আমের অমৃত কথন
মণীন্দ্রনাথ সাহা
গরম মানেই আমের রাজত্ব। আমকে ফলের রাজা বলা হয়। শুধু স্বাদের দিক থেকেই ফলের রাজা নয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন- এর বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্যগুণও আছে। সে হিসেবে আমের স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলো একঝলক দেখে নেওয়া যাক। আম ক্যানসার প্রতিরোধী। ত্বককে ভিতর থেকে পরিষ্কার করে। কোলেস্টোরেলের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। চোখকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেয়। পরিপাক ক্রিয়ায় প্রভূত সাহায্য করে। বডিস্ক্র্যাব হিসেবেও ভালো। অ্যালকালাইজ করে সম্পূর্ণ শরীর, হিটস্ট্রোকের প্রকোপ থেকে শরীরকে বাঁচায় এবং রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তাই পুষ্টিবিদরা বলেন, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ভিটামিন খান। অর্থাৎ আম খান, আম। পাকা আম খান। পোড়া আমের সরবত খান। কাঁচামিঠা আম খান।
আমাদের দেশে বিভিন্ন রকমের ফলের সমারোহ দেখা যায়। শুধু ফলই-বা বলি কেন। ফল, সবজি, মায় নলেন গুড় পর্যন্ত। ফল, সবজি, মিষ্টির চরিত্র বহুদিন হলো হারিয়েছে মরসুমের প্রতীক্ষায়। এখন সারা বছরই পাওয়া যায় কমলালেবু কিংবা ফুলকপি অথবা নলেন গুড়। ব্যতিক্রম শুধু আম বাঙ্গালির প্রিয় ফলের জন্য আজও দিন গুনতে হয় ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে। ‘এপ্রিল’ যাব যাব করে আর ‘মে’ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে টোকা দিয়ে জানান দেয় ফলের রাজার আসার সময় হয়ে গেছে। এই আমকে কে, কবে, কোথা থেকে, কী প্রকারে আবিষ্কার করেছে বা এনেছে তার সঠিক ব্যাখ্যা মনে হয় কেউ দিতে পারবে না। তবে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমে আমরা দেখতে পাই বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে ধুমধাম করে আমের বিবাহের কথা এবং তাতে অগাধ প্রশস্তি শ্লোকের দেখা মেলে। ভাগবত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের লীলা প্রসঙ্গে বারবার উঠে এসেছে চূতবৃক্ষের উল্লেখ। রামায়ণে দেখি সীতা হনুমানকে বলছেন- ‘সীতা বলিলেন বাছা হইল স্মরণ। অমৃতের ফল কিছু করহ ভক্ষণ।। হাত পাতি লয় বীর পরম কৌতুকে। অমনি ফেলিয়া দিল আপনার মুখে।। অমৃত সমান সেই অমৃতের ফল। ফল খাইয়া হনুমান হইল বিকল।।’ এরপর হনুমান রাবণের বাগানে গিয়ে ‘সাধারণ’ ফলটি অজস্র খায় এবং কিছু ফল এপারে নিয়ে আসে। কে বলতে পারে হয়তো তার জন্যই তামিল শব্দ ‘ম্যাঙ্কো’-র অপভ্রংশ ইংরেজি ম্যাঙ্গো কিনা।
মহাভারতের বনপর্বে দেখা যায় পঞ্চপাণ্ডব কাম্যকবন ত্যাগ করে অন্য একটি বনে এসে যখন উপস্থিত হলেন তখন সেই তপোবনে একটি আমগাছে মাত্র একটি আম দেখে দ্রৌপদী অর্জুনকে সেই অসময়ের আম পেড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন- ‘অসময়ে আম্র এক তরু ডালে দেখি। অর্জুনে কহিলা কৃষ্ণা পরম কৌতুকী।। আশ্চর্য দেখহ দেব, এ বড় বিস্ময়। এই আম্র পাড়ি দেহ, কৃপা যদি হয়।। এত শুনি ধনঞ্জয় জুড়ি দিব্য শর। দিলেন পাড়িয়া আম্র কৃষ্ণার গোচর।।’ অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের পূর্বেই ভারতে আমের অস্তিত্ব ছিল।
প্রবাদের মতো আজও চালু আছে যে কথা, তা হলো- দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র আর ফলের মধ্যে বহুরূপী আম। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আম নিয়ে লিখে গেছেন- ‘বল, বর্ণ, রক্ত, মাংস, শুক্র বৃদ্ধি করে/কিছু শ্লেষ্মাকর, কিন্তু বায়ুপিত্ত হরে/কচি আমের ঝোল খেলে দেহ ঠাণ্ডা হয়/সিদ্ধ আম, স্নিগ্ধ গুণে মেদ করে ক্ষয়/কেশীচূর্ণ উপকারী বমি অতিসারে/ বোঁটার আঠার তেলে চুলকনা সারে/পাতার রসেতে নাশে রক্ত আমাশয়/ছাল বেটে লেপে দিলে ব্যথা ভালো হয়।’
ফা-হিয়েনের লেখায় রয়েছে, গৌতম বুদ্ধকে গোটা একটা আমের বাগান উপহার দিয়েছিলেন ‘আম্রপালিকা’ নাম্নী এক গণিকা। বুদ্ধ সেই বাগানে এসে মাঝে মধ্যেই হতেন ধ্যানমগ্ন। সে না হয় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের ঘটনা। আম কাহিনি তারও আগে থেকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। তা জানা যায় একটি পুরাণকথা থেকে। ‘সূর্যের মেয়ের উপর এক মায়াবী ডাকিনীর ভয়ংকর রাগ। কারণে অকারণে তাকে বিব্রত করত সর্বক্ষণ। এই ডাকিনীর হাত থেকে বাঁচতে সূর্যকন্যা চলে এলেন মর্ত্যে। একটি পদ্মের রূপে প্রস্ফুটিত হলেন পৃথিবীর সম্রাটের সরোবরে। রাজা সেই পদ্ম দেখেই পড়লেন প্রেমে। রোজ দিবারাত্র পদ্মের কাছে আসা যাওয়া তার হয়ে উঠল নিত্যকর্ম।
এতে ওই ডাকিনী আরও ক্ষিপ্ত। সে এসে মায়াজালে এক রাতে ভস্ম করে দিল পদ্মকে। রইল শুধু ছাই। পদ্ম নেই দেখে দুঃখে রাজা সরোবর বুজিয়ে দিলেন। সেখানে জন্ম নিল একটি আমের গাছ। একদিন গাছপাকা আম পড়ল মাটিতে। সেই মাটিতেই মিশে আছে ছাইয়ের আকারে সূর্যকন্যা। আমের স্পর্শে কন্যা ফিরে পেল প্রাণ। রাজা আনন্দে আত্মহারা। সূর্যকন্যা হলেন পৃথিবীর রানি।’
আমের চাষ আমাদের দেশের প্রত্যেক প্রান্তে কম-বেশি দেখা যায়। ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে সবচাইতে বেশি আম চাষ হয় উত্তর প্রদেশে। মোট এলাকার ২৬.১৫ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গে চাষ হয় ৯.২ শতাংশ। ভারতবর্ষে মোট ১২,৮৭,৯৭২ হেক্টরেরও বেশি জমিতে আম চাষের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১,৪০,০০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে মালদা জেলায় ৬৫,০০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হচ্ছে। আম চাষের পরিমাণের দিক দিয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান চতুর্থ।
বঙ্গললনাদের যেমন নামের শেষ নেই- ‘রসলা, কমলা, বিমলা, সরলা, এনাক্ষি, মিনাক্ষী, নীতা, সীতা, নমিতা, সুমিতা, মধুমিতা, পারমিতা’ ইত্যাদি। তেমনি আমের নামেরও বোধ করি শেষ নেই- ‘হিমসাগর, ল্যাংড়া, বোম্বাই, জাহাঙ্গীর, হাপুন, আলফানসো, ব্ল্যাক আলফানসো, চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি, সৌন্দর্য, ভাদু, তলবি, তোতাপুরি, কালাপাহাড়, দিলসাদ, লস্করসেকন, লজ্জতবক্স, তাইমুরিয়া, সোরিপেয়ারফুলি, মানিকজী রুস্তমজী, স্বর্ণজাহাঙ্গীর, হেমাউদ্দিন, নীলউদ্দিন, আউরোমানিয়া, মোলায়েমজাত, কোহিনুর, রইসপসন্দ, ইয়োলো মুন্ধুরাদো, বাগানপল্লী, কালুয়া, রত্না, বিশ্বনাথ, বৃন্দাবনি, আশ্বিনী’ ও আরও অনেক।
আমের জন্মবৃত্তান্ত ও চরিত্র জানতে আনন্দে মন ভরে ওঠে। যেমন- বোম্বাই: নামেই বোম্বাই আম। মহারাষ্ট্রের রাজধানীর বা গোটা মহারাষ্ট্রের সঙ্গেই এই আমের কোনো সম্পর্ক নেই। গোপালভোগ আর কালুয়া নামের দুই সম্প্রদায়ের মিলনের ফল এই বোম্বাই আম। খেতে সুস্বাদু। ২৪ পরগনায়
এর রমরমা বেশি।
সিন্ধু : সিন্ধু নদ নয়, আম। আম অথচ আঁটি নেই, ভাবা যায়? দেশ বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে এই আম। যেমন সুস্বাদু তেমনি মন মাতানো গন্ধ। বিখ্যাত আলফানসো আর রত্না আমের সংকরায়ন হলো এই সিন্ধু আম। বীজবিহীন আঙ্গুর ফলনের পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে আঁটিবিহীন সিন্ধু তৈরি করেছে মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন বিদ্যাপীঠের আঞ্চলিক ফল গবেষণা কেন্দ্র। আঁটিবিহীন বা সিডলেস বললেও এতে আঁটি আছে তবে ওজন মাত্র সাত গ্রাম। সিন্ধুতে এ তো বিন্দুই বটে!
নীলম : মহারাষ্ট্রে এক ধরনের আম হয়, নাম নীলম। আশ্চর্য আম এই নীলম। যেমন মিষ্টি তেমনি স্বাদ। তবে মিষ্টি ও স্বাদ এ দুটোই তার বৈশিষ্ট্য নয়। এর বৈশিষ্ট্য হলো- ‘এই আম কাটা মাত্রই এর ভেতর থেকে বেরিয়ে যায় মৌমাছি। হ্যাঁ, মাত্র একটিই। বেশ রসালো ও মিষ্টি এই আমে মধুমক্ষিকা ঢোকে কী করে- তা আজও রহস্য।’
দশেরি : শশার মতো দেখতে উত্তর ভারতের মুখ্য আম দশেরি। ওজন ১৫০-২০০ গ্রাম। গন্ধ ভালো, আঁশহীন, রং হলদে, ছাল পাতলা, পাকা ফল অনেকদিন পর্যন্ত থাকে।
সৌন্দর্য : মধ্যপ্রদেশবাসী আমের স্বাদে এতই মুগ্ধ যে তাদের একটি আমের নাম সৌন্দর্য। রিওয়া জেলায় উৎপন্ন এই আমের বৈশিষ্ট্য হলো এর আঁটি এতই নরম যে অসতর্কতায় সেটিও অনায়াসে পেটে চলে যেতে পারে।
কিষাণভোগ : সন্দেশ নয়, আম। যার রমরমা রাজস্থানে। স্বাদে ও সুগন্ধে মন উতলা করে তোলে।
আলফানসো : আম নিয়ে ব্যবসা করে যে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যাবে সেটা প্রথম মুম্বইয়ে চালু করেন এক পর্তুগিজ বণিক। তার নাম আলফানসো। তারই নামে মহারাষ্ট্রের এই আমটি ভারতের মধ্যে সব থেকে স্টার স্ট্যাটাস প্রাপ্ত। এই আমই এখন সব থেকে বেশি যায় বিদেশে। কলকাতাতেও পাওয়া যায় ১২টার একটা প্যাকেট। দাম ৩০০ টাকার ওপর। বোম্বাইয়ে এই ফলটিকে সংরক্ষিত করে বিরাট শিল্প গড়ে উঠেছে। আমটা ডিম্বাকৃতি, নাকবিহীন, ফলত্বক পাতলা, আঁশবিহীন, খুব সুস্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত। আমের সঙ্গে মিশে আছে নবাবি আমলের ইতিহাস। নবাব ফেরাদুনজার মা রাইসুন্নেসা বেগমের নামে বেগম পসন্দ, ফেরাদুনজার পিতা ফেরদিউম সাহেবের নামে ফেরদিউম পসন্দ। নবাব মুবারকদৌল্লার পৌত্র নবাব সফদার জংবাহাদুরের নামে সফদার পসন্দ নামকরণ হয়। নাটোরের রানি ভবানীর বিশেষ পছন্দের আমটির নামকরণ করা হয় ‘ভরানীচৌরস’। তোতাপাখির ঠোঁটের মতো গোড়ার দিকটি দেখতে বলে ‘তোতা’ আমের নামকরণ করা হয়। ওই আমটি নবাব ওয়াসিম আলি মির্জা তাঁর বাগান থেকে নবাব রইস মির্জাকে উপহার দেন। রইল মির্জা এর নামকরণ করেন ‘চম্পা।
মির্জাপসন্দ আমটির উৎপত্তি মির্জা খোকার বাগানে। কথিত আছে, নবাব নাজিমের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ মির্জাসাহেব ছেড়ে দেন এই আমের একটি চারার বিনিময়ে। বর্তমানে অবশ্য এসব আমের অধিকাংশই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
হুগলিতে পাওয়া যায় সোরি, পেয়ারফুলি, গোলাপখাস। মুর্শিদাবাদে তো এতো আমের বৈচিত্র্য আছে যে, কয়েক কিলোমিটার দূরের বাজারে আমের বিভিন্নতা দেখা যায়। মুর্শিদাবাদের রইসবাগকে আমের ল্যাবরেটরি বলা যায়। নবাবি আমলে রইসবাগ, হুমায়ুনমঞ্জিল, মির্জাখোকার বাগান, গুলাববাগ, ফৈয়াজবাগ, লবাববাগ, মোতিঝিলবাগ, দারোগা আঞ্জুমানবাগ, রাজওয়ালাবাগ, গোলাপবাগ, মোবারক মঞ্জিল, হাকিম আগামহম্মদের বাগান ইত্যাদি আমবাগানগুলিতে কার্যত কায়েম হয়েছিল আম সাম্রাজ্য। এমন বাগান ছিল যেখানে একসঙ্গে প্রায় ১৫০ জাতের আম মিলত। এই বাগানগুলির মধ্যেই বাগানবাড়ি থাকত। আমের মরসুমে সেখানে মজলিশ বসত। নাচ, গান, মুশায়ারায় মুখর হয়ে উঠত বাগান। সেখানে কাশিমবাজারের রাজা, নসিপুরের রাজারাও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। অতিথি আপ্যায়নের জন্য আম ছাড়া আম পোলাও নামে বিশেষ ‘ডিস’ তৈরি করা হতো।
উত্তরবঙ্গে বেশি পাওয়া যায় লক্ষ্মণভোগ, ফজলি, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ভাদু আর আশ্বিনী। তবে ইদানীং আম্রপালী ও মল্লিকারও বাজার তৈরি হয়েছে। হিমসাগরের দাপাদাপি সবচেয়ে বেশি উত্তর ২৪ পরগনা, নদীয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। নবাব, বাদশা, খলিফা, রাজা, রানি, অভিজাত পরিবার ছাড়া আম কালচার অর্থহীন। আর সেজন্যেই তো কহিতুর, কালাপাহাড়, আলফানসোর মতো স্পর্শকাতর আমগুলিকে টুসিতে তুলো দিয়ে পাড়া হতো। এগুলিকে রাখাও হতো তুলোর বিছানায় শুইয়ে। আজ যদি আমটিকে এপিঠে রাখা হয় তবে পরেরদিন অপর পিঠে শুইয়ে দিতে হবে। আম খাবার মতো তৈরি হয়েছে কিনা তা বোঝা যেত বিভিন্ন আমের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে। লস্কর সেকন, লজ্জত বক্স, চম্পা এসব আমের ক্ষেত্রে তাদের খোসার কালো ছিট ছিট দাগ দেখে বোঝা যায় সেগুলি খাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। নাজিম পসন্দ আমকে ঝুড়িতে করে কুয়োর জলে চুবিয়ে ঠাণ্ডা গরম পদ্ধতিতে খাওয়ার উপযুক্ত করে তৈরি করা হতো।
নবাবি আমগুলিকে কাটার জন্যও বিশেষ এক ধরনের সরু ছুরি ব্যবহার করা হতো। আঁটিতে ছুরি লাগলে নাকি আমের স্বাদের পরিবর্তন ঘটে যেত। খোসা ছাড়ানোর পর আস্ত আমটাই পরিবেশন করা হতো। তবে ফজলি, দিলসাদ আমকে লম্বাভাবে ফালাফালা করে কাটা হতো। রানি, বোম্বাই, হিমসাগর, সফদারপসন্দ, নাজিমপসন্দ প্রভৃতি আম খাওয়ার প্রায় তিন ঘণ্টা আগে বোঁটার দিকে কেটে জলে ভিজিয়ে রাখার রীতি প্রচলিত ছিল। একের পর এক আম খাওয়ার সময় স্বাদের তফাত বোঝার জন্য ‘আনানাস’ আম খাওয়ার রীতি ছিল। এর স্বাদ আনারসের মতো। অনেকেই বলেন, আনানসের সঙ্গে সংকর প্রথায় এর সৃষ্টি।
নবাবি আম আলোচনায় যে আমের উল্লেখ না করলে আম আলোচনা অর্থহীন হয়ে পড়বে তাকে বলা যেতে পারে আমের মহারাজা কহিতুর। মুর্শিদাবাদের এই আম নবাবদের কাছ থেকেও সমীহ আদায় করে নিয়েছে। বাদশাহি মেজাজের প্রতিফলন এই আমের চরিত্রে। নবাব ওয়ালাকাদার সৈয়দ হোসেন আলি মির্জার তৃতীয় পুত্র নবাব আলি মির্জা এই আমের প্রবর্তন করেন। কালাপাহাড় প্রজাতির আমের সঙ্গে বিশেষ সংকরায়নের মাধ্যমে তৈরি এই আম। এই আম তুলোর টুসিতে করে পেড়ে প্রতিটি আমকে রাখতে হবে তুলোর বাক্সে। আজ যে পিঠে রাখা হবে কাল তাকে ঘুরিয়ে অন্য পিঠে রাখতে হবে। নচেৎ দাগ ধরে যাবে। লোহার ছুরি বা বঁটির প্রশ্নই নেই। হয় রুপোর ছুরি দিয়ে কাটতে হবে নয়তো বাঁশের ছাল তীক্ষ্ণ করে সেটা দিয়ে কাটতে হবে।
জেনে রাখবেন, আমটি কেটে রেখে অন্য কাজে গেলে চলবে না। এ কিন্তু নিঃসঙ্গতা মোটেই পছন্দ করে না। খোসা ছাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে না খেলে অভিমানী এই আম কয়েক মিনিটে স্রেফ বরফের মতো গলে জল হয়ে যাবে। একই রকম সেনসিটিভ রামদাসপুরের তলবী আম। এই আমও টুকরো করে রেখে দিলে একটু পরেই গলে জল হয়ে যায়। গাছপাকা আম খেতে সুস্বাদু নয়। তাই ডাঁশা থাকতে আম গাছ থেকে পেড়ে, ফেলতে হবে। তারপর চোখে চোখে রেখে তাকে পাকালে স্বর্গস্বাদ পাওয়া যায়।
একটা আমগাছ কত বড়ো হতে পারে এবং বছরে কতমণ ফল দিতে পারে? জানা গেছে যে, পঞ্জাবের চণ্ডীগড়ের পুলাইল গ্রামে ২৭০০ বর্গগজ দখল করে দাঁড়িয়ে আছে অতিকায় এক আমগাছ। এটি বছরে ৪৫০ মণ ফল দেয়।
রাজা ঠিক রাজার মতোই থাকে। আমও তাই আছে আজও। সব ফল, সব সবজি হাইব্রিড অথবা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে সারা বছরই ফলন হয়। কিন্তু আমের একগুয়োমিকে বাগে আনতে পারেনি কৃষি বিজ্ঞানীরা। বিচ্ছিন্নভাবে অন্য মরসুমে কিছু আমের ফলন হলেও আমজনতার রসনার সমর্থন না পাওয়ায় সেসব আদৌ ধোপে টেকে না। আজও সে এক এবং অদ্বিতীয়। যেহেতু তার অপর নাম অমৃত।