• About
  • Contact Us
Sunday, October 19, 2025
Swastika
No Result
View All Result
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • সঙ্ঘবার্তা
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • ই -পত্রিকা
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • সঙ্ঘবার্তা
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • ই -পত্রিকা
No Result
View All Result
Morning News
No Result
View All Result
Home প্রচ্ছদ নিবন্ধ

14th April প্রচ্ছদ নিবন্ধ

in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
14th April প্রচ্ছদ নিবন্ধ

বঙ্গপ্রদেশের সঙ্ঘকাজের আরম্ভ ও বিস্তার
সুনীলবরণ মুখোপাধ্যায়
আজ ভাবতেও অবাক লাগে যে অবিভক্ত বঙ্গের রাজধানী কলকাতায় সর্বপ্রথম সঙ্ঘশাখা শুরু হয় ১৯৩৯ সালে শ্রীগুরুজীর উপস্থিতিতে, সরকার লেনের হিন্দু মহাসভার অফিসের মধ্যে। সেবার (১৯৩৯) শ্রীগুরুজীর চেষ্টায় ৮ জন স্বয়ংসেবক কলকাতা থেকে সেই প্রথম নাগপুরে ওটিসি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কয়েকজন ফিরে আসেন কলকাতায়। ডাঃ হেডগেওয়ারের সামনে ৬ জন স্বয়ংসেবকের ‘প্রতিজ্ঞা’ হয়েছিল আমহার্স্ট স্টিট ও কেশবসেন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের ঘরে (বর্তমানে অবলুপ্ত) এদের মধ্যে ছিলেন শুশ্রুত মুখার্জি (তদানীন্তন কার্যবাহ ডাঃ সন্তোষ মুখার্জির ছেলে) ও দেবদাস চ্যাটার্জি। সেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত স্বয়ংসেবকদের মধ্যে জয়দেব ঢোলে (ঘোষ) ও বঙ্কিম ঘোষালের নাম উল্লেখযোগ্য। ডাক্তারজী কলকাতায় আসেন বীর সাভারকারের হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে যোগদানের জন্য। কলকাতা আগমন উপলক্ষ্যে ডাক্তারজী এই সময়েই মানিকতলা শাখায় (রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের ঘেরা মাঠে) কয়েকজন সহকর্মীসহ উপস্থিত ছিলেন। শ্রীবালাসাহেব দেওরস ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১৯৪০ সালের ওটিসি পূর্ব পর্যন্ত কলকাতা তথা বঙ্গের কাজ দেখাশোনা করতেন। তাঁর সঙ্গেই ১৯৪০ সালে ওটিসি দ্বিতীয় ব্যাচ কলকাতা থেকে নাগপুরে যায়। এই ব্যাচের মধ্যে বর্তমানে প্রদেশের প্রান্ত সঙ্ঘচালক কালিদাস বসু, জ্ঞানেশ সান্যাল (গোরাদা) ও বঙ্কিম ঘোষাল ছিলেন। ১৯৪০ সালের নাগপুর ওটিসি-তে শেষদিনে গোরাদা বঙ্গপ্রদেশের ‘প্রতিনিধিত্ব করেন, বাংলাভাষায় তাঁর বক্তব্য রাখেন। গোরাদা কয়েকবছর আগেই স্বর্গগত হয়েছেন। তার কিছুদিন আগে তাঁর উপর কলকাতা মহানগরের সঙ্ঘচালকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে কলকাতার সঙ্ঘশাখা সরকার লেনের ছাদ থেকে নেমে আসে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের বিপ্লবী পুলিনবাবুর মাঠে, সেখান থেকে বাদুড়বাগান পার্কে এবং পরে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের একটি ঘেরা মাঠে। সেখানে এখন বিদ্যমান জিতেন্দ্র নারায়ণ রায় ইনফ্যাক্ট ও নার্সারি স্কুল। এখানেই বঙ্গের প্রথম প্রাদেশিক প্রচারক শ্রীবালাসাহেব দেওরসের তত্ত্বাবধানে সর্বপ্রথম মূল শাখার ধ্বজ লাগানো এবং সঙ্ঘের প্রথম প্রার্থনা (মরাঠি ও হিন্দি) আরম্ভ হয়। অকস্মাৎ একদিন এই ঘেরা মাঠে প্রবেশ করা বন্ধ হয়ে যায়। অদ্ভুত ধৈর্য সহকারে বালাসাহেব চেষ্টা করেন যাতে বন্ধ দরজা খুলে যায়। কিন্তু সফলতা এল না। শান্ত, স্থির ও দৃঢ়তার সঙ্গে বালাসাহেব কয়েকহাত জমি পরিষ্কার করে মানিকতলা তেলকলের মাঠে সঙ্ঘশাখার কাজ চালিয়ে যান। এই তেলকলের মধ্যে সঙ্ঘস্থানে শ্রীবালাসাহেব ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে আমন্ত্রণ করে এনে স্বয়ংসেবকদের ‘গার্ড অফ অনার’ দেন। শ্রীবিঠলরাও পাল্কী নাগপুর থেকে প্রথমে শ্রীগুরুজীর সঙ্গে (১৯৩৯) প্রথমে কলকাতায় আসেন কিছুদিনের জন্য এবং পরে ফিরে যান। শ্রীবালাসাহেব যখন ১৯৪০ সালে ওটিসি-র সময় নাগপুর যান তার পর দ্বিতীয় প্রাদেশিক প্রচারক শ্রীবিঠঠলরাও আবার কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বঙ্গপ্রদেশের সঙ্ঘকাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শ্রীদত্তাত্রেয় শ্রীধর গোরে (যবতমাল) কলকাতা নগরের প্রচারক ছিলেন। শ্রীবালাসাহেবজীর কলকাতা থাকাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে শ্রী আন্না কেদার এবং প্রভাকর তামসকর নামের দুজন কলেজ ছাত্র (মহারাষ্ট্রের স্বয়ংসেবক) খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাভাষা শিখে নিয়েছিলেন এবং কলকাতার সঙ্ঘশাখাতে কলেজ ছাত্রদের নিয়ে আসার ব্যাপারে তাদের অবদান ছিল অপরিসীম। এসময়ে প্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে ডাঃ সন্তোষ কুমার মুখার্জি ও বাবু পদ্মরাজ জৈন ছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কলকাতা সঙ্ঘের প্রথম নিবাস ছিল ২৫ নং আমহার্স্ট স্ট্রিট, তিনতলায়। আমহার্স্ট স্ট্রিট ও হ্যারিসন রোডের সংযোগস্থলে। সেখানেই শ্রীবালাসাহেব দেওরস অন্যান্য প্রচারকদের সঙ্গে থাকতেন। বঙ্গপ্রদেশের দ্বিতীয় প্রান্ত প্রচারক শ্রীবিঠলরাওয়ের কার্যকাল ছিল ১৯৪০-৪৬। সেই সময় কার্যালয় উঠে আসে ২৬নং বিধান সরণি, তিনতলা। (মুখ্য শাখা) শ্যামনগর, গোয়াবাগান, দর্জিপাড়া, জানবাজার, বড়বাজার, ভবানীপুর ইত্যাদি। গঙ্গার পশ্চিমপাড় শিবপুরেও শাখা আরম্ভ হয়। কলকাতার বাইরে প্রদেশের শাখা বলতে সলপ, গাইবান্দা, ময়মনসিংহ সুসং, নবদ্বীপ, বহরমপুর, মালদা, খঙ্গপুর, শ্রীরামপুর, রানাঘাট, কাঁচড়াপাড়া, ব্যারাকপুর, বর্ধমান, সিউড়ী, শিলিগুড়ি, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা উল্লেখযোগ্য। সেই সময়ের প্রচারক ও কার্যকর্তাদের মধ্যে দত্তোপন্ত ঠেংড়ী (হাওড়া), দত্তাত্রেয় (ময়মনসিংহ), কালিদাস সালোটকর (বহরমপুর), কালিদাস বসু (নবদ্বীপ), মুরলীধর নাইক (মালদা), রামপ্রসাদ দাস, (২৪ পরগনা ও হুগলী), সুকুমার ব্যানার্জি (চাঁপাই নবাবগঞ্জ), মাধব বনহাট্টি (বাঁকুড়া), ভাউ (বড়বাজার), নাগেশ সেজওয়ালকর (বর্ধমান) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
শ্রীবিঠঠলরাও নাগপুরে ফিরে যাওয়ার পর তৃতীয় প্রান্ত প্রচারক হয়ে আসেন নাগপুরেই শ্রী মনোহর রাও হরকরে। উনি বঙ্গপ্রদেশে ছিলেন ১৯৪৬-৫০। এই সময় দেশ স্বাধীন তথা দ্বিধাবিভক্ত হলো। অগণিত হিন্দু পূর্ববঙ্গ, মনোহররাও হরকরে পশ্চিম পঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে বাস্তুহারা ও সর্বহারা হয়ে পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্থানে চলে আসতে লাগলেন। গান্ধীজীর মুসলমান তোষণ নীতির প্রতিক্রিয়া ‘একমাত্র সঙ্ঘই হিন্দুদের রক্ষা করতে পারে’— এই ধারণা মনে রেখে অনেক বর্ষীয়ান হিন্দুও কলকাতা এবং এরাজ্যের অন্যান্য জেলায় দলে দলে শাখায় যোগদান করতে লাগলেন। ঠিক এইসময় নাথুরাম গোডসে গান্ধীজীকে হত্যা করল এবং তার সমস্ত দোষ সঙ্ঘের উপর পড়ল। ফলস্বরূপ সঙ্ঘকে অন্যায়ভাগে ১৯৪৮ সালে বেআইনি ঘোষণা করা হলো। পূজনীয় শ্রীগুরুজীকে গ্রেপ্তার করা হলো। সারা দেশে সঙ্ঘের প্রচারক ও কার্যকর্তাদের ধরপাকড়ও চলতে লাগল। এরাজ্যও বাদ গেল না। প্রতিবন্ধের সময়ও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরস্পর মেলামেশা অব্যাহত ছিল। তবুও ১৯৪৯-এর মাঝামাঝি যখন সঙ্ঘের উপর বাধানিষেধ উঠে গেল, আমরা অনুভব করলাম পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র দেশে কাজের দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে গেছি। ১৯৪৮-৪৯ নিষেধাজ্ঞার সময়ে দত্তোপন্ত ঠেংড়ীজী জেলের বাইরেই ছিলেন এবং এরাজ্যের কাজের দেখাশোনা করা ও যোগাযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁর উপরই ছিল। হাওড়ার শিবপুরে সঙ্ঘকাজের দায়িত্ব আগে থেকেই শ্রী পাণ্ডুরঙ্গ ক্ষীরসাগরজীর উপর ছিল। হাওড়া নগরের কাজের তিনিই ছিলেন প্রধান স্থপতি। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় তিনি জেলে ভীষণ অসুস্থ হন এবং মুক্তিলাভ করার পরেই তাঁর জীবনাবসান হয়। নাগপুরে ডাক্তারজীর স্মৃতিমন্দিরের সামনেই ‘পান্ডুরঙ্গ ভবন’ তাঁর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। বঙ্গপ্রদেশে সঙ্ঘকার্য আরম্ভের প্রথম উদ্দীপনা শ্রীগুরুজী ও শ্রীবালাসাহেবজীর কাছ থেকে এসেছিল-এটা আগেই বলা হয়েছে। তারপর পর্যায়ক্রমে এই প্রদেশে সঙ্ঘের গুরুদায়িত্ব যাঁদের উপর ন্যস্ত ছিল তাঁরা হলেন-
প্রান্ত সম্প্রচালক অধ্যাপক কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সম্প্রচালক (১৯৬৯-৭৯), অধ্যাপক অমল কুমার বসু ১৯৭৯-৮৪, কালিদাস বসু, অ্যাডভোকেট, কলিকাতা হাইকোর্ট। প্রথমে সহ প্রান্ত সঙ্গচালক ১৯৮৪-৮৯ ও পরে তিনিই তৃতীয় প্রান্ত সঙ্গচালক।
প্রান্ত কার্যবাহ-প্রথম প্রান্ত কার্যবাহ অমল কুমার বসু ১৯৬৩-৭৭, কালিদাস বসু ১৯৭৭-৮৪, সুনীলবরণ মুখোপাধ্যায় ১৯৮৪-
প্রান্ত প্রচারক-প্রথম প্রান্ত প্রচারক ১৯৩৯-৪০, বিঠঠলরাও পাকী ১৯৪০-৪৬, মনোহর হরকরে ১৯৪৬-৫০, (প্রতিবন্ধ সহ)। অমল কুমার বসু ১৯৪৯ সালে প্রথম কয়েক মাস দক্ষিণ কলকাতার প্রচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন পরে প্রান্ত প্রচারক ১৯৫০-৭৭), অমলকুমার বসু (২য় বার) পরে প্রান্ত প্রচারক হলেন ১৯৭৭-৭৯। শ্রী কেশবরাও দীক্ষিত সহপ্রান্ত প্রচারক ১৯৭৭-৭৯, প্রান্ত প্রচারক ১৯৭৯-৯১, শ্রীকৃষ্ণ মোতলগ সহপ্রান্ত ও প্রচারক ১৯৮১-‘৯১, সুনীলপদ গোস্বামী ১৯৯১ প্রান্ত প্রচারক।
পূর্বাঞ্চল ক্ষেত্র প্রচারক—একনাথ রাণাডে ১৯৪৯-৫৩, পরে অখিল ভারতীয় বৌদ্ধিক প্রমুখ, সরকার্যবাহ, ১৯৬২ বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। ভাউরাও দেওরস পূর্বাঞ্চল ক্ষেত্র প্রচারক- ১৯৬৫-৭৫, রজ্জু ভাইয়া ১৯৭৫-৭৭, কেএস সুদর্শন ১৯৭৭-৮১। বাবুরাও পালধিকর ১৯৮২…। কিছুদিন শ্রীমধুসূদন দেও ছিলেন। পরে শ্রীকৃষ্ণ মোতলগ ১৯৯১…। সঙ্ঘের উপর দ্বিতীয় আঘাত আসে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সঙ্ঘকে বেআইনি ঘোষণা করলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ সেদিন দেশব্যাপী যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সত্যাগ্রহ প্রভৃতির মাধ্যমে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা ছিল তার পুরোভাগে। প্রবল জনমতের চাপে, সেবারের লোকসভার নির্বাচনে সেই প্রথম কংগ্রেস দল কেন্দ্রের শাসন ব্যবস্থা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। সঙ্ঘ দ্বিতীয়বার সরকারি বাধা ও বিরোধের কষ্টিপাথরে সঙ্ঘশক্তিকে যাচাই করে এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
এরপর আরও ১৫টি বছর পার হয়ে গেছে। সংগঠনের স্বাভাবিক নিয়েমে এবং প্রচারক, কার্যকর্তা ও স্বয়ংসেবকদের নিরলস প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘের শাখার সংখ্যা এখন প্রায় ১০০০। গত কয়েকবছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ কাজের অগ্রগতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পশ্চিম দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি সীমান্তবর্তী জেলাগুলি ছাড়াও বর্ধমান, বীরভূম জেলাতেও শাখার সংখ্যা ১২৫ থেকে ১৫০ মধ্যে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সারা প্রদেশে একটি মাত্র সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের আয়োজন করতে হতো। এখন প্রথম বর্ষের জন্য উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের আলাদা আয়োজন করতে হয়। এছাড়া দ্বিতীয় বর্ষের বর্গতো আছেই। প্রদেশে প্রচারকের সংখ্যাও বাড়ছে। পরম পূজনীয় সরসঙ্ঘচালকজীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সম্প্রতি একশো জনের বেশি স্বয়ংসেবক প্রচারক রূপে সঙ্ঘের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারকের সংখ্যা ২২৫। সম্প্রতি সুনীলপদ গোস্বামী নবীন প্রাদেশিক প্রচারক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। প্রাদেশিক কার্যকরী মণ্ডলের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৪। ‘সঙ্ঘ সমাচার’ ও ‘জাগরণ’ নামে দুটি পত্রিকা সঙ্ঘের প্রকাশন বিভাগ থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের পরিশ্রমে ও অর্থে ১৯৮৯ সালে সঙ্ঘের নতুন প্রাদেশিক কার্যালয় ‘কেশব ভবন’-এর উদ্বোধন হয়েছে। এই উদ্বোধন উপলক্ষ্যে বঙ্গপ্রদেশে সঙ্ঘের কাজের বিস্তারের জন্য অন্য প্রদেশ থেকে যাঁরা প্রচারক এসেছিলেন তাঁদেরও আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। সঙ্ঘপ্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারজীর জন্মশতাব্দীর কার্যক্রম উপলক্ষ্যে সারা প্রদেশে প্রায় ১০,০০০ গ্রামে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। ইতিমধ্যেই বহু গ্রামে ‘সঙ্ঘমণ্ডলী’ গঠিত হয়। তাছাড়া সঙ্ঘের প্রচার অভিযান, ষাট বছর পূর্তি প্রভৃতি কার্যক্রম স্বয়ংসেবকরা উৎসাহের সঙ্গে সাফল্যমণ্ডিত করেছে। একাত্মতা যজ্ঞ, রামশিলা পূজা, করসেবা প্রভৃতি হিন্দু জাগরণের নানা কাজে স্বয়ংসেবকরা প্রথম সারিতে থেকে সুষ্ঠুভাবে রূপায়ণে সাহায্য করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘের ইতিহাসে এই প্রথম প্রান্ত প্রচারক তথা তদূর্ধ্বদের বার্ষিক দীপাবলী বৈঠক (১৯৯১) কলকাতায় হলো। বৈঠক উপলক্ষ্যে স্বয়ংসেবকদের একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এরকম সম্মেলন এর আগে কখনও এরাজ্যে হয়নি। কল্যাণী শিবিরও এরাজ্যের স্বয়ংসেবকদের (২৩-২৬ জানু. ৯২) কাছে একটি ঐতিহাসিক কার্যক্রম। এর আগে ব্যাঙ্গালোর ও পুণায় এইরকম বিশাল শিবির হয়েছিল। এরাজ্যের সত্তরের দশকে এইরকম বিশাল শিবিরের প্রচেষ্টা একবার হয়েছিল। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধের জন্য তা স্থগিত রাখতে হয়। ১৯৯২-এর এই প্রাদেশিক শীত শিবির পশ্চিমবঙ্গের স্বয়ংসেবকদের কাছে এক প্রেরণাদায়ী স্মৃতি হয়ে থাকবে।


ত্রিপুরায় সঙ্ঘকাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কানু রঞ্জন দেবনাথ
ত্রিপুরায় সঙ্ঘকাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস কানু রঞ্জন দেবনাথ ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য। ভারতের সেভেন সিস্টার্সের এক সিস্টার কিংবা বলা যায় ভারতের ‘অষ্টলক্ষ্মী’র এক লক্ষ্মী আমাদের এই ত্রিপুরা। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ত্রিপুরা প্রান্তের ইতিহাস বহু পুরানো। ১৯৫০ সালে ত্রিপুরাতে সঙ্ঘের শাখা শুরু হয়। সঙ্ঘের কথা বলতে গেলে ত্রিপুরার সবচেয়ে প্রবীণ একনিষ্ঠ, নিষ্ঠাবান স্বয়ংসেবক পীযূষকান্তি ভট্টাচার্যের নাম বলতে হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের পুরানো ও নিষ্ঠাবান স্বয়ংসেবকদের মধ্যে তিনিই বর্তমানে জীবিত। এখন তাঁর বয়স প্রায় ৮০ বছর। তাঁর কাছ থেকেই আমরা ত্রিপুরার ত্রিপুরার প্রথম প্রচারক গণেশ দেবশর্মা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মোটামুটি একটা তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত জানতে পারি। তাঁর লেখা ‘আমার স্মৃতিতে ত্রিপুরায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ ত্রিপুরার স্বয়ংসেবকদের কাছে একটি আকর গ্রন্থ।
বর্তমানে ত্রিপুরাতে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত মোট শাখা ৩১৫টি এবং আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত এটি বেড়ে ৩৭৯টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সাপ্তাহিক মিলন মোট ১৪৭টি এবং আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১৯২ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। শাখাযুক্ত খণ্ড ৫২টি এবং আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত হবে ৫৯টি। শাখা যুক্ত খণ্ড কেন্দ্র আছে সারা ত্রিপুরাতে ৪০টি এবং আগামী অক্টোবর মাস নাগাদ ৫৪টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৯২৫ সালে নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও ত্রিপুরা রাজ্যে সঙ্ঘকাজ শুরু হয় ১৯৫০ সালে। এর অনেক আগেই পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে সঙ্ঘের আগমন ঘটেছিল। ত্রিপুরায় আগত সঙ্ঘের প্রথম প্রচারক ছিলেন গণেশ দেবশর্মা। তিনিই প্রথমে ত্রিপুরাতে সঙ্ঘের বীজারোপণ করেছিলেন। তিনি যাঁদের নিয়ে সঙ্ঘের শাখা শুরু করেছিলেন, তাঁরা হলেন ত্রিপুরার স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রমথনাথ ভট্টাচার্য, শচীন দত্ত, বিনয় গাঙ্গুলি, তড়িৎ দাশগুপ্ত, শান্তি দাশগুপ্ত, পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা, ধীরেন্দ্র চক্রবর্তী, অবনী দাস, শশাঙ্ক ভদ্র প্রমুখ। সেই সময়ে পীযূষকান্তি ভট্টাচার্যের বয়স ছিল প্রায় ৫-৬ বছর মাত্র। পীযূষদার সবচেয়ে বড়ো অবদান হলো তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭সালে যখন দেশে জরুরি অবস্থা চলছিল, সেই সময় তিনি প্রায় ১৩ মাস গুয়াহাটি জেলে ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে তাঁকে আরও প্রায় ৩ মাস কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছিল। এই হিসেবে তাঁকে ১৬ মাসের মতো এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। ৮ জুলাই গুয়াহাটিতে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের খরচ জোগাড় করতেন মায়ের পইতা বিক্রি করা টাকা থেকে।
ত্রিপুরার প্রথম প্রচারক গণেশ দেবশর্মা তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কামান চৌমুহিনীতে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনিই ‘বিবেক বিতান’ নামে প্রথম সঙ্ঘ কার্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন। আগরতলার শঙ্কর চৌমুহিনীর কাছে বিজয় কুমার স্কুলের মাঠে ত্রিপুরার প্রথম শাখা শুরু হয়েছিল হয়। সেই শখায় আসতেন পরিমল ভট্টাচার্য, মধুসূদন চক্রবর্তী, নিখিল চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তী, কাজল রায় বর্মণ-সহ আরও কয়েকজন। এর কিছুদিন পরে অরুন্ধতীনগরে, মেলারমাঠে, ভাটি অভয়নগরে, শিবনগরেও শাখা শুরু হয়।
১৯৫২ সালে ত্রিপুরায় প্রথম ৫ দিনের বর্গের আয়োজন হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রীগুরুজী (মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর) ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবাসে এসেছিলেন। গণেশদার পরে সন্তোষদা ত্রিপুরাতে আসেন। সন্তোষদার সময়ে ত্রিপুরার সঙ্ঘ কার্যালয় কামান চৌমুহিনী থেকে স্থানান্তরিত হয়ে কৃষ্ণনগরে চলে আসে। এরপর লামডিং থেকে রবীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস নামে একজন প্রচারক এসেছিলেন। তাঁর সময়ে ত্রিপুরার উদয়পুর ও বিলোনিয়াতে শাখা শুরু হয়। উদয়পুরের সমীর চক্রবর্তী প্রথম সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের কোনো এক মাসে ত্রিপুরাতে স্বস্তিকা পত্রিকার কাজ শুরু হয়েছিল।
ত্রিপুরার স্বয়ংসেবকরা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের আর্থিকভাবে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছিলেন। ত্রিপুরার স্বয়ংসেবকরা অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সঙ্ঘের কাজ যথাসাধ্য চালিয়ে গেছেন। ১৯৮০ সালে ত্রিপুরাতে সুদর্শনজী এসেছিলেন। ১৯৮০ সালে কলেজটিলা শাখা শুরু হয়। অভয়নগর হিন্দিস্কুলের মাঠের স্বয়ংসেবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভবতোষ পাল, ব্রজলাল ধর, ধীমান দেববর্মা প্রমুখ।
ত্রিপুরায় আজ যে সঙ্ঘের কাজ চলছে তা এত সহজ ছিল না। রাজনৈতিক বিরোধিতা পূর্ণমাত্রায় ছিল। ত্রিপুরায় প্রথমে কংগ্রেস সরকার ছিল। তারপরে বামফ্রন্ট ২০১৮ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত ত্রিপুরাতে শাসন করেছে। এছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিদের বিরোধিতা তো ছিলই। সর্বোপরি ছিল খ্রিস্টান মদতপুষ্ট চরম হিন্দুবিদ্বেষী উগ্রপন্থীরা। বামপন্থী, কংগ্রেস, খ্রিস্টান মিশনারি এবং ত্রিপুরার একটি বিশেষ মতাবলম্বী উগ্রবাদী এই চার শক্তি সব রকমভাবে ত্রিপুরাতে সঙ্ঘের বিরোধিতা করে গেছে। তাই ত্রিপুরায় যাঁরা সঙ্ঘকে ভালোবাসতেন বা সঙ্ঘের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই বিভিন্নরকমের ভয়ের কারণে সঙ্ঘে সরাসরি যোগদান করতে পারেননি। যারা সরাসরি সঙ্ঘে যোগদান করেছিলেন, তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সঙ্ঘের কাজ করেছেন। তাঁরা কীরকম ঝুঁকি নিয়ে তখন ত্রিপুরাতে সঙ্ঘের কাজ চালিয়ে গেছেন, তা তাঁদের মুখ থেকে শুনলে আমাদের শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে!
ত্রিপুরার ভয়ানক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই বা জেনেই ত্রিপুরাতে সারা দেশ থেকে শত শত সাহসী, নিবেদিতপ্রাণ এবং সুশিক্ষিত প্রচারকরা এখানে এসেছিলেন। তারা সকলেই ত্রিপুরার স্থানীয় ভাষা, উপভাষা, খাদ্যাভ্যাস ও রীতিনীতির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এই কারণেই পরবর্তী সময়ে অনেক স্থানীয় স্বয়ংসেবক প্রচারক ও পূর্ণকালীন হিসেবে বের হয়েছেন। ত্রিপুরায় সঙ্ঘকাজের কীরকম প্রতিকূল অবস্থা ছিল তার জ্বলন্ত ঘটনা হলো ত্রিপুরাতে সঙ্ঘের চারজন কার্যকর্তাকে খ্রিস্টান মদতপুষ্ট উগ্রপন্থীদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। এটি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার স্বয়ংসেবকদের কাছে খুবই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনা।
১৯৯৯ সালের ৬ আগস্ট, ত্রিপুরার ৮২ মাইল থেকে ২ কিলোমিটার দূরে কাঞ্চনছড়ায় কল্যাণ আশ্রমের ছাত্রাবাস থেকে সঙ্ঘের চারজন কার্যকর্তাকে ত্রিপুরার একটি উগ্রপন্থী দল অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এই চারজন কার্যকর্তার মধ্যে ছিলেন ক্ষেত্রকার্যবাহ শ্যামলকান্তি সেনগুপ্ত। তিনি অসমের করিমগঞ্জের স্বয়ংসেবক হলেও কলকাতা নিবাসী ছিলেন। দ্বিতীয়জন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত ত্রিপুরার বিভাগ প্রচারক দীনেন দে। তৃতীয়জন ত্রিপুরার বিভাগ প্রচারক সুধাময় দত্ত। তিনি স্বস্তিকার ব্যবস্থাপক হিসেবে ২৭/১বি, বিধান সরণিতে দীর্ঘদিন স্বস্তিকা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিও পশ্চিমবঙ্গের। চতুর্থজন শুভঙ্কর চক্রবর্তী। তিনিও পশ্চিমবঙ্গের ছিলেন। ত্রিপুরার হিন্দুবিদ্বেষী উগ্রপন্থীরা ২০০০ সালে জনজাতি হিন্দু সন্ন্যাসী শান্তিকালী মহারাজকে গুলি করে হত্যা করে।
ত্রিপুরার সঙ্ঘকার্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ত্রিপুরার জাতি-জনজাতি উভয়েরই যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ত্রিপুরার মাতৃমণ্ডলীর অবদানও অনস্বীকার্য। পীযূষকান্তি ভট্টাচার্যের বিবরণ অনুসারে, ‘ত্রিপুরায় সঙ্ঘ যাত্রা এনেছিলেন গণেশদা, সন্তোষদা একে বিস্তৃত করেছেন। অল্পদিনে ত্রিপুরায় দাগ রেখে গেছেন ঝুনুদা ও গুরুদা। রামদার সময় সঙ্ঘ নিত্য শাখার পরিসর ছাপিয়ে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে’।
পীযূষদার বর্ণনানুসারে ত্রিপুরায় সঙ্ঘকার্যে নিজেদের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, মধুকর লিময়ে (মধুজী), সুধাকর কুলকার্ণী, শশীকান্ত চৌথাইওয়ালে, বিনায়ক কানিতকর, অরবিন্দ ভট্টাচার্য, গৌরীশঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখ। এই জীবনব্রতী প্রচারকদের অসীম ত্যাগ ও তিতিক্ষায় ত্রিপুরা-সহ সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সঙ্ঘকাজ বিস্তার লাভ করেছে।
স্থানীয় স্বয়ংসেবকদের মধ্যে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন কামনাদা, প্রশান্তদা, চিত্তদা, সত্যদা, রামনারায়ণদা, দুলালদা, দীপকদা, বিষ্ণুদার কথা, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে সঙ্ঘের কাজে প্রচণ্ড দায়িত্ব বহন করেছেন এবং সঙ্ঘের কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বলা দরকার। একসময় ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়াতে যখন সঙ্ঘের বদনামের খবরই শুধু প্রকাশ হতো, তখন মাঝে মাঝে ‘অভিম্যু রায়’ নামে একজনের লেখায় সঙ্ঘের সঠিক তথ্য এবং কার্যাবলী প্রকাশ হতো। স্বয়সেবকরা ওই লেখা পড়ে খুবই আনন্দ লাভ করত। সেই অভিমুন্যদা এখনও মাঝে মাঝে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিষয়ে লেখা লিখে চলছেন। ত্রিপুরায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঠিক তথ্য অভিমন্যুদাই লেখা পড়েই সবাই জানতে পারে।
ত্রিপুরার মাটি সঙ্ঘকাজের উর্বর ভূমি। কারণ ত্রিপুরার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং সঙ্ঘও হিন্দুত্বনিষ্ঠ সংগঠন। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার কারণে বেশিরভাগ মানুষ সঙ্ঘ থেকে দূরে থাকতেন। কার্যকর্তা ও স্বয়ংসেবকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে এখন ত্রিপুরার সামাজিক পরিবেশ অনুকূল হয়েছে। আজকাল নতুন প্রজন্মের তরুণে ও যুবকেরা সঙ্ঘমুখী হচ্ছে।
একদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থার মতো দেশবিরোধী কার্যকলাপ যখন তুঙ্গে ছিল এবং অন্যদিকে বামপন্থা এবং নেহরুপন্থার মতো হিন্দুবিরোধী দলগুলির রমরমা চলছিল, ঠিক সেই চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যারা ত্রিপুরাতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে টিকিয়ে রেখে আজকের এই জায়গাতে এনেছেন, সঙ্ঘের শতবর্ষে তাঁদের সবাইকে প্রণাম। তাঁরা মৃত্যুভয়কে জয় করে ত্রিপুরা রাজ্যকে ভয়মুক্ত করেছেন।



সঙ্ঘকাজের পথ কণ্টকাকীর্ণ

বর্তমানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রার্থনায় বলি ‘কণ্টকাকীর্ণ মার্গম্’। এই কণ্টকাকীর্ণ পথে বঙ্গভূমিতে দীর্ঘ ৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সঙ্ঘ কাজ চলছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে হিমালয় (দার্জিলিং), দক্ষিণে সাগর আর মাঝে অসংখ্য নদী-নালা। আমরা তপোভূমি নর্মদার কথা শুনেছি। নর্মদার তীরে বহু সাধক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গও তাই। বহু সাধকের সাধনস্থল এই বঙ্গভূমি।
বালাসাহেব সঙ্ঘপ্রতিষ্ঠাতা প্রাতঃস্মরণীয় ডাক্তারজী পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরম পূজনীয় শ্রীগুরুজীর জীবনের অনেকটা সময় পশ্চিবঙ্গে কেটেছে। মুর্শিদাবাদের সারগাছি আশ্রমে অনেকদিন থাকেন এবং স্বামী অখণ্ডানন্দজীর কাছে তিনি দীক্ষা নেন। বঙ্গপ্রদেশে সঙ্ঘকাজ শুরু করার জন্য ডাক্তারজী শ্রীগুরুজীকেই পাঠান। কিন্তু ডাক্তারজীর শরীর অসুস্থ হওয়ার জন্য কিছুদিন পরেই শ্রীগুরুজীকে নাগপুরে ফিরে যেতে হয়। কলকাতায় পাঠানো হয় দেওরসজীকে, যিনি পরবর্তীকালে তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক হন। কালিদাস বসু, সুনীলবরণ মুখার্জি, জয়দেব ঢোলে প্রমুখ শ্রীগুরুজী ও বালাসাহেবজীর সময় সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক হন। ১৯৪০ সালে ডাক্তারজীর দেহাবসানের পর শ্রীগুরুজী সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক হন। ফিরে যেতে হয় বালাসাহেব দেওরসজীকে। নাগপুরের সঙ্ঘকাজের মূল দায়িত্ব তাঁর ওপর। ১৯৭৪ সালে রজ্জুভাইয়ার সঙ্ঘকাজে কলকাতার দায়িত্ব ঘোষণা হলেও জরুরি অবস্থা ঘোষণা হওয়ায় তাঁকে আরও বড়ো দায়িত্ব দিয়ে দিল্লিতে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে রজ্জু ভাইয়াও কলকাতার সঙ্ঘকাজের কণ্টকাকীর্ণ পথে বিচরণ করেছেন। সুদর্শনজীও দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বহুবার কলকাতায় এসেছেন। বর্তমান পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক মোহনজী সরকার্যবাহ হওয়ার পর তাঁর প্রথম কেন্দ্র হয় কলকাতা। অর্থাৎ সমস্ত সর- সঙ্ঘচালকেরই কোনো না কোনো সময়ে এই বঙ্গভূমির সঙ্গে একটা নাড়ির টান গড়ে ওঠে।
১৯৩৯-৪৯ এই সময়কালে বঙ্গপ্রদেশে সঙ্ঘকাজ সর্বব্যাপী ছিল না। প্রথম শাখা শুরু হয় কলকাতায়। দেশবিভাজনের আগেই কলকাতার সঙ্গে সঙ্গে চব্বিশ পরগনা, মুশির্দাবাদ, বহরমপুর, নদীয়ার নবদ্বীপ, বর্ধমান ও মালদায় শাখা শুরু হয়। ১৯৪৭-এর আগে এখানে প্রচারক হিসেবে কাজ করেন নাগপুর থেকে আগত মনোহরলাল হরকরেজী, কালিদাস সালোটকরজী, মালদায় মুরলীধরজী। দেশ বিভাগের আগে শত শত যুবক শাখায় আসত। সেসময় পূর্ববঙ্গেও শাখা শুরু হয়। প্রচারক হিসেবে যান শৈলেন্দ্রনাথ সিংহ। সুকুমার ব্যানার্জি, রাজশাহীতে সঙ্ঘকাজ বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। দেশবিভাগ রুখে দেবার জন্য পঞ্জাবের মতো বঙ্গের স্বয়ংসেবকরাও আপ্রাণ চেষ্টা করেন। সেসময় বঙ্গপ্রদেশের কাজের দায়িত্বে মনোহরলাল হরকরেজী। আজকে যেমন জেহাদি শক্তি, হিন্দু বিরোধী শক্তি এরাজ্যে সক্রিয়তা দেখাচ্ছে; সেই সময়েও কিন্তু একই চিত্র ছিল। তখন সুবিধাবাদী- সেকুলারপন্থী কংগ্রেস, কমিউনিস্ট এবং মুসলিম লিগ তথা জেহাদি শক্তি সক্রিয়। ইংরেজরা তাদের মদত দিত। দেশ- বিভাগের প্রাক্কালে শ্রীগুরুজী যেমন অনবরত ভ্রমণ করেন, বঙ্গপ্রদেশের তৎকালীন প্রান্তপ্রচারক মনোহরলালজীও এরাজ্যের বহুস্থানে অনবরত ভ্রমণ করেন। বর্তমান বাংলাদেশের বহু প্রবুদ্ধ নাগরিকের সঙ্গে দেখা করে দেশবিভাজন সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তখন বুদ্ধিজীবী, প্রবুদ্ধ হিন্দু সমাজ এক নির্লিপ্তভাব দেখিয়েছিল- তার পরিণাম ১৯৪৬ সালে কলকাতায় এক ভয়াবহ জেহাদি আক্রমণ। সুরাবর্দির লক্ষ্য একটাই, সমগ্র বঙ্গকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। সেই সময় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং অন্যান্য রাজনৈতিক এবং কিছু অরাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্দোলনের ফলেই হিন্দু বাঙ্গালিদের হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হয়।
১৯৪৭-৫৭ অবধি দেশবিভাজনের ফলে বঙ্গ ও পঞ্জাবের অর্ধেকের বেশি জায়গা চলে যায় পাকিস্তানে। বঙ্গপ্রদেশে সঙ্ঘের কাজ তখন সবেমাত্র ১০ বছরে পা রেখেছে। তখনই গান্ধীহত্যার মিথ্যা অপবাদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। স্বয়ংসেবকরা এই নিষেধাজ্ঞাকে ভয় করেনি। খুব অল্প স্থানেই তখন সঙ্ঘের কাজ। কিন্তু সেইসময় বরিষ্ঠ প্রচারকদের নেতৃত্বে সারা ভারতের সঙ্গে এরাজ্যের স্বয়ংসেবকরাও জেলে যায়। সত্য কোনোদিন পরাজিত হয় না। গান্ধী হত্যার কারণে সারা ভারতে চুয়াল্লিশ হাজার স্বয়ংসেবক সত্যাগ্রহ করেছিলেন। কংগ্রেস সরকার পরবর্তীকালে সঙ্ঘের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই সময় সক্রিয় ভূমিকা নেন জ্ঞানচন্দ্র সান্যাল (গোরাদা), সুনীল মুখার্জি, সুকুমার ব্যানার্জি, রামপ্রসাদ দাস, সীতানাথ গোস্বামী, কালিদাস বসু, অহীন্দ্রকুমার দে প্রমুখ কার্যকর্তা।
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর পূর্বক্ষেত্রের ক্ষেত্র প্রচারক হিসেবে এলেন একনাথ রাণাডে। তখন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অসম ও ওড়িশাও ছিল। পূর্বাঞ্চলে সঙ্ঘকাজ বিস্তারের জন্য তিনি মধ্যপ্রদেশের বিভাগ প্রচারক অমলকুমার বসুকে পশ্চিমবঙ্গের প্রান্ত প্রচারক করে নিয়ে এলেন। অমলদা ১৯৪৯-এ আসার পর কখনো প্রান্ত প্রচারক, কখনো প্রান্ত কার্যবাহ, কখনো প্রান্ত সঙ্ঘচালক রূপে এরাজ্যের স্বয়ংসেবকের পথনির্দেশ করেন এবং এরাজ্যে সঙ্ঘকাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। সেসময় (১৯৫০) এলেন কেশবরাও দীক্ষিত। মধুকর লিমায়ে গেলেন অসমে। গৃহী কার্যকর্তারূপে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন বসন্তরাও বাপট। মধ্যপ্রদেশে পড়াশোনা শেষ করে পশ্চিমবঙ্গকে কর্মজীবন হিসেবে বেছে নেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একজন আদর্শ গৃহী কার্যকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। এরাজ্যের কাজকে বাড়ানোর জন্য আরও অনেক গৃহী কার্যকর্তা এই কলকাতায় কাজ করেন। উল্লেখযোগ্য মানিকতলার শ্যামচাঁদ মল্লিক প্রমুখ।
দেশবিভাজনের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে যে সমস্ত হিন্দু এদেশে চলে আসছে, তাদের সহায়তার জন্য একনাথজীর নেতৃত্বে তৈরি হলো বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি। শ্যামচাঁদ মল্লিক বাস্তুহারা সহায়তার সমিতির মাধ্যমে সেবাকাজ করেন, সঙ্গে ভোঁওরলালজী। রাজস্থানের বাসিন্দা কলকাতার বহু স্বয়ংসেবক এখনও ভোঁওরলালজীর কথা শুনে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন। শিব ভগবান বাগেড়িয়াজী, যুগলকিশোর জৈথেলিয়াজী-র মতো শত শত গৃহী কার্যকর্তার অবদান অনস্বীকার্য এই রাজ্যে সঙ্ঘকাজকে পুষ্ট করার জন্য। ১৯৫০-র পর কলকাতায় এলেন বসন্তরাও ভট্ট। কণ্টকাকীর্ণ পথ কেমনভাবে সুগম করতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন বসন্তরাও ভট্ট। পরবর্তীকালে কল্যাণ আশ্রমে গিয়ে সেখানকার কাজ দাঁড় করান। দুইভাই বংশীলাল সোনী ও অনন্তলাল সোনী সম্পর্ক করেন বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীর সঙ্গে যিনি পরবর্তীকালে রাজনীতি ও সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন। শ্যামমোহন দে (স্কুল শিক্ষক ছিলেন) প্রমুখ পরবর্তীকালে এরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন। রথীনদার (রথীন চক্রবর্তী) কথা সবাই স্মরণ করে। বিষম পরিস্থিতিতে তাঁরা দশ হাতে আগলে রেখে ওইসব স্থানে সঙ্ঘকাজ বিস্তার করেন।
১৯৫৭-১৯৬৭— পশ্চিমবঙ্গে অনেক বিষয়ে পটপরিবর্তন হয়। ১৯৫৭ সালে গোরক্ষা আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনে স্বয়ংসেবকেরা বড়ো ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ সালে যুদ্ধের সময় চীনা আক্রমণ এবং এখানকার কমিউনিস্টদের ব্যবহারের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে জাগ্রত করেন স্বয়ংসেবকরা। বোমডিলা, তেজপুর, অসমের বিভিন্নস্থানে চীনা আক্রমণের সময় ট্রাফিক পুলিশের কাজ করেন। সেনাবাহিনীকে রক্তদান, ওষুধ ও খাবার পাঠানোর কাজে স্বয়ংসেবকরা অগ্রণী ভূমিকা নেন। ১৯৬৫-র যুদ্ধেও স্বয়ংসেবকরা পিছিয়ে থাকেননি। তখন সব জেলায় সঙ্ঘকাজ শুরু হয়েছে।
ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে যুদ্ধ হলেও পশ্চিমবঙ্গের স্বয়ংসেবকরা বিভিন্নভাবে ওইসময় সক্রিয়। ১৯৬২ সালে যে বামপন্থীরা চুপ হয়ে যায়, তারা ৫-৭ বছর পর আবার সংগঠিত হয়। শুরু হয় নকশাল আন্দোলন, যার লক্ষ্য সমস্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া। অনেক স্থানে শাখার ওপর হামলা হয়। কিন্তু চারু মজুমদার, কানু সান্যালের নকশাল বাড়ি আজ সঙ্ঘের দুর্গ। সেখানে জনমানসে হিন্দুত্বের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সেসময় কিন্তু সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গও হয়। সেসময় বঙ্গের সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গে বিহার, অসম, ওড়িশার স্বয়ংসেবকরা আসতেন। বালাসাহেবজীর ছোটোভাই ভাউরাউজী ছিলেন ক্ষেত্র প্রচারক। ১৯৭০ সালে ভাউরাউজীর আহ্বানে দেশ-ধর্ম-সমাজ রক্ষার জন্য বহু সাধু-সন্ত সারা ভারতকে পথ দেখান। এরাজ্যের কাজের জন্য বাইরে থেকে কেন প্রচারক আসবে? এখানকার প্রচারক চাই। এই আহ্বানে তৎকালীন প্রান্ত সঙ্ঘচালক কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী (মাস্টার মশাই)-র বড়ো ছেলে অরুণ কুমার চক্রবর্তী প্রচারক বের হন। ১৯৭১ সালে তিনি প্রচারক হিসেবে মালদা যান। রাধাগোবিন্দ পোদ্দার কলকাতা থেকে প্রচারক বের হয়ে হুগলী এবং পরে মালদায় যান। শ্যামলাল ব্যানার্জি কলকাতা থেকে প্রচারক বের হন। শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রচারক পরম্পরা। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় অত্যাচারিত হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে থাকে। ভারতবর্ষের জওয়ানদের জন্য বাংলাদেশের জন্ম। বনগাঁ সীমান্তে বাস্তুহারা সহায়তা সমিতির মাধ্যমে হাজার হাজার পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়। ক্যাম্প হয়েছিল বেনাপোতায়। সেসময় কলকাতায় প্রচারক রতনদা (বিশ্বরঞ্জন ভট্টাচার্য) মূলত পশ্চিমবঙ্গের লোক কিন্তু বড়ো হন দিল্লিতে। সেসময় শ্যামচাঁদদা, রতনদা, গজানন বাপটজী বনগাঁর মতো দুর্গম স্থানে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করেন।
উত্তরবঙ্গের হিলি বর্ডারে, মালদা বর্ডারে জওয়ানরা যুদ্ধে যাবার সময় এবং জয় করে ফেরার সময় বংশীদার নেতৃত্বে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। সমাজ যখন কষ্টে পড়েছে, সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা কোনোদিন পিছপা হননি—এগিয়ে এসেছেন। ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় রাগ পড়ল বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সঙ্ঘের ওপর। মধ্যরাতে কার্যালয় সিল করে দেওয় হয়। বিরোধী নেতাদের জেলে ভরা হয়। আজ অসহিষ্ণুতার কথা বলেন অনেকে। অসহিষ্ণুতা কী জিনিস তা জানতে হবে কংগ্রেসের কাছ থেকে। তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেবজীকে জেলে বন্দি করা হয়। শুরু হলো বিরোধীদের ওপর অত্যাচার। ননী পাল্কিওয়ালা লিখেছেন- ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভারতের সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দ ছিল না। ৪৪তম সংশোধনী করে, বিরোধীদের জেলে ভরে, সমস্ত সামাজিক সংগঠনকে রুদ্ধ করে রাতের অন্ধকারে সেকুলার ও সোশ্যালিস্ট শব্দ দুটি সংবিধানে প্রবেশ করানো হয়। আজও তার পরিবর্তন হয়নি। ১৯৭৭ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর সারা ভারতের সঙ্গে এরাজ্যের কাজও বাড়তে থাকে। ১৯৭৭-৮৭ এই কালখণ্ডে পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘকাজের ব্যাপক বিস্তার হয়। জেলায় জেলায় তো কাজ ছিলই। এই কালখণ্ডে মহকুমা এবং খণ্ড স্তর পর্যন্ত সঙ্ঘের কাজ বাড়তে শুরু করে।
১৯৮৩ সালে হিন্দু সমাজকে জাগ্রত করার জন্য একটি ভাবাত্মক একাত্মতা রথযাত্রা হয়। কলকাতার ওপর দিয়ে একটি রথ যায়। এপ্রসঙ্গে মোরপন্থ পিংলেজীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শাসন। তারা জঘন্যরূপে এই রথযাত্রার বিরোধিতা করে। কিন্তু তারা কেউ আটকাতে পারেনি। মাইকে করে জনসাধারণের উদ্দেশে এই রথযাত্রা বয়কট করার আহ্বান জানায়। কিন্তু কোচবিহার থেকে চব্বিশ পরগনা পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছেন। এরপর এরাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে সঙ্ঘ কাজের আরও বিস্তার হয়। অনেক জেলায় সঙ্ঘের ১০০-র বেশি শাখা হয় তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিম দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, হুগলী, উ: ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর।
১৯৮৭-১৯৯৭—এই দশ বছরে আমাদের কণ্টকাকীর্ণ পথের অনেক কণ্টক দূর করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। ১৯৮৬ সালে যখন রামজন্মভূমির তালা খুলে গেল, যখন রামজন্মভূমি আন্দোলন শুরু হলো-সেই আন্দোলনের কত বিরোধিতা হয়েছে। যারা সেদিন বিরোধিতা করেছিল আজ তারা কোথায়? যে লালুপ্রসাদ যাদব বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁকে জেলে বসে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন দেখতে হলো। যে মুলায়ম সিংহ গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল, যে গুলিতে কলকাতার ১৮-২০ বছরের যুবক রাম ও শরদ কোঠারী ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ ধ্বনি দিয়ে গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই মুলায়কেও ঘরে বসে দেখতে হয়েছে যে রামমন্দিরের শিলান্যাস হচ্ছে! লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী সেদিন গর্জে উঠেছিল।
১৯৩৯ সালে বঙ্গপ্রদেশে সঙ্ঘকাজ শুরু হয়, তার ৫০ বছর পর ১৯৮৯ সালে ডাক্তারজীর জন্মশতবর্ষের কলকাতায় গড়ে উঠল ‘কেশবভবন’— প্রান্ত কার্যালয়। তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেওরসজী এর উদ্বোধন করতে আসেন। এসেছিলেন সেইসব প্রচারকেরা, যাঁরা একসময় বঙ্গপ্রদেশে সঙ্ঘকাজ করেছিলেন। তখন ক্ষেত্র প্রচারক শ্রীকৃষ্ণরাও মোতলগ। ডাক্তারজীর জন্মশতবর্ষে বালাসাহেবজী আহ্বান করেন পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘকাজ বিস্তারের জন্য এরাজ্যের যুবকরা প্রচারক বের হোক। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এরাজ্য থেকে ১১১ জন প্রচারক বেরায়। এঁদের মধ্যে আজও অনেকে প্রচারক জীবন পালন করছেন। কেউ কেউ অসম, ত্রিপুরা, পঞ্জাব ও দিল্লিতে গেছেন। যে বঙ্গে একসময় বাইরে থেকে প্রচারক আসতেন, সেই বঙ্গের প্রচারকরা সমর্পিত মন নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গেছেন। এরাজ্যের চারজন কার্যকর্তা-শ্যামল সেনগুপ্ত, দীনেন দে, সুধাময় দত্ত, কাঞ্চন চক্রবর্তী—ত্রিপুরা থেকে অপহৃত এবং খুন হন। আমরা এঁদের ভুলতে পারি না। আজকে অসমে যে হিন্দুত্বের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার পেছনে পশ্চিমবঙ্গের স্বয়ংসেবকদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।
সঙ্ঘের ওপর অত্যাচার সবসময় হয়েছে। ১৯৪৮, ১৯৭৫ এবং ১৯৯২ সালে তিন-তিনবার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও কিন্তু স্বয়ংসেবকরা পিছপা হননি। ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে একটি মাত্র সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ হতো, এখন সেখানে চারটি সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ হচ্ছে। কার্যকর্তা নির্মাণ হচ্ছে। পরিস্থিতি বিরুদ্ধ থাকলেও আমরা কার্যকর্তা নির্মাণের মাধ্যমে নবনির্মাণের কাজে সময় দিতে পেরেছি, আমরা পিছিয়ে পড়িনি। হিন্দু সমাজকে জাগ্রত করার জন্য আমরা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করেছি। কল্যাণী মহাশিবিরে (১৯৯২) ১৮ হাজার স্বয়ংসেবক পূর্ণ গণবেশে তিনদিন উপস্থিত ছিলেন। সারা ভারতের কাছে এটি একটি উদাহরণ।
১৯৯৭ থেকে ২০০৭-এই কালখণ্ড আমাদের প্রদেশে সঙ্ঘকাজের অনেক বিস্তার হয়েছে। আমরা সুদূর আন্দামানেও সঙ্ঘের কাজের বিস্তার করেছি। আমরা সিকিমের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির চা-বাগান অঞ্চলে শাখা শুরু করেছি। ২০০৫ সালে আন্দামান সুনামি হয়। সেসময় সেখানে সঙ্ঘ যে সেবাকাজ করে তা আজও সেখানকার হিন্দু সমাজ নতমস্তকে স্মরণ করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বয়ংসেবকরা বিভিন্ন দ্বীপে যান সেবাকাজ করতে।
২০০৩ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ একটি প্রান্ত ছিল-দক্ষিণে সমুদ্র থেকে উত্তরে সিকিম, উত্তর পূর্বে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র। সেসময় পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক সুদর্শনজী। মাননীয় সরকার্যবাহ মোহনরাও ভাগবত পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘকাজের বিস্তার ও দৃঢ়ীকরণের জন্য দুটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তুতি আমাদের ছিল। উত্তরবঙ্গে কাজের বিস্তারে বংশীলাল সোনী এবং ডাঃ দেবব্রত সিংহের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। গণেশ দেবশর্মা উত্তরবঙ্গের কাজের জন্য সমর্পিত জীবন। তিনবিঘা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেন মনমোহন রায়। বামপন্থীরা তিনবিঘা আন্দোলনকে ভেঙে দেবার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। দক্ষিণবঙ্গে সাড়ে ৮ কোটি জনসংখ্যা। এখানেও কাজের বিস্তার ও দৃঢ়ীকরণের জন্য অনেক চিন্তাভাবনা করে ২০২১ সালে দু-ভাগে বিভক্ত হয়- দক্ষিণবঙ্গ ও মধ্যবঙ্গ। কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুর নিয়ে দক্ষিণবঙ্গ আর হুগলী, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ নিয়ে মধ্যবঙ্গ।
আমাদের প্রদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বড়ো বড়ো কার্যক্রম হয়েছে। বঙ্গপ্রদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অশুভ শক্তি ছিল। দেশবিভাগের সময় তিনটি অশুভ শক্তি ছিল-মুসলিম লিগ (জেহাদি শক্তি) তাকে সমর্থন করল রাষ্ট্রবিরোধী বামশক্তি আর তাকে সমর্থন করে কুচক্রী সেকুলার শক্তি। দেশ বিভাজন হয় জাতির ভিত্তিতে। মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে থাকবে না-এই দাবিতে পাকিস্তান তৈরি হয়। কিন্তু আমরা দেখলাম জনবিনিময় পঞ্জাবে হলো কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হলো না। ১৯৬৭-২০১০ পর্যন্ত ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ হলো পশ্চিমবঙ্গে— কোটি কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে এখন আবার যোগ দিয়েছে রোহিঙ্গা মুসসমরা। তারা এখন আবার হিন্দুদের আক্রমণ করছে। ৩৪ বছরের বাম শাসন হিন্দুশক্তিকে হীনবল করার ষড়যন্ত্র সুচারুরূপে করেছিল। ২০১১-তে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির পরিবর্তন হলো। তখন তারা বড়ো বড়ো আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল, যে ভুল আগের শাসকরা করেছিল, তারাই একই ভুল করল। জেহাদি শক্তিকে এরাও প্রশ্রয় দান করল। এর পরিণামে দেখলাম রামনবমী উৎসবের বিরোধিতা, সরস্বতী পূজায় বিরোধিতা মা দুর্গার পূজায় বিধিনিষেধ, বিসর্জনে বিধিনিষেধ, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির বিরোধিতা। কিন্তু এর ফল হলো উলটো। ‘জয়শ্রীরাম’ ধ্বনিকে সামনে রেখে হিন্দু সমাজ জাগ্রত হয়ে লক্ষ লক্ষ লোক একত্রিত হলো। এটি একটি বড়ো প্রাপ্তি। সামাজিক জাগরণ। ১৯৩৯ থেকে ২০২১-প্রায় ৮১ বছরে যেটি হয়নি সেটিই হলো—হিন্দু শক্তির রাজনৈতিক উত্থান—যা দেখে রাষ্ট্রবিরোধীরা ঘাবড়ে গেল। তারা ঘাবড়ে গিয়ে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের পথ বেছে নিল। এই যে হিন্দুশক্তির উত্থান-যেটা ১৯৪৭ সালে হয়নি, যেটা ১৯৭৫ সালে হয়নি, যেটা ১৯৯০ সালে হতে পারেনি—সেটা ২০১৯ সালে হলো- একটি রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত হলো। চল্লিশ শতাংশ মানুষ একপক্ষে মত পোষণ করল-সংগঠিত হিন্দুশক্তি। এই বিষয়টা রাষ্ট্রবিরোধীদের মনে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করল। ফলে যারা মুখে ‘গণতান্ত্রিক’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ইত্যাদি শব্দ বলে, তারা জেহাদি শক্তির সঙ্গে হাত মেলাল। আমরা দেখলাম, যারা ২০ বছর পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করেছে, যারা ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করেছে, সেই দুটি রাজনৈতিক দল নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে বিপন্ন করে জেহাদিশক্তির সঙ্গে হাত মেলাল। তৃণমূল দলও জেহাদি শক্তিকে কাছে পাওয়ার জন্য প্রকাশ্যে বলা শুরু করল— পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাস করার ব্যবস্থা করা হবে, পশ্চিমবঙ্গে সিএএ-র বিরোধিতা করা হবে, এখানে যারা রামের কথা বলবে তাদের নিয়ে খেলা হবে। এক অদ্ভুত খেলা ২০২১-এর ২ মে’র পর থেকে আমরা দেখছি। বর্তমান সময় সঙ্কটময়। বর্তমানের পথও কণ্টকাকীর্ণ। ডাক্তারজী যে চিন্তা নিয়ে ১৯৩৯ সালে শাখা শুরুর জন্য জন্য শ্রীগুরুজীকে বঙ্গভূমিতে পাঠিয়েছিলেন, যাঁরা নানাসময় আমাদের পথনির্দেশ করেছিলেন, যাঁরা কণ্টকাকীর্ণ পথে কাজ করছেন– তাঁরা অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন।
এই কণ্টকাকীর্ণ পথকে আমরা সুগম করব। বঙ্গভূমি একসময় সারা ভারতকে পথ দেখিয়েছে। আমাদের মহাপুরুষ ঋষি অরবিন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, মাস্টারদা সূর্য সেন তাঁদের বংশধর আমরা। তাঁরা হিন্দুসমাজকে জাগ্রত করার জন্য কাজ করেছেন। ‘ওই দেখ চেয়ে নতুন সূর্য’- এই গান আমরা সঙ্ঘের শাখায় গাই। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি সেই নতুন সূর্যের দিকে। তাই কবি গেয়েছেন— ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নত শির নাহি ভয়।’
আমাদের পূর্বপুরুষ যাঁরা নিজেদের তন-মন-ধন সমর্পণ করে আমাদের রাস্তা দেখিয়েছেন—তা ভগবানের কাছে যাওয়ার জন্য—সেই পথ সবসময় কণ্টকাকীর্ণ। তাঁরা জেলকে ভয় পাননি, তাঁরা পুলিশকে ভয় পাননি, তাঁরা আক্রমণকে ভয় পাননি। আদর্শের জন্য তাঁরা নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে গেছেন। তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে উদাহরণ দাঁড় করিয়ে গেছেন। আসুন, আমরা সবাই মিলে সেই পথকে আরও প্রশস্ত করি।



সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারজীর পুণ্যস্মৃতি

প্রাতঃস্মরণীয় ডাক্তারজীকে দেখার আগে কিংবা তাঁর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কিছু শোনার আগে তাঁর লিখিত পত্রের কথা জানা ও শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ঠিক তারিখ স্মরণ করতে না পারা একটি প্রাক্ সন্ধ্যাকালে আমরা মানিকতলা শাখার স্বয়ংসেবকরা একত্রিত হয়েছি প্রার্থনা করার জন্য। প্রার্থনা আরম্ভ হওয়ার আগে শ্রীবালাসাহেব দেওরসজী আমাদের সামনে এসে বললেন যে, রাজগীর থেকে ডাক্তারজীর চিঠি আজই তিনি পেয়েছেন এবং তার অংশবিশেষ আমাদের পড়ে তিনি শোনাচ্ছেন। কিশোর বয়সের স্মৃতি থেকে মন্থন করা এখন আমার সম্ভব হচ্ছে না যে তাঁর পত্রের অন্যান্য বিষয়বস্তু কী ছিল। কিন্তু স্পষ্টভাবে একথা মনে আছে যে তিনি আমাদের কলকাতা শাখার স্বয়ংসেবকদের তাঁর অন্তরের স্নেহ জানিয়েছেন। সঙ্ঘে আসা পর্যন্ত গণ্ডিবন্ধ জীবনের অপরিসর পরিধিতে এ ধারণা ছিল না যে যাকে জানি না, যাকে চিনি না কিংবা যাকে দেখিনি তাকে উদ্দেশ্য করে অন্তরের শুভকামনা জানানো সম্ভবপর। তাই সেই সন্ধ্যায় ডাক্তারজীর লেখা প্রথম শোনা সেই চিঠি মনের মধ্যে এক অনাস্বাদিত অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল।
ওই বছরের ওই মাসেরই শেষের দিকে ডাক্তারজীকে চাক্ষুষ করার সুযোগ আমরা পেয়ে গেলাম। সেইসময় হিন্দু মহাসভার অধিবেশন কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল। সেই অধিবেশনে যোগ দিতেই ডাক্তারজী কলকাতায় এলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন পরমপূজনীয় শ্রীগুরুজী, ভাউরাও দেওরস প্রমুখ সঙ্ঘের কর্ণধারগণ। যেদিন তিনি কলকাতায় পৌঁছলেন খুব সম্ভবত তারপরের দিন বিকালে মানিকতলা সঙ্ঘস্থানে ডাক্তারজী উপস্থিত হলেন প্রার্থনার কিছুক্ষণ আগে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। প্রার্থনান্তে শাখা শেষ হবার পর অতি অল্পক্ষণের জন্যই তাঁর উপস্থিতি আমাদের সঙ্ঘস্থানে ছিল। কী বলেছিলেন তিনি তখন তা কিছুই মনে নেই। কেবল মনে আছে তাঁর মুখের হৃদয়শান্তিকারী স্নিগ্ধোজ্জ্বল হাসিটুকু, যে হাসি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দূরকে নিকট করা যায়, অজানা হয়ে ওঠে একান্ত আপনার।
তখন কলকাতায় কেবল একটি ছোট্ট শাখা, প্রদেশের অন্য কোথাও সঙ্ঘের শাখা নেই। কলকাতা শাখার স্বয়ংসেবকদের একদিন বৌদ্ধিক রাখা হলো। সঙ্ঘের কার্যালয় তখন ২৫নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে, যে বাড়িতে হিন্দু শিল্প বিদ্যালয়ও অবস্থিত ছিল। সেই বিদ্যালয়েরই দোতালার নাতিপ্রশস্ত একটি ঘরে বিকেলবেলায় আমরা স্বয়ংসেবকরা একত্রিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকে সঙ্ঘবিষয়ে কিছু শুনতে পাব। শুনেছিলাম যেন যে তাঁরই ভাষণ হবে। ধ্বজপ্রণামের পর আমরা সবাই বসলাম। ডাক্তারজী একটি চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি বলতে শুরু করলেন। বলা কিন্তু ভাষণ নয়। তিনি শ্রীগুরুজীকেই নির্দেশ দিলেন আমাদের সামনে কিছু বলার।
শ্রীগুরুজী ঘরের উত্তরদিকে রাখা একটি লম্বা টেবিলের ওপরে বসে তাঁর ইংরেজি বক্তৃতা আরম্ভ করেন। শ্রীগুরুজীর বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য জীবনে সেই প্রথম। সঙ্ঘে আসার কয়েক মাস পরে নাগপুরের অধিকারী শিক্ষণ বর্গে যোগ দেবার সুযোগ খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ভাগ্যে ঘটে গেল। বালাসাহেব দেওরসজী টাঙ্গা থামিয়ে নামলেন এবং তাঁকে প্রণাম করলেন। জানলাম ডাক্তারজীর পরমপূজ্য খুল্লতাত তিনি-আবাজী হেডগেওয়ার। ডাক্তারজীর সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বগঠনে আবাজীর অবদানও ছিল যথেষ্ট। ১৯৪০ সালের সেই শিক্ষা বর্গে এ ধারণাই আমরা মনে মনে পোষণ করে আসছিলাম যে, ৪০ দিনের নিরবচ্ছিন্ন আবহাওয়ায় ডাক্তারজীর সহজ সান্নিধ্য আমরা পাব। আমরা যখন নাগপুরে পৌঁছাই তখন পুণায় ওটিসি চলছিল। ডাক্তারজী তখন সেখানে। ওখান থেকেই তিনি নাগপুরে আসবেন এই আশাই আমরা সবাই করেছি। ১৯৪০ সালের নাগপুরের ওটিসি-তে সঙ্ঘের বর্তমান প্রার্থনার আরম্ভ। বর্গে যোগদানকারী প্রতিটি স্বয়ংসেবকের মুখে মুখে প্রার্থনার ভিন্ন ভিন্ন পঙ্ক্তি উচ্চারিত হতো। নতুন প্রার্থনার সবটুকু কণ্ঠস্থ করার স্বতোৎসারিত ইচ্ছা সবার। এই উচ্চারিত প্রার্থনা অভ্যাসের সঙ্গে চলেছিল আরেকটি গুঞ্জন-ডাক্তারজী কবে আসছেন। স্বয়ংসেবকরা তাদের নিজেদের জানা-অজানা সূত্র থেকে ডাক্তারজীর আগমনের সম্ভাব্য তারিখটুকু প্রচার করতে কসুর করেনি।
আমাদের ভাগ্যে কিন্তু অনেকদিনের জন্য তাঁকে পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা নিয়ে তিনি যখন নাগপুরে এলেন তখন বর্গের মাত্র কয়েকদিন বাকি।
নীল সিটি হাইস্কুলের হলঘরের পাশেই ছিল বঙ্গপ্রদেশের স্বয়ংসেবকদের থাকার জায়গা (হলঘরের অপর এক ধারে বর্গের কার্যালয়)। একদিন সকালে ডাক্তারজী আমাদের হস্টেলে এলেন- বসলেন সেই কার্যালয়ে। আরেকদিন দুপুরে বৌদ্ধিকবর্গে উপস্থিত হলেন। যে চেয়ারে ডাক্তারজী বসবেন তার ওপর দুটি বালিশ দিয়ে বসাটা একটু আরামপ্রদ করতে চাইলেন কয়েকজন স্বয়ংসেবক। ডাক্তারজী বৌদ্ধিক বর্গে উপস্থিত হয়েই কিন্তু সেই বালিশ সরিয়ে ফেলতে বললেন।
সেই বছরের ওটিসি-র সমারোপ উৎসবে রেশিমবাগ সঙ্ঘস্থানে ডাক্তারজী উপস্থিত থাকবেন এরকম আমরা শুনেছিলাম প্রত্যেকটি সম্ভাব্য সূত্র থেকে। সঙ্ঘস্থানে উপস্থিত হয়ে স্বয়ংসেবকেরা অধীর আগ্রহে ডাক্তারজীর আগমন প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু ডাক্তারজী এলেন না। পরে শুনেছিলাম যে ডাক্তারজী আসতে পারেননি চিকিৎসকের অসম্মতির জন্য। আর পরে শুনলাম যে ডাক্তারজীর সঙ্ঘস্থানে উপস্থিত হবার ইচ্ছা ছিল অত্যন্ত প্রবল। তিনি সঙ্ঘস্থানে উপস্থিত হবার জন্য সম্পূর্ণরূপে নিজেকে প্রস্তুতও করছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাঁর চিকিৎসকেরা সম্মত হননি ডাক্তারজীকে বাইরে যেতে দিতে, তাই শ্রীগুরুজী ডাক্তারজীর সমস্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে সঙ্ঘস্থানে উপস্থিত হওয়ার থেকে অতিকষ্টে বিরত করেন।
তারপরের দিন সকালে নীলসিটি হাইস্কুলের বাইরের প্রাঙ্গণে বৌদ্ধিক মণ্ডপে স্বয়ংসেবকেরা একত্রিত হয়েছে সমারোপ ভাষণ ও প্রার্থনার জন্য। কয়েকবারই ডাক্তারজীর আসার কথা থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাদের মধ্যে আসতে পারেননি, তাই স্বস্তিকা।। ৩১ চৈত্র – ১৪৩১ ।। ১৪ এপ্রিল – ২০২৫ সেই সকালেও আমরা দোদুল্যমান ছিলাম ডাক্তারজীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি সম্পর্কে। শেষপর্যন্ত স্বয়ংসেবকেরা উৎফুল্ল হয়ে উঠল ডাক্তারজীকে দেখে। প্রত্যেক প্রদেশ থেকে একজন করে প্রতিনিধি সামান্য কিছু কথায় নিজ নিজ প্রদেশের সঙ্ঘকার্যের আগামীদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করার পর মাদ্রাজ প্রদেশের নব- প্রতিজ্ঞা-প্রাপ্ত একজন স্বয়ংসেবকের স্বল্প ভাষণ হলো। তারপর ডাক্তারজীর ভাষণ যা নাকি ‘অন্তিম ভাষণ’ রূপে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের নিকট একান্ত প্রিয় ও পুনঃ পুনঃ পঠিত। নিজের জীবনের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে যিনি দেশের কথা ভেবেছেন, শরীরের প্রত্যেকটি রক্তবিন্দু যিনি ব্যয়িত করেছেন সমাজের কল্যাণ কামনায়, মন ও প্রাণ দিয়ে যিনি সদাসর্বদা চিন্তা করেছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সংগঠন সম্পর্কে, তিনি যখন আসমুদ্র-হিমাচল অখণ্ড সমাজের এক ক্ষুদ্র অথচ স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখলেন তাঁর সামনে, তখন তাঁর হৃদয়ের প্রশান্ত পরিতৃপ্তিবোধ প্রকাশিত হয়েছিল এই ভাষায় যে আজকে তিনি তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপরেখা দেখছেন।
নাগপুরের চল্লিশদিনের অধিকারী শিক্ষণ বর্গ এইভাবেই শেষ হয়ে এল। তারপরের দিনেই আমাদের কলকাতা প্রত্যাবর্তনের তারিখ। সেইজন্য রাত্রে বঙ্গপ্রান্তের স্বয়ংসেবক আমরা আমাদের প্রদেশের প্রচারক বিঠলরাওজী পার্কির সঙ্গে ডাক্তারজীর বাড়ির দিকে রওনা হলাম। বাড়ির দরজায় আমরা যখন উপস্থিত হয়েছি তখন শ্রীগুরুজী বেরিয়ে আসছেন। তিনি পাকিজীকে বললেন, যে আমরা যেন বেশিক্ষণ সেখানে না থাকি।
ডাক্তারজী যে ঘরে ছিলেন আমরা তার মধ্যে প্রবেশ করলাম। আয়তাকার বিশিষ্ট ঘরটির এক প্রান্তে দেওয়াল জুড়ে একটি চৌকি ছিল। ঘরের স্তিমিত আলোক ঘরটির পক্ষে একান্ত অপর্যাপ্ত ছিল। ডাক্তারজী চৌকিতে শুয়েছিলেন। চৌকির বিপরীত দিকে আমরা সতরঞ্চির ওপর বসলাম। আমরা ঘরে ঢুকতেই তিনি উঠে বসলেন, এতক্ষণ শুয়েছিলেন। উঠে বসতেই তাঁর মুখখানা প্রশান্ত হাসিতে ভরপুর হয়ে উঠল, মাথায় তখন টুপি ছিল না। এই তাঁর সেই হাসি যার প্রথম পরিচয় আমরা পেয়েছিলাম পূর্বকথিত মানিকতলা সঙ্ঘস্থানে। ডাক্তারজী বললেন—ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও পদ্মরাজ জৈন বলেছেন যে বঙ্গপ্রদেশে কাজ বাড়াতে হবে, তা তোমরা কী বল? আমরা আমাদের মতো করে উত্তর দেবার কিছু চেষ্টা করলাম।
আমাদের উত্তর শুনে তিনি সরবে হেসে উঠলেন। এই বোধ হয় তাঁর সরব হাসির প্রকৃতি যার সম্পর্কে নানা ঘটনা সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে তাঁর জীবনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। আমাদের সঙ্গে কিছু কথা তিনি বাংলাভাষাতেও বললেন। আমাদের ভাগ্যে কিন্তু বেশিক্ষণ সুযোগও ছিল না, তাঁকে প্রণাম করে বললাম যে আমরা তারপরের দিনই রওনা হচ্ছি। তিনি আবার হাসিমুখে আমাদের সেই কথা শুনলেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এলাম, তাঁর অপূর্ব হাসির রেশটুকু কিন্তু আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। অতি অল্পদিনের স্বয়ংসেবক জীবনের অভিজ্ঞতায় সঙ্ঘ-পরিচিতি অতি সামান্যই ছিল। কিন্তু কিশোর মনের হৃদয়তন্ত্রীতে এই আঘাত অতি গভীরভাবে বেজেছিল যে, নাগপুরের সব আবহাওয়া যেন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে ডাক্তারজীর দীর্ঘ অসুস্থতার জন্য।
কলকাতায় পৌঁছে তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সংবাদ পাবার জন্য সাগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের সবাইকার মনের প্রার্থনা ভগবানের কাছে যে ডাক্তারজী নিরাময় হয়ে উঠুন, তাঁর হৃত-স্বাস্থ্য তিনি ফিরে পান। নাগপুর থেকে ফেরার কয়েকদিন পরেই সকালে একজন প্রচারক অশ্রুসজল চোখে জানালেন যে, নাগপুর থেকে টেলিগ্রামে জানিয়েছে ডাক্তারজী আর আমাদের মধ্যে নেই। তাঁর চোখের জলের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল ডাক্তারজীর হাসি-ভরা মুখটুকু যা প্রত্যক্ষ করেছি মাত্র কয়েকদিন আগে। জীবন- মরণ-জয়কারী তাঁর অম্লানবদনের অফুরন্ত প্রশান্ত হাসি!



সঙ্ঘের শাখাই স্বয়ংসেবকদের সাধনাস্থল

অমিত কুমার চৌধুরী
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রী বালাসাহেব দেওরস, কোনো তাত্ত্বিকভাবে নয়, অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় সঙ্ঘ কী, তার ব্যাখ্যায় বলেছিলেন- সঙ্ঘ মানে শাখা, শাখা মানে কার্যক্রম। সঙ্ঘকে বুঝতে হলে শাখাকে বুঝতে হবে, তবেই সঙ্ঘকে বোঝা যাবে। শাখা কী? ভারতে সঙ্ঘের শাখার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার। একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে দৈনিক একটি নির্দিষ্ট সময়ে এক ঘণ্টা কিছু স্বয়ংসেবক মিলিত হন। শিশু, বালক, কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ- যেকোনো বয়সের মানুষই শাখায় আসতে পারে। সেখানে তারা এক ঘণ্টা শারীরিক ও বৌদ্ধিক কার্যক্রম করে থাকে। তিনভাগ সময় শারীরিক ও একভাগ সময় বৌদ্ধিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। দেশজ খেলাধুলা, সমতা (প্যারেড), ব্যায়াম, প্রাণায়াম, ধ্যান, দণ্ড (লাঠি) চালনা ইত্যাদি শারীরিক কার্যক্রম স্বয়ংসেবকরা সঙ্ঘস্থানে করে থাকে। একসঙ্গে বসে তারা দেশাত্মবোধক গান গায়, অমৃত বচন, বোধকথা, মহাপুরুষদের প্রেরণাদায়ক জীবন নিয়ে আলোচনা, দেশের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে আলোচনা ইত্যাদি বৌদ্ধিক কার্যক্রম শাখায় হয়ে থাকে। শেষে ত্যাগের প্রতীক গৈরিক ধ্বজের সামনে সকলে সমবেত হয়ে বুকে হাত দিয়ে সংস্কৃত ভাষায় প্রার্থনা করে থাকে। সেই প্রার্থনায় স্বয়ংসেবকরা বলে থাকেন- হে আমাদের পুণ্যভূমি, মাতৃভূমি ভারতমাতা তোমাকে প্রণাম জানাই। এই হিন্দুরাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই প্রার্থনা স্বয়ংসেবকরা শাখায় সমবেত হয়ে প্রতিদিন করে থাকে।
প্রতিদিন সঙ্ঘস্থানে স্বয়ংসেবকরা শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশের প্রতি নিষ্ঠা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, দায়িত্ব, কর্তব্যের বিষয়ে শেখে। স্বামীজী বলেছেন, ‘সারাজীবন পরের জন্য করবি, নিজের জন্য কিছুই চাইবি না। মহাভারতে পিতামহ ভীষ্ম মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অন্তিম উপদেশে পাণ্ডবদের বলেছিলেন যে, দেশ তোমার জন্য কী করেছে তা কখনো জিজ্ঞাসা করবে না, তুমি দেশের জন্য কী করছ তা সর্বদা ভাববে। সঙ্ঘের বর্তমান সরসঙ্গচালক ডাঃ মোহনরাও ভাগবতও একই কথা বলেছেন যে, সঙ্ঘে এলে আপনি কিছু পাবেন না, বরং আপনার কিছু থাকলে সেটাও চলে যাবে। এই উচ্চ আদর্শ নিয়ে স্বয়ংসেবকরা শাখায় আসে। শাখা হচ্ছে দেশপ্রেমের পাঠশালা, যেখানে দেশকে কিছু দিতে হবে আর পাওয়া যাবে স্বদেশপ্রেমের আদর্শ। এই নিঃস্বার্থ ভাবনা সকল দেশবাসীর মনে জাগ্রত হোক এটাই চায় সঙ্ঘ।
‘আমি নই আমরা’- এই ভাবনা তৈরি হয় শাখায়। শাখার কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বয়ংসেবকরা সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, নিখাদ দেশপ্রেমের শিক্ষা পায়। কোনো কাজ প্রতিদিন নিষ্ঠাভরে কেউ করলে, সেটি আর নিছক কোনো সাধারণ কাজ থাকে না, সেটা হয়ে ওঠে সাধনা বা তপস্যা। এই সাধনাই সঙ্ঘ করে চলেছে বিগত একশো বছর ধরে। দৈনিক শাখার মধ্য দিয়ে এই ভাবনাই জাগ্রত হয় যে, ‘আমি’ নই, ‘আমরা’। আমি একা নই, অনেকের মধ্যে আমি। এতে একাকীত্ব দূর হয়, সমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে, সমাজ শক্তিশালী হয়। এইভাবেই ‘এক’ থেকে ‘আমরা’ হওয়ার মাধ্যমে সমাজ সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রাচীন মুনি-ঋষি রচিত বৈদিক সংগঠন মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে সেই একাত্মতার ভাবনা শাখায় গড়ে ওঠে। ‘ওঁ সংগচ্ছধ্বম্ সংবদ্ধবম্ সং বো মনাংসি জানতাম্।’ অর্থাৎ, একসঙ্গে বলো, একসঙ্গে চলো, আমাদের সকলের মন এক হোক। এটাই সঙ্ঘচেতনা, সঙ্ঘোপলব্ধি, ঐক্যবদ্ধতা।
দেশের যেখানে যখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খড়া, বন্যা, ভূমিকম্প, দুর্ঘটনা, মহামারী, যুদ্ধ হলে স্বয়ংসেবকরা সর্বাগ্রে সেখানে পৌঁছে দেশবাসীর পাশে দাঁড়ায়। শাখা এই শিক্ষাই দেয় যে, দেশের মানুষ আমাদের রক্ত, আমাদের ভাই। তাঁদের দুঃখ-বেদনা আমাদেরও দুঃখ বেদনা। শাখার মাধ্যমে সঙ্ঘ স্বয়ংসেবক তৈরি করে, নেতা নয়। শাখায় ব্যক্তির নানে জয়ধ্বনি দেওয়া হয় না, সেখানে হয় ভারতমাতার জয়ধ্বনি। স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে শেখে সকলেই। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে অরুণাচল – সঙ্ঘবোধের মাধ্যমে এক অটুট, ঐক্যবদ্ধ ভারতভূমি, যেখানে নেই কোনো বর্ণভেদ, ভাষাভেদ। সেখানে সকলে ভারত জননীর সন্তান। এই ভাবনাই স্বয়ংসেবকদের মনে জাগ্রত হয়।
স্বয়ংসেবকরা প্রতিদিন শাখায় যায়। কোন শাখায়? সঙ্ঘের শাখায়। শাখার সংজ্ঞা আরও স্পষ্টভাবে দিয়েছেন শ্রী বালাসাহেব দেওরস- “সঙ্ঘের শাখা কেবল খেলাধুলা বা কুচকাওয়াজ করার স্থান নয়, আড়ম্বরহীনভাবেই সজ্জনদের সুরক্ষার অভিব্যক্তি, তরুণ-যুবকদের কু-অভ্যাসাদি থেকে মুক্ত রাখার সংস্কারপীঠ, সমাজের ওপর আগত আকস্মিক বিপত্তি বা সংকটে দ্রুত ও পক্ষপাতহীন সহায়তা দানের আশাকেন্দ্র, মহিলাদের নির্ভয়তা এবং সুসভ্য আচরণপ্রাপ্তির আশ্বাসস্থল, দুষ্ট ও দেশদ্রোহী শক্তির ওপর নিজ প্রভাব স্থাপনকারী শক্তি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ্য কর্মী ও কার্যকর্তা যাতে পাওয়া যায় তার প্রশিক্ষণদানকারী বিদ্যাপীঠ হলো সঙ্ঘশাখা।”
জননী-জন্মভূমি, অর্থাৎ দেশমাতৃকার সঙ্গে তাঁর সন্তানদের যে সম্পর্ক, তা হলো রাষ্ট্রীয়তা। ভারতে সেই রাষ্ট্রচেতনা হলো ‘হিন্দুত্ব’। ‘রাষ্ট্রীয়’ শব্দের অর্থ হলো হিন্দু, সঙ্ঘ শব্দের অর্থ সমগ্র হিন্দুসমাজের সংগঠন। এই হিন্দুসমাজকে সংগঠিত করার দায়িত্ব যারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তারাই স্বয়ংসেবক। সঙ্ঘের শাখা পরিচালিত হয় কার্যকর্তা নির্মাণেক জন্য। সঙ্ঘের শাখা হচ্ছে সমাজ জাগরণ ও রাষ্ট্রনির্মাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস। শাখা থেকে নির্গত এই শক্তির প্রভাব সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়ে। এর ফলে একদিন সমাজ ধীরে ধীরে সঙ্ঘময় হয়ে উঠবে। তখন সমাজ ও সঙ্ঘ আর পৃথক থাকবে না। সঙ্ঘের কার্যকর্তারা শাখার মাধ্যমে সমগ্র হিন্দুসমাজকে সংগঠিত করার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। কাজটি খুব সহজ নয়, বরং ভীষণ কঠিন। সংগঠন করা মানে মানুষকে এক করা, বিভাজন নয়। কিন্তু হিন্দুসমাজ বর্ণ, ভাষা, মত-পথ, রাজনীতি ইত্যাদি নানাভাবে বিভাজিত। সেই সমাজকে এক করা প্রায় অসম্ভব বলে একদা মনে করা হতো। সেই কঠিন কাজটিই হাতে তুলে নেয় সঙ্ঘ। সঙ্ঘ এটাও জানে যে, সমগ্র সমাজ শাখায় সম্মিলিত হবে না। তাই সঙ্ঘকেই সমাজের কাছে যেতে হবে। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। দেশ শাসন থেকে দেশসেবা- সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে আজ স্বয়ংসেবকদের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সঙ্ঘ শাখার মাধ্যমে ব্যক্তিনির্মাণের কাজে রত। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা সমাজের সব কাজে যুক্ত।
সঙ্ঘের কাজ হলো ব্যক্তিনির্মাণ। সঙ্ঘকাজ কয়েক বছরের জন্য নয়, এটি একটি ধারাবাহিক, নিরবচ্ছিন্ন কাজ যা গত একশো বছর ধরে হয়ে চলেছে। হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবিকতার পতন হিন্দুসমাজকে যেভাবে পিছিয়ে দিয়েছে, রাতারাতি কোনো যাদুমন্ত্রের দ্বারা তার সমাধান সম্ভব নয়। কথায় আছে- ‘Short cut, cut you short’। স্বামী বিবেকানন্দ পরাধীন ভারতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বছর সব দেবদেবীকে তাকে তুলে রেখে দাও, একমাত্র ভারতমাতা হোন তোমাদের আরাধ্যা দেবী।’ স্বাধীনতার পর দেশের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় স্বামীজীর কথার প্রাসঙ্গিকতা আজও রয়েছে। সঙ্ঘের শাখায় গৈরিক ধ্বজকে সামনে রেখে স্বয়ংসেবকরা ‘ভারতমাতা কী জয়’ বলার মধ্য দিয়ে এই শিক্ষা লাভ করে যে, আমরা সকলে হিন্দু, আমাদের মধ্যে নেই কোনো ভেদ, আমরা সকলে ভারতমায়ের সন্তান; জাতি-বর্ণ-ভাষার ক্ষুদ্র পরিচয় সরিয়ে রেখে আমরা সকলেই হিন্দু। ভারতমাতা হচ্ছেন পরমারাধ্যা, সমগ্র হিন্দুসমাজ তাঁরই আরাধনারত, গৈরিক ধ্বজ হলো ত্যাগের প্রতীক। সংক্ষেপে এটিই হলো সঙ্ঘের আদর্শ। এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে রাষ্ট্রনির্মাণ হলো মূল কাজ যা সঙ্ঘ শাখার মাধ্যমে নিরন্তরভাবে করে চলেছে বিগত একশো বছর ধরে।



একটি চিন্তাধারার পূর্ণতা

বলবীর পুঞ্জ
যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাগপুরস্থিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কার্যালয় রেশিমবাগে গিয়ে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এবং দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন, সেসময় ইতিহাসের একটি চক্র সম্পূর্ণ হয়। একশো বছর আগে যে চিন্তাধারার বীজ ডাক্তারজী রোপণ করেছিলেন, তা আজ সহস্র শাখা-প্রশাখার বিরাট স্বরূপ নিয়ে দেশ-বিদেশের জনমানসকে প্রভাবিত করে চলেছে। প্রসঙ্গটি এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৯২৫-এ স্থাপনা থেকে আজ পর্যন্ত সঙ্ঘকে অনবরত উপেক্ষা, তিরস্কার ও বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। আজ শাসনতন্ত্রের শীর্ষপুরুষ কেবলমাত্র সঙ্ঘের প্রতি নিজের নিষ্ঠা প্রকট করেছেন তা নয়, বরং রাষ্ট্র নির্মাণে সঙ্ঘের অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
১৯২৫ সালে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয় বিজয়াদশমীর দিন নাগপুরে, অপরদিকে সিপিআই সেই বছরই ক্রিসমাসের সপ্তাহে কানপুরে স্থাপিত হয়। কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপিত হলেও এর সূত্রপাত হয় ১৯২০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত দেশে। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার আগে ডাক্তারজী বিদর্ভ কংগ্রেসের সহ-সম্পাদক ছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার কারণে তাঁকে ১৯২১-২২ সালে কারাবরণ করতে হয়েছিল। সেসময় বামপন্থী শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একজন যিনি স্বাধীন ভারতে নির্বাচিত হয়ে বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন সেই ইএমএস নম্বুদ্রীপাদও কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
কমিউনিস্টদের চিন্তাধারা মূলত কার্ল মার্কস ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের সঙ্গে স্বৈরাচারী লেনিন, স্তালিন ও মাও সে তুং-এর দ্বারা প্রেরণাপ্রাপ্ত। এর কারণেই যে আজকেও তারা ভারতের প্রতিটি সমস্যাকে বিদেশি দৃষ্টিকোণে দেখে এবং তার সমাধানের চেষ্টা করে হয়। ১৮৫৩ সালের ২৫ জুন ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’-এ মার্কস লেখেন, ‘আমাদের এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, এই ছোটো গোষ্ঠীগুলি জাতিগত ভেদাভেদ এবং দাসত্বের মতো কুরীতিতে ডুবে ছিল। তা মানুষকে পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে ওঠার পরিবর্তে তাকে বাহ্যিক পরিস্থিতির অধীন করে দেয়… এর বড়ো উদাহরণ হলো প্রকৃতির অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষ হনুমান (বানর) ও শবলার (গোরু) কাছে শ্রদ্ধায় নতমস্তক হওয়া শুরু করে দেয়।’ মজার বিষয় হলো যে, মার্কস ভারতের মূল সনাতন সংস্কৃতির বিষয়ে এই অপপ্রচার করেন, যদিও কখনোই তিনি ভারতে আসেননি। এই চিন্তাধারাকে মার্কসের তল্পিবাহকরা স্বাধীন ভারতে এখনো বয়ে নিয়ে চলেছে।
ভারতীয় চিন্তাধারা একেবারেই আলাদা। সনাতন সংস্কৃতি হলো মানুষ প্রকৃতি ও ব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি নয়, বরং তার অংশ। ভারতের আধ্যাত্মিক ধারণাকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ‘ভারতমাতা’ রূপে দেখে; অপরদিকে কমিউনিস্টদের কাছে ভারত এমন ভূখণ্ড, যার ভাষা, সম্প্রদায়, এলাকাভিত্তিক বিভাজন করা যেতে পারে। যেখানে সঙ্ঘের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে গান্ধীজী এবং অন্যেরা দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বিভাজনের বিরোধিতা করেছেন, সেখানে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ ও মুসলিম লিগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাকিস্তান তৈরির কাজ সম্পূর্ণ করেছে। স্বাভাবিকভাবে সঙ্ঘকে ইংরেজ সরকারের শাসক ভালো চোখে দেখত না। ১৯৩০ ও ১৯৩২ সালে ইংরেজ অধীনস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা বিদেয় হওয়ার পর এই মানসিকতা স্বাভাবিকভাবে বদলানোর কথা ছিল। কিন্তু তেমনটা হলো না, কেননা স্বাধীন ভারতের প্রশাসনিক ক্ষমতা সেই ভারতীয়দের হাতে চলে যায়, যারা চিন্তাধারায় ঔপনিবেশিক এবং সনাতন সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে গান্ধীজীর হত্যার পর মার্কসবাদ ও ঔপনিবেশিক মানসিকতায় প্রভাবিত জওহরলাল নেহরু সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে সঙ্ঘের নিঃস্বার্থ ও সমর্পিত রাষ্ট্রসেবা দেখার পর প্রধানমন্ত্রী নেহরু তার ভুল বুঝতে পারেন এবং ১৯৬৩ সালের সাধারণতন্ত্র দিবসের প্যারেডে সঙ্ঘকে আমন্ত্রণ জানান। এর পর ইন্দিরা গান্ধী রাজনৈতিক কারণে জরুরি অবস্থা জারি করে সঙ্ঘের উপর (১৯৭৫-৭৭) নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই মানসিকতার পুনরাবৃত্তি বাবরি ধাঁচা ধূলিসাৎ হওয়ার পর ১৯৯২-৯৩ সালেও দেখা যায়।
কংগ্রেস ইউপিএ-র সময়কালে (২০০৪-১৪) বিকৃত তথ্যের ভিত্তিতে সঙ্ঘ-বিজেপিকে অভিযুক্ত করার জন্য মিথ্যা ‘গৈরিক সন্ত্রাস’-এর অপপ্রচার শুরু করে কংগ্রেস।
প্রত্যেকটা সংগঠনের জন্ম সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হয়ে থাকে। সঙ্ঘ এর ব্যতিক্রম। সঙ্ঘ কোনো প্রতিক্রিয়াজাত নয়। সময়ের আহ্বানে সঙ্ঘের সৃষ্টি। সঙ্ঘের কার্যপদ্ধতি ও উদ্দেশ্যকে তাৎকালিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে না। ভারতের সঙ্গে বিশ্বের বাকি অংশের প্রতি সঙ্ঘের ব্যাপক দৃষ্টিকোণ সনাতন বৈদিক সিদ্ধান্ত- ‘একং সদ্‌ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’, ‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ’ ইত্যাদি শাশ্বত মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই চিন্তাভাবনা মাথায় রেখে সঙ্ঘ বিগত ১০০ বছরে একতা, সামঞ্জস্য এবং রাষ্ট্রের পুনরুত্থানের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
সঙ্ঘ স্বয়ং রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। কিন্তু এর দ্বারা প্রদত্ত চরিত্র নির্মাণের প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত কার্যকর্তারা কেন্দ্র সরকার এবং বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার পরিচালনা করছেন। এই অভিনব সম্পর্ককে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও চাণক্যের সহযোগের প্রকাশ মনে করা যেতে পারে। এই আলোকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রশংসা করে সঙ্ঘের সম্পর্কে বলেন, ‘অমর সংস্কৃতির মহান বটবৃক্ষ হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়সেবক সঙ্ঘ’। গত মাসে এক আমেরিকান পডকাস্টারের কাছে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী মোদী ঠিকই বলেছেন, ‘সঙ্ঘকে বুঝতে পারা এত সহজ নয়।’ বাস্তবে, সঙ্ঘ কোনো সংগঠন নয়, বরং একটি চিন্তাধারা, একটা চেতনা এবং সতত প্রবহমান রাষ্ট্রভাবনায় ভরপুর এক আন্দোলন, যার ধ্যেয় পন্থ-সম্প্রদায়-জাতির সংকীর্ণ সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে সম্পূর্ণ সমাজকে সংগঠিত করা, তাকে আত্মনির্ভর, স্বাভিমানী ও রাষ্ট্রানুকূল করে তোলা। সঙ্ঘের কার্যপদ্ধতির ভিত্তি অবশ্যই আধ্যাত্মিক। কিন্তু এতে নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী বা যে কোনো উপাসনাপদ্ধতি অনুসরণকারী যুক্ত হতে পারেন।
সঙ্ঘের বাস্তবিকতা এবং স্বরূপের মধ্যে পার্থক্য করা হয় কেন? কেননা শুরু থেকেই সঙ্ঘ নীরবে থেকেই কাজ করছে এবং প্রচার থেকে বরাবর দূরত্ব বজায় রেখেছে। এই কারণেই সঙ্ঘ বিরোধীরা প্রায়ই তাদের অপপ্রচারে সফল হয়। শতাব্দীবর্ষে সঙ্ঘ এই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করবে আশা কার যায়।



সংকটের সেই দিনগুলি

বংশীলাল সোনী
১৯৪৮ সালে গান্ধী হত্যার অপরাধে সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। এরপর এখানে ক্ষেত্র প্রচারক হিসাবে এলেন একনাথজী (একনাথ রাণাডে)। তিনি পঞ্জাব থেকে তিনজন প্রচারক এনেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম রাম সিংহ ঠাকুর ও বাবুরাও পালধিকর। একনাথজী পুণে থেকে এনেছিলেন সাতজন প্রচারককে। তার মধ্যে কেশবজী (কেশবরাও দীক্ষিত) একজন। আরও সাতজনকে আনলেন তিনি নাগপুর থেকে। কয়েকজন বাঙালি প্রচারক যেমন অমলদা (অমল কুমার বসু), জিতেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিভাস ব্যানার্জিকে এনেছিলেন।
আমি প্রচারক হয়েছি ১৯৫০ সালের ৭ জুলাই। ১৯৫২ সালে আমাদের প্রচারকদের যে বৈঠক হয় তাতে পশ্চিমবঙ্গে ৩৯ জন প্রচারক ছিলেন। প্রথমে কাজ বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে শ্লথ হয়ে এল। ১৯৫৪ সালে এখানে সঙ্ঘের কাজ প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গেল।
গুরুদক্ষিণা কমতে শুরু করেছে, গান্ধী হত্যার অভিযোগের ফলে অনেক অভিভাবক নিজের ছেলেদের ক্রমে ক্রমে গুটিয়ে নিচ্ছেন। নতুন ছেলেদের আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বেশ মনে আছে যে ১৯৫৬ সালে সারা পশ্চিমবঙ্গে আমরা মাত্র ১২ জন প্রচারক কাজ করেছি। কলকাতায় ৬ জন। আর বাকি জেলায় ৬ জন। সমগ্র উত্তরবঙ্গে আমি একা ছিলাম। নদীয়া-মুর্শিদাবাদে ছিলেন অহীন্দ্র কুমার দে। ভুবনেশ্বর দাস যিনি কোচবিহারে ছিলেন তাঁকে এনে মেদিনীপুর ও বাঁকুড়াতে দেওয়া হয়েছিল। সে বছর কলকাতার গুরুদক্ষিণা হয়েছিল ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। তারপর দার্জিলিং জেলার হয়েছিল ৬৩০ টাকা। মাননীয় অমলদা সমস্ত প্রচারকদের সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘বংশী সেকেন্ড’। তখন এমন অবস্থা যে দু’বছর ধরে প্রচারকদের বৈঠক হয়নি। কারণ কে ভাড়া দেবে। কে আসা যাওয়ার খরচ দেবে? অমলদা তখন ছিলেন প্রান্ত প্রচারক। তখন কলকাতার কার্যালয় ২৬ নং বিধান সরণিতে, কোনো রান্নাবান্না হতো না। অমলদা সমস্ত প্রচারকদের ডেকে বললেন, ভাইয়েরা, এই অবস্থায় আমি আর চালাতে পারছি না। তোমরা নিজেরা কোনো কাজকর্ম করে যদি চলতে পারো তো প্রচারক থাকো, না হলে যে যার বাড়িতে চলে যাও।
আমার মনে আছে মণিমোহন কর্মকার তখন জলপাইগুড়িতে ঘড়ি মেরামতের কাজ করে সঙ্ঘের শাখা চালাতেন। আমার দাদা অনন্তদা প্রচারক ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় বাঙুর ব্রাদার্সে চাকরি করতেন নিবাসে থেকে। সেখান থেকে যে টাকা আনতেন তাতে কয়েক জন প্রচারকের খাওয়ার খরচ চলত। তখন এইরকম অবস্থা চলছিল।
১৯৫৮ সালে পূজনীয় শ্রীগুরুজী এসেছিলেন মালদায়। লোকেদের এখন বিশ্বাসই হবে না যে তাঁর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল মাত্র ২২ জন তরুণ আর ২৩ জন বালক। নাগরিকদের মধ্যে ৬ জন ভদ্রলোক আর মায়েদের মধ্যে ৪ জন। কিন্তু তাতেও শ্রীগুরুজীর প্রায় সওয়া ঘণ্টা ভাষণ হয়েছিল। সেই সময় শিলিগুড়িতে ও কোচবিহারে তিনি গিয়েছেন। ওই মালদাতে ১৯৬৮ সালে পূজনীয় গুরুজী যখন এসেছিলেন তখন স্বয়ংসেবকদের ১,৬০০ সংখ্যা ছিল। স্টেডিয়ামে কার্যক্রম হয়। ৪ হাজার নাগরিক উপস্থিত ছিলেন। অথচ ১৯৫৮ সালে ছিল ওইরকম দীনহীন অবস্থা। একজন সাধারণ কার্যকর্তার বাড়ির বাইরের ঘরে শ্রীগুরুজীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।
অনেক অসুবিধার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু প্রচারকদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল যথেষ্ট। ওই যে বললাম গুরুদক্ষিণা উঠেছিল ৬৩০ টাকা। তা ওই টাকায় এক বছর চালাই কী করে! তখন শিলিগুড়ি কার্যালয়ের ভাড়া ছিল ৩৬০ টাকা। তা এক বছরের ভাড়া আগে দিয়ে দিলাম। কী জানি! মাঝখানে যদি ভাড়া না দিতে পারি তো কার্যালয় হয়তো ছেড়ে দিতে হবে। বাকি রইল ২৭০ টাকা। সেই সময় জলপাইগুড়ির যিনি প্রচারক ছিলেন তিনি এসে ধরনা দিয়ে বসে গেলেন। তাঁর কার্যালয়ের ভাড়া ছিল ১০ টাকা। তাও ৬ মাস ভাড়া দিতে পারেননি। বাড়ির মালিক চরম হুমকি দিয়েছিলেন এই বলে যে কালকের মধ্যেই যদি ভাড়া মিটিয়ে না দেওয়া হয় তো জিনিসপত্র তুলে ফেলে দেওয়া হবে। সুতরাং ওই প্রচারক নিয়ে গেলেন ৬০ টাকা। কী আর করব! পঞ্জাবি হোটেলে গিয়ে খেলাম। তখন সাড়ে বারো আনা লাগত সেখানে খেতে। কী করি কী না করি ভেবে পাই না। সাইকেল কেনার পয়সা পর্যন্ত নেই। পুরনো সাইকেল যদিও একটা পাওয়া গেল, ১৩৫ টাকা দাম। হাতে তো মাত্র ২১০ টাকা সম্বল। কিনব কী দিয়ে। দু’মাইল হেঁটে যেতাম, শিলিগুড়ি জংশনের ওপারে গিয়ে যেখানে কুলিরা খায় সেখানে খেতে শুরু করলাম। ৪টে রুটি ৪ আনা, আর ১ আনার তরকারি-৫ আনার খেয়ে ফের হেঁটে হেঁটে আসতাম।
এই রকম একটা বিষম পরিস্থিতিতেও কিন্তু বিশ্বাস, শ্রদ্ধা অটুট ছিল। আর মাননীয় একনাথজীর যে প্রেরণা ছিল তার ফলেও কার্যত ১৯৫৮ সালের পর থেকে সঙ্ঘের কাজ আবার বাড়তে শুরু করল। সেইসব দিনগুলোর স্মৃতিকথা যখন মনে পড়ে তখন একটা অদ্ভুত আনন্দের অনুভব হয়, শিহরণ জাগে। আমার মনে আছে মালদা কার্যালয়ের ভাড়া ছিল ২০ টাকা। বছরে ২৪০ টাকা। তখন আর কী করব, সাবলেট করলাম। একটা অংশকে ১২ টাকায় ভাড়া দিলাম। ওখানকার গুরুদক্ষিণা ছিল ২২০ টাকা, তা ৮ টাকা মাসে মানে বছরে ভাড়া লাগল ৯৬ টাকা। এই অবস্থার মধ্যে এক সময় কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, তখন বিশেষ করে ১৯৫৬ সালের পর থেকে সঙ্ঘের মধ্যে যে সমস্ত স্বয়ংসেবকরা এসেছেন তাঁদের মধ্যে কোনোরকম হীনম্মন্যতা বা আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল না।
আজ যখন এসব কথা বলছি, তখন সেদিনের স্মৃতি বার বার মনে উদয় হচ্ছে। তখন কিন্তু এসব কথা কখনো মনেও আসত না। আমার ভাইয়েরা যখন জানতে পারল আমি একবছর প্রায় একবেলা খেয়ে দিন কাটিয়েছি তখন তারা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছে, এতদিন এসব কথা বলোনি কেন? এই বাড়ির ছেলে হয়ে তুমি এত কষ্ট সহ্য করেছ, ইত্যাদি। আমি হেসে বললাম, তাহলে তোমরা বলতে বেচারা সঙ্ঘ খেতে দিতে পারে না, সেখানে তুমি সঙ্ঘের প্রচারক হয়েছ! অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি একদিন পশ্চিমবঙ্গে এই পরিস্থিতির মধ্যেও সঙ্ঘের দিন কেটেছে। সেই তুলনায় এখন তো ভগবানের কৃপায় অনেক ভালো অবস্থা।

READ ALSO

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

October 8, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
ShareTweetShare

Related Posts

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

October 8, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025

POPULAR NEWS

4th September 2023 Rajjopat

4th September 2023 Rajjopat

September 21, 2023
৩৫০ বছর পর দেশে ফিরছে শিবাজীর বাঘনখ

৩৫০ বছর পর দেশে ফিরছে শিবাজীর বাঘনখ

October 2, 2023
কেশব ভবনে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী হানা

কেশব ভবনে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী হানা

October 4, 2023
4th September Angana

4th September Angana

September 21, 2023
2nd October 2023 Parampara

2nd October 2023 Parampara

October 1, 2023

EDITOR'S PICK

5th May পরম্পরা

5th May পরম্পরা

May 8, 2025
9th June প্রচ্ছদ নিবন্ধ

9th June প্রচ্ছদ নিবন্ধ

June 12, 2025
25th September 2023 Uttar Sampadakiya

25th September 2023 Uttar Sampadakiya

September 27, 2023
04th August প্রচ্ছদ নিবন্ধ

04th August প্রচ্ছদ নিবন্ধ

August 7, 2025

About

Follow us

Categories

  • Uncategorized
  • অতিথি কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • পরম্পরা
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • রাজ্যপাট
  • সঙ্ঘবার্তা
  • সম্পাদকীয়
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি

Recent Posts

  • 29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • 29th September পরম্পরা
  • 29th September পরম্পরা
  • 29th September পরম্পরা

© 2023 Swastika. All rights reserved.

No Result
View All Result
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • ই -পত্রিকা

© 2023 Swastika. All rights reserved.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In

Add New Playlist

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?