ইজরায়েল: বাঙ্গালি হিন্দুর অতীত ও ভবিষ্যৎ পাঠ
অরিন্দম ভট্টাচার্য্য
প্রায় ১৯০০ বছর ধরে যে জাতিটার নিজস্ব কোনো দেশ ছিল না, ১৯৪৮ সালে তারা পেয়েছিল একখণ্ড ভূমি। আজ সেই দেশের মাত্র দেড় কোটি মানুষ বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা পরিষেবাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁদের মেধা, প্রযুক্তি, হার-না-মানা মনোবৃত্তি এবং প্রবল স্বাজাত্যবোধের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের জীবনকে তাঁরা প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে। সেই জাতিটি ইহুদি এবং দেশটির নাম হলো- ইজরায়েল। ইহুদিদের হাত ধরেই বর্তমানে তৈরি হচ্ছে মহাকাশযান থেকে শুরু করে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। তাঁদের যোগদানেই অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করছে বিভিন্ন দেশ। তাঁরা তৈরি করেছে ক্ষত্রিয়তার নতুন সংজ্ঞা।
ভারতীয় সমাজে বৈদিক মতে বর্ণাশ্রম হলো গুণ ও কর্মাশ্রিত। তার ছায়া যেন দেখা যায় ইহুদি জাতির মধ্যে। তাঁদের একদল নিজেদের উপাসনা
পদ্ধতি, নিজেদের জাতির ইতিহাস জেনে, পড়াশোনা ও মেধার দ্বারা সুরক্ষিত করছে তাঁদের ভবিষ্যৎ। তাঁদের বিজ্ঞানীরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে তৈরি করছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, এর ফলে বহু মানুষের কর্মসংস্থান ও উপার্জনের পথ হচ্ছে উন্মুক্ত। তাঁরা আক্রান্ত হলে তাঁদের সেনা ও প্রযুক্তির বলে বলীয়ান ক্ষত্রিয় সমাজ প্রত্যাঘাতের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ১৫০০ বছরের আদিম-বর্বর ব্যবস্থার অনুসারী জেহাদিদের। তাঁদের বৈশ্য সমাজ বিনিয়োগ করছে দেশে-বিদেশে। নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্যাংকিং, আন্তর্জাতিক ব্যবসাবাণিজ্যে। বিশ্বের ৮০ শতাংশ ব্লু-চিপ কোম্পানির মালিক তাঁরা। বড়ো মাপের ন্যানোটেকনোলজি, অ্যাগ্রোটেক, ফার্মা, অস্ত্রশস্ত্র (আর্মস্), সিমুলেশন, এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা), খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, রাসায়নিক শিল্প, চামড়া, পোশাক, প্রসাধনী শিল্পের মালিক ইহুদিরা। প্রায় ৭২ শতাংশ প্রযুক্তির পেটেন্ট ইহুদিদের হাতে রয়েছে। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ও কর্মরত ইহুদিরা অর্থপ্রেরণ করে থাকে ইজরায়েলে। কোটি কোটি ডলার, পাউন্ড, ইউরো, দিনার দিয়ে তাঁরা সমৃদ্ধ করছে ইজরায়েলের অর্থভাণ্ডার। তাঁদের দেশের কৃষক, শ্রমিক, জনগণের কাছে তাঁদের দেশ এক পবিত্র ভূমি, একখণ্ড ‘প্রমিসড্ ল্যান্ড’। এরা পুঁজি, অর্থ, ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পের মর্ম বোঝে। জন্মের পর থেকে তাঁরা জানে যে, জেহাদিরা তাঁদের শত্রু। জেহাদি শক্তির পিছনে কমিউনিস্ট এবং উওক কালচারপন্থীদের মদত সম্পর্কেও তাঁরা অবহিত। কয়েক দশক আগে অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ৮টি ইসলামি দেশের বিরুদ্ধে ৮টি ফ্রন্টে তাঁদের যুদ্ধ লড়তে হয়েছে। সেই শত্রুদের তারা হারিয়েছে বার বার। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইওরোপে তাঁদের প্রভাব সর্বজনবিদিত। বিভিন্ন উন্নত দেশের শিল্প, তথ্য-প্রযুক্তি, অর্থনীতি ইহুদিদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এটাই তাঁদের অ্যাডভান্টেজ। ভাতা, ভাঁওতা, ভিক্ষার জাতি হিসেবে তারা তৈরি হয়নি কোনোদিন।
পৃথিবীতে অনেক উন্নত দেশ রয়েছে। বেলজিয়াম, সুইডেন, নরওয়ে, কানাডা, ব্রুনেই, সৌদি আরব, কাতার, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি ছোটো ছোটো অনেক দেশ নানা ক্ষেত্রে বর্তমানে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গিয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, চীন- এই দেশগুলি বিশ্বের বড়ো অর্থনীতি। অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে ধনী বা সম্পদশালী হলেই জাত্যাভিমান বা জাতিসত্তাবোধ তৈরি হয় না। জাতিসত্তাবোধ একটি দেশকে প্রদান করে জাতীয় সুরক্ষা। বিভিন্ন দেশে যাওয়া, থাকা, ঘুরে দেখার সুবাদে দেশগুলি সম্পর্কে জানার কিছুটা সৌভাগ্য হয়েছে এই প্রতিবেদকের। সেই অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি তুলে ধরার জন্যই এই লেখার অবতারণা।
সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন দেশ। ব্যবসা বাণিজ্যেও উন্নত। এই দেশগুলির মানুষ সৎ, দেশগুলিতে দুর্নীতি কম। কিন্তু দেশগুলি প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভর নয়, পরনির্ভর। আমেরিকা, ইওরোপের রয়েছে হাজার হাজার বহুজাতিক কোম্পানি। দেশগুলিতে রয়েছে প্রচুর নৌবন্দর ও বিমানবন্দর। লক্ষ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির এই দেশগুলিতে জনজীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ। কিন্তু চীন হাইপারসনিক মিসাইল বা উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমা
পরীক্ষা করলে পশ্চিমি শক্তি কেমন যেন একচু স্তিমিত হয়ে যায়। দেশগুলি হলো ক্ষাত্রবীর্যবর্জিত। আমেরিকার মোসাহেব ও তল্পিবাহক হয়ে দেশগুলির কী লাভ? এগুলি প্রকৃতপক্ষে কোনো বলিষ্ঠ দেশ বা জাতি নয়। এই অবস্থা বর্তমানে দেখা যায় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রেও। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স-সমন্বিত ন্যাটোর সাহায্য না পেলে রাশিয়ার আঘাতে ইওরোপের অনেক দেশই ধ্বংস হতে পারে। এগুলি উন্নত জাতি হলেও ক্লীবতায় জর্জরিত।
১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর বহু দশক ধরে ভারতও ছিল অনুন্নত, পরনির্ভর একটি দেশ। ১৯৯১-এর পর আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি রূপায়িত হতে থাকলে ধীরে ধীরে ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়। বিগত ৫০০০ বছরের ইতিহাসে ভারত ছিল একটি সুপ্রাচীন সভ্যতা। ভারত ছিল উন্নত, পরম বৈভবশালী একটি দেশ। বিশ্বের জিডিপি-র সিংহভাগ অবদান ছিল ভারতের। বর্তমান বিশ্বের বিরাট অঞ্চল অধিকার করে রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন। তাদের নিজস্ব অর্থনীতি, পণ্য উৎপাদন, ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানি, সেনাবাহিনী, অস্ত্রব্যবসা, অন্য দেশগুলিকে পণ্য সরবরাহ এবং তার সঙ্গে সেই দেশগুলিকে সুরক্ষা প্রদানের গ্যারান্টি হলো বিগত ৭৫-৮০ বছরের বিশ্বের চলমান ইতিবৃত্ত। এদের পদতলে হাজির থাকে বাকি পৃথিবী, বেঁচে থাকার জন্য। অহিংসা ও অবনতি দুর্বলতা ও ক্লীবতার পরিচায়ক। উন্নত দেশগুলিই তাই বিশ্ব শাসনের যোগ্য। উৎপাদনে স্বনির্ভর দেশগুলির অর্থনীতিও স্বাভাবিক নিয়মেই রপ্তানি-নির্ভর। তাদের দেশে চলে একমাত্র তাদের নিজস্ব আইন। বিশ্বজুড়ে অস্ত্র উৎপাদন এদের নিয়ন্ত্রণে। দেশের উপর সংকটের মেঘ ঘনিয়ে উঠলে, বা দেশের উপর
এতটুকু আঘাত এলে তারা প্রতি-আক্রমণে পিছপা হয় না। প্রত্যাঘাতের মাধ্যমে শত্রুকে গুঁড়িয়ে দিয়ে থাকে।
প্রতিবেশী নামধারী ১২-১৪টি অসভ্য-বর্বর-জেহাদি নেকড়ে দেশ পরিবেষ্টিত হয়ে বেঁচে থাকতে হলে ইজরায়েলকে সিংহ হতেই হবে। আজকের ইজরায়েল যেন সত্যিই সেই ‘সিংহ’। ইজরায়েল ভ্রমণের সময় এমন কিছু বিষয় এই প্রতিবেদকের চোখে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালির কাছে যা ইউটোপিয়া মনে হবে।
দেশটিতে কোনো ধর্মঘট হয় না। রাস্তা দখল করে মিটিং-মিছিল, বিক্ষোভ, বনধ, ‘ভেঙে দাও-গুঁড়িয়ে দাও’-এর রাজনীতি হয় না। ইজরায়েলে থাকাকালীন এই প্রতিবেদক আরবীয় বিনিয়োগে চলা একটি রেল কোম্পানিতে একটিমাত্র শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। চাকরি, কর্মসংস্থান বা রোটি-কাপড়া- মকানের জন্য এই দেশে মিটিং-মিছিল হয় না। নির্বাচনের সময়, সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সভা-সমাবেশ হয়। দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধ তীব্র। কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁরা দৃঢ়ভাবে তাঁদের সরকারের পাশে থাকেন। হামাস, হেজবোল্লা, হুথিদের মতো জেহাদি শক্তির বিরুদ্ধে যেকোনো লড়াই লড়তে তাই পিছপা হয় না ইজরায়েল।
ইজরায়েলে রয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ মুসলমান। তাদের অনেকেই পেশায় ব্যবসায়ী। সরকারের থেকে সবরকম সুযোগসুবিধা তারা পেয়ে থাকে। সরকারি নীতি ‘জেহাদি খতম’ জানা সত্ত্বেও সেদেশে তারা নিশ্চিন্তে রয়েছে। সরকার তাদের সুরক্ষা প্রদান করে থাকে। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও ইজরায়েল ছেড়ে তারা জর্ডন, সৌদি আরব বা বাহরিন যাবে না। তাদের অনেকেই আবার ইজরায়েল অন্ত প্রাণ। এরকম একজন ইজরায়েলি মুসলমানের বাড়িতে দু’মাস ভাড়া ছিল এই প্রতিবেদক। তবে তাদের মধ্যেও ১-২ শতাংশ রয়েছে ইয়াসিন মালিক, বুরহান ওয়ানির মতো। তবে তেলআভিভ, হেব্রন, হাইফাতে স্থানীয় কোনো মুসলমানের বাড়ি নিরাপত্তাবাহিনী ঘিরে ফেলেছে এমন দৃশ্য কিন্তু দেখা যায় না।
১৯৪৮-এ জন্মলগ্ন থেকেই ইসলামিক জেহাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে ইজরায়েল। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের নিকেশ করাটাই ইজরায়েলের নীতি। ২০২৩-এর ৭ অক্টোবরের ভয়াবহ ইহুদি গণহত্যার পর গাজা, ওয়েস্ট ব্যাংক, জেরুজালেমের আরাফাতি জেহাদি, হামাস জঙ্গিদের ছাড়বে না ইজরায়েল সরকার। তাঁদের পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া কী বললো, অন্যান্য দেশ কী প্রতিক্রিয়া দিল তাতে তোয়াক্কা করে না ইজরায়েল। কোথায় সেকু-মাকু-পাকুরা কী আন্দোলন করল তাতে কিছুই এসে যায় না ইজরায়েলের। মেধা, শ্রম, ক্ষত্রিয়তা, আত্মনির্ভরতার আদর্শ গ্রহণ করে তাঁরা আজ পরাক্রমী হয়ে উঠেছে। লাপিড, শ্যারন, বেঞ্জামিন, বেন গুরিনের মতো সেনাপতি তৈরি করেছে ইজরায়েল। আগামীদিনেও তাঁদের মধ্যে থেকে আরও সেনাধ্যক্ষ উঠে আসবেন।
ইহুদি জাতির সঙ্গে বাঙ্গালি হিন্দু জাতির অবস্থা একমাত্র তুলনীয়। ১৯৪৬ সালে বাঙ্গালি সাক্ষী থাকে কলকাতা ও নোয়াখালী হিন্দু নরসংহারের। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয় ভারত। পাকিস্তানের অন্তর্গত হয় বঙ্গভূমির বৃহদংশ। হিন্দু বাঙ্গালির রক্তে রঞ্জিত হয় পূর্ববঙ্গের বিরাট অংশ। অথচ ঊনবিংশ শতক এবং বিংশ শতকের প্রথম পর্যায়ে মেধা, আধ্যাত্মিকতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞান সাধনায় সমগ্র বিশ্বে বাঙ্গালি ছিল অনন্য। সেই সময় না ছিল মার্ক্সবাদ বা মোল্লাবাদের তীব্র প্রভাব, না ছিল বাঙ্গালি জাতি দুটো ভাত-ভিক্ষার মুখাপেক্ষী। বেদ-উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারতের পাশাপাশি নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল হিন্দু বাঙ্গালির। আত্মত্যাগে পিছপা হতো না এই জাতি। বাঙ্গালি জানত যে তাঁরা জন্ম হতেই মাতৃভূমির জন্য বলিপ্রদত্ত। বাঙ্গালি হিন্দুকে সম্ভ্রম ও ভয় করতে বাধ্য হয়েছে অত্যাচারী, লুণ্ঠনকারী ব্রিটিশ শাসক। বহু বছরের দীর্ঘ ইসলামি শাসন এবং তারপর ব্রিটিশ শাসনে শাসকের অত্যাচার, লুঠ, ধর্ষণ, ধর্মান্তরণ, গোলামির গ্লানির কথা বাঙ্গালি বিপ্লবী ও মনীষীরা জানতেন, স্মরণে রাখতেন জহরব্রত, বারো ভূঁইয়া, মহারাজ
প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়, চিলা রায়দের লড়াইয়ের ইতিহাস। মন্দির, আখড়ার গুপ্ত স্থানে বিপ্লবীরা পাঠ করতেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য। শরীরচর্চার পাশাপাশি পালন করতেন বীরাষ্টমী ব্রত। তাঁদের উদ্বুদ্ধ করত গীতার কর্মযোগ ও স্বামীজীর বাণী। ১৯৫০ থেকে ২০২৫- আরব, রাশিয়া, চীন থেকে আসা দুই বিজাতীয় ‘ম’ (মোল্লাবাদ-মার্ক্সবাদ)-এর মতাবাদের দাপাদাপিতে পূর্ববঙ্গ থেকে উচ্ছেদ হয়ে, সব হারিয়ে উদ্বাস্তু, পথের ভিখারি হয়েছে বাঙ্গালি। তার শেষ হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গও হয়ে উঠেছে নরক।