্ত্রীদের ধর্মনিষ্ঠা। স্বামীদের জন্য তাঁরা করতেন নিয়মিত ব্রত পালন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের ওই ব্রতই যেন অক্ষয়কবচ হয়ে জড়িয়ে ছিল ত্রিপুরাসুরের দেহে। সেটাও ছিল তাঁদের অক্ষত থাকার একটা বড়ো কারণ।
ব্রহ্মার বর, স্ত্রীদের আনুগত্য ও ব্রতনিষ্ঠা- এই দুই রক্ষাকবচে ত্রিপুরাসুর
হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত। তাঁদের অত্যাচারে ভীতসন্ত্রস্ত তখন সকলে। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেবতারা তাই গেলেন শিবের কাছে। মিনতি জানলেন তাকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু ত্রিপুরাসুরের দুই রক্ষাকবচের কথা মনে করে শিব প্রথমে রাজি হলেন না। আর সেই সময় বিষ্ণু এবং সমস্ত দেবতা তাঁকে সবরকমভাবে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলে সম্মত হলেন শিব ত্রিপুরবধে।
প্রতিশ্রুতি মতোই বিষ্ণু অবতীর্ণ হলেন সুগত বুদ্ধ হয়ে। অপরূপ দেবোপম মূর্তি। মনোমোহন তাঁর রূপ। গৌরবর্ণ, কুঞ্চিত কেশদাম সুগতবুদ্ধ বিবস্ত্র অবস্থায় ধ্যানমগ্ন হলেন পথের ধারে এক বৃক্ষের নীচে।
ওই পথ ধরেই ত্রিপুরাসুরের স্ত্রীরা যান স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায়। সেদিনও যাচ্ছিলেন তাঁরা। যাওয়ার পথে দেখেন অনিন্দ্যসুন্দর ধ্যানমগ্ন যুবক সুগত বুদ্ধ। দেখামাত্রই তাঁদের ঘটল চিত্তবৈকল্য।
‘আহা মরি মরি, কী অপরূপ রূপমাধুরী।’ দেখামাত্র তাঁদের মন ধেয়ে যায় সেই ধ্যানমূর্তির দিকে। চিত্তে ডালপালা মেলে তাঁর সঙ্গে মিলনের তীব্র কামনা। অশান্ত হৃদয়ের কারণে ব্রত পালনে আসে শৈথিল্য। ঘটে বিঘ্ন। আর সে কারণেই দেবতাদের সঙ্গে সঙ্গে হারতে থাকেন ত্রিপুরাসুর। একসময় আসে সেই চূড়ান্ত সময়। ত্রিপুরাসুরের ত্রিপুর আসে একই রেখায়। সেই সন্ধিক্ষণে শিবের পিনাক ধনু থেকে নিক্ষিপ্ত হলো বাণ। এক বাণে বিদ্ধ হলো তিনটি পুর। নিহত হলো তারকাসুরের তিন পুত্র। আর কার্য শেষে বিষ্ণুর নবম অবতার সুগতবুদ্ধ আবার ফিরে গেলেন তাঁর স্বধামে।
বিষ্ণুর অবতার রূপে সুগত বুদ্ধের এই আবির্ভাবের কথা রয়েছে কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায়। সুগত বুদ্ধের সহায়তায় শিব ত্রিপুরাসুককে বধ করেছিলেন পূর্ণিমা তিথিতে। পৃথিবীতে আবার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তি ও ধর্মকে। তাই এই পূর্ণিমা তিথিটি ত্রিপুরারি পূর্ণিমা হিসেবে অভিহিত।
গৌতমবুদ্ধ
এতো গেল সুগত বুদ্ধের কথা। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ। যিনি সিদ্ধার্থ, শাক্যমুনি বা শুধুই বুদ্ধদেব নামে অভিহিত, তিনি হলেন ২৮তম
বুদ্ধ। সম্যক সম্বুদ্ধ বা তপস্বী এবং জ্ঞানী গৌতম বুদ্ধের উপলব্ধ সত্য ও তত্ত্বকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ মত।
সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা হলো মিথ্যাদৃষ্টি, অজ্ঞানতা, তৃষ্ণা, পুনর্জন্ম ও কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে পরম সুখ বা নির্বাণ লাভের জন্য প্রয়োজন সাধনার। অতি কৃচ্ছসাধন অথবা ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’-এর মতো প্রায় নীতিহীন সাধনার কথা তিনি বলেননি। মধ্যপন্থা ছিল তাঁর ধর্মসাধনার পথ।
এক কথায় বৌদ্ধমত হলো একটি দর্শন এবং সেই সঙ্গে একটি ধর্মমার্গ। চারটি আর্যসত্য এবং অষ্টমার্গ হলো বৌদ্ধমতের ভিত্তি। বৌদ্ধমতের মূল কথা হলো, দুঃখ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। জন্ম, মৃত্যু, রোগ ও কষ্টের মূলে রয়েছে দুঃখ। কাম, ঘৃণা ও মোহ হলো এই দুঃখের কারণ। এই দুঃখ থেকে মুক্তি ও পরম শান্তি লাভের পথ হলো নির্বাণ। সম্যকদৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক আচরণ, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি- বুদ্ধ নির্দেশিত এই আটটি উপায়কে এক কথায় বলা হয় অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এটাকেই বলা হয় বৌদ্ধমতের মূল ভিত্তি।
গৌতম বুদ্ধ জন্মেছিলেন হিন্দু পরিবারে। তাঁর সাধনা এগিয়ে চলে হিন্দুধর্ম নির্দেশিত পথেই। কিন্তু তাতে পান না শান্তি। পান না পরমের সন্ধানও। তখনই হয় এক বিশেষ উপলব্ধি। সেই পথেই লাভ করেন বুদ্ধত্ব। আর তারপরই বহু জটিলতায় ভরা কঠিন কৃষ্ণ সাধনার পরিবর্তে দেন সহজ সরল-ধর্মাচরণের পথের সন্ধান। সত্য-অহিংসা-সৎ জীবনযাপন এবং সৎ আচরণ হলো বৌদ্ধমতের মূল কথা।
বৌদ্ধমতের এই নীতিগুলি কিন্তু কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নয়। এগুলি হলো সর্বজনীন মানবিক ধর্মবোধের আদর্শ। এই আদর্শই সর্বকালের সমস্ত মানুষকে পরিণত করে প্রকৃত মানুষে। এই নীতিতে নিহিত সৎ-সুন্দর-সাম্য-সংহতির মধ্য দিয়েই মানুষ মিলিত হয় মানুষের সঙ্গে। এটাই হলো মহামানবের সাগরতীরে এক মহাজাতিতে পরিণত হওয়ার মহান জীবনদর্শন।
স্বদেশপ্রেমী বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু
দীপক খাঁ
কৃতিত্বের পিছনে আপনার অনুপ্রেরণা কী ছিল প্রশ্নের উত্তরে সত্যেন্দ্রনাথ সহজ সরল উত্তর দিয়েছেন- ‘আমরা যে সাহেবদের চেয়ে কম নই, তা দেখিয়ে দিতে হবে। সাহেবরা যা পারে, আমরা তা পারব না কেন?’ তিনি লিখছেন, ‘স্কুলের পড়া শেষ হয়নি, এসে পড়ল স্বদেশীয়ানার যুগ। কিশোর বয়সে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, রাখিবন্ধনের গান গেয়ে অনুভব করেছি, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলেই ভারতমায়ের সন্তান। দীন ভারতমাতার দুঃখ দূর করতে হবে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে হবে-বিদেশির শাসন ও শোষণ থেকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে পুরাতন ঐতিহ্যসম্পন্ন একটি মহাজাতিকে।’
ছাত্রাবস্থায় সত্যেন্দ্রনাথের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল অনুশীলন সমিতি এবং ওয়ার্কিং মেনস্ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে। অনুশীলন সমিতি যে ব্যায়ামগার পরিচালনা করত, তা ছিল গোপনে বিপ্লবীদের একটি কর্মকেন্দ্র। এই সমিতির উদ্যোগে ১৯০৯ সালে কলকাতার গোয়াবাগান অঞ্চলে যে ‘বয়েজ ওন লাইব্রেরি’ স্থাপিত হয়, সত্যেন্দ্রনাথ গোড়া থেকেই তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
‘ওয়ার্কিং মেন্স ইনস্টিটিউট’ ছিল কলকাতার মানিকতলায় দিনমজুরদের জন্য পরিচালিত একটি অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয়। রাত্রিবেলা হ্যারিকিনের আলোয় এখানে মজুরদের লেখাপড়া শেখানো হতো। সত্যেন্দ্রনাথ নিজেই কেবল এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেননি, তার একাধিক বন্ধুকেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এখানে শিক্ষকতা করার জন্যে।
বোস সংখ্যায়ন রচনার অল্পকাল পরে সত্যেন্দ্রনাথ যখন বিদেশ যান, নিজে মূলত তত্ত্ববিজ্ঞানী হলেও তখন ফ্রান্সে কয়েক মাস প্রথমে মাদাম কুরির ও পরে দ্য ব্রগলির সুপ্রসিদ্ধ পরীক্ষণাগারে কর্মরত ছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে স্বদেশ গবেষণাগার গড়ে তুলতে তাঁর এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করবার সময় সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি নির্মাণে তাঁর উৎসাহের অন্ত ছিল না। এই বিষয়ে তিনি স্বনির্ভরতার অত্যন্ত পক্ষপাতী ছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথের কাছে দেশপ্রেম কেবল ভাবাবেগের বিষয় ছিল না। তিনি মনে করতেন, দেশের ভালো-মন্দ সব কিছু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিচার-বিশ্লেষণ করে চললে তবেই দেশকে সত্যিকারের মঙ্গলের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাঁর কাছে ছিল দেশপ্রেম মানবপ্রেমেরই অপর নাম। মানুষের কল্যাণ সম্বন্ধে বিজ্ঞানের কাছে তাঁর আশা ছিল- বিজ্ঞান সহজে মিটাবে
মানুষের প্রতিদিনের চাহিদা, তার ফলে মনে জাগবে সন্তোষ, কুসংস্কার ঘুচে যাবে, পরিপূর্ণ জ্ঞানের আলোকে সত্যস্বরূপ খুঁজে পাবে মানুষ।
তিনি বলেছিলেন: ‘এটা ঠিক যে দেশ বলতে যদি দেশের লোককে বোঝায়, শুধুমাত্র শিক্ষিত বা নায়ক সম্প্রদায় না হয়, যদি মনে হয় দেশের সাধারণ মানুষই দেশ, তবে তারা শিক্ষিত হলেই তো সেই দেশকে উন্নত বলা যাবে’।
বাংলা ভাষায় সত্যেন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক লোকরঞ্জন রচনার প্রথম নিদর্শন ‘পরিচয়’ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিজ্ঞানের সংকট’ নামক প্রবন্ধ। বস্তুত ১৯২১ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা যাবার আগে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন, তখন প্রমথ চৌধুরী তাঁর সম্পাদিত ‘সবুজ পত্র’ নামক পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ে লেখবার জন্য সত্যেন্দ্রনাথকে বহুবার অনুরোধ করলেও তার এই বিষয়ে আশা পূর্ণ হয়নি। সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু হারীতকৃষ্ণ দেবকে একটি চিঠিতে প্রমথ চৌধুরী অভিমান করে লিখেছিলেন- ‘সত্যেনদাদা কাগজের উপর কালো আঁচড় কাটেননি, বোধহয় তিনি কালো বোর্ডের উপর সাদা আঁচড় কাটাকেই তাঁর স্বধর্ম বলে স্থির করে নিয়েছেন। ‘বিজ্ঞানের সংকট’ প্রবন্ধে সত্যেন্দ্রনাথ classical physics-এ সংকটের বিষয়ে আলোচনা করেছেন সহজ, সাবলীল ভাষায়। একদিকে আলো তথা সাধারণভাবে বিকিরণের, অন্যদিকে
ইলেকট্রনের তথা সাধারণভাবে বস্তুকণার যে দ্বৈত চরিত্রের কথা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জানা গেল- অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের রূপ ও বিচ্ছিন্ন কণার রূপ-যা সনাতনী পর্দায় বিদ্যার ভিতকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই প্রবন্ধ প্রকাশের পরে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘আইনস্টাইন’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠা করে তিনি বলেছিলেন-‘স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে, এই স্বাধীনতার যা কিছু সুফল তা যেন শুধু অল্পসংখ্যক শিক্ষিত লোকের আয়ত্তের মধ্যে না থেকে সেগুলি যেন দেশের লোকের সকলের কাছে পৌঁছে যায়।’