হিন্দু জাতীয়তাবোধের কেন্দ্র বঙ্গভূমি
সঙ্ঘশতবর্ষ পর্ব-২
ড. জিষ্ণু বসু
আধুনিক ভারতের নবজাগরণের কেন্দ্র ছিল পশ্চিমবঙ্গ। এই বঙ্গের মনীষীরা হিন্দু জাতীয়তাবোধকে নবজাগরণের হাতিয়ার করেছিলেন। হিন্দু ভাবনায় ভারতীয় জীবনযাত্রার মূল চালিকা শক্তি হিন্দু, হিন্দুত্ব কোনো উপাসনা পদ্ধতি নয় বরং এই দেশের মূল জীবনপদ্ধতি। এটিই সে যুগের বাঙ্গালি প্রবুদ্ধজনেরা তাঁদের রচনা, বক্তৃতা, কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে প্রকাশের প্রয়াস করেছিলেন।
১৮০৩ সালে ভারতের নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা পুরুষ রাজা রামমোহন রায় লিখেছিলেন ‘তওফাত-উল-মুওয়াহিদিন’ নামক ফার্সি ভাষায় পুস্তক। ফরাসি ভাষা সে যুগে খুবই সমৃদ্ধ ভাবা হতো। বহুদিন পরে আদি ব্রাহ্মসমাজ ১৮৮৯ সালে ইংরেজি ভাষায় বইটি অনুবাদ করে। রাজা রামমোহন রায় এই পুস্তকে দেখিয়েছিলেন যে একেশ্বরবাদ ভারতীয়দের কাছে নতুন কিছু নয়। তওফাত-উল-মুওয়াহিদিন নামের অর্থ হলো ‘একেশ্ববাদীদের জন্য উপহার।’ এই বইতে বেদ-উপনিষদের গভীর থেকে ‘একেশ্বরবাদ’ মানে ‘মনোথিজম’-এর উপাদান উপস্থাপন করেছিলেন।
মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি, নাটোর-সহ উত্তরবঙ্গে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন হবে এমনটাই ঠিক হয়েছিল ১৭৬১ সালের পূর্ণকুম্ভ মেলায়। প্রয়াগরাজের পূর্ণকুম্ভর সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে দশনামী নাগা সন্ন্যাসী সম্প্রদায় বঙ্গপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিলেন। ১৭৭১ সালে ১৫০ জন বিদ্রোহী সন্ন্যাসীকে কোম্পানি বিনা কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়। বৈকুণ্ঠপুর-সহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পণ্ডিত ভবানীচরণ পাঠক। ভগবদ্ভক্তি থেকে দেশভক্তির বিস্তার
বঙ্গপ্রদেশেই শুরু হয়েছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মাধ্যমে।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই বিদ্রোহের পটভূমিতেই তিনি তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ লিখলেন।
১৮৮২ সাল মানে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রায় শতবর্ষ পরে লেখা হলো আনন্দমঠ। এই আনন্দমঠ উপন্যাসেই তিনি দেশবাসীকে ‘বন্দেমাতরম’ গান উপহার দিলেন। মা, তোমাকে বন্দনা করি। দেশমাতৃকার চরণকমলে এক অনবদ্য অর্ঘ্য।
সংস্কৃত বন্দনার মাঝে নিপাট বাংলা ভাষার একটি লাইন, ‘তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।’ দেশমাতৃকার বর্ণনায় হিন্দুত্বই জাতীয়তা হয়ে উঠেছে। ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী/কমলা কমলদল বিহারিণী/বাণী বিদ্যাদায়িনী নমামি ত্বাম্…’। ভারতবর্ষকে মা দুর্গা, লক্ষ্মী ও দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তুলনা করলেন বঙ্কিম।
ভূদেব মুখোপাধ্যায় ১৮৫৭ সালে লিখেছিলেন ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’। বাংলা সাহিত্যে মরাঠা বীর হিন্দু পাদ পাদশাহি ছত্রপতি শিবাজীর প্রবেশ অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মাধ্যমে। বিহারে ফার্সি ভাষার পরিবর্তে হিন্দি প্রয়োগ
এবং হিন্দি স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
আরব তুর্কি বা উজবেক আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের প্রতিরোধ গল্প, উপন্যাস ও কাব্য কাহিনিতে উঠে আসতে থাকে। এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের
‘পদ্মিনী উপাখ্যান’। আলাউদ্দিন খিলজির নারীলোলুপতা, নিষ্ঠুরতা আর তার বিরুদ্ধে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে কীভাবে চিতোরের রানি-সহ সকল নারীপুরুষ প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন তার এক বেদনাবিধুর উপাখ্যান এই কাব্যকাহিনি। এই কাব্যকাহিনির দুটি পঙ্ক্তি পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়’- এই সরল অথচ শক্তিশালী দুটি কথা বঙ্গ তথা সারা দেশের যুব সমাজের মনে স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিল।
কলকাতায় হিন্দুমেলা শুরু হওয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। আজকের ভাষায় যাকে ‘গেম চেঞ্জার বলা হয়। রাজনারায়ণ বসু, নরগোপাল মিত্র, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন সব মনীষীদের হাতে সংঘটিত হিন্দুমেলা স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্বদেশী আন্দোলনে সঠিক অর্থে ছিল গেম চেঞ্জার। ১৮৬৭ সালে রাজনারায়ণ বসু ‘ন্যাশেনাল’ পত্রিকায় একটি অসাধারণ প্রবন্ধ লেখেন- প্রসপেক্টাম অব আ সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব ন্যাশেনাল ফিলিং এবং ‘দ্য এডুকেটেড নেটিভস অব বেঙ্গল।’ এই লেখাটির প্রেরণাতেই নবগোপাল মিত্র, মনমোহন বসু, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুররা সেই বছরই শুরু করলেন হিন্দুমেলা। কলকাতায় হিন্দুমেলায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সর্বাত্মক ভূমিকা ছিল। এই হিন্দুমেলাতে কবিতা, গান, কুটির শিল্প, স্বদেশী, আত্মরক্ষার প্রদর্শন সকলের সামনে প্রস্তুত হতো। ১৫ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দুমেলায় স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলেন। দিল্লি দরবার কবিতাটিও তিনি এখানেই পাঠ করেন। ইংরেজ সরকারের নির্মম শোষণ আর সেই অত্যাচার অবিচারকে চাপা দিয়ে দিল্লিতে ইংল্যান্ডের রাজরানিকে বরণের এলাহি ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতা উঠে এসেছে এই কবিতায়।
এই হিন্দুমেলা থেকেই প্রথমে ‘সঞ্জীবনী সভা’ এবং ধীরে ধীরে বিবর্তিত হতে হতে স্বদেশী আন্দোলনে পরিবর্তিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনের আগুন এই বঙ্গভূমি থেকে ধীরে ধীরে সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়।
ইংরেজ ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে সংস্কৃত শিক্ষার টোল প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে একটি সরকারি সিদ্ধান্তে ভারতবর্ষের এক বড়ো সংখ্যক মানুষ শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত বলে ঘোষিত হয়ে গেলেন। কেবলমাত্র ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর জন্য ইংরেজের কেরানি তৈরি করার শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। এর বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা।
সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরে শুরু করেছিলেন ভাগবৎ চতুষ্পাঠী। সতীশচন্দ্র ১৯০২ সালে ডন পত্রিকা এবং পরে ডন সোসাইটি তৈরি করেন। ১৯০৪ সালে বড়লাট কার্জন ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট চালু করেন। দেশীয় রাজা বা সংগঠনের প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তারপর যে ঘটনায় ইংরেজের কুমতলব প্রকাশ্যে আসে তা হলো বঙ্গভঙ্গ আইন। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিভাবান, প্রতিবাদী বঙ্গপ্রদেশকে ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
বঙ্গের জাতীয়তাবাদী মনীষীরা বোঝেন দেশের মানুষকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। ১৯০৫ সালের ১০ ডিসেম্বর পার্কস্ট্রিটে ‘ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি’-র বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দেড় হাজার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক, ব্রজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী ও অরবিন্দ ঘোষের মতো প্রবুদ্ধজনেরা। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় তৈরি হলো ‘বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’। স্থাপিত হয় বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ। বরোদা এস্টেটের মাসিক ৭৫০ টাকার চাকরি ছেড়ে অরবিন্দ ঘোষ এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। সামান্য বেতনে। অরবিন্দ ঘোষ অধ্যক্ষ থাকার সময়ই যুগান্তর, কর্মযোগিন ও বন্দেমাতরম্ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। আজকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রূপ সেই সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভাগবৎ চতুষ্পাঠী।
স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধীনে একটি মেডিক্যাল কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এই মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ব্যাচের ডাক্তারিতে স্নাতক হন। নাগপুর থেকে তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদে ডাক্তারি পাঠ পড়ার জন্য।
আসলে ডাক্তারি পড়াটা ছিল ছুতো। ডাঃ বালকৃষ্ণ মুঞ্জে কেশবরাওকে ডাক্তারি পড়তে কলকাতায় পাঠানোয় এই মরাঠি তরুণ বঙ্গের সশস্ত্র বিপ্লবীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। তিনি কলকাতায় পুলিনবিহারী দাসের অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন।
এই অনুশীলন সমিতির জন্ম হয়েছিল ১৯০২ সালে। পূর্ববঙ্গে ঢাকায় এই সংগঠনের নাম হয় অনুশীলন সমিতি। এপার বঙ্গে কলকাতাতে শুরু হয় যুগান্তর সমিতি। অনুশীলন সমিতির প্রতীক চিহ্নে লেখা ছিল রামায়ণের সেই বিখ্যাত সংস্কৃত শ্লোক ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী,’ সেই সঙ্গে নিজে ইংরেজি ভাষায় লেখা ছিল ‘অখণ্ড ভারত’। দেশের অগ্রগণ্য নেতৃত্ব ঢাকা অনুশীলন সমিতির পুলিনবিহারী দাসকে কলকাতায় সংগঠনের কাজ দেখভাল করার জন্য এখানে নিয়ে আসেন। এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিল শ্রীঅরবিন্দের অধ্যক্ষতায় জাতীয় শিক্ষা
পরিষদের মহাবিদ্যালয় শুরু হয়ে গিয়েছিল।
পুলিনবিহারী দাসের আত্মজীবনী ‘আমার জীবন কাহিনি’ গ্রন্থে তিনি তাঁর বিপ্লবী জীবনের গুরু প্রমথনাথ মিত্রের অনুশীলন সমিতির দীক্ষাদানের অনুষ্ঠানের বর্ণনা করেছেন। বিপ্লবী শিক্ষার্থী ও তাঁর গুরু দুজনই একদিন হবিষ্যান্ন খেয়ে প্রস্তুত হতেন। দীক্ষার দিনে সকাল থেকে উপবাস থেকে পুণ্যস্নান করে আসতেন। তারপর প্রমথনাথ মিত্র অপূর্ব জলদগম্ভীর স্বরে বেদমন্ত্র পাঠ করতেন। সেই বিপ্লবীরা ইংরেজ সরকারের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সে যুগে বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম বিদুষী নারী ছিলেন সরলাদেবী চৌধুরানী। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে লিখেছেন বীরাষ্টমী ব্রত পালনের কথা। ঠাকুর পরিবারের এই বীরাঙ্গনা বর্ণনা করেছেন বীরাষ্টমী ব্রতের মন্ত্রগুলি ‘বীরাষ্টম্যাং মহাতিথৌ পূর্ব পূর্বগতান বীরান/নমস্কর্য ভক্তিপূর্বং পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্।।
সানুজং শ্রীরামচন্দ্র, রঘুকুলপতিশ্রেষ্ঠম/বীরাষ্টম্যাং নমস্কর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্।।’
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের আশীর্বাদ নিয়ে বিপ্লবী জীবন শুরু করতেন বঙ্গের অগ্নিযুগের বীরেরা।
ভারতের নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল বঙ্গ। স্বদেশী আন্দোলনের জন্মভূমি এই বঙ্গদেশ। সশস্ত্র বিপ্লবের সুচনাক্ষেত্রও ছিল এই বঙ্গদেশ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হিন্দু ভাবনা থেকেই দেশভক্তির পাঠ নিতেন বঙ্গের মনীষীরা।
আধুনিক ভারতে ‘হিন্দুত্ব’ এই শব্দটিও প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন এক বাঙ্গালি মনীষী। তিনি চন্দ্রনাথ বসু। ১৮৯২ সালে তার লেখা ‘হিন্দুত্ব: হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস’ নামে একটি গ্রন্থের মাধ্যমে নতুন যুগের সূচনা করেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানে নিত্যপূজার আরাধ্যা জননী আর দেশমাতৃকা এক হয়ে গেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই ভিত্তিভূমি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই ভাবনা স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত ছিল।
‘চল সমরে দিব জীবন ঢালি, জয় মা ভারত জয় মা কালী’। তাই কেবলমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাব-আন্দোলন নয় উনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত বঙ্গের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার- ভিত্তিভূমি তৈরি করেছিল।
শিক্ষা হলো না পাকিস্তানের
দু’খানা টর্পেডোর আঘাতে ডুবে গিয়েছিল পাক সাবমেরিন পিএনএস গাজি
দুর্গাপদ ঘোষ
কথায় বলে ‘শত ধৌতেন অঙ্গারস্য মলিনত্বং ন মুচ্যতে’। একশোবার ধূলেও কয়লার মলিনত্ব ঘোচে না। পাকিস্তানও কয়লার মতো একটা দেশ যাকে বারবার পর্যুদস্ত করে শিক্ষা দিলেও তাঁর নোংরা মানসিকতা ঘোচে না। কুঁজোর যেমন মাঝে মাঝে চিৎ হয়ে শোবার বাসনা জাগে, তেমনি পাকিস্তানেরও অনবরত ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিগির ঠেলে ওঠে। অথচ তার আকার, আয়তন এবং মোট জনসংখ্যা ভারতের একটা অঙ্গরাজ্য উত্তরপ্রদেশের চাইতেও কম। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান বস্তুত একটা সন্ত্রাসবাদী দেশ। কখনো ‘হানাদার’, কখনো সন্ত্রাসবাদীদের সামনে রেখে দেশটা ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। নিরন্তর চড়-থাপ্পড় ছাড়াও অন্তত বার চারেক মোক্ষম আঘাতে ধরাশায়ী হবার পরও তার বদস্বভাব বদলাচ্ছে না। ১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে ভারত কীভাবে পাকিস্তানকে পিটিয়ে ছাল ছাড়িয়ে দিয়েছিল তা সবার জানা। এছাড়া ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর জঙ্গি হামলা চালানোর পরিণামে ওইবছরই ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক করে কীভাবে পাকিস্তানের কান মুচড়ে দিয়েছিল এখনও তা কেউ বিস্মৃত হয়নি। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, ‘স্বভাব যায় না মলে!’ বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ঘা শুকোতে না শুকোতেই গত ২২ এপ্রিল পহলগাঁওয়ে ফের জঙ্গি পাঠিয়ে ২৬ জন নিরীহ হিন্দু পর্যটককে হত্যা করেছে। পরিণতি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে এবং আরও কী কী ঘটতে পারে তা খোদ পাকিস্তনি মাতব্বররাও অনুমান করতে পারছেন। এই জঙ্গিস্তানের যে বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ ঘটেছে তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
পাকিস্তানের গায়ে বিগত ৭৬-৭৭ বছর ধরে সজারুর কাঁটার ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়া বহু রকমের ক্ষতচিহ্নের কথা এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। অবান্তর হলেও এখানে সে অবসর নেই। এমনকী ১৯৭১ সালে যা যা ঘটেছিল তার সবদিকেও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত যে, সেই যুদ্ধে তাদের নৌবহরের অন্তর্ভুক্ত একটা দূরপাল্লার সাবমেরিন ‘পিএনএস গাজি’র পরিণতির কথা। এ নিয়ে বিগত ৫৪ বছর ধরে অনেক আলোচনা হয়েছে। বলিউডে ‘গাজি অ্যাটাক’
পাকিস্তান এমন একটা
আগাছা যা ভাঙে তবু মচকায়
না। গাজি’র অকাল মৃত্যুর
কথা মানলেও ভারতের
হাতে ধ্বংসের কথা পাকিস্তান
কখনও স্বীকার করেনি। বলে
এসেছে অকস্মাৎ মাইন
বিস্ফোরণ ঘটে দুর্ঘটনার
কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
নামে একটা চলচ্চিত্রও নির্মাণ হয়েছে। তখন ভারতীয় নৌ-বাহিনীর শক্তি আজকের তুলনায় অনেক কম ছিল।
বিমানবাহী রণতরী বলতে ছিল একমাত্র আইএনএস বিক্রান্ত। আর এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বিক্রান্ত ও বিক্রমাদিত্য ছাড়াও আরও ১৩৩ খানা রণতরী রয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের নৌবহরে তাদের বৃহত্তম যুদ্ধজাহাজ এমএসসি আন্না-সহ কার্যশীল রণতরীর সংখ্যা হলো ৩৬ খানা। বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা শূন্য। পাকিস্তানের কাছে সংখ্যার হিসাবে যদিও ৮ খানা সাবমেরিন আছে কিন্তু উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে তার মধ্যে ২ খানা অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। বস্তুত বাতিল-স্ক্র্যাপ। আর পড়ে থাকা ৩ খানার তড়িঘড়ি মেরামতি শুরু করা হয়েছে। আপতত কার্যশীল রয়েছে ৩ খানা। পাকিস্তানের কাছে একখানাও পরমাণুচালিত ডুবোজাহজ নেই। অন্যদিকে ভারতীয় নৌবহরে সক্রিয় রয়েছে আইএনএস কালভারি, সিন্ধুঘোষ, অরিহন্ত ইত্যাদি নিয়ে মোট ১৬ খানা। তার মধ্যে ৩ খানা পরমাণু চালিত। বাকি ১৪ খানা ডিজেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রচলিত জ্বালানি চালিত। পাকিস্তানের সবগুলোই তাই। অর্থাৎ তুলনামূলক নৌশক্তিতে ভারতের সামনে পাকিস্তান নিতান্ত তালপাতার সিপাই, নিধিরাম। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের নেতারা দিনরাত থেঁতলে যাবার ভয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়া বিষধর সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে চলেছে।
অদূর ভবিষ্যতে সিন্ধুনদের জল শুকিয়ে পাকিস্তানের মাটি কাঠ হয়ে যাবে, না সিন্ধু নদ দিয়ে ভারতীয়দের রক্তস্রোত বইবে তা গোটা বিশ্ববাসী দেখতে পাবেন। কিন্তু এই মর্মে আস্ফালনকারী এক পাক নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো যেন ভুলে না যান যে তাদেরই আঁতুরঘরে তৈরি হওয়া সন্ত্রাসবাদীদের বিস্ফোরণে তার মা তথা তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়েছিল। যেন ভুলে না যান যে তাঁর মাতামহ তথা পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টো ১৯৭১ সালে ‘আমরা বাবরের বংশধর, ভারতের বিরুদ্ধে হাজার বছর ধরে লড়াই করে যাবো’ বলে আস্ফালন করার দু’ সপ্তাহের মধ্যে ভারতের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। বিলাওয়ালের মতো বালখিল্য পাক নেতারা যেন ভুলে না যান যে সেদিন তাঁদের নৌবাহিনীর একটা মোক্ষম অস্ত্র পিএন এস গাজিকে ভারতীয় নৌসেনারা কী কৌশলে বঙ্গোপসাগরের তলায় চিরকালের মতো সলিল সমাধি ঘটিয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। রণে ভঙ্গ দিয়ে দুহাতে সাদা পতাকা উঁচিয়ে আত্মসমর্পণ করার মাত্র ১৩ দিন আগের কথা। সন্ধ্যে ৬টার সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশকে জানালেন যে পাকিস্তানি বিমানবহর অকস্মাৎ অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, যোধপুর, আম্বালা ও আগ্রায় বোমা বর্ষণ করেছে। তখন জল, স্থল ও আকাশ-তিন ক্ষেত্রেই মার্কিন রণসম্ভারে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তান সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ভারত ছিল মুখ্যত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্রনির্ভর। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে ওই ৩ ডিসেম্বর থেকে সরকারিভাবে যুদ্ধ শুরু হয়। তবে তার দিন পনেরো আগে থেকে পাকিস্তান ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিল। স্থল ও বিমানবাহিনীকে সামনে রেখে জলের তলা দিয়ে তলে তলে এগিয়ে আসছিল তাদের সবচাইতে বড়ো ও সবচাইতে দূরপাল্লার ডুবো জাহাজ পিএনএস গাজি। ২৭ নভেম্বরের মধ্যে তা এসে ঘাঁটি করে বসে ভারত মহাসাগর থেকে ভারতের প্রধান নৌবন্দর বিশাখাপত্তনমে প্রবেশ পথের ৫-১০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে। টর্পেডো ও মাইন নিয়ে তাক করতে থাকে তখন ভারতের একমাত্র বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে ধ্বংস করে দেবার জন্য। সেই সঙ্গে ভারতের জলসীমার বাইরে দিয়ে এগিয়ে আসছিল পাকিস্তানের ৪ খানা ছোটো যুদ্ধজাহাজও। যদিও ভারতের নৌবহরও সক্রিয় ছিল এবং পাকিস্তানের নৌশক্তির তুলনায় ছিল যথেষ্ট শক্তিশালীও। কিন্তু পাক সামরিক কর্তাদের ধারণা ছিল আমেরিকার কাছ থেকে লিজে পাওয়া এবং দ্রুত আক্রমণে সক্ষম ওই সাবমেরিন থেকে আইএনএস বিক্রান্তকে ধ্বংস কিংবা অকেজো করে দিতে পারলে তাঁরা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারবেন, যুদ্ধটা পাকিস্তানের পক্ষে চলে আসবে। কারণ নৌশক্তিতে ভারত অনেকখানি এগিয়ে থাকলেও তাঁদের বিমানবাহিনীতে রয়েছে আমেরিকার কাছ থেকে পাওয়া অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-১৫ এবং এফ-১৬। অন্যদিকে ভারতের হাতে রয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে পাওয়া যুদ্ধবিমান মিগ-২১ এবং খুব ছোটো ও কম শক্তিশালী যুদ্ধবিমান ‘ন্যাট’। তাছাড়া তখন বিশ্বের সবচাইতে বড়ো শ্যাফি ট্যাঙ্কও ছিল পাকিস্তানের হাতে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমেরিকার কাছ থেকে পাওয়া প্যাটন ট্যাঙ্ক নিয়েও পাকিস্তানকে ল্যাজেগোবরে হতে হয়েছিল। সেজন্য ১৯৭১ সালে আমেরিকার কাছ থেকে কিনেছিল চাকায় মোটা রবারের টায়ার লাগানো দৈত্যাকার শ্যাফি ট্যাঙ্ক। রবারের টায়ার থাকায় যা চলার সময় খুব কম আওয়াজ হতো। কিন্তু এখন থেকে ৫৪ বছর আগেও পাকিস্তানি রণপিপাসুরা বুঝতে পারেনি যে যুদ্ধটা কেবল রণসম্ভারের কিম্বা অস্ত্রবলে জেতা যায় না। আজকের দিনে যুদ্ধ হয় বুদ্ধিমত্তায়, প্রযুক্তিগত কৌশলে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে। যেসব ক্ষেত্রে ভারত এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাছাড়া এখন ভারতের কাছে রয়েছে শতাধিক নিজস্ব উপগ্রহ। যেখানে পাকিস্তান এখনও চীন-সহ অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। এখন আর ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে যেমন যুদ্ধ জেতা যায় না, তেমনি ভাড়া করা প্রযুক্তি নিয়েও নয়।
পিএনএস গাজি-র ওপর পাকিস্তান যত বেশি নির্ভর করেছিল তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি মাত্রায় সক্রিয় ছিল ভারতের নৌ-গোয়েন্দাদের প্রযুক্তি কৌশল। ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার পর থেকেই পিএনএস গাজি-র সংকেত বার্তা ধরে ফেলতে থাকে ভারতীয় নৌবাহিনীর মেরিন
রাডার। পাকিস্তানকে বিভ্রান্ত করার জন্য নৌবাহিনীর কর্তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আইএনএস রাজপুত নামের একখানা প্রায় জংধরা ডেস্ট্রয়ার (যুদ্ধ জাহাজ)-কে ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে অনবরত সংকেত পাঠিয়ে যেতে থাকেন। যাতে পাকিস্তানের স্থির বিশ্বাস জন্মে যে ‘রাজপুত’-এর অবস্থানেই আইএনএস বিক্রান্ত রয়েছে। উপগ্রহ না থাকায় পাকিস্তানের পক্ষে বিক্রান্তের সঠিক অবস্থান এবং গতিবিধি জানা সম্ভব ছিল না। ফলে ভারতের এই কৌশলে ফাঁদে পড়ে যায় পাকিস্তান। বিক্রান্ত বিশাখাপত্তনমের আশেপাশে রয়েছে ধরে নিয়ে পাক সাবমেরিন গাজি ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে এগিয়ে আসতে থাকে। এদিকে বিক্রান্তকে চুপিসারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এমন এক দিকে যা ছিল পাকিস্তানের ধারণার বাইরে। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে।
ডিসেম্বরের একেবারে গোড়ার দিকে ভারতের নৌ-গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়ে যান যে ‘গাজি’ চেন্নাই ও বিশাখাপত্তনমের মাঝামাঝি কোথাও জলের তলায় লুকিয়ে আছে। ইতমধ্যে ১ ডিসেম্বর ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণন যিনি তখন ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন, পরিকল্পিতভাবে এমন কিছু সংকেত পাঠান যাতে গাজি’র পরিচালকের নিশ্চিত ধারণা হয়ে যে তারা আইএনএস বিক্রান্ত-এর সন্ধান পেয়ে গেছে। সেই সংকেতবার্তা ছিল এই রকম যে ডেস্ট্রয়ার রাজপুত-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত লেঃ কমান্ডার ইন্দর সিংহ যেন বিক্রান্তকে সরিয়ে নিয়ে যান। বলা বাহুল্য, ‘রাজপুত’ নামের ওই ডেস্ট্রয়ারকে তখন ‘বিক্রান্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ঝুঁকির ছিল। বিশেষ করে তখন রাজপুত-এ মোতায়েন ছিলেন ১০ জন নেভি অফিসার-সহ ২৫০ জন নাবিক। কিন্তু ইন্দর সিংহ দৃঢ়ভাবে জানিয়ে ছিলেন যে তিনি এই চ্যালেঞ্জটা নিতে প্রস্তুত। সেইমতো ‘রাজপুত’-কে তিনি বিশাখাপত্তনম নৌঘাঁটি থেকে ১৬০ নটিক্যাল মাইল দূরে সরিয়ে নিয়ে যান। সেই সময় রাজপুত-এর ওয়ারলেস ফ্রিকোয়েন্সির ভল্যুম অনেকটা বাড়িয়ে দেন। যাতে পাকিস্তানের মনে হয় ‘বিক্রান্ত ‘পিএনএস গাজির কাছে এগিয়ে আসছে। সাপে-নেউলের মতো এই লুকোচুরি খেলার পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্বালানি ভরে এবং অন্তত ২০ দিনের মতো খাবারদাবার মজুত করে রাত ১১টার সময় ‘নেউল’ রাজপুত ভাইজাগ থেকে রওনা দেয়। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টর্পেডো এবং মাইন-এ পেট মোটা করে থাকা ‘সাপ’ গাজির সংকেত বার্তার ফ্রিকোয়েন্সি ধরে ফেলে। নিখুঁত অবস্থান সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই রাজপুত থেকে দু’দুটো টর্পেডো ছোড়া হয় এবং তা তীব্রগতিতে ছুটে গিয়ে গাজি-তে আঘাত করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রের গভীরে বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যায়। কিছুটা জল তোলপাড় হয়ে ওপরে উঠে আসে। ১১ জন পাক নেভি অফিসার এবং ৮২ জন নাবিককে নিয়ে সলিল সমাধি ঘটে সেই সময় পাকিস্তানের সবচাইতে বড়ো এবং সবচাইতে ভরসার সাবমেরিন পিএনএস গাজি’র।
এই মেরিন এনকাউন্টারের দু’দিন পরে আইএনএস অক্ষয় থেকে কয়েকজন ডুবুরিকে অনুসন্ধানের জন্য সমুদ্রে নামানো হয়। তাঁরা সমুদ্রতলে গিয়ে দেখেন পাকিস্তানি আস্ফালনের এক বড়ো প্রতীক ‘গাজি’ সেখানে বিধ্বস্ত অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। তার খেল খতম হয়ে গেছে। কিন্তু ঘটনা হলো, পাকিস্তান এমন একটা আগাছা যা ভাঙে তবু মচকায় না। গাজি’র অকালমৃত্যুর কথা মানলেও ভারতের হাতে ধ্বংসের কথা পাকিস্তান কখনও স্বীকার করেনি। বলে এসেছে অকস্মাৎ মাইন বিস্ফোরণ ঘটে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
একটি মেয়ের কুড়িটি চিঠি
মৃত্যুপুরীর সঞ্জীবনী
একটি মেয়ে ৩৭ বছর বয়স। এখন সে পরিণত। এটা বুঝতে পারার জন্য যে মাত্র ৬ মাস বয়সে যখন সে মাতৃহারা হয়, যখন তার মায়ের ৩১ বছর বয়স। কী মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কষ্ট পাচ্ছিল তাঁর মা। তিনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন আর শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী সেই দেশের সবথেকে শক্তিশালী মানুষটিকে। সেই মানুষটি এই ৩৭ বছরের মেয়েটির বাবা সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাধিনায়ক জোসেফ স্ট্যালিন।
দ্বিতীয় পর্ব
পিন্টু সান্যাল
নিজেকে সোভিয়েত রাশিয়ার একনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্তালিন একে একে তার এক সময়ের সঙ্গীদের সরাতে থাকেন। স্তালিনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ব্যর্থতার দায় দেওয়া হয় বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি আধিকারিক, পার্টির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী, বিভিন্ন লেখক, ইঞ্জিনিয়ার, যৌথ খামারের ম্যানেজারদের উপর। ‘দি গ্রেট পার্জ’ বা শুদ্ধীকরণের নামে সমাজের সর্বস্তরে নেমে আসে স্তালিনের দণ্ডাদেশ-হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের গুলাগ ক্যাম্পে নির্বাসন বা গুলি করে হত্যা।
এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ব্যর্থতার প্রভাব স্তালিনের দাম্পত্য জীবনেও পড়েছিল আর তারই জমে ওঠা বিষবাষ্প তাঁর মা-কে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল, এমনটাই মত শ্বেতলানার। শ্বেতলানার মাতামহ সের্গেই আলিলুয়েভা ছিলেন একজন রেলওয়ে কর্মী। তিনি বলশেভিক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তথাকথিত বিপ্লবের পূর্বে ভ্লাদিমির লেনিন এবং জোসেফ স্তালিন-সহ অনেক বলশেভিককে তাঁদের পরিবার আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছিল। সেই সূত্রেই শ্বেতলানার মায়ের সঙ্গে স্তালিনের প্রেম ও বিয়ে।
১৯৩১-এ নাদেঝদা’র বয়স ৩১। রসায়ন বিভাগের এক নতুন শাখা ‘সিন্থেটিক ফাইবার’ নিয়ে পড়াশোনা করছেন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাকাডেমি’-তে। নাদেঝদা কখনোই চায়নি সোভিয়েত রাশিয়ার ‘ফার্স্ট লেডি’ হতে। খুব সাধারণ ছিল তাঁর চাওয়া- অন্য দুই বান্ধবীর মতোই একজন টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করবেন। স্তালিনের থেকে
২২ বছরের ছোটো, স্তালিনের প্রথম স্ত্রীর ছেলে ইয়াকভের থেকে মাত্র ৭ বছরের বড়ো শ্বেতলানার মা। ১৯২৮ সালে ইয়াকভ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকে মানসিক শক্তি জোগান তার বিমাতা কিন্তু নিজের ছেলের প্রতি স্তালিনের শ্লেষ- ‘Ha! He couldn’t even shoot straight!’ (‘হাঃ! ও সোজাসুজি একটা গুলিও করতে পারল না!’)
স্তালিনের সমস্ত ব্যর্থ সম্পর্কের খামতিগুলো ভরাট করার দায়িত্ব শ্বেতলানার মায়ের। ইয়াকভের আত্মহত্যার চেষ্টা হয়তো নাদোদাকেও স্তালিনের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোর প্রতি তৈরি হওয়া এক অস্বাভাবিক পরিবেশ থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। মায়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শ্বেতলানা লিখেছেন- ‘ইয়াকভের শরীরে গুলির সেই আঘাতটি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুও হয়তো ছিল সেই গুলিটির শব্দেরই প্রতিধ্বনি। ইয়াকভআমায় এবং আমার মায়ের অভিভাবকদের খুবই ভালোবাসতো। আমার মাকে তো সে খুবই ভালোবাসতো ও শ্রদ্ধা করত।’
শ্বেতলানা তাঁর মাসি অ্যানা রেডেন্স-এর থেকেও সত্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন- ‘সম্প্রতি আমার মায়ের বোন অ্যানা আমায় বলেছেন যে তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলিতে বাবাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গভীরভাবে চিন্তা করতেন আমার মা। আমার মাসিমা অ্যানা প্রায়ই আমায় বলতেন যে বাবার কারণে দীর্ঘদিন ধরে নানা যন্ত্রণা সহ্য করে শেষপর্যন্ত প্রাণত্যাগ করেন আমার মা। বাবা ছিলেন অত্যন্ত নির্মম ও কঠোর। মায়ের মনে বাবার প্রতি নিখাদ প্রেম ও ভালোবাসা থাকলেও মায়ের ইচ্ছা ও অনুভূতির কোনো মূল্য বাবার কাছে ছিল না। এই কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আমার মা।’
খুব সাধারণ জীবনযাপন চেয়েছিল নাদেঝদা (Nadezhda Sergeyevna Alliluyeva)। নিজের অল্প বয়সের প্রেমের সুন্দর পরিণতি চেয়েছিল। কিন্তু মার্কসবাদে দীক্ষিত এক বলশেভিক স্বৈরাচারীর সঙ্গে ঘরবাঁধা কতটা কঠিন তার প্রমাণ রেখে গেছেন নাদেঝদা। শ্বেতলানার বাড়ির নার্স, রক্ষী সবার বক্তব্য মিলে যায় নাদিয়ার বান্ধবী পলিনা মলোটভের সঙ্গে। স্তালিন পলিনা মলোটভকে কাজাখস্তানে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। ১৯৫৫ সালে ফিরে এসে সে শ্বেতলানাকে জানায়- ‘তোমার বাবা তাঁর সঙ্গে খুবই ভয়ংকর আচরণ করতেন। তার সঙ্গে তিনি একটি অত্যন্ত কঠিন জীবন যাপন করতেন। সকলেই এই সম্পর্কে জানত।’
মার্কসবাদ বলে, পরিবার হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটা রূপ। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী পরিবার হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম একক। ভালো পরিবারের সমষ্টি দিয়েই ভালো সমাজের নির্মাণ হয়। স্তালিন সোভিয়েত রাশিয়াকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ল্যাবরেটরি করতে গিয়ে পুরো সমাজকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, তার নিজের পরিবার সেই আঘাত সমানভাবে সহ্য করেছে। স্তালিনের স্বৈরাচারী মনোভাব শুধু সরকার চালানোর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, স্বৈরতন্ত্রের শিকার হয়েছে তার পরিবার ও পরিচিতদের সকলেই।
স্তালিনের সঙ্গে বিয়ের পর সহজ-সরল নাদেঝদার জীবনে বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ের গুরুত্ব বেড়ে যায় শুধুমাত্র তাঁর ভালোবাসার মানুষটির টানে। তথাকথিত অক্টোবর বিপ্লবের পর থেকে সোভিয়েত রাশিয়ায় যেমন বদল শুরু হয়েছিল, নাদেঝদাও স্কুলের ছাত্রী থেকে স্তালিনের দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে পরিবর্তিত হলেন।
স্তালিন-নাদেঝদার জীবনের বৈপরীত্য বোঝাতে গিয়ে শ্বেতলানা বলেছেন- ‘সে তার ভাগ্যটাকে তার সঙ্গে জুড়ে দিল, যেন একটি ছোট্ট পালতোলা নৌকা বিশাল সমুদ্রগামী স্টিমারের আকর্ষণে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই আমি তাদের দেখি- উত্তাল মহাসাগরে পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কতক্ষণ সেই ছোট্ট নৌকাটি সমুদ্রগামী জাহাজের সঙ্গে তার মিলিয়ে চলতে পারবে? তা কি প্রচণ্ড ঢেউ সামলে টিকে থাকতে পারবে, নাকি এমন তরঙ্গের আঘাতে উলটে যাবে, যা সেই বিশাল জাহাজের কাছে কিছুই নয়?’।
সেই ছোট্ট পালতোলা জাহাজটি সত্যিই উলটে গিয়েছিল, স্তালিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সুনামিতে। কত পরিবার ভেসে গিয়েছিল, কত শিশু মাতৃহারা-পিতৃহারা হয়েছিল, কত নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল কমিউনিজমের নামে।
স্তালিনের জীবদ্দশায় তার জীবন কখনোই স্বাভাবিক ছিল না, নিজের পিতার মৃত্যুর পর তার জীবন থেকে যেন পাথর সরে গিয়েছিল, সে যেন মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পেরেছিল- এ কথা কমিউনিস্টদের নায়ক স্তালিনের নিজের মেয়ের কথায়-
‘এক কথায়- বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন আমার জীবনও স্বাভাবিক থাকতে পারত না। বর্তমানে আমি যতখানি স্বাধীন, ততখানি স্বাধীনতা কি আগে কোনোভাবে আমি পেতাম? অনুমতি ছাড়া ইচ্ছামতো যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম? আমার পছন্দের কারও সঙ্গে দেখা করতে বা বন্ধুত্ব করতে পারতাম? আমার সন্তানেরা স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠেছে। তারা কি এখনকার মতো কোনো নজরদারি ছাড়া স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারত? এখন আমরা সকলে স্বাধীনভাবে
শ্বাস নিতে পারি। আজ যেন আমাদের বুকের উপর থেকে একটি জগদ্দল পাথর সরে গিয়েছে।’
সোভিয়েত রাশিয়ার বুক থেকে স্তালিন নামক পাথর সরার আগে লক্ষ লক্ষ কৃষক অনাহারে মরেছে, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত থেকেছে সবসময়। শ্বেতলানার আত্মকথায় সেই অজানা অচেনা মানুষদের প্রতিও সমবেদনা উঠে এসেছে আর উঠে এসেছে আলিলুয়েভা পরিবারের প্রত্যেকের করুণ পরিণতির কথা যার জন্য দায়ী তাঁর পিতা স্তালিন।
এত প্রিয়জনের মৃত্যুর বর্ণনা দিতে দিতে যে নিজেই মানসিক ভারাক্রান্ত। তিনি পাঠকদের জানাচ্ছেন- ‘তুমি সম্ভবত এখন ক্লান্ত, বন্ধুবর, আমি যে অগণিত মৃত্যুর কথা তোমাকে বলে চলেছি তা শুনতে শুনতে। আমি কি একটাও এমন মানুষকে চিনতাম যার জীবন ভালোভাবে কেটেছে? যেন আমার বাবা এক অন্ধকার বৃত্তের কেন্দ্রে ছিলেন, আর যে কেউ সেই বৃত্তের ভেতরে প্রবেশ করলেই হারিয়ে যেত, মারা যেত বা কোনো না কোনোভাবে ধ্বংস হয়ে যেত’। শ্বেতলানার স্মৃতিকথা প্রকাশিত হওয়ার এত বছর পরেও কমিউনিস্ট নামে পরিচিত কিছু মানুষ দাবি করেন এই কালো বৃত্তের মাঝখানে থাকা মানুষটিই নাকি পৃথিবীকে সাম্যবাদের দিশা দিতে পেরেছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ইঙ্গিতে বাড়ছে উদ্বেগ
অর্ণব কুমার দে
সম্প্রতি বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশ্বে এই অর্থনৈতিক মন্দা গত শতাব্দীতেও দেখা গেছে। অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, তাই এই মন্দার প্রভাব সমাজে প্রতিফলিত হলেই রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। প্রথমে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে এর প্রভাব দেখা যায়, আর বিশ্বায়নের যুগে অন্য দেশও জড়িয়ে পড়ে। তবে যেকোনো একটি দেশ, অর্থনৈতিক মন্দায় পড়লে আজকের বিশ্ব অর্থনীতিতে খুব সমস্যা সৃষ্টি করে না। এই দশকেই গ্রিস অর্থনৈতিক মন্দায় পড়লেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকে সামাল দিয়ে দেয়। কিন্তু সমস্যা হয় যখন বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বেশ কিছু দেশ এক সঙ্গে মন্দার শিকার হয়। বর্তমানে ফের সেরকম সম্ভবনার উদয় হয়েছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক কী ধরনের বিপদ আসন্ন।
একটি দেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা সেই দেশের ম্যাক্রো-অর্থনীতি দিয়ে বোঝা যায়। কিন্তু এই ম্যাক্রো-অর্থনীতির শিকড়ে থাকে মাইক্রো-অর্থনীতি। তাই সেখান থেকেই বুঝতে হবে বড়ো চিত্রটি কীরকম। বিশ্বে এখন প্রায় আটশো কোটির বেশি লোক বসবাস করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টির মূল কারণ। মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের বৃদ্ধি ঘটে। ছোটোবেলার সেই পাটিগণিতের অঙ্ক, এক ব্যক্তি একটি কাজ দশদিনে করলে, পাঁচ ব্যক্তি কতদিনে করবে? ঠিক সেই তত্ত্বে মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি, উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু অর্থনীতিতে আরও একটি তত্ত্ব রয়েছে- ল’ অব ডিমিনিশিং রিটার্ন, যে তত্ত্বের ফাঁদে পড়ে বিশ্ব এই আর্থিক মন্দার কবলে পড়েছে।
ল’ অব ডিমিনিসিং রিটার্ন তত্ত্বটি হলো, এক বিঘা জমির উপর একের জায়গায় পাঁচজন কাজ করলে উৎপাদন বেশি হয়, কিন্তু লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটালে বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। একটা ফ্যাক্টরিতে একশো লোকের বদলে তিনশো লোক নিযুক্ত করলেই বেশি উৎপাদন হবে না, উলটে ফ্যাক্টরিতে লাভ হ্রাস পাবে, কারণ বেশি কর্মীর সম্মিলিত বেতন লভ্যাংশে ভাগ বসাবে।
আর একটি দিক হলো consumption বা ক্রয় ক্ষমতা, যার কিনা একটি সীমা আছে। ক্রয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হলো বিক্রয়, তারও একটি স্যাচুরেশন আছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে, তেমনি একই কাজে বহু সংস্থা থাকায় তাদের সংস্থার লভ্যাংশের হ্রাস ঘটেছে। সেই লভ্যাংশ বাড়াতে বিজ্ঞাপনের খরচ বেড়েছে, তাতে আরেক প্রস্থ লভ্যাংশের হ্রাস পেয়েছে। সেই খরচ মেটাতে মূল্য বৃদ্ধি করতে হয়েছে আর তার ফলে বাজার দর চক্রাকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ রাসায়নিক দ্রব্যের দাম বৃদ্ধিতে, সার প্রস্তুতকারী সংস্থার উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, তার ফলে কৃষক বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হয়েছে। কৃষকের ফসল উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই উৎপাদিত ফসল কিনতে গিয়ে রাসায়নিক ফ্যাক্টরির কর্মীকে বেশি দাম দিতে হয়েছে, ফলস্বরূপ সে বেতন বৃদ্ধির দাবি করেছে। এভাবেই বাজার চক্রবৃদ্ধিহারে অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে।
এভাবে চললে অসুবিধা কোথায়? সমস্যা হলো মানুষের জন্মানোর হার হয় জ্যামিতিক অগ্রগতিতে অর্থাৎ ২, ৪, ৮ অনুপাতে। কিন্তু কৃষি উৎপাদনের হার গাণিতিক অগ্রগতিতে বাড়ে যেমন ১, ২, ৩। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের হার গণনার ক্ষেত্রে রয়েছে একটি সূচক-‘ইনডেক্স অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন’। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি জনসংখ্যা
পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ হলো- জনসংখ্যার বিস্ফোরণ এবং বিভিন্ন শিল্পে প্রবল প্রতিযোগিতা। সে কারণেই আজ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বা কৃষি উৎপাদন হারের মতো নির্দিষ্ট নয়। শিল্প উৎপাদন কত শতাংশ বৃদ্ধি বা হ্রাস পেল তা প্রতি বছর গণনা করা হয়ে থাকে। আজকের যুগে স্বয়ংক্রিয় মেশিনারির ফলে উৎপাদনের হার বেড়েছে কিন্তু তাতে শ্রমিক নিযুক্তির হার কমেছে। তাই পরিবার পিছু বা মাথা পিছু ক্রয়ক্ষমতা সেই অনুপাতে বাড়ে না। এই কারণে বামপন্থীরা নাকি কম্পিউটারের বিরোধিতা করেছিল। সে যুক্তির প্রতিযুক্তি হলো তাহলে বৈদ্যুতিক সংযোগ না করে রাস্তার লাইট জ্বালাতে একটি করে লোক নিয়োগ করলেই ভালো। বস্তুত বিজ্ঞান কখনো থেমে থাকে না, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঘটতে থাকে নিরন্তর। বিজ্ঞান অনবরত এগিয়ে যেতে থাকে। আর তার ভালো-খারাপ নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উপর। আর একটি দিকে ওই বামপন্থীরা বলবেন পুঁজিবাদীরা সব লভ্যাংশ নিয়ে নেওয়া ও পুঁজিবাদী সরকার তাতে মদত দেওয়ার জন্য এই মন্দা সৃষ্টি হয়েছে। সে যুক্তি খুব সঙ্গত নয়। একটা উদাহরণ দেখা যাক। এক কৃষকের এক বিঘা জমির উৎপাদন যদি তার চার পুত্রের ভিতর ভাগ হয় তাহলে কোনো পুঁজিপতির শোষণ ছাড়াও সেই পুত্রদের উপার্জন এক-চতুর্থাংশে নেমে যায়। আর এটাও দেখা গেছে সোভিয়েত রাশিয়ার ৭৪ বছরের বামপন্থা-নির্ভর অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, তাই পুঁজিবাদী অর্থনীতি আর পুঁজিপতি তত্ত্ব যে খুব গ্রহণযোগ্য, তা বলা যায়
না।
পৃথিবীতে এখন এই অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ হলো- জনসংখ্যার বিস্ফোরণ এবং বিভিন্ন শিল্পে প্রবল প্রতিযোগিতা। সে কারণেই আজ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিগত তিরিশ বছরে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের অভাব, প্রাকৃতিক উৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যা বিপুল হওয়া এবং বিশ্বের বহু দেশে অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় এই বিপদ দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলির অর্থ উপার্জন কমে এবং প্রগতিশীল দেশগুলিতে তারা বিভিন্ন কাজ আউটসোর্স করতে থাকার ফলে প্রথম সারির দেশগুলিতে প্রশাসনিক আধিকারিক, কর্মচারী ও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের কপালে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার নিযুক্ত বহু কর্মচারীকে কর্মচ্যুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে শোনা গেছে। ইউরোপীয় দেশগুলি ফ্রি ট্রেড চুক্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এটিও একটি দ্বিদেশীয় উৎপাদন তত্ত্ব। একটি দেশ দুটির বদলে একটি জিনিস উৎপাদন করবে ও রপ্তানি করবে এবং অন্য দেশ থেকে অন্য একটি জিনিস আমদানি করবে যা কিনা দ্বিতীয় দেশটির প্রতুল্য দ্রব্য। সেখানে বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা হবে অর্থাৎ আমদানি রপ্তানির ফলে দুই দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বেশি অপব্যয় করবে না।
বিষয়টি শুরু হয় বেশ আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বহু দেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু সেই সময় তারা ছিল গরিব দেশ বা তৃতীয় বিশ্বের দেশ। সেসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলি এই নতুন দেশগুলিতে দ্রব্য রপ্তানি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে থাকে। সস্তা উৎপাদনের স্বার্থে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা এই তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিনিয়োগ করে। তাদের উৎপাদন কায়দা শিখে, নব্বই দশক নাগাদ বহু দেশীয় বস্তু তৈরি শুরু হতে থাকে। তখন মার্কিনি-ইউরোপীয়রা দেখেন প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে লাভ কম হচ্ছে, সে কারণে তারা ‘দ্য জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন টারিফস্ অ্যান্ড ট্রেড’ বা ‘গ্যাট’- নামক এক চুক্তিপত্র তৈরি করে। ১৯৯৪ সালে ভারত-সহ ১২৮টি দেশ তাতে স্বাক্ষর করে। তৈরি হয় ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন। এই চুক্তি অনুযায়ী এই দেশগুলি একে অপরের দেশে বাণিজ্য করতে পারবে। পশ্চিমি দেশগুলি ভেবেছিল তাতে তাদের ব্যবসা বাড়বে। তদানীন্তন দুর্বল সরকারের দরুন ভারত এই চুক্তিতে ব্যাপকভাবে লাভবান না হলেও চীন তার মিলিটারি কমিউনিজম দিয়ে সস্তার উৎপাদন করিয়ে বিশ্ববাজার থেকে প্রভূত লাভবান হয়।
বিগত ১১ বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নীতিতে নানা পরিবর্তন আসায় এই চুক্তিতে লাভবান হয়েছে ভারতও। এছাড়াও রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ ও ওপেক দেশগুলি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হয়। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার একত্রীকরণের ফলে ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘ব্রিকস’ দেশগোষ্ঠী। পাশ্চাত্য
দেশগুলি সেভাবে লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায় তারা রাজনৈতিক ভাবে সেই বিষয়টির মোকাবিলা করতে থাকে। তারা অর্থ ঢেলে বিভিন্ন দেশে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, যাতে পুতুল সরকার বসিয়ে সেই দেশগুলিকে ‘ব্রিকস’ দেশগুলির পণ্য কেনা থেকে বিরত রাখতে পারে। তার পালটা জবাবে চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রোজেক্ট’ দিয়ে ছোটো দেশগুলিকে কবজা করতে থাকে। তার উপর পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অনলাইন সেল বেড়ে গিয়ে প্রোডাকশন লাইনে এক সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রোডাকশন হাউসের থেকে ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল হাউসগুলির হাতে আসতে থাকে অধিক পরিমাণ অর্থ। যেমন-ওয়ালমার্ট বা অ্যামাজন ইত্যাদি কোম্পানিগুলো সারা বিশ্বের পণ্য ও নানা জিনিসপত্র জড়ো করে বেচতে থাকে। এমনিতে আমরা জানি মা লক্ষ্মী চঞ্চলা, তার উপর সরকার ফেলার অপারেশন বা ধর্মান্তরণে মদত দেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন USAID বা মার্কিন আগ্রাসন রুখতে চীনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে অর্থের দুর্ব্যবহার ঘটতে থাকলে তো লক্ষ্মীদেবী রুষ্ট হবেন। লেখক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর এক গল্পে লিখেছেন, ছেলে ব্ল্যাকমানি বলাতে তার অবাঙ্গালি বাবা তাকে বলছেন, ‘বেটা লক্ষ্মীকে কালা বোলো না, তাকে আন-অ্যাকাউন্টেড বলো’। যাই হোক, অর্থ অপচয়ের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশগুলি ও চীনের হাতে অর্থ অপ্রতুল হতে থাকে।
মার্কিনি ডেমোক্র্যাট নেতা বারাক ওবামা ২০০৭-০৮ নাগাদ চীনের উহান বায়ো ল্যাবরেটরিকে অর্থ প্রদান করে চীন সরকারের সঙ্গে ‘ডিপপুলেশন’ বা বিশ্বব্যাপী মানুষের সংখ্যাহ্রাসের এক ছক কষলেন। তার ফলে উহান ল্যাব ২০২০ সালে করোনা নামক এক বিশ্বব্যাপী মারণ ভাইরাস তৈরি করে বসলো। ছড়িয়ে পড়লো কোভিড মহামারী। মহাবীর শ্রীহনুমানের কৃপাতে মানবজাতির সংকটমোচন হয়েছে বটে। বের হয়েছে সেই ভাইরাসের প্রতিষেধক। মা ষষ্ঠীর কৃপায় বিশ্ববাসী তাদের বংশবৃদ্ধি করে চলেছে।
এসমস্ত সংঘাতের মাঝে পড়ে অর্থনৈতিক অবস্থা হয়েছে বেহাল। মহামারী ছাড়াও সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধ পরিস্থিতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কঠিন আঘাত হানতে শুরু করেছে।
ইজরায়েল-হামাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে বিপুল ব্যয় এবং মার্কিন টারিফ (শুল্ক) বৃদ্ধির কারণে চীন থেকে বড়ো ব্যবসায়ীদের সরে আসা, বিশ্বজুড়ে আর্থিক ক্ষেত্রে এক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। অর্থলগ্নিকারীরাও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাঁদের লগ্নির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট দ্রুততার সঙ্গে ট্যাক্স রিফর্ম বা শুল্কনীতি পরিবর্তন করাতে আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের এক নতুন আশঙ্কা দানা বাঁধছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই পরিবর্তনগুলির ফলে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা রয়েছে, যার থেকে উত্তরণ না ঘটলে আর্থিক মন্দা অবশ্যম্ভাবী। তাতে আগামীদিনে অর্থসংকট আরও ঘনীভূত হবে, ২০২৭ ও ২০২৮ সালে বিশ্ব জুড়ে তার চরম প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশনি সংকেত নিয়েও বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে।
ভাতা, ভাণ্ডার না পাবার ব্ল্যাকমেলের ভয় আর মানুষ পাচ্ছেন না
বিশ্বপ্রিয় দাস
২০২৬ সালের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে জনগণের মন বোঝার একটা মরিয়া চেষ্টা শুরু করেছে রাজ্যের শাসক দলের সুপ্রিমো ও সেকেন্ড ইন কম্যান্ড। সুপ্রিমো ইতিমধ্যেই বুঝে গেছেন, এবারের লড়াই অত সুবিধের ও সহজ হবে না। কেননা সাধারণ মানুষ তাদের থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। রাজ্যের শাসক দলের বাহুবলীদের ক্ষমতা ও দুবৃত্তদের কাজে লাগিয়ে বৈতরণী পার হবার যে কৌশল, সেই কৌশল এবার প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়বেই, সে ধারণাও জনমনে পরিষ্কার। এদিকে সাধারণ মানুষকে নানা ভাতা নিয়ে যে ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি, সেটা যে আর ফলপ্রসূ হবে না, সেটাও বুঝে গেছে শাসকদল। এর পিছনে কারণ আর কিছুই নয়, রাজ্যের শাসকদল ভাতা হিসেবে যে অর্থ সাধারণ মানুষকে দেয় সেটি সরকারিভাবে স্বীকৃত ও বাজেটে দেখানো হয়। ফলে এই ভাতা বন্ধ করার কোনো ক্ষমতা নেই কারুর। পরবর্তী সময়ে ক্যাবিনেট পর্যায়ে আলাদা সংশোধনী এনে তবেই কিছু করা যাবে। বন্ধ করা যাবে না। এদিকে যে ভাতা বা প্রকল্পগুলি চালু হয়েছে, সেগুলির অর্থের জোগান সরকারি কোষাগার থেকে আসে, কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিগত পিতৃ সম্পত্তি থেকে দেওয়া হয় না। ফলে ওই ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি যে আর কাজে আসবে না, সেটাও বুঝেছে রাজ্যের শাসক দল। বিরোধী দল ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, ওই সব প্রকল্পে অর্থের মূল্যমান বাড়বে। বন্ধ হবে না। ফলে দাবার চাল যে কিস্তিমাতের দিকে এগোচ্ছে, সেটা শাসক দলের ছোটো থেকে বড়ো নেতারাও টের পাচ্ছেন। আর আবাসন থেকে ত্রাণ, রেশন থেকে চাকরি কেলেঙ্কারি। সব তো
রয়েইছে।
দেখা যাক জনগণকে কীভাবে মাপার চেষ্টা চালাচ্ছে রাজ্যের শাসক দল? প্রথমেই তাঁরা একটি ধুয়া তুলেছে ভুতুড়ে ভোটারের। এই সুযোগে তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছেন। আর কথা বলে জল মাপার চেষ্টা চালাচ্ছে। এটাকে ভোটের একটা সাধারণ কৌশল হিসেবে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়। শাসক দলের কর্মী থেকে জনপ্রতিনিধি সবাই দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছে। কথা বলছে। আর বুঝে যাচ্ছে কে পক্ষে, আর কে বিপক্ষে। অন্যদিকে শাসক দলের কর্মীদের কথায়, সাধারণ মানুষ খুব একটা ভালোভাবে নিচ্ছে না তাদের। একটা বড়ো শতাংশ যে এই মুহূর্তে শাসক দলের সমস্ত কাজ ও কীর্তিকলাপ বেশ বাঁকা চোখে দেখছে, সেটাও পরিষ্কার। কলকাতায় ও জেলায় যে সব শাসক দলের কর্মী কাজ করছেন, তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যে ‘রেসপন্স’ কেমন? তাঁদের কথার ভিত্তিতে যদি শতাংশের হিসেব ধরা হয়, ৪০ ভাগের সমর্থন এই সময়ে শাসক দলের পক্ষে নেই। সবাই একটা পরিবর্তন চাইছেন। মানুষের কাছে পৌঁছানোর,
‘দুয়ারে সরকার’ বা সেবাশ্রয়ের মত নানা কৌশল খুব একটা যে কাজে আসছে না, সেটাও বুঝেছেন শাসক দলের নেতারা।
ধরা যাক ডায়মন্ড হারবার, সেকেন্ড ইন কম্যান্ডের কেন্দ্র। সেখানে জল মাপার জন্য তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামান্তরাল একটা ব্যবস্থা শুরু করেছেন। তাঁর আইটি টিম ফলাও করে তাঁর প্রচার করছে। আদতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অপমান করা হচ্ছে, সেটা কি সুপ্রিমো বুঝছেন, না বুঝতে চাইছেন না? নাকি চোখ বন্ধ করে রয়েছেন? প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই সেবাশ্রয় এর নামে যে মেডিকেল ক্যাম্প হচ্ছে, সেগুলি আগেও হতো কোনো ক্লাব বা সংগঠনের সহযোগিতায়। এখানে সেটাই রাজনৈতিক কর্মসূচি। আর খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কিছু হাতে গোনা টেস্ট ছাড়া খুব একটা যে সুফল পাচ্ছেন ক্যাম্পে যাওয়া মানুষজন, তা নয়। এখানে তার দলের কর্মীরা নিজেদেরকে প্রমাণ করার জন্য ক্যাম্পে মানুষকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেল করে নিয়ে আসছে। যেমন ভাতা বন্ধ হয়ে যাবার, আবাসনের টাকা না পাবার, পঞ্চায়েতের বা পুরসভার কাছে কোনো সহযোগিতা না পাবার মতো কথা বলার পাশাপাশি ভয়ও দেখানো হচ্ছে। আর এভাবেই মানুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে চলেছেন সুপ্রিমো। এবার গোটা ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের জন্য কি দাওয়াই হবে, সেটা নির্ধারিত হবে।
তাঁর কারণ ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের যে কয়টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে, সেই বিধায়কদের মধ্যে হয়তো অনেকেই এবার টিকিট পাবেন না। ফলে বিদ্রোহের একটা আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে শুরু করেছে বালে শাসক দলের একটি সূত্র মারফত জানা গেছে। ওই সূত্রটি আরও জানিয়েছেন যে এবারে অনেক প্রভাবশালী নেতা টিকিটের দাবিদার। তাঁরা অনেকেই সেকেন্ড ইন কম্যান্ডের কাছের লোক, এদের সংখ্যাটাও সাতের কয়েকগুণ। বেশ কিছু জেতা ক্যান্ডিডেট আছেন, তাঁদের গ্রহণ যোগ্যতা থাকলেও তাঁরা হয়তো এবারে তালিকায় নাও থাকতে পারেন। যদিও আরেকটি বিশ্বস্ত সূত্র জানাচ্ছে, গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনার টিকিট দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হবে শাসক দল। সুপ্রিমোর সঙ্গে মতের মিলের ক্ষেত্রে কে জেতে আর কে হারে, সেটার দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল। অন্যদিকে রাজনৈতিক মহলের মতে, নির্বাচনে যে বাহুবলী সংস্কৃতি রাজ্যের শাসক দল চালু করেছে, সেই বিষয়টিকে রুখতে না পারলে কারোর পক্ষেই জেতা সম্ভব নয়। প্রত্যন্ত গ্রামে ভোট লুটের ঘটনাকে থামাতে গেলে একেবারে নিরাপত্তার কঠিন বর্মে ঢেকে দিতে হবে নির্বাচন ক্ষেত্রকে। দুষ্কৃতীদের থামানোর জন্য এখন থেকে কেন্দ্রীয় ভাবে তালিকা তৈরি করে হস্তক্ষেপ করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তা না হলে বিরোধীদের সব চেষ্টা বিফলে যাবে।