সাধনার শতবর্ষে
ভারতের নূতন রূপ দেখিয়া চমকিত হইবারই কথা। ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণে জর্জরিত হইয়া ভারত পুনর্বার মাথা তুলিয়া দণ্ডায়মান হইতে পারে? এতদ্বিষয়ে প্রমুখ নেতৃবর্গ বারংবার ইহা অসম্ভব বলিয়া তাহাদিগের মত ব্যক্ত করিয়াছেন। তথাপি সকল সন্দেহের অবসান ঘটাইয়া সমস্ত প্রকারের অসম্ভব সম্ভবপর হইয়াছে। পরাধীনতার নিদর্শন ধুলিসাৎ হইয়া স্বাভিমানের বিজয় প্রতীক নির্মিত হইয়া চলিয়াছে। একদা ম্লান হইয়া পড়া প্রাচীন পরম্পরাসকল স্বমহিমায় তথা পূর্ণমর্যাদায় পালিত হইতে শুরু হইয়াছে। জনমানসে ধারণা নির্মিত হইয়াছে যে, সমাজ জাগ্রত হইতেছে। মুখ্যত হিন্দুসমাজের শক্তি জাগ্রত হইয়া মৃগেন্দ্র গর্জনে দিগ্বিদিক মুখরিত করিতেছে। পরস্পরের মধ্যেকার ক্ষুদ্র সংকীর্ণ পরিচয় ভুলিয়া হিন্দু নামে জাগ্রত হইতেছে। কিন্তু এই জাগরণের আধার কী? এই জাগরণের আধার হইল সাধনা। একক সাধনা নহে, সম্মিলিত সাধনা, রাষ্ট্রসাধনা। শতবর্ষ পূর্বে সাধনার শুভারম্ভ ঘটিয়াছে। এক রাষ্ট্রঋষি রাষ্ট্রভক্তির বীজমন্ত্র লইয়া কতিপয় বালক-কিশোরকে সঙ্গে লইয়া সেই সাধনায় রত হইয়াছিলেন। আত্মপ্রচারের অন্তরালে থাকিয়া সমাজের অভ্যন্তরে সমাজকে সঙ্গে লইয়া সেই সাধকগণ বীরব্রত ধারণ করিয়া অদ্ভুত সাধনায় মগ্ন হইয়াছেন। এক নিষ্কাম তপস্বীর ন্যায় সহযোগী সাধকগণও নিরন্তর সাধনা করিয়া
চলিতেছেন। এই সাধনা আত্মসিদ্ধির জন্য নহে, রাষ্ট্রকল্যাণের নিমিত্ত। রাষ্ট্রকে পরম বৈভবসম্পন্ন করিবার দৃঢ় সংকল্প হৃদয়ে ধারণ করিয়া কণ্টকাকীর্ণ পথে নিরন্তর অগ্রসর হইবার সাধনা। শতবর্ষের দীর্ঘ সাধনার যাত্রাপথে বারংবার বাধা উপস্থিত হইয়াছে। প্রতিবারই সাধকগণ নিজ অভীষ্টে অবিচল থাকিয়া সমস্ত বাধা দূরীভূত করিয়াছেন, বরং তাহার ফলস্বরূপ সাধনায় নব নব শক্তি সঞ্চারিত হইয়াছে। সাধকগণ ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তের প্রত্যন্ত স্থানে তাহার বিস্তৃতি ঘটাইয়াছেন। তাহার ফলে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভক্তির বিস্তার ঘটিয়াছে। জনমানসে চেতনা জাগ্রত হইয়াছে এবং সেই প্রক্রিয়া নিরন্তর চলিতেছে। ভারতের ক্ষয়িষ্ণু চিন্তা দূরীভূত হইয়া সমাজের স্বাভিমান জাগ্রত হইতেছে। প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা দৃঢ়তর হইতেছে। ভারতের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতির বিশ্বজনীন বিস্তার ঘটিতেছে। নবীন প্রজন্ম রাষ্ট্রীয় কার্যে সোৎসাহে নিযুক্ত হইতেছে। এই সমস্ত কিছুই সেই সাধনার ফল।
এই রাষ্ট্র সাধনার নাম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ১৯২৫ সালে ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার তাহার সূচনা করিয়াছেন। অবজ্ঞা, নিন্দা, বিরোধিতার কাল সমাপ্ত হইয়া সমাজের প্রশংসা তথা সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করিয়াছে সঙ্ঘ। সূচনাকালে কতিপয় ব্যক্তি রাষ্ট্র সাধনার এই মহতী প্রচেষ্টাকে অবজ্ঞাভরে কৌতুক করিয়াছে, নিন্দা করিয়াছে। এতসত্ত্বেও স্বয়ংসেবকগণ ভিন্ন প্রদেশে যাইয়া সেইখানকার ভাষা, রীতিকে আয়ত্ত করিয়া অতিকষ্টে দিনাতিপাত করিয়া, কিঞ্চিন্মাত্র খাদ্যে জীবন ধারণ করিয়া নিরন্তর কার্যবিস্তার ঘটাইয়াছেন। নীরবে নিভৃতে রাষ্ট্রের পুনর্নির্মাণের সাধনায় মগ্ন থাকিয়াছেন। বিরোধিতার পর্ব পরাধীন ভারত অপেক্ষা স্বাধীন ভারতে অধিক ঘটিয়াছে। সঙ্ঘকে সম্পূর্ণরূপে নিষ্পেষিত করিবার অভিপ্রায়ে তৎকালীন বৈরী শাসনতন্ত্র তিন-তিনবার নিষেধাজ্ঞা আরোপিত করিয়াছে। তথাপি সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া বহুগুণে বহু ধারায় কার্যের বিস্তার ঘটিয়াছে। সঙ্ঘ কেবলমাত্র রাষ্ট্র সাধনার সাধকরূপ ব্যক্তি নির্মাণ কার্য সম্পাদন করিয়াছে। তাঁহারা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক আদর্শের প্রতি অবিচল থাকিয়া স্ব-স্ব ক্ষেত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রোত্থানের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন। শতবর্ষের কালখণ্ডে সঙ্ঘ সমাজের সহিত সম্পৃক্ত হইয়া গিয়াছে। শতবর্ষে উপনীত হইয়া শতবর্ষ উদ্যাপন লক্ষ্য নহে, লক্ষ্য হইল সমাজে প্রচলিত সমস্ত ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটাইয়া সদর্থক বিমর্শ নির্মাণ। পঞ্চ পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তি তথা সমাজের মানস পরিবর্তন। সম্পূর্ণ সমাজকে সাধনক্ষেত্রে পরিণত করা। সঙ্ঘ সাধনার শতবর্ষ হইয়াছে, তথাপি সাধনা নিরন্তর চলিতে থাকিবে, কারণ এই সাধনা নিত্য সাধনা, অখণ্ড সাধনা।