বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বঙ্গের স্বাধীন ও সার্বভৌম নৃপতি
মহারাজা শশাঙ্ক
নন্দলাল ভট্টাচার্য
শশাঙ্ক।
-বলো মা!
-এবার তো যেতে হবে তাই না!
-হ্যাঁ মা। জগন্নাথ ধাম শ্রীক্ষেত্র এখনও অনেকটা পথ। তাই
এবার রওনা হতে হবে।
গৌড় অধিপতি রাজা শশাঙ্কর এই কথার পরেই রাজমাতার
প্রশ্ন, তা, এদের কথা কিছু ভাবলে?
-কাদের কথা!
-এই গ্রামের মানুষগুলো। যারা আমাদের জন্য এতো করল-
ওদের কথা বলছি।
মায়ের কথার উত্তরে শশাঙ্ক পালটা জিজ্ঞাসা, বলো কী করতে
চাও তুমি? কী তোমার ইচ্ছা।
-সে কী কথা! তুমি রাজা। প্রজাদের জন্য তুমি কী করবে সেটা
তো তোমার জানার কথা। আমি কেবল মনে করিয়ে দিলাম
তোমাকে।
রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে মা-কে নিয়ে তীর্থ দর্শনে বেরিয়েছেন
রাজা শশাঙ্ক। সেই যাওয়ার পথেই এসে পৌঁছান বর্তমান পশ্চিম
মেদিনীপুরের দাঁতনের এই গ্রামটায়। শিবির ফেলেন কিছুটা জিরিয়ে
নেওয়ার জন্য। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলো তাদের সাধ্যের বাইরে
গিয়েও আপ্যায়ন করে সকলকে। তাদের সেই আন্তরিকতায় মুগ্ধ
রাজমাতা। তাই যাওয়ার আগে গ্রামবাসীদের জন্য কিছু করার কথা
মনে করিয়ে দেন। এর আগেই গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে
রাজমাতা জেনেছিলেন তাদের আসল সমস্যার সমাধান করে দেবেন
তিনি। কিন্তু কথাটা মনের মধ্যে রেখেছিলেন। দেখছিলেন রাজা
হিসেবে তাঁর ছেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে কিনা! তাই
বলেছিলেন, রাজা তুমি। প্রজাদের জন্য কী করতে হবে তা তো
তুমিই ঠিক করবে। আমি কেন নির্দেশ দেবো!
মায়ের কথার অর্থটা বুঝতে পেরেছিলেন মহারাজা শশাঙ্ক। তাই
কথা না বাড়িয়ে গ্রামবাসীদের বলেন, তোমাদের অবস্থা দেখে বুঝতে
পারছি, ভালো নেই তোমরা। কিন্তু কেন? কীসের অভাব তোমাদের?
গ্রামবাসীরা একসময় ভেবেছিল, রাজাকে বলবে তাদের সমস্যার
কথা। কিন্তু ভয় পেয়েছিল। রাজা যদি রেগে যান। যদি ভাবেন, তাদের
এই আতিথেয়তা আন্তরিক নয়। এর পেছনে রয়েছে একটা উদ্দেশ্য।
তাহলে?
এই তাহলের জন্যই কিছু বলেনি তারা। কিন্তু এখন মহারাজা
নিজে যখন জানতে চাইছেন, তখন তো বলতে কোনো বাধা নেই।
রাজা তো বাবার মতো। তাঁর কাছে তো সবই বলা যায়। বলা উচিতও।
তাই সরব গ্রামবাসীরা। বলে, এখানকার জমি খুবই উর্বর। কিন্তু জলের
অভাবে ভালো ফসল হয় না। তাই হাড়মাস এক করে খাটাখাটানির
পরও অভাবকে সঙ্গী করেই আমাদের বাঁচা। বৃষ্টির জলের ভরসায়
চাষাবাদ আর সবই নিয়তি বলে কপাল চাপড়ানো ছাড়া অন্য উপায়
নেই আমাদের।
কথাগুলি শুনতে শুনতে চোখে জল আসে রাজমাতার। তাই যে
কথাটা বলতে চাইছিলেন না এতক্ষণ সেটাই বলে ফেললেন, এদের এই জলের অভাব মেটাবার জন্য কিছুই কি করতে পারো না তুমি?
মায়ের একথার অর্থ বুঝতে দেরি হয় না মহারাজা শশাঙ্কের। তাই
কিছু না বলে তিনি নেন ধনুকটা। শর যোজনা করেন তাতে।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে যায় গ্রামবাসীরা। অভাবের কথাটা
জানিয়ে কোনো ভুল করেনি তো তারা! রাজা ক্রুদ্ধ হয়েছেন।
রাজমাতা নির্বিকার। আর মহারাজা শশাঙ্ক লক্ষ্য স্থির করেই শর
নিক্ষেপ করেন। যেখানে তিরটা মাটিতে গেঁথে যায়, সেই পর্যন্ত জায়গা
জুড়ে একটা দিঘি খননের নির্দেশ দেন সঙ্গে সঙ্গে। কেবল নির্দেশ নয়,
কাজটা শুরুও করেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। প্রায় ১৫০ একর জুড়ে
খোড়া হয় একটি দিঘি। কম করে ৮০টি ফুটবল মাঠের সমান ওটি।
শর নিক্ষেপ করে মহারাজা শশাঙ্ক দিঘির জায়গা ঠিক করে সেটি
খনন করেছিলেন বলে তার নাম হয় শশাঙ্ক দিঘি। সেই দিঘির জলে
দাঁতনের ওই অঞ্চল হয়ে উঠে সুফলা। আজও টলটল করছে ওই দিঘি।
দিঘির পাড়ে এখন এক মন্দির আর মাজার ঘিরে বসে মেলা। আজও
এলাকার মানুষ মহারাজা শশাঙ্কের নামে দেন জয়ধ্বনি!
দুই
খুলে যায় কারাগৃহের দ্বার। পায়ের শব্দে চমকে ওঠেন বন্দিনী।
তস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন নারী,- কে?
-ভয় নেই। আমি শশাঙ্ক।
-আপনি! আর কী চান আপনি!
নরম গলাতেই বলেন রাজা শশাঙ্ক, কিছু না রানি রাজ্যশ্রী।
রানি! রানি! রানি! ঝলসে ওঠে কণ্ঠ, আপনি কি আমাকে ব্যঙ্গ
করছেন?
-মাপ করবেন, আপনাকে ব্যঙ্গ করার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নেই প্রথমেই একটা সুশিক্ষিত, সুশৃঙ্খলিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দিকে
আমার।
-তাহলে কেন এসেছেন এখানে?
-একটা কথা শুধু জানতে। এটা আমি চাইনি, মালবরাজ দেবগুপ্ত
ঠিক করেনি- আপনাকে বন্দি করে। তার এই কাজের জন্য ক্ষমা চাইছি
আমি।
আরও তীক্ষ্ণ কণ্ঠ রাজ্যশ্রী। ক্ষমা আপনাকে। ভীরু! কাপুরুষ!
বিশ্বাসঘাতক। অন্যায়ভাবে হত্যা করেছেন আপনি আমার দাদা
রাজ্যবর্ধনকে। ক্ষমা আপনাকে কখনোই নয়।
বিব্রতকণ্ঠে শশাঙ্ক বলেন, ভুল-ভুল আপনার এ ধারণা। আমি হত্যা
করিনি রাজা রাজ্যবর্ধনকে। অন্যায় করেছিলেন তিনি। সেই অনুতাপে
আত্মঘাতী হয়েছেন তিনি। বিশ্বাস করুন আমাকে।
-বিশ্বাস! আপনাকে! কখনই নয়! আপনি একজন ঘাতক।
এবার কঠিন কণ্ঠ শশাঙ্কও। বলেন, অন্য কেউ একথা বললে এই
মুহূর্তে তার মাথাটা মাটিতে গড়াগড়ি খেত। কিন্তু আপনি নারী। তাই
সংযত করছি নিজেকে? আমি কেবল জানাতে এসেছি, মুক্ত আপনি।
বাইরে অপেক্ষা করছে শিবিকা। অশ্বও। যেমন আপনার অভিরুচি-
তেমন ভাবেই আপনি এখন যেতে পারেন। বলেন তো, সঙ্গে দেহরক্ষী
দিয়ে দিচ্ছি।
-করুণা করছেন? আমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন? সময়
যদি আসে তাহলে এর যোগ্য জবাব দেব আমি।
ক্রোধে সিংহিনীর মতোই গর্জন করতে থাকেন থানেশ্বর রাজনন্দিনী,
কনৌজরাজ গ্রহবর্মার স্ত্রী রাজ্যশ্রী। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে শশাঙ্ক
আবারও বলেন, আপনি এখন মুক্ত। যেতে পারেন যেখানে আপনার
অভিপ্রায়। তবে আবারও বলবো, আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আপনার
দাদা রাজ্যবর্ধনকে আমি চাইলেই হত্যা করতে পারতাম তাঁর
বিশ্বাসভঙ্গের জন্য। কিন্তু আমি তা করিনি। আবারও বলছি, রাজা
রাজ্যবর্ধন তাঁর অন্যায়টা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই প্রায়শ্চিত্ত করেছেন
জীবন দিয়ে। তবুও বলছি, পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন। এখন আপনি
আপনি মুক্ত। যেতে পারেন যেখানে খুশি।
কারাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসেন রানি রাজ্যশ্রী। তারপর শিবিকা
নয়, বাইরে রাখা সাদা ঘোড়ায় চেপে চলে যান তিনি। তাঁর যাওয়ার
দিকে তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে- মহারাজা শশাঙ্ক।
তিন
গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক। দু’চোখে তাঁর স্বপ্ন। সম্রাট হবেন তিনি। উত্তর
ভারত হবে তাঁর অধীন। বদলে দেবেন তিনি ইতিহাসের গতি। এতদিন
উত্তর ভারত আধিপত্য করে এসেছে বঙ্গদেশের ওপর। সেটাই
স্বাভাবিক- সেটাই ভবিতব্য বলে মনে হয়েছে বঙ্গবাসীরও। সেই
ধারণাটা এবার বদলে দেবেন তিনি।
এই ভাবনা- মনে মনে এই শপথ নেওয়ার সময় শশাঙ্ক একজন
সামন্তমাত্র। মগধের মৌখরি রাজাদের আর পাঁচজন সামন্তর একজন
মাত্র। কিন্তু ওই পদে খুশি নন তিনি। বারবারই মনে হয় সামান্য সামন্ত
হয়ে থাকার জন্য জন্ম হয়নি তাঁর। আরও অনেক- অনেক বড়ো হতে
হবে তাঁকে। আর তারই প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি- প্রায় প্রকাশ্যেই।
শশাঙ্ক জানেন, পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কখনই পৌঁছনো
যাবে না কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। আর তাই তৈরি করতে থাকেন নিজেকে।
প্রথমেই একটা সুশিক্ষিত, সুশৃঙ্খলিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দিকে
নজর দেন তিনি। নিজে সামনে দাঁড়িয়ে প্রশিক্ষিত করতে থাকেন
বাহিনীকে।
প্রাচীনকালের চতুরঙ্গবাহিনীর কথা মাথায় রেখে তিনি পদাতিক
বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে অশ্বারোহী ও গজারোহী বাহিনী তৈরি করেন। সব
দিক থেকেই শক্তিশালী করে তোলেন ওই দুই বাহিনীকে। অবশ্য
ওইখানেই থেমে থাকেন না শশাঙ্ক। অন্যান্য সামন্তরা সাধারণত যা
করেন না সেটাই করলেন তিনি। জলপথে শত্রুর মোকাবিলায় গড়ে
তোলেন এক নৌবাহিনী।
শশাঙ্ককে ওই ভাবে শক্তিবৃদ্ধি করতে দেখে আতঙ্কিত হতে থাকেন
বঙ্গদেশের অন্যান্য সামন্তরা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাই
আত্মসমর্পণ করলেন। নেতা হিসেবে মেনে নিলেন শশাঙ্ককে। আর
বাকিদের বশ মানালেন তিনি শক্তি প্রয়োগ করে। আর তারই জোরে
তিনি সামন্ত থেকে হলেন মহাসামন্ত। হলেন বঙ্গদেশের সর্বময়
অধিপতি। হলেন গৌড়াধিপতি। আর তারপরই মন দিলেন রাজ্য
বিস্তারে।
প্রথমেই মুখোমুখি কামরূপ রাজ সুস্থিতিবর্মণের। যুদ্ধে নিহত হলেন
কামরূপ রাজ। কামরূপ রাজ্যের দুই ছেলেকে বন্দি করে আনলেন বঙ্গে।
পরে তাদেরই নিয়োগ করলেন কামরূপে তাঁর সামন্তরাজা হিসেবে।
এরপর তাঁর লক্ষ্য কনৌজ। আর তার জন্য জোট বাঁধলেন মালবরাজ
দেবগুপ্তের সঙ্গে। কনৌজের মৌখরিরাজ গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে শশাঙ্কর
বাহিনীর সাহায্য পেয়ে দেবগুপ্ত এক সংগ্রামে গ্রহবর্মাকে পরাজিত ও
নিহত করেন। কেবল তাই নয়। বন্দি করলেন গ্রহবর্মার স্ত্রী থানেশ্বরের পুষ্যভূতি-রাজ যশোবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে।
মিত্র দেবগুপ্তের এই কাজকে কিন্তু সমর্থন করতে পাললেন না
শশাঙ্ক। নারী নিগ্রহ তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। কোনো অবস্থাতেই মাতৃজাতির
অসম্মান করতে চান না তিনি। কিন্তু তাঁর অনুমোদন ছাড়াই সেই কাজটা
করলেন দেবগুপ্ত। থানেশ্বরের সিংহাসনে তখন প্রয়াত যশোবর্ধনের
বড়ো পুত্র রাজ্যবর্মন। ভগ্নীপতির মৃত্যু এবং ভগ্নীর বন্দি হওয়ার খবর
পেয়ে ভাই হর্ষবর্ধনকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি এক বিরাট বাহিনী নিয়ে
ছুটলেন দেবগুপ্তকে উচিত শিক্ষা দিতে।
শশাঙ্কর বাহিনীর একটি অংশ মালবে থাকলেও তিনি নিজে সে
সময় ছিলেন বঙ্গদেশেই। রাজ্যবর্ধনের অভিযানের খবর পেয়ে তিনি
রওনা হন কনৌজের পথে। ততদিনে মালব আক্রমণ করেছেন
রাজ্যবর্ধন। যুদ্ধে পরাজিত হন দেববগুপ্ত। রাজ্যবর্ধন নিহত করেন
তাঁকে। ততদিনে শশাঙ্কও পৌঁছে গেছেন কনৌজে। নগরদ্বারেই অবরোধ
গড়ে তুললেন তিনি। মুখোমুখি সেখানেই দুই বাহিনী। দিন দুয়েকের
মধ্যেই রাজ্যবর্ধন বুঝতে পারেন, এবারের লড়াইটা বড়ো সহজ হবে
না। দেবগুপ্তর মতোই পরাজিত করা যাবে না রাজা শশাঙ্কর বাহিনীকে।
হয়তো হার হবে তাঁরই। তাই যুদ্ধ নয়, শান্তির পথ বেছে নিলেন তিনি।
ওই মুহূর্তে শশাঙ্কও সেটাই চাইছিলেন। ফলাফল যখন অনিশ্চিত
তখন অকারণ রক্তপাত সুবুদ্ধির পরিচয় নয়। তাই রাজ্যবর্ধনের সন্ধি
প্রস্তাবে অরাজি হলেন না তিনি। সবকিছু সুনিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ
একটা জায়গায় আলোচনায় বসলেন তাঁরা।
শোনা যায়, শান্তি দীর্ঘস্থায়ী করতেই শশাঙ্ক জামাতা করতে
চেয়েছিলেন রাজ্যবর্ধনকে। আর রাজ্যবর্ধনও রাজি ছিলেন কনৌজের
অধিকার ছেড়ে দিতে। শেষ হয় আলোচনা। সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন
দু’জনেই। আলিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে আলোচনা পর্ব। আর তখনই
কেটে গেল সুর- ভঙ্গ হলো তাল-ছন্দ।
রাজ্যবর্ধন ছিলেন পরম বৌদ্ধ। কথায় কথায় স্মরণ করেন
তথাগতকে। অন্যদিকে শশাঙ্কও ডাকেন তাঁর আরাধ্য শিবশঙ্কর-
মহাদেবকে। এধরনের দুই ধার্মিকের মিলনে তাই অবিশ্বাসের কোনো
জায়গা থাকার কথা নয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজ্যবর্ধন হলেন ধর্মচ্যুত।
এমনটাই বলেন একদল ঐতিহাসিক।
আসলে অবিশ্বাস ছিল দু’জনেরই মনে। তাই শশাঙ্ক পোশাকের
নীচে পরে এসেছিলেন লৌহবর্ম। আর রাজ্যবর্ধন পরিধেয়ের মধ্যে
লুকিয়ে রেখেছিলেন এক তীক্ষ্ণ ছুরি। আলিঙ্গনের মুহূর্তেই অন্তর থেকে
অন্তর্হিত তথাগত। সহসা ছুরিটা বের করে সজোরে বসিয়ে দেন শশাঙ্কের
বুকে।
শশাঙ্ক এধরনের কোনো ঘটনার জন্য তৈরিই ছিলেন। তাই ঝটিতি
একটু সরে গিয়ে পালটা প্যাঁচে মাটিতে ফেলে দেন রাজ্যবর্ধনকে।
তারপর যা ঘটল তার জন্য শশাঙ্ক তৈরি ছিলেন না মোটেই।
মাটিতে পড়েই রাজ্যবর্ধন আর্তনাদ করে ওঠেন। হায়-হায় ভগবান
তথাগত। এ আমি কী করলাম। কেন আমার মন থেকে অন্তর্হিত হলেন
আপনি। এ কোন মহাপাপ করলাম। এ পাপের শাস্তি আমাকে ভোেগ
করতেই হবে। ‘সত্যানুরোধে’ মৃত্যুই বরণ করতে হবে আমাকে।
কথাগুলো বলতে বলতে হাতের ছুরিটা দিয়ে কেটে ফেলেন নিজের
কণ্ঠনালীটা। ঢলে পড়েন মৃত্যুর শীতল কোলে।
শশাঙ্ক হতভম্ব। এমনটা যে হবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি। কিন্তু ওই মুহূর্তে বুদ্ধির খেই হারালেন না। এখানে থাকলে সকলে তো
তাঁকেই মনে করবে রাজ্যবর্ধনের হত্যাকারী। তাই তড়িঘড়ি শিবির থেকে
বেরিয়ে উঠে পড়লেন ঘোড়ায়। চলে গেলেন সেখান থেকে নিজের
সেনাশিবিরে। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুসম্পর্কে প্রায় এমন কথাই আছে
হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা তাম্রশাসনে।
রাজ্যবর্ধনের নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে বাণভট্ট বা হিউয়েন
সাঙ কিন্তু দায়ী করেছেন শশাঙ্ককেই। বাণভট্ট তো তাঁকে ‘গৌড়ভুজঙ্গ’,
‘গৌড়াধম’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বা হিউয়েন সাঙ যে শশাঙ্ক
সম্পর্কে সব সত্য তুলে ধরেননি তা কিন্তু পরবর্তীকালে লিপি ও অন্যান্য
তথ্য থেকে প্রমাণিত।
চার
মহারাজা শশাঙ্ক ছিলেন গৌড় সাম্রাজ্যের সার্বভৌম রাজা,
গৌড়াধিপ। বঙ্গদেশের প্রথম স্বাধীন নৃপতি। মেদিনীপুর থেকে পাওয়া
দু’টি লিপি, এগরার আরেক লিপি, গঞ্জামের রাজা মাধব বর্মার তাম্রশাসন
(৬১৯ খ্রিস্টাব্দ), হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা ও মধুবন তাম্রশাসন,
কামরূপরাজ ভাস্কর বর্মণের নিধানপুর তাম্রশাসন, শশাঙ্ক নামাঙ্কিত
স্বর্ণ ও রত্ন মুদ্রা, বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙের বিবরণ, বৌদ্ধগ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রী
মূলকল্প ইত্যাদির পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলতে হয়, মহারাজা শশাঙ্ক
মোটামুটি ভাবে ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন।
রোহতসগড় থেকে পাওয়া সিলমোহরের ছাঁচে উৎকীর্ণ লিপিতে তাঁকে
‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্কদেব’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়, তিনি
ছিলেন গুপ্তরাজবংশের শেষপর্বের দুর্বল শাসক মহাসেনগুপ্তর
মহাসামন্ত।
শশাঙ্ক প্রথমে গৌড় অঞ্চলে ক্ষমতা সুসংহত করে নিজেকে বঙ্গ
থেকে ভুবনেশ্বর এবং কামরূপ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের একজন অধিপতি
হন। শশাঙ্কর রাজ্যবিস্তারের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল প্রাকৃতিক সীমান্তের
মাধ্যমে রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখা। তাঁর রাজ্যের প্রাকৃতিক সীমা ছিল পূর্বে
ব্রহ্মপুত্র নদ, পশ্চিমে শোনগণ্ডক উপত্যকা, উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিণে
চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত বিস্তৃত।
শশাঙ্ক কনৌজ থেকে বারাণসী পর্যন্ত অঞ্চল জয় করে গাঙ্গেয়
উপত্যকায়ও নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর
হর্ষবর্ধন রাজা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেও তাঁর বোন
রাজ্যশ্রী বিন্ধ্যাচলে রয়েছেন শুনে যুদ্ধের ভার সেনাপতি ভাণ্ডীর উপর
দিয়ে নিজে যান বোন রাজ্যশ্রীকে উদ্ধারে।
শেষপর্যন্ত রাজা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধন জয়ী হয়েছিলেন কিনা,
তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। হর্ষবর্ধন জয়ী হলেও
তাতে শশাঙ্কের বিশেষ ক্ষতি হয়নি। তাঁর রাজ্যসীমা তাঁর জীবনকালে
অটুটই ছিল।
পাঁচ
পরম ভট্টারক গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ছিলেন শৈব ব্রাহ্মণ সন্তান এমনই
অভিমত ঐতিহাসিকদের। অন্যদিকে থানেশ্বররাজ হর্ষবর্ধন প্রথমে শৈব
মতাবলম্বী হলেও পরে হন বৌদ্ধমতের পরম পৃষ্ঠপোষক। তাঁর
শাসনকালে ভারতে আসা চীনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙকে
অনুগৃহীত করেন তিনি নানাভাবে। বৌদ্ধমতের মহিমা প্রতিষ্ঠায় হিউয়েন
সাঙ হর্ষবর্ধনকে প্রায় তথাগতর আসনে বসান। একই সঙ্গে মহারাজা
শশাঙ্কের বিরুদ্ধে করেন একাধিক অতিরঞ্জিত অভিযোগ। বৌদ্ধমত পীড়ক শশাঙ্ককে শাস্তি দেবার জন্য তথাগতই
আবির্ভূত হয়েছিলেন হর্ষ-রূপে এমন কথাও
বলেন হিউয়েন সাঙ।
মহারাজা শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিরোধী
কার্যকলাপ হিসেবে কুশীনগর থেকে বৌদ্ধ
বিতাড়ন, পাটলিপুত্র থেকে বুদ্ধপদ-রঞ্জিত
পাথর উৎপাটন, গয়ায় বোধিবৃক্ষে অগ্নি
সংযোগ ইত্যাদি নানা ঘটনার কথা উল্লেখ
করেছেন হিউয়েন সাঙ।
ঐতিহাসিকদের অভিমত, এসব অভিযোগ
কেবল অতিরঞ্জিতই নয়, অলীকও। মহারাজা
শশাঙ্ক যদি বৌদ্ধ নির্যাতনকারীই হবেন, তাহলে
তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণে হিউয়েন সাঙ দশটি
সমৃদ্ধ বৌদ্ধবিহার ও সেখানে বসবাসকারী দশ
হাজার বৌদ্ধকে দেখলেন কী করে? এই সময়ে
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েরই-বা চরম উন্নতি ঘটল
কী করে? এমন নানা প্রশ্ন করেন
ঐতিহাসিকরা।
হিউয়েন সাঙ এমনও লিখেছেন,
বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণের পাপেই কুষ্ঠ হয়
শশাঙ্কের। রোগে তাঁর দেহের মাংস খসে খসে
পড়ে।
ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, এসবই হিউয়েন
সাঙের কষ্টকল্পনা। কেউ কেউ অবশ্য বলেন,
মহারাজা শশাঙ্ক সত্যিই কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত
হয়েছিলেন। রোগমুক্তির জন্য সেসময়
আয়োজন করা হয় বিশেষ বৈদিকযজ্ঞের। তার
জন্য সরযূনদী তীর থেকে আনানো হয় একদল
ব্রাহ্মণকে। সেটাই ছিল বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণদের
স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রথম ঘটনা। এই
ব্রাহ্মণরাই পরবর্তীকালে গ্রহবিপ্র নামে পরিচিত
হন।
ছয়
বঙ্গদেশের ইতিহাসের এক বর্ণময় চরিত্র
মহারাজা শশাঙ্ক। এদেশের বহু ঘটনার সঙ্গেই
জড়িত ছিলেন তিনি। সেসব ঘটনা আজও মনে
করিয়ে দেয় তাঁর কথা। তাঁর নানা কীর্তির
অন্যতম বঙ্গাব্দের প্রবর্তন এমন কথাও বলে
থাকেন ঐতিহাসিকতা। কিন্তু ভারতভাগের পর
থেকেই মুঘল বাদশা আকবরকে এই সম্মান
দেওয়ার এক সংগঠিত চেষ্টা শুরু হয়েছে।
ব্যাপারটা প্রথম মাথাচাড়া দেয় গত
শতাব্দীর ষাটের দশকে। পূর্ব পাকিস্তানে ড.
মহম্মদ শহীদুল্লার নেতৃত্বে গঠিত এক কমিটি
বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের কৃতিত্ব দেন বাদশা
আকবরকে। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পর
সেখানকার জঙ্গিশাসক হোসেইন এরশাদ
আবার সরকারিভাবে আকবরকেই বঙ্গাব্দের
প্রবর্তক বলে সরকারিভাবে ঘোষণা করেন।
আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে এই বিষয়টি
নিয়ে বিতর্ক।
আকবর দক্ষ প্রশাসক ছিলেন একথা
মানেন সকলেই। ধর্মীয় উদারতা ছিল তাঁর
প্রশাসনিক কৌশলের একটি অঙ্গ। এমনটা
ঐতিহাসিকদেরই একটা বড়ো অংশের ধারণা।
একথা সত্য, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য
তিনি বেশ কিছু নতুন নীতি নিয়েছিলেন।
আবার একথাও সত্য, প্রকাশ্যেই তিনি ছিলেন
হিজরি সন এবং দিনপঞ্জীর বিরোধী। আর ওই
কারণেই হিজরির পরিবর্তে তারিখ-ইলাহি
নামে নতুন এক দিনপঞ্জীর প্রবর্তন করেন।
পরবর্তীকালে তিনি এই তারিখ ইলাহি দিনপঞ্জী
বাতিল করেছিলেন এমন কোনো নজির
কোথাও নেই। তাছাড়া মুঘল সাম্রাজ্য ১২টি
সুবায় বিভক্ত ছিল। সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র
বঙ্গের জন্য তিনি আলাদা একটি অব্দ চালু
করবেন কেন? আবার সেটা হিজরির সঙ্গেই-বা
মিলিয়ে করবেন কেন?
প্রশ্ন আরও আছে, আবুল ফজলের
‘আইন-ই-আকবরি’-তে বহু সালতামামির কথা
আছে, কিন্তু বঙ্গাব্দর কথা নেই কোনোখানে।
আকবরই বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করে থাকলে আবুল
ফজল অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু সেটা
না করায় আকবর বঙ্গাব্দের প্রবর্তক এই দাবি
টেকে না কোনোভাবেই।
মহারাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রবর্তন
করেছিলেন এর পক্ষে কিন্তু বেশ কিছু বাস্তব
যুক্তি রয়েছে। শশাঙ্ক তাঁর রাজ্যাভিষেকের বছর
৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন বলে
উল্লেখ করা হয়। বঙ্গাব্দর সঙ্গে খ্রিস্টাব্দের
পার্থক্য ৫৯৩ বছর। এক্ষেত্রে মহারাজা শশাঙ্ক
বঙ্গাব্দের প্রবর্তক, এটাই মান্যতা পায়।
আকবরই যদি বঙ্গাব্দর প্রবর্তক হন তাহলে
বাঁকুড়া জেলার ডিহারগ্রামে এবং সোনাতপন
গ্রামের হাজার বছরের পুরোনো দুটি শিব
মন্দিরে ১০২ বঙ্গাব্দের উল্লেখ এল কী
করে?
এইসব প্রশ্ন পালটা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে
জিজ্ঞাসা, বাঙ্গালি আত্মবিস্মৃত জাতি। আসল
ছেড়ে নকলের পেছনে ছোটাটাও বাঙ্গালির
বৈশিষ্ট্য। বঙ্গাব্দের প্রবর্তনের ক্ষেত্রে মহাক্ষ্ম
রাজা শশাঙ্ককে অস্বীকার করার ক্ষেত্রেও তেমন
মানসিকতারই দায়ী নয় তো?