মন্ত্র সিদ্ধ, তন্ত্র শুদ্ধ
অজেয় শক্তির দ্বারা পরিপূর্ণ হিন্দু সমাজ উঠে দাঁড়ালেই
বিশ্ব তথা মানবতার কল্যাণ সম্ভব। এই ধ্যেয় নিয়েই
ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার সঙ্ঘ স্থাপনা করেন।
মধুভাই কুলকর্ণী
১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের
স্থাপনা এবং ১৯৪০ সালেই ডাক্তার কেশব
বলিরাম হেডগেওয়ারের পরলোকগমন।
মাঝের পনেরো বছরে সঙ্ঘ কাজ দেশব্যাপী
বিস্তার লাভ করে। ১৯৪০ সালের প্রশিক্ষণ
বর্গে সারা দেশ থেকে ১৪০০ জন কার্যকর্তা
অংশগ্রহণ করেন। ৯ জুন বর্গের সমাপ্তি
পর্বে তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক পূজনীয়
ডাক্তারজীর ভাষণ হয়। কার্যকর্তাদের কাছে
সেটিই ডাক্তারজীর শেষ পথনির্দেশ।
ডাক্তারজী হয়তো তা বুঝতে পেরেছিলেন
বলেই সমস্ত শক্তি এক করে সেই ভাষণটি
দেন।
তিনি বলেছিলেন, “…আমার মনে হয়
না আজ আমি আপনাদের সামনে দুটো
শব্দও ঠিক করে বলতে পারব। সঙ্ঘের
দৃষ্টিতে এই বছরটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের।
আজ আমি আমার সামনে হিন্দুরাষ্ট্রের ছোট্ট
স্বরূপ দেখতে পাচ্ছি। আমার ও আপনাদের
পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও এমন কী বিষয়
আছে যার কারণে আপনাদের অন্তঃকরণ
আমার দিকে এবং আমার অন্তঃকরণ
আপনাদের দিকে আকৃষ্ট হয়ে চলেছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তত্ত্বজ্ঞান এতটাই
প্রভাবশালী যে, যে স্বয়ংসেবকদের মধ্যে
পরস্পর পরিচয় নেই, তাদের মধ্যে একে
অপরের দিকে তাকাতেই ভালোবাসার উদয়
হয়। কথা বলতে বলতেই পরস্পর বন্ধু হয়ে
যায়। আমি ২৪ দিন অসুস্থতার কারণে
শয্যাশায়ী ছিলাম, কিন্তু আমার মন
আপনাদের কাছেই ছিল। আজ আপনারা
নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাবেন। আমি
আপনাদের আন্তরিকতার সঙ্গে বিদায়
জানাচ্ছি। আপনারা প্রতিজ্ঞা করুন, ‘যতক্ষণ
শরীরে প্রাণ আছে ততক্ষণ আমি সঙ্ঘকে
ভুলব না’।”
ডাক্তারজী এরপর বলেন, “আজ
আমার দ্বারা কতটা কাজ হলো, তা প্রতিদিন
শোওয়ার সময় ধ্যান করুন। সঙ্ঘের কার্যক্রম
ঠিক মতো করার জন্য প্রতিদিন সঙ্ঘস্থানে
উপস্থিত থাকলেই সঙ্ঘকাজ শেষ হয়ে যায়
না। ‘আসেতু হিমালয়’ বিস্তৃত হিন্দু সমাজকে
আমাদের সংগঠিত করতে হবে। … গুরুত্বপূর্ণ
কার্যক্ষেত্র সঙ্ঘের বাইরেই রয়েছে। সঙ্ঘ
শুধুমাত্র স্বয়ংসেবকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ
নয়। সঙ্ঘের বাইরের মানুষদের জন্যও
সঙ্ঘ। রাষ্ট্রোদ্ধারের প্রকৃত পথ নির্দেশ করা
আমাদের কর্তব্য। …হিন্দু সমাজের চরম
কল্যাণ সংগঠনের মধ্যেই রয়েছে। দ্বিতীয়
কোনো কাজ সঙ্ঘকে করতে হবে না।
সঙ্ঘ আগে কী করবে? এই প্রশ্ন
অর্থহীন। সঙ্ঘ সংগঠনের এই কাজ আগে
আরও গতির সঙ্গে করে যাবে। অবশ্যই এই
যাত্রায় এক স্বর্ণিম দিন আসবে, যখন সমগ্র
ভারত সঙ্ঘময় হয়ে যাবে। এর পর হিন্দুদের
দিকে বাঁকা নজরে দেখার সাহস বিশ্বের
কোনো শক্তিই করবে না।…আমরা কারও
উপর আক্রমণ করার জন্য বের হইনি, কিন্তু
আমাদের উপর আক্রমণ না হোক, এই
সাবধানতা আমাদের রাখতেই হবে।”
ডাক্তারজী যেমন বলেছেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ
কার্যক্ষেত্র সঙ্ঘের বাইরেই রয়েছে। সঙ্ঘ
শুধুমাত্র স্বয়ংসেবকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ
নয়। সঙ্ঘের বাইরের মানুষদের জন্যও
সঙ্ঘ। রাষ্ট্রোদ্ধারের প্রকৃত পথ নির্দেশ করা
আমাদের কর্তব্য।’
সঙ্ঘের কার্যরচনাতে সেই কাজ
গটনায়ক করে থাকে। ৭-৮ জন
স্বয়ংসেবকের বাড়িতে সম্পর্ক করার কাজ
তাদের দেওয়া হয়। তারা প্রতিটি বাড়িতে
বার বার যায়। মা-বাবা, ভাই-বোন এবং
অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করা, সঙ্ঘ
বিষয়ে বিভিন্ন খবরাখবর দেওয়া, এসব কাজ
তারা সহজভাবেই করে থাকে। তারা
পরিবারের বড়োদের শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রণাম
জানায়। বার বার যাতায়াত করার কারণে
একসময় তারা পরিবারেরই একজন হয়ে
যায়। মনে করুন, একজন গটনায়ক ৮টি
পরিবারে যায়, প্রতিটি পরিবারে গড়ে ৫
জন সদস্য থাকলে একজন গটনায়ক প্রায়
৪০ জনের মনকে সঙ্ঘানুকূল অর্থাৎ
রাষ্ট্রানুকূল করে। একটি শাখায় যদি ৫ জন
গটনায়ক থাকে, তবে সেই শাখা কমপক্ষে
২০০ জনের মধ্যে চেতনাবোধ জাগ্রত করে।
একেই একাত্ম মানবদর্শন প্রণেতা পণ্ডিত
দীনদয়াল উপাধ্যায় ‘জনমন সংস্কার’
বলেছেন। গটনায়ক সম্পর্ক সোপানের
প্রথম ধাপের কার্যকর্তা।
জাগ্রত বিবেক
জনমন বিভিন্নভাবে তৈরি হতেই থাকে।
শিক্ষা, সাহিত্য, কলা, সংগীত, সংবাদমাধ্যম,
সামাজিক মাধ্যম, নির্বাচনের সময় বিভিন্ন
দলের দ্বারা উত্থাপিত আলোচনা ইত্যাদি
মাধ্যমে জনমন নির্মাণ হয়ে থাকে। বর্তমান
যুগ হলো তথ্যের যুগ। বিভিন্ন চিন্তাধারা ও
মতাদর্শ আমাদের উপর অনবরত প্রভাব
ফেলে চলেছে। এমন পরিবেশে কী গ্রহণ করা উচিত আর কোনটা ছেড়ে দেওয়া উচিত, সেই বোধ জাগ্রত
রাখতে হয়। কিছু মানুষ একে বিবেকবুদ্ধিও বলে থাকেন। ব্যক্তি,
পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য যা মঙ্গলজনক, তা স্বীকার করা
উচিত। ‘আমার জন্য উপকারী কিন্তু পরিবারের জন্য নয়, পরিবারের
জন্য মঙ্গলজনক কিন্তু সমাজের (জাতি, সংগঠন, মত-পন্থ ইত্যাদি)
জন্য অমঙ্গল, সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিন্তু দেশের জন্য নয়
এমন বিষয়কে ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমার নিজের, পরিবারের,
সমাজের ও দেশের হিতে যা হবে সেটাই গ্রহণযোগ্য’, একেই
বিবেকবুদ্ধি বলে। ব্যক্তি ও সমাজের বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত রাখার
জন্য যে সমস্ত প্রচেষ্টা চলছে তাকে ‘জনমন সংস্কার’ বলা যেতে
পারে। এ ধরনের কাজ সাধুসন্ত, কীর্তনিয়া, প্রবচনকারী, ঋষি-মুনি,
ভিক্ষুগণ করে থাকেন। যাঁদের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই, যাঁরা
প্রশাসনিক ক্ষমতাতুর, কামাতুর, ধনাতুর, মানাতুর নন এবং
রাষ্টহিতকেই সর্বোপরি মনে করেন, তাঁরাই জনমন সংস্কার করতে
পারেন। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকের সমাজে ভূমিকা অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবনে
ভূমিকা জনমন সংস্কারেরই। স্বয়ংসেবকরা গৈরিক পতাকা অর্থাৎ
‘ত্যাগমূর্তি’কে সাক্ষী মেনে প্রতিজ্ঞা করে- “আমি সঙ্ঘের কাজ
সৎভাবে, নিঃস্বার্থ বুদ্ধিতে, দেহ, মন ও ধন দ্বারা করিব।”
স্বয়ংসেবকদের কোনো বস্তুর প্রতি মোহ সৃষ্টি হয় না। একটি
কবিতার দুটি পঙ্ক্তি তার হৃদয়ে সর্বদা বাজতে থাকে—
পত্রিকায় হবে নাম লেখা, পরিবে গলে স্বাগতহার,
ছেড়ে এই ক্ষুদ্র ভাবনা, হিন্দুরাষ্ট্রের ত্রাতা হয় অগ্রসর।।
স্বয়ংসেবক যেখানেই থাকে সেখানেই অনেক আত্মীয়-পরিজন
তৈরি করে ফেলে। সে কারও প্রতি ভেদাভেদ বা বৈরিতা পোষণ
করে না। চরিত্রবান, নিঃস্বার্থ সেবা, স্নেহপূর্ণ বিনম্র ব্যবহারের
কারণে নিজের এলাকায় সম্মানের পাত্র হয়ে থাকে। সমাজের
কোনো একটি বর্গের, জাতির বা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে
সে কাজ করে না। যে কারও বিপদেই সে দৌড়ে যায়, এই জন্য
বহু মানুষের মনে হয় এ তো এই এলাকার বা সংগঠনের ভিত্তি।
মানুষজন তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে। এখান থেকেই
তার জনমন সংস্কার করার কাজ শুরু হয়। ডাক্তারজীর দেওয়া
শেষ ভাষণের পথনির্দেশ তার মনে থাকে-
‘রাষ্ট্রোদ্ধারের প্রকৃত পথ নির্দেশ করা
আমাদের কর্তব্য। …হিন্দু সমাজের কল্যাণ
সংগঠনের দ্বারাই।’
তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রীবালাসাহেব
দেওরস বলেন, ‘আত্মীয়তাপূর্ণ পারিবারিক
সম্পর্ক যদি হয় তবেই আলোচনা সহজ ও
সরল হবে।’ বাড়ি-বাড়ি সম্পর্ক সঙ্ঘ শাখার
প্রাণ। ১০ হাজার জনবসতিতে কমপক্ষে
একটি শাখা, এই গড় হিসাব আজও একই
আছে অর্থাৎ একটি শাখার দ্বারা ২০০০
পরিবারে সম্পর্ক। সমাজ সঙ্ঘের এবং সঙ্ঘ
সমাজের, এটাই মন্ত্র। সমাজের মন বোঝার জন্য সম্পর্ক অতি
প্রয়োজন। সঙ্ঘের শাখা সম্পর্কের সুযোগ খুঁজতেই থাকে।
রক্ষাবন্ধন এমনই একটি সুযোগ। বন্ধুত্ব বিস্তারের জন্য রক্ষাবন্ধনের
অনুষ্ঠান অত্যন্ত উপযোগী।
সম্পর্ক ও নিয়োজন
লোক সম্পর্ক, লোক সংস্কার, লোক সংগ্রহ এবং লোক
নিয়োজন-এগুলিকে আমরা ডাক্তারজীর জীবনসূত্র বলতে পারি।
এই সূত্র ধরেই স্বয়ংসেবকেরা সমাজে কাজ করে চলেছেন।
জনসম্পর্কের মাধ্যমে আত্মীয়তা ও সরলতা নির্মাণ হয়, এটিই
জনসম্পর্কের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। লোক সংস্কার অর্থাৎ সমাজের
তথা দেশের অনুকূল ভাবনাচিন্তা এবং সেই মতো ব্যবহার করা
প্রয়োজন। লোক সংগ্রহ অর্থাৎ দেশহিতে চিন্তাভাবনাকারী
ব্যক্তিদের আমাদের কাজে যুক্ত করা এবং লোক নিয়োজন অর্থাৎ
সংগঠনের কাজে নিজেকে সমর্পিত করবে এমন কার্যকর্তা নির্মাণ।
এই পর্যায় সবসময় চলতে থাকা চাই।
সঙ্ঘের প্রচেষ্টা হলো, জনসম্পর্কের পরিধি যতটা বৃদ্ধি করা
যায় ততটা বাড়ানো উচিত। সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর (বৈজ্ঞানিক,
খেলোয়াড়, শিল্পী, সাধুসন্ত, ধর্মাচার্য, কৃষক, শ্রমিক, জনজাতি
ইত্যাদি) প্রমুখ ব্যক্তির তালিকা তৈরি করে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক
করা হয়। প্রতিনিধি সভার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হয়। পরম
পূজনীয় সরসঙ্ঘচালকজীর বিজয়াদশমী উৎসবের বক্তব্য নিয়ে
দেশের বেশিরভাগ শহরে বিশেষ আলোচনার আয়োজন করা হয়।
ডাক্তারজী তাঁর শেষ বক্তব্যে বলেছেন, ‘সঙ্ঘের দৃষ্টিতে এই বছরটি
অত্যন্ত সৌভাগ্যের। আজ আমি আমার সামনে হিন্দুরাষ্ট্রের (জাগ্রত
হিন্দু সমাজের) ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখতে পাচ্ছি। … অবশ্যই এই যাত্রায়
এক স্বর্ণিম দিন আসবে, যখন সমগ্র ভারত সঙ্ঘময় হয়ে যাবে।
এর পর হিন্দুর দিকে বাঁকা নজরে দেখার সাহস বিশ্বের কোনো
শক্তিই করবে না।’ এই রকম অজেয় শক্তির দ্বারা পরিপূর্ণ হিন্দু
সমাজ উঠে দাঁড়ালেই বিশ্ব তথা মানবতার কল্যাণ সম্ভব। এই ধ্যেয়
নিয়েই ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার সঙ্ঘ স্থাপনা করেন।
(লেখক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রবীণ প্রচারক)